কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৬

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৬
সাবিকুন নাহার নিপা

সুহাস সত্যিই ঘর টা দীপাকে ছেড়ে দিয়েছে। পড়ার জন্য টেবিল চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দীপা সবকিছু গুছিয়ে নিলো। কাবার্ডের একটা অংশ দীপাকে খালি করে দিয়ে বলল,
“এখানে নিজের জামাকাপড় গুছিয়ে রাখো। ”
দীপা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কোথায় থাকবেন?”

“গেস্ট রুম টা তো খালিই আছে। আপাতত আমি ওখানেই থাকব। বাট সেটা শুধু তোমার পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্তই।”
“আপনি এই রুমে থাকুন। আমি গেস্ট রুমে সব গুছিয়ে নিচ্ছি।”
“থাক দরকার নেই। এখানেই থাকো। পার্মানেন্টলি তো আর রুম টা তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি না। পরীক্ষা অবধিই তো।”
দীপা ভেবেছিল চুপ থাকবে বরাবরের মতো। কিন্তু মুখ ফসকে বলে ফেলল,
“হিসাব অনুযায়ী এই ঘর টা তো আমারও তাই না। না মানে আপনিই তো বললেন যে যতদিন আপনার নামের সঙ্গে আমার নাম টা জুড়ে আছে ততদিন….

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সুহাস খুব অবাক হলো। পর পর দুটো ঘটনা ও’কে খুব অবাক করে দিয়েছে। অথচ এই মেয়েটা ঠিক জায়গায় ঠিক কথাটা বলতে পারে না। তখন বিড়ালের মতো মিউ মিউ করে।
সুহাস আর কথা বাড়ালো না। রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দীপা ঠিক বুঝতে পারলো না যে সুহাস রেগে গেছে কী না! অবশ্য সুহাস কে ও মাঝেমধ্যে একদম ই বুঝতে পারে না। বোধহয় ওর বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুটা কমে গেছে।

বৃহস্পতিবার রাতে শাওনের বাবা আসেন। শুক্রবার দিন টা থেকে শনিবার বিকেলে চলে যান। তিনি আপাতত গ্রামের বাড়িতে আছে। পুকুর কেটে মাছ চাষ করছে। বাড়ির আশেপাশে নানান রকম ফলের গাছ লাগিয়েছেন। সেই সঙ্গে বাজারে ফার্মেসী আছে।

শাওনের বাবা সোবাহান মল্লিক মানুষ হিসেবে খুব একটা সুবিধার না। প্রায় সবাই ই তাকে কমবেশী অপছন্দ করেন। আত্মীয় মহলে তাকে অপছন্দ করার কারণ হলো তার অহংকারী আর অন্যকে ছোট করার জন্য । স্বামী হিসেবেও বোধহয় সুরমা বেগমের কাছে পাশ মার্ক পাবেন না। সুহাস বাবাকে পছন্দ করে না মোটেও। অবশ্য এর জন্য সুহাস দায়ী না, বাবা নিজেই দায়ী। শাওনের জন্মের পর সুহাস প্রথম টের পেল যে বাবা ও’কে তেমন একটা পছন্দ করেন না।

আস্তে আস্তে সেটা বাড়তে লাগলো। বাড়িতে চকলেট, লজেন্স, চিপস সব আসতো শাওনের একার জন্য। মা সেখান থেকে লুকিয়ে সুহাস কে দিতেন। সুহাস ভারী মন খারাপ করে বাবার অপছন্দের কারন খুঁজে বের করার চেষ্টা করতো। কিন্তু পারতো না। দিনে দিনে সেটা বাড়তে লাগলো। আর সুহাস বাবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতো। ওর সব আবদার, সুখ, দু:খ জমিয়ে রাখার জায়গা ছিলো মা। বাবার অবহেলা, নিষ্ঠুর আচরণ সবকিছু পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন মা।

মা ওর জন্য অনেক করেছেন। এতোকিছু করেছেন যে প্রাপ্তির খাতায় সবগুলো পেজ ভরে গেছে। তবুও একটা ব্যাপারে সুহাসের ভীষণ আক্ষেপ। কেন দীপার সঙ্গে বিয়ের সময় মা কঠিন হলেন না! কেন সুহাসের পক্ষে থাকলেন না!
সবারই নিজ নিজ যুক্তি থাকে। সুহাসও মায়ের কাছে তার যুক্তি জানতে চেয়েছিলেন। এমন কী অসহায়তা আছে সেটা জানার জন্য মরিয়াও হয়েছিল। কিন্তু পারে নি। সেই আক্ষেপ ও এখনো ভুলতে পারে নি।

সোবাহান সাহেব বসার ঘরে চা খাচ্ছেন। আজ শুক্রবার। সুহাস এই দিনে তেমন বাসায় থাকে না। আজ আছে, বসার ঘরে পত্রিকা নিতে এসে দেখলেন বাবা পড়ছেন। কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে গেল। কিবরিয়া সাহেব আড়চোখে দেখলেন। তিনিও কিছু বললেন না। প্রয়োজন ছাড়া বাপ, ছেলের এখন আর কথাও হয় না। অবশ্য সুহাসের এখন আর প্রয়োজনও নেই।
শাওন বাইরে যাচ্ছিলো। বাবার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ায় হাসলো। বাবা জিজ্ঞেস করলেন,

“কোথায় যাচ্ছ মা?”
“একটু বাইরে যাচ্ছি বাবা। কিছু কেনাকাটা করব। পরের সপ্তাহে একটা পরীক্ষা আছে।”
“তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”
“ভালোই বাবা।”
“ভেরি গুড। একটা সরকারি চাকরি হয়ে গেলে জীবনে আর কিছুর দরকার হয় না। অন্য সবার মতো রান্নাঘরে বসে চাল, ডাল ফুটিয়ে জীবন শেষ করবে না তুমি।”
শাওন হাসলো। ডাইনিং রুমে থাকা সুরমা বেগম কথাটা শুনলেন। আহা কী নীতিবাক্য! অথচ তার বেলায় চিরকাল সব ছিলো উল্টো।
সুরমা বেগম স্বামীকে খেতে দিলেন। দেশী মুরগী আলু দিয়ে রান্না করা সঙ্গে গরম চিতই পিঠা। ভাবলেন আজ কিবরিয়া সাহেব কে বলবেন শাওনের কথা। পলাশের ভুত যদি কেউ বের করতে পারেন তো সেই পারবে।

জুয়েল ভাই আজ এসেছেন পলাশ দের ওখানে। ভাইয়ের বাসায় নাকি কিসব ক্যাচাল চলছে। যখন ই এমন ক্যাচাল টাইপ ঘটনা ঘটে তখনই সে এখানে চলে আসে।
পলাশ ঠিক করলো আজ ও ওর কথাটা বলবে। শাওনের বিষয় টা ইদানীং ও’কে খুব ভাবাচ্ছে। মায়ের বন্ধুর ছেলে টাইপ আত্মীয়রা কখন বাসায় আসা যাওয়া করে সেটা পলাশ জানে। শাওনের মা চুপিচুপি সব কিছু ঠিক করে মেয়ের বিয়ে দিলেও দিতে পারে। আর যদি তাই হয় তখন ওর হাত কামড়ানো ছাড়া আর কিছু করারও থাকবে না।

জুয়েল ভাই ভদ্রলোক বিশালদেহী। তার খানা খাদ্যও মাশাল্লাহ! সকালের ব্রেকফাস্ট সেড়েছেন পনেরো টা পরোটা, ছয়টা ডিম, তিন বাটি মুরগীর স্যুপ আর বিশাল এক মগ চা। সেই সঙ্গে সিগারেট চলছে।
কিন্তু সমস্যা হলো খাবারের বিলগুলো পরিশোধ করতে হবে পলাশ কে। ভাই বিল টা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। পলাশ বলতে পারে নি যে ওর পকেটে টাকা নেই। এসব বললে ভাই আবার মাইন্ড করতে পারেন। তাই বাইরে এসে শাওন কে ফোন করলো। শাওন তখন রিকশায়, বসুন্ধরায় যাচ্ছে। ওর বন্ধু সৌমি বসুন্ধরায় ওর জন্য ওয়েট করছে।
পলাশের ফোন ধরতেই বলল,

“হ্যালো শাওন, কোথায় তুমি?”
“বসুন্ধরায় যাচ্ছি।”
“কেন?”
“একটু কাজ আছে। কিছু কসমেটিকস কিনতে হবে।”
“ওহ। একটা হেল্প লাগতো।”
“কী হেল্প? কিছু হয়েছে?”
“তোমার কাছে কিছু টাকা হবে?”
শাওনের ম্যুড টা খারাপ হয়ে গেল। পলাশ এর আগেও ওর কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। সেগুলো ফেরত দেবার কথা মনেও করছে না। শাওন শান্ত গলায় বলল,

“আমার কাছে টাকা নেই।”
পলাশ আশা করে নি যে শাওন এরকম বলবে। প্রত্যেকবার ই দিতো। অবশ্য সেই টাকাগুলো ফের‍ত দেবার সুযোগ হয় নি পলাশের। আমতা আমতা করে বলল,
“একটু আর্জেন্ট ছিলো… যদি পারতে।”
এতোটা কঠিন হতে শাওনের ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি খারাপ লাগছে পলাশের এমন বেহায়াপনা দেখে। শাওন বলল,

“কত টাকা লাগবে?”
“হাজার পাঁচেক হলে হবে।”
শাওন ফোন রেখে টাকাটা পাঠিয়ে বলল,
“এই নিয়ে তেত্রিশ হাজার নিলে। হিসেব টা নিজেও মনে রেখো।”
ম্যাসেজ টা দেখে পলাশের লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করলো। ওদিকে শাওনের মন খারাপ ভাব দূর হলো না। তবে কী মায়ের কথাই ঠিক! পলাশ কে নিয়ে মায়ের ভাবনাই কী তবে সত্যি!

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৫

বসুন্ধরায় শাওন একা একাই ঘুরে বেড়ালো। কিচ্ছু কিনলো না, খেলও না। ওর বন্ধুকে পাঠিয়ে দিয়ে আরও কিছুক্ষন একা একা ঘুরলো। এমন মন খারাপ নিয়ে বাসায় যাবে না। মা বুঝে ফেলবে। নিজের দূর্বলতা কাউকে বুঝতে দিতে হয় না। মা’কেও না। তবুও মায়েরা কিভাবে কিভাবে যেন বুঝে যায়।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৭