খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৬

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৬
আভা ইসলাম রাত্রি

আজ পূর্ণিমা রাত। আকাশে থালার ন্যায় মস্ত বড় এক চাঁদ উঠেছে। চাঁদের দেহে চোখ মেলানো যাচ্ছে না, চোখ যেন ঝলসে যাবে। চিত্রার পরণে আটপৌরে লাল রঙা শাড়ি। শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে রাখা। কানে শেহজাদের গড়িয়ে দেওয়া সোনার ঝুমকো। এসব সাজন ছাপিয়ে এই মুহূর্তে চিত্রার ঠোঁটের ওই পূর্ণতার হাসি ঝলমল করছে। শেহজাদ ঘরে এলো। আশেপাশে চেয়ে চিত্রাকে বারান্দায় গ্রিল ঘেঁষে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল সে ধীর কদমে।

‘সুভাষিণী?’
শেহজাদ আলগা কণ্ঠে ডাকে। শেহজাদের ওমন গম্ভীর কণ্ঠে বরাবরের মত এবারেও চিত্রার বুক কাঁপে। চিত্রা টলমল চোখে পেছনে ফেরে চায়। শেহজাদের আবছা চোখ নিক্ষেপ হয় চিত্রার সুডৌল মায়াবী মুখপানে। ধীরে ধীরে ওই নয়নের তীর থামে চিত্রার শাড়ি দিয়ে ঢেকে রাখা মসৃণ পেটে। শেহজাদের কন্ঠমণি কেঁপে উঠে এই ভেবে যে, এই পেটে, এই কোমল চামড়ার ভেতরে আছে প্রথম সন্তান, শেহজাদ আয়ুষ্মানের প্রথম উত্তরাধিকারী।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শেহজাদ এগিয়ে আসে। শেহজাদ মেঝেতে একটা কদম রাখে, চিত্রার বুক প্রতিটা কদমে ধড়াস ধড়াস করে লাফায়। চিত্রা ডান হাতে বুকের বা পাশ চেপে ধরে অন্যদিকে চোখ ঘুরায়। হাপরের মত নিঃশ্বাস নিয়ে অনুভব করে শেহজাদের এগিয়ে আসার একেকটা ধাপ। শেহজাদ চিত্রার পাশে এসে থামলে চিত্রা আকস্মিক শেহজাদের বুকে মাথা রেখে দুহাতে শেহজাদের পিঠ আকরে ধরে। শেহজাদ হালকা হাসল বুঝি? নিজের স্ত্রীকে দুহাতে বাহুবন্ধনীতে জড়িয়ে নিতে এটুকু সময় অপচয় করল না শেহজাদ আয়ুষ্মান। চিত্রা শেহজাদের বুকের পাঞ্জাবিতে নাক ঘষে কিছুক্ষণ পর আলগা স্বরে জানায়,

‘আমাদের রাজারানীর ঘরে রাজপুত্তুর আসছে, নেতাশাহ! এ খুশি, এ আনন্দ– সবকিছু আমার কেমন যেন লাগছে। আমি বোঝাতে পারছি না, আমার মনে বয়ে চলা অদ্ভুত এ অনুভূতি! আপনি —-‘
শেহজাদ চিত্রাকে আর একটি কথাও বলতে দেয় না। আঙ্গুলের ডগায় চিত্রার ঠোঁট চেপে ধরে। চিত্রা চুপ, নয়নে ভাসে শেহজাদের পবিত্র মুখের অবয়ব। শেহজাদ চিত্রার চুলে আদরে হাত বুলিয়ে আওড়ায়,

‘আমাদের প্রথম সন্তানের আগমন শুভ হোক আয়ুষ্মান মহলে। আজকে থেকে সবসময় তুমি মেপে চলবে। বাড়ির কাজ করার পাশাপাশি আমাদের অনাগত সন্তানের যত্ন নেবে। শেহজাদ আয়ুষ্মানের উত্তরাধিকারী তার মতই শক্তিশালী হয়ে জন্মানো চাই।’

চিত্রা তোতাপাখির ন্যায় মাথা নেড়ে সায় দেয়। শেহজাদ ঠোঁট নামিয়ে এনে চিত্রার ললাটে গাঢ় চুমু বসায়। চিত্রা শিহরণে শেহজাদের বুকের পাঞ্জাবি চেপে ধরে চোখ বুজে। চিত্রার চোখের কোণ ঘেঁষে অশ্রু বেয়ে পরে। অতি শীঘ্রই এ ললাটে জমা সুখ চিত্রার হিংসা হচ্ছে। বারবার বোধ হচ্ছে, এত সুখ, এত শান্তি, এত আনন্দ কি কোনো একদিন এক নিমিষে নিঃশেষ হয়ে যাবে? চিত্রাকে অসহায় করে দিয়ে তাদের ঘরে আসা সুখ পালিয়ে দম নেবে?

চিত্রা ছটফট করে উঠে যেমন। দীর্ঘ এক চুমুর শেষে শেহজাদ সরে আসে। চিত্রার চোখের জল মুছে কানের পেছনে চুল গুঁজে দেয়। হাঁটু গেঁড়ে চিত্রার পেটের কাছে মুখ এগিয়ে বসে। শাড়ি সরিয়ে চোখ রাখে চিত্রার কোমল পেটে। সেথায় অনেক যত্ন নিয়ে হাত বুলিয়ে আওড়ায় কটা কথা,
‘আমার সন্তান, রুহের জগৎ থেকে দোয়া নিয়ে এসো এ পৃথিবীতে। পৃথিবীতে তোমার আগমন শুভ হোক, শেহজাদ আয়ুষ্মানের শক্তির উৎস হয়ে এবং মায়ের পবিত্রতা পেয়ে তোমার জন্ম হোক। তোমার আব্বাজান তোমাকে জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি ভীষন ভালোবাসবে।’

চিত্রা শেহজাদের কথা শুনে টলমল চোখে হেসে উঠে শব্দ করে। মাথা ঝুঁকে ফিসফিস করে শেহজাদকে মনে করিয়ে দেয়,
‘শুধু নিজের ব্যাপারে বলছেন, ওর আম্মাজানের ব্যাপারে বলুন না।’
চিত্রার বোকা বোকা কথা শুনে শেহজাদ মাথা নত করে হেসে উঠে হালকা। পরপর পেটে হাত বুলিয়ে বলে,
‘তোমার আম্মাজান তোমাকে পৃথিবীতে আনার জন্যে এত কষ্ট করছে, সারাটাজীবন তার কষ্টের সম্মান জানানোর মনোভাব নিয়ে পৃথিবীতে এসো। আজকে থেকে তোমার আম্মাজান, আব্বাজান, এবং পুরো আয়ুষ্মান বংশ তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।’

চিত্রার চোখে মুখে অশ্রুজলে মাখামাখি। শেহজাদ পেটের শাড়ি ঠিক করে উঠে দাঁড়ায়। চিত্রা আবারও শেহজাদের বুকে মাথা রেখে চাঁদের দিকে চায়। শেহজাদের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি, তা চিত্রা না দেখে বুঝেছে। চিত্রা ভেজা কণ্ঠে ডাকে,
‘নেতাশাহ?’
শেহজাদ জবাব দেয়, ‘হুঁ।’
চিত্রা নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘আপনি খুশি?’

শেহজাদ থেমে যায়। চিত্রা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে অপেক্ষা করে থাকে। একসময় শেহজাদ এতদিনের নিয়ম ভেঙে নিজের খুশিটুকু প্রকাশ করেই ফেলে,
‘এতদিন একা ছিলাম, শুধুমাত্র পরিবারের উপর দায়বদ্ধতা ছিল। তারপর তুমি এলে। দায়বদ্ধতা বাড়ল। আর এখন! এক নতুন অবুঝ সদস্য আসছে। দায়বদ্ধতা আরো বেড়েছে ঠিকই কিন্তু এ দায়বদ্ধতা আমার খুশির, এ দায়বদ্ধতা আমার আনন্দের।’

শেহজাদ টেলিফোনে কথা বলছে। আগামীকাল শহরে যাবে সে। একটা গুরুত্তপূর্ণ প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। শহরে প্রবেশ করার পথে হাইরোডের দুপাশে গাছ লাগানো হবে। এতে একদিকে যেমন পথের সৌন্দর্য্য বাড়বে, তেমনই তাপমাত্রা কমবে। শেহজাদ তাই নিয়েই কথা এগুচ্ছে টেলিফোনে। শেহজাদ কথা বলতে বলতে হেঁটে বাড়ির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছনে সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে সে কথা বলায় মগ্ন আপাতত। চিত্রা চা নিয়ে শেহজাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। শেহজাদ চায়ের কাপ হাতে নিল। চিত্রা নাকের নিচে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমে আছে।

রান্নাঘরে এতক্ষণ ছিল বলেই হাঁপিয়ে গেছে চিত্রা। শেহজাদ আড়চোখে সেসব কিছুই লক্ষ্য রাখছে। শেহজাদ টেলিফোনে কথা বলার ফাঁকে একহাতে চিত্রার আঁচল টেনে তার জমে থাকা ঘাম মুছে দেওয়ার চেষ্টা করল। চিত্রা সেটা বুঝতে পেরে সঙ্গেসঙ্গে আঁচলে ঘামটুকু মুছে নেয়। চিত্রা শেহজাদের পাশে ঠাই দাঁড়িয়ে শুনে তার কথা। একসময় শেহজাদ ফোন কাটে। সিঁড়ির উপরে বসে পরে চা খাওয়া শুরু করে।
চিত্রাও শেহজাদের পাশে সিঁড়িতে বসে। শেহজাদ চা পান করছে, পাশে থেকে চিত্রা রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে। শেহজাদ শুনছে, মাঝেমাঝে দু একবার ‘হু, হা’ করছে।

হঠাৎ শেহজাদের কানে শব্দ আসে, সাপের ফোঁসফোঁস শব্দের। শেহজাদ এক হাত উঁচু করে ইশারায় চিত্রাকে থামতে বলে। চিত্রার কথা তাৎক্ষণিক বন্ধ হয়ে যায়। শেহজাদ কান উঁচু করে সতর্কভাবে শোনার চেষ্টা করে আগত শব্দ। শেহজাদ চায়ের কাপ চিত্রার হাতে ধরিয়ে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ায়। সূক্ষ ভাবে প্রতি কদম ফেলে এগিয়ে যায় সামনে। চিত্রা কাপ সিঁড়ির উপর রেখে শেহজাদের পিছু পিছু এগিয়ে যায়। মূলত সেও শুনেছে সাপের ফোসফোস শব্দ।

কিছুটা দূরে যাবার পর শেহজাদের চোখে পরে মাটিতে বানানো ছোটখাটো একটা কাঠের ঘর। শেহজাদ বিস্মিত হয়। ঘর দেখে মনে হচ্ছে, এখানে বড্ড যত্ন করে প্রাণী পোষা হচ্ছে। শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে চিত্রার দিকে একপল চায়। চিত্রা ভয় পেয়ে বলে,

‘শুনুন, আপনি একা কিছু করবেন না। বিপদ যদি হয়?’
শেহজাদ আবার তাকায় কাঠের ঘরের দিকে। সতর্ক কণ্ঠে আওড়ায়,
‘শুসস —–‘
চিত্রা চুপ হয়ে যায় আবারও। শেহজাদের পিছু পিছু থাকল। পাছে কোনো বিপর হয় তার! শেহজাদ কাঠের ঘরের দিকে হাঁটু গেড়ে বসে। দরজার দিকে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে। শেহজাদ এবার পাক্কা মনে করে, সাপের শব্দ এখান থেকে এসেছে। শেহজাদ হাত বাড়িয়ে দরজা খুলবে, তবে পেছন থেকে হঠাৎ মেহজাদ ডেকে উঠে,

‘ভাইয়া! ওখানে কি করছ?’
শেহজাদ থেমে যায়। মেহজাদ দ্রুত কদমে শেহজাদের দিকে এগিয়ে যায়। শেহজাদ উঠে দাঁড়ায়। মেহজাদের দিকে চেয়ে কঠিন কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
‘এই ঘরটা কে বানিয়েছে?’
মেহজাদ ভেতরে ভেতরে থতমত হয়ে গেলেও মুখে প্রকাশ করে,

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৫

‘আমি বানিয়েছি।’
শেহজাদ পুনরায় প্রশ্ন করে,
‘এখান থেকে সাপের আওয়াজ আসছে, তুমি জানো সেটা? কোনোভাবে কি তুমি ফ্যান্টাসিতে পরে সাপ পুষে বেড়াচ্ছ?’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৭