কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৪

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৪
সাবিকুন নাহার নিপা

পলাশ থাকে আজিমপুরের এক বাসায়। বাসা বলতে ব্যাচেলর বাসা। কয়েকজন মিলে শেয়ারে বাসা নিয়েছে। পলাশ পরোক্ষ রাজনীতি করে। মানে স্থানীয় নেতা জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে থাকে। সেই কারণে অন্য কোনো চিন্তা আপাতত ওর মাথায় নেই।

আজ বাসায় পার্টি আছে। সবাই মিলে রাতে জম্পেশ আড্ডা দিবে। এই আড্ডা যেমন তেমন আড্ডা না। এখানে মদ, গাজা সবকিছু আসবে। পলাশ এসব থেকে যদিও দূরে থাকে তবুও সতীর্থ দের পাল্লায় পড়ে একটু আধটু জোর করে খায়। সন্ধ্যা থেকে আয়োজন চলছে। পুরান ঢাকা থেকে তেহারি, মোরগ পোলাও খাশির চাপ এগুলো আসবে। সবকিছুর আয়োজন ই ও’কে করতে হচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হঠাৎ শাওনের ফোন পেল। এই সপ্তাহে শাওনের সঙ্গে দেখা হয় নি। নিজে যাবার সময় পায় নি। ও সময় না পেলেও শাওন ঠিক সময় বের করে চলে আসে। সেদিন আসবে বলেও আসে নি। পলাশ ফোন টা ধরলো। হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই শাওন ওপাশ থেকে ফিস ফিস করে বলল,
“এই কোথায় আছ? শিগগিরই বটতলায় চলে আসো। বেশীক্ষন থাকতে পারব না। ”
পলাশ আমতা আমতা করে বলল,

“এখন?”
“কেন তুমি কোথায়?”
“আমি বাসায়… কিন্তু… ”
কিছু সময় পর ফোনের ওপাশ থেকে জবাব আসে। শাওন বলে,
“পাঁচ মিনিট ম্যানেজ করতে পারবে না?”
পলাশ একটু সময় নিয়ে বলে,
“আচ্ছা আসছি।”

শাওন ফোন রাখার পর রিশাব প্রশ্ন করলো,
“আপনি কি আসলে অন্য কোথাও যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ। আসলে মাকে সরাসরি বললে যেতে দিবে না। তাই মিথ্যে বলা। আমি কিন্তু সবসময় মিথ্যা বলি না। ”
রিশাব হেসে ফেলল। শাওনও হাসলো।

শাওনের সঙ্গে পলাশের বন্ধুত্ব অনেক আগের। ওরা একই পাড়ায় থাকতো। খুনশুটি, বন্ধুত্ব করতে করতে কখন যে প্রেম হয়ে গেল! পলাশ পুরোপুরি শাওনের উল্টো। তেঁজগাও কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েও বছর দুয়েকের মধ্যে রাজনীতির খাতায় নাম লিখিয়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়েছে। চাকরি বাকরির খুব একটা ইচ্ছেও তার মধ্যে নাই। তার আগ্রহ ব্যবসাতে। শাওন যতবারই যায় ততবারই নতুন ব্যবসার আইডিয়া শোনে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আইডিয়াও অনেক বদলায়। কিন্তু ক্যাপিটালের অভাবে কিছুই করা হয়ে উঠছে না। যদিও পলাশ আশায় আছে যে নেতা ভাই মুখ তুলে তাকাবেন কিন্তু শাওন জানে যে দিনশেষে নেতা সাহেব একটা কাঁচকলাও পলাশের দিকে ছুড়ে মারবেন না। কিন্তু এসব কথা পলাশ কে বলে না। ওর যা ভালো লাগে করুক। চাকরি, বাকরি, ব্যবসা কোনো কিছু নিয়েই ও ঘ্যানঘ্যান করবে না। নিজের উপর ওর অগাধ কনফিডেন্স। একটা না একটা ব্যবস্থা করেই ফেলবে। পলাশ আস্তে ধীরে নিজেকে গুছিয়ে নিক। কোনো সমস্যা নেই। শুধু ওর জীবনের চাপ্টারগুলো পলাশ নামের ছেলেটাকে নিয়েই লেখা হোক।

গাড়িতে রিশাব আর শাওনের কথাবার্তা তেমন হলো না। টুকটাক কথাবার্তা। আজ রাস্তাও ভীষণ ফাঁকা ছিলো। নাখালপাড়া থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত তেমন জ্যাম ছিলো না। নীলক্ষেতের মোড়ে এসে জ্যাম পড়লো। তখনই শাওন পলাশ কে ফোন করেছিল।
রিশাব শাওনের দিকে আড়চোখে কয়েকবার। সেদিন শাওনকে ওয়েস্টার্নে দেখেছিল। ভালোই লেগেছে। কিন্তু আজ শাড়িতে ভীষণ সুন্দর লাগছে।

শাওনের সঙ্গে রিশাবের চোখাচোখি হলো। শাওন মৃদু হেসে বলল,
“বিরক্ত হচ্ছেন? রাস্তা ফাঁকাই। আর আমার বেশীক্ষন সময় লাগবে না।”
রিশাব হাসলো। বলল,

“একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে। করা উচিত কি না সেটাই ভাবছি।”
“করে ফেলুন। আপনি আমার মায়ের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর ছেলে। তার উপর আবার আমার সুন্দর নাম টা আপনার মায়ের রাখা। আপনি দুই একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতেই পারেন। নো প্রবলেম।”
শাওনের বলার ধরন দেখে রিশাব হেসে ফেলল। বলল,
“আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলেন।”
“থ্যাংক ইউ। যারা একটু কম কথা বলে তারা যখন কথা বলে তখন সুন্দর করেই বলে। আমি অবশ্য মাঝারি টাইপ কথা বলি।”

রিশাব আবারও হাসলো। শাওনের সঙ্গে ওর কথা বলতে খুব ভালো লাগছে। নীলক্ষেতের এই জ্যাম টা আরও কিছুক্ষন থাকলে ভালোই হতো। কিন্তু সেটা হলো না।

পলাশের সঙ্গে শাওন বেশীক্ষন কথা বলতে পারলো না। টিফিন ক্যারিয়ার টা হাতে দিয়ে বলল,
“এই নাও। আমি আসছি।”
“এক্ষুনি যাচ্ছ?”
“হ্যাঁ। তুমিও তো বললে বেশী সময় দিতে পারবে না।”
পলাশের চোখ গাড়ির দিকে। রিশাব গাড়ি থেকে না নামলেও ওকে দেখা গেল। জিজ্ঞেস করলো,
“উনি কে? কার গাড়িতে এসেছ?”
“মায়ের বন্ধুর ছেলে। আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে।”
“তার সঙ্গে চলে এলে?”

“হ্যাঁ। গাড়ি করে আসলাম বলেই তো এতো জলদি আসতে পারলাম।”
পলাশ বিড়বিড় করে বলল, এতো তাড়াহুড়োর বা কী আছে!
শাওন শুনতে পেলেও পাত্তা দিলো না। বলল,
“আমি আসি।”
“এখন এই গাড়িতেই যাবে?”

“হ্যাঁ। ওনাকে তো আমাদের বাসা থেকেই নিয়ে এলাম। বাই দ্য ওয়ে, তোমার কথাবার্তা একটু অন্যরকম লাগছে। এই গাড়িতে গেলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে!”
পলাশ একটু সহজ হবার চেষ্টা করলো। বলল,
“না আসলে.. এমনি বলছিলাম। আমার হাতে সময় থাকলে পৌঁছে দিতাম।”
শাওন আর কোনো কথা বলল না। গাড়িতে উঠে গেল। পলাশ ভাবলো ই ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে। একটা কিছু গতি করা দরকার। শাওনের মা দিনরাত মেয়ের কানের কাছে মন্ত্র পড়তে থাকেন। যদি কোনো কারনে শাওনের মন ঘুরে যায়! আজ ই ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করবে। আর দেরি করা যায় না আসলে।

শাওন রা বাসায় তাড়াতাড়িই ফিরলো। সুরমা বেগম স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললেন। গেট দিয়ে ঢোকার সময় শাওন আর রিশাব কথা বলতে বলতে ঢুকছিল। দুজনের মুখেই হাসি। কী বিষয়ে কথা হচ্ছিলো সুরমা বেগম জানেন না। তবে হঠাৎ করে তার মনে হলো শাওনের পাশে রিশাব কে দারুন মানায়। কিন্তু মানালেই বা কী! দিলু কোনোদিন রিশাবের সঙ্গে শাওনের বিয়ে দিবে না। মরে গেলেও না।

দীপা আজ ই হোস্টেলে ফিরে যাবে। শরীর টা এখনো দূর্বল তবুও যাবে। সুরমা বেগম বললেন,
“তোমার আজ ই যেতে হবে?”
“জি মা। ”
“পরীক্ষা কবে?”
“আগামী মাসে।”
“এখানে থাকলে হয় না?”

দীপা স্মিত হাসলো। সুরমা বেগম বক্সগুলো ব্যাগে ভরে দিচ্ছেন। শুকনো খাবার, আচার, মুড়িভাজা এসব দিয়ে দিচ্ছেন। হোস্টেলে যখন থেকে থাকা শুরু করেছে তখন থেকেই দিয়ে দেন। দীপা বারন করায় বলেছিল,
“দিয়ে দিচ্ছি। না খেলে কাউকে একটা দিয়ে দিও। আবার ফেলে দিও না। ”
দীপার ব্যাগ গোছানো শেষ। একাই ব্যাগ হাতে নিয়ে গেট পর্যন্ত গেলেন। সুরমা বেগম পিছনে যাচ্ছেন। হঠাৎ ডেকে বললেন,

“দীপা শোনো।”
“জি মা বলুন।”
সুরমা বেগম কিছু বললেন না। দীপার হাতে পাঁচশ টাকার কতগুলো নোট দিলেন। দীপা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। তিনি বললেন,
“তোমার মোবাইলের ডিসপ্লে ভেঙে গেছে দেখলাম। একটা মোবাইল কিনে নিও।”
দীপা দূর্বল গলায় বলল,
“লাগবে না। ”
সুরমা বেগম নরম গলায় বললেন,
“না লাগালে অনেক কিছুই লাগে না। কিনে দিও।”
দীপা হাসলো। ওর গলা বুজে এলো প্রায়। কিছু আর বলল না। ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় নেমে গেল। দীপা একবার পেছন ফিরে তাকালো। সুরমা বেগম হাত নাড়লেন। টাকা ভর্তি মুঠ করা হাত দিয়ে দীপাও হাত নাড়লো।

মোট পনেরো হাজার টাকা আছে। এই ভদ্রমহিলা প্রত্যেকবারই ওকে টাকা দেয়। এই টাকাটা হিসাব ছাড়া। এই মহিলার ছেলে হয়েও সুহাসের মধ্যে কেন বিন্দুমাত্র মায়া, মমতা নেই সেটা ভেবেই পায় না।
দীপা আর সুহাস সম্পর্কে মামাতো ফুপাতো ভাই বোন। সুহাসের বাবা দীপার মামা। অথচ ভদ্রলোকের সঙ্গে ওর ছোটবেলায় দেখা হয়েছে হাতে গোনা কয়েকবার। দীপার মা মারা গেছেন ও যখন ক্লাস ফোরে পড়ে। তারপর সৎ মায়ের সংসারে থেকেছে। শহরে পড়তে আসার সুবাদেই সুহাস দের বাসায় এসেছিল।

ভর্তি কোচিং এর কয়েকটা মাস থেকেছে। এরপর ইডেন কলেজে ভর্তি হয়ে হোস্টেলে চলে গেল। মামার বাসায় মামীর আন্তরিকতায় মাঝেমধ্যে যাওয়া হলেও সুহাসের সঙ্গে ওর তেমন কথাবার্তা হতো না। সুহাস ভালো করে ও’কে কোনোদিন দেখেও নি। হঠাৎ শুনলো ওর সঙ্গে সুহাসের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। সেই বিয়ে নিয়েও বিশাল ঝামেলা। সুহাস বিয়ের দিন রাতে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো যে শুধু মায়ের সংসার বাঁচাতেই সে বাবার কথায় রাজী হয়ে বিয়েটা করেছে। দীপা ডিভোর্স চাইলে সে খুশিমনে ডিভোর্স দিয়ে দিবে।

দীপা তখন অনেক কিছুই বুঝতে পারে নি। পরে আস্তেধীরে বুঝলো যে তার মায়ের সম্পত্তির ভাগটুকু নিজেদের করে রাখার জন্যই দীপাকে সুহাসের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই নিয়ে চূড়ান্ত রকম ঝামেলা হয়েছে সুহাসের সঙ্গে বাবার। সুহাস অবশ্য দীপার পক্ষেই কথা বলেছে। দীপাকে এও বলেছে যে তুমি যা চাইবে তাই হবে। তবে আমার মনে হয় তোমার উচিত আমাদের সবার নামে মামলা করা। এক কাজ করো, থানায় গিয়ে আমার নামে নারী নির্যাতনের মামলা করো। কাউকে ছাড়বে না। এমনকি আমার মাকেও না।

পুরোনো কথা ভেবে দীপা হেসে ফেলল। সুহাস অনেক বুদ্ধি দিয়েছে। এমনকি মামলা মোকদ্দমা চালানোর সব পয়সা ও বহন করবে সেটাও বলেছিল। কিন্তু দীপা সেটা করে নি। ডিভোর্স দিতেও রাজি হয় নি। ঠিক সেই কারনেই দীপা সুহাসের বিরক্তির এতো কারন।
সিএনজিতে বসে দীপা আপনমনে হাসে। মানুষের চাওয়া পাওয়ার সমীকরণ টা এতো গোলমেলে! সুহাস দীপা কে চায় না। আর দীপা এই বিয়েটা ভাঙতে চায় না। যেখান থেকে ওর পাওয়ার কিছু নেই। তবুও কেন চায় না জানে না।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৩

সুহাস অফিস থেকে ফিরে দেখলো শাড়ির প্যাকেট টা খাটের উপর রাখা। সঙ্গে একটা মাখন রঙা ছোট কাগজ। সেখানে ছোট করে লেখা, ধন্যবাদ ও দু:খিত।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৫