কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৮

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৮
সাবিকুন নাহার নিপা

শনিবার বিকেলে সুহাস বেইলি রোডে আসে। প্রতি শনিবার। তেমন কোনো কাজ নেই। রাস্তায় খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়ায়। এদিকে বেশ কিছু ফাস্ট ফুডের দোকান হয়েছে। চাপ,লুচি,ফুচকা,ভেলপুরী, মোমোর দোকানগুলোতে বিকেল হলেই রাজ্যের ভীড় জমে যায়। রাস্তার ধারে হাটতে দেখা যায় প্রেমিক প্রেমিকাদের। কিছু ছেলে মেয়েদের দেখলে বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে সুহাসের। মনে পড়ে যায় পুরোনো সেই দিনগুলোর কথা। একসময় ওরাও আসতো এই রোডে ঘুরতে। চিপা গলির ছোট দোকান টাতে বিশ টাকায় লুচি আর ডালের তরকারি খেত আয়েশ করে। সেসব দিন আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। আহারে! কী দিন ছিলো সেসব!

এমন রাস্তায় হাত ধরে আঙুলে আঙুল গুজে সুহাসও একজনের সঙ্গে হাটতো। তার নাম ছিলো ঝুমুর। ঝুমুর আর ও একই কোচিং এ পড়তো। সুহাস ভালো ছিলো পড়াশোনায়। বাড়িতে বাবার কঠিন অনুশাসন ছিলো বলেই পড়াশোনায় ফাঁকি দেয়া সুহাসের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এসএসসি অবধি ওর জগৎ ছিলো বই খাতার সঙ্গে। ঝুমুর ছিলো সেদিক দিয়ে উলটো। পড়াশোনায় একটু এভারেজ থাকলেও অন্যসব কিছুতে দারুন পারদর্শী ছিলো। এতো সুন্দর করে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতো। কি সুন্দর আবৃত্তির গলা! এসব কারনেই পিছনে বসে থাকা পাতলা গড়নের ঝুমুর সকলের প্রিয় ছিলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সুহাসের কনফিডেন্স লেভেল বরাবরই জিরোর দিকে ছিলো। সেই জায়গা থেকে ঝুমুর কে ভালো লাগার কথা বলা কখনোই সম্ভব ছিলো না। কিন্তু সুহাসও যে নিরুপায়! রাত বিরাতে ঘুম ভেঙে যায়। বুকের ভেতর তীব্র জ্বালা! ঝুমুর নামের মেয়েটা যদি অন্য কারো হয়ে যায়!

সুহাস এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। কলেজের দিনগুলো ওর কাছে পানসে লাগে। ঝুমুর পড়তো মহিলা কলেজে। ওদের পাশেই। ছুটির পরে দাঁড়িয়ে থাকতো দেখার জন্য। যদিও সন্ধ্যেবেলা কোচিং এ দেখা হবে। তবুও যতটুকু বেশী দেখা যায়।
তারপর একদিন সুহাস সাহস করে ঝুমুর কে চিঠি দিলো। সেই চিঠির জবাব আসে না। সুহাস অস্থির হয়ে যায়। সেই সঙ্গে ভারী লজ্জাও হয়। ঝুমুর বুঝি আবার ও’কে মন্দ ছেলে ভেবে নিলো।
কোচিং এ যাবার পথে একদিন ঝুমুরের সঙ্গে একা দেখা হলো। ঝুমুর ও’কে দেখে মৃদু হাসলো। সেই হাসিতে কী ছিলো কে জানে! সুহাসের সাহস অনেকখানি বেড়ে গেল। ঝুমুর কে বলল,

“তুমি কী একটু আমার কথা শুনবে?”
ঝুমুর দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে হাসছে। সুহাস আমতাআমতা করে বলল,
“আমি তোমাকে যে চিঠি দিয়েছিলাম তাতে কী তুমি মাইন্ড করেছো?”
ঝুমুর মাথা নেড়ে না বলল। সুহাস আবারও বলল,
“তাহলে জবাব দাও নি যে?”
ঝুমুর সুহাসের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ওটাকে চিঠি বলে? চিঠিতে কত্তো কিছু লেখা থাকে। ওখানে তুমি মোটে একটা লাইন লিখেছ। আমার তোমাকে ভালো লাগে। এই লাইন টার কি জবাব দেব আমি?”
সুহাস ওর উত্তর পেয়ে যায়। মাথা চুলকে হেসে বলে,
“আমার পকেটে বিশ টাকা আছে। ফুচকা খেতে যাবে?”
ঝুমুর একটুও সময় না দিয়ে বলেছিল,
“যাব।”

সুহাসের জীবনে প্রথম প্রেম এসেছিলো সুন্দর এক বসন্তের মতো। একটা বছর কাটলো স্বপ্নের মতো। চিঠি দেয়া, বাসার ফোন থেকে এসএমএস লেখা। মাঝেমধ্যে দু:সাহস করে ফোনে কথা বলা। সুন্দর স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর ছিলো সেই দিনগুলো।

কিন্তু স্বপ্নের পেছনে দু:স্বপ্নও থাকে। ঝুমুরের দেয়া চিঠি একদিন বাবার হাতে পড়লো। বাবা সেই চিঠি পেয়ে ঝুমুরের বাবা, মা’কে ডাকলেন। চূড়ান্তরকম অপমান করা হলো তাদের। ঝুমুরের বাবাও কম যান না। তিনিও কম বেশী সুহাসের বাবাকে কথা শোনালেন। ঝুমুর কোচিং এ আসা বন্ধ করে দিলো। বাড়িতে টিচার রেখে পড়ানো শুরু করলো। সুহাসের সঙ্গে মা যেত। দেখা করা, কথা বলার উপায়ও নেই কোনো।

সুহাস সবরকম চেষ্টা করেছে। ঝুমুর কলেজে আসে না। টেস্ট পরীক্ষার আগের ক্লাসগুলোও মিস করছে। একদিন সুহাস ওদের বাড়ির সামনে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ি থেকে খানিক দূরে। দেখা হয় না, দুদিন পর আবারও যায়। ভেতর থেকে এক মহিলা বেরিয়ে আসেন। তিনি জানান যে ঝুমুর খুব অসুস্থ। টাইফয়েড হয়েছে। সুহাস রোজ গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়িতে আবারও অশান্তি, মারামারি। অমানুষের মতো মারে বাবা সুহাস কে।
ঝুমুরের মা একদিন অধৈর্য্য হয়ে বেরিয়ে আসেন। তার মেয়েটারও যে বদনাম হচ্ছে ছেলেটার জন্য। কী বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটা। অনেক দিন পর সুহাস দেখা পায় ঝুমুরের। আনন্দে চোখে জল আসার উপক্রম। ঝুমুর সামনে আসেনা। পর্দার আড়াল থেকে মুখ বের করে বলে,

“তুমি আর আসবা না।”
সুহাস চোখ ভর্তি জল নিয়ে বলে,
“তুমি কেমন আছ?”
“বাড়ি যাও। আব্বা চলে আসবেন।”
সুহাস নি:শব্দে কাঁদে। ঝুমুর আবারও বলে,
“বাড়ি যাও। ভালো করে পড়বা কিন্তু। ”
সুহাস কিছু বলে না। চলে আসে। আসার সময় ঝুমুরের মা বলে,

“এই ছেলে শোনো, আর আসবা না। জানো আমার মেয়েটা তোমার জন্য কত মার খাইছে!”
সুহাস চলে আসে। কিছুদূর আসতেই ঝুমুরদের বাড়ির সেই ভদ্রমহিলা কে দেখতে পায়। উনি একটা কাগজ সুহাসের হাতে দিয়ে বলে,
“বাসায় যাও বাবু, মন খারাপ কইরো না। ”
সুহাস সেই চিঠি দ্রুত খুলে পড়তে শুরু করে। সেখানে লেখা থাকে,

“আমি কিচ্ছু খাইতে পারি না। সব তিতা লাগে। ডিম ভাজা, আর লেবু দিয়ে গরম ভাত টা খাইলে একটু ভালো লাগে। মাথার চুল কেটে ফেলছি। সব চুল উঠে যাইতেছে তাই। এইজন্য তোমার সামনে আসি নাই। তুমি কিন্তু ভালো করে পড়বা। আমি মনে হয় পরীক্ষা দিতে পারব না। তুমি পড়া বন্ধ করবা না। আমার জন্য পড়বা। চিন্তা করবা না, যতই মারুক কাটুক তোমারে আমি ভুলব না।”

কিছু সোজা সরল বাক্য সুহাসের দিনগুলো আগের মতো করে দেয়। পড়াশোনায় মনোযোগী হয়। আগের মতো সব চলতে থাকে। হঠাৎ একদিন সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। সেদিনও ছিলো শনিবার। সকালে সুহাসের বন্ধু সাইফ এসে ও’কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে বলে ঝুমুর আর নেই সুহাস। সুহাস তখনও বুঝতে পারে না। নেই মানে কী! মামাবাড়ি, বা দূরে কোথাও গেছে! না, ঝুমুর আর পৃথিবীতেই নেই। এমন জগতে চলে গেছে যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না।

ঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। খানিক আগে আকাশে শুভ্র মেঘ দেখা গিয়েছিল বটে। সুহাস উঠে দাঁড়ালো। বৃষ্টিতে ভিজতে মন্দ লাগছে না। চোখের পানিটাকেও ধুয়ে, মুছে দিলো। পকেটে ফোন টা বাজছে। সুহাসের ফোন টা ধরতে ইচ্ছে করছে না। চারদিকে ছোটাছুটি চলছে। বৃষ্টিতে যে যার মতো গুছিয়ে নিলেও এখন সবাই ছুটছে। আকাশের অবস্থা ভালো না। কালবৈশাখী ঝড় আসবে হয়তো। সুহাস হাটছে নিশ্চিন্তে। ঝড় নিয়ে মাথাব্যথা নেই ওর। কিছুদূর যাবার পর একটা সিএনজি সামনে পেল। সিএনজি ওয়ালাও নাছোড়বান্দা। সুহাস কে না নিয়ে যাবে না। অগত্যা সুহাস কে উঠে বসতে হলো।

সুহাস যখন বাড়ির সামনে এসেছে তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। ঢাকা শহর পুরো অন্ধকার। সুহাস দরজায় কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গেল। দীপা অস্থির গলায় বলল,
“আপনি ফোন ধরছিলেন না কেন? ইশ! পুরো ভিজে গেছেন! ঠান্ডা না লাগলে হয়!”

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৭

সুহাস ঘরে ঢোকে। দীপার হাতে মোমবাতি। বাসায় কেউ নেই। শাওন মা’কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে। দীপা তোয়ালে টা এগিয়ে দিলো সুহাসের দিকে। সুহাস দীপার দিকে তাকিয়ে আছে। মোমবাতির আলোটা ওর মুখে পড়েছে। দীপার সঙ্গে কী ঝুমুরের কোনো মিল আছে? আছে। একটা জায়গায় মিল আছে। দুজনের মুখেই মায়াভাব প্রবল। তবে দীপাকে কখনো সুহাস হাসতে দেখে নি। দেখবে বা কী করে। দীপা তো সবসময় ভয়ে তটস্থ থাকে। আর ও তো কখনো ভালো করে কথাও বলে না, সবসময় ধমকের উপর থাকে।
সুহাস হাত বাড়িয়ে দীপার গালে হাত রাখলো। মোমবাতী হাতে নিয়েই দীপা কাঁপতে লাগলো।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৯