খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৭

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৭
আভা ইসলাম রাত্রি

‘এখান থেকে সাপের আওয়াজ আসছে, তুমি জানো সেটা? কোনোভাবে কি তুমি ফ্যান্টাসিতে পরে সাপ পুষে বেড়াচ্ছ?’
শেহজাদ এ প্রশ্ন করে ভ্রু বাঁকিয়ে মেহজাদের দিকে চায়। ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে মেহজাদের উত্তরের। মেহজাদ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আড়চোখে চিত্রার দিকে চায়। চিত্রা মেহজাদের চোখের দৃষ্টি বুঝে শেহজাদের হাতের পাঞ্জাবি টেনে ধরে নরম কণ্ঠে শুধায়,

‘খামোকা ওকে জেরা করছেন কেন? আপনার শহরে যেতে দেরি হয়ে যাবে।’
শেহজাদ তীক্ষ্ম চোখে চিত্রার দিকে ঘাড় ঘুরায়। শেহজাদের ওমন রাগান্বিত দৃষ্টি দেখে চিত্রার গলা শুকায়। চিত্রা দ্রুত শেহজাদের হাত ছেড়ে দিয়ে দু কদম পিছিয়ে দাড়ায়। চিত্রা অযথা ভয় পেয়ে যাচ্ছে দেখে শেহজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এ সময় মস্তিকে চাপ নেওয়া চিত্রার জন্যে বিপদজনক। শেহজাদ চোখ উল্টিয়ে উদাস ভঙ্গিতে চিত্রার দিকে চোখ ফেরায়। নাকে আঙ্গুল ঘষে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে চিত্রাকে আদেশ করে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘সুভাষিণী, ভেতরে যাও। আমার মেহজাদের সঙ্গে কথা আছে।’
চিত্রা আবারও অসহায় চোখে মেহজাদের দিকে চায়। যদি কোনোভাবে মেহজাদের কোনো অদ্ভুত কাজ শেহজাদের চোখে পরে, তাহলে আজ আয়ুষ্মান মহলে কুরুক্ষেত্রে ঘটে যাবে। দু ভাইয়ের দ্বন্দ্বের মধ্যে চিত্রা এক নাজুক পঙ্খি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রা জানে না মেহজাদ কোনো দোষ করেছে কি না। তবুও মেহজাদের চোখের ভাষা চিত্রাকে সাফ সাফ বলে দিচ্ছে, সে আবারও কোনো অদ্ভুত কাজ করে বসেছে। চিত্রা আবারও আগ বাড়িয়ে মেহজাদকে বাঁচানোর জন্যে বলে,

‘আপনি কি শহরে —–‘
শেহজাদ এবার মৃদু ধমকের ভাষ্যে বলে বসে,
‘আমার ঘর তছনছ হয়ে গেলে আমি শহর দিয়ে কি করব, বলো? এ জোশ, প্রতিপত্তি এসব কি কাজে আসবে যদি আমার ঘরের মানুষ নষ্ট হয়ে যায়? তুমি ঘরে যাও। আমি কথা বলছি। তোমার এতক্ষণ বাইরে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না।’

‘আপনি —-‘
‘যেতে বলেছি না আমি?’
শেহজাদের হালকা স্বরের ধমকে চিত্রার দেহ দৃশ্যমান রূপে কম্পিত হয়ে উঠে। চিত্রা জানে, শেহজাদ এখন অসামান্য রেগে আছে। এখন তাকে ঘাটানো মানে যেচে ধমকের স্বীকার হওয়া। শেহজাদের সঙ্গে এত মাস সংসার করে এটুকু চিত্রা বোঝা আছে। তাই মাথার আঁচল ঠিক করে চিত্রা মেহজাদের দিকে একবার চেয়েই ভেতরে চলে যায়।
চিত্রা চলে যেতেই শেহজাদ পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহজাদের দিকে। মেহজাদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

‘শুধুশুধু ভাবিজানকে বকলে। এই অবস্থায় এসব উনার জন্যে ভালো না।’
শেহজাদ সেসব কথা পাত্তা দেয়না। বরং আদেশ করে,
‘আমি দাঁড়িয়ে আছি, দরজা খুলো এ কাঠের ঘরের। আমি জানতে চাই, এর ভেতরে কি আছে।’

মেহজাদ শেহজাদের চোখে চোখ মেলাল। তীক্ষ্ম চোখে শেহজাদের চোখের ভাষা পরে বুঝে নিল, ঘরের ভেতরে কি আছে সেটা শেহজাদ না জেনে এখান থেকে এক পা-ও নড়বে না। আর মিথ্যা বলার সাহস মেহজাদের নেই। শেহজাদ প্রচুর চতুর পুরুষ। চট করে ধরে ফেলবে মেহজাদের মিথ্যা কথা। মেহজাদ হার মানল। কোমর ঝুঁকিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসল নিচে। কাঠের দরজা খুলে দেওয়ার পর আড়াআড়ি ভাবে এগিয়ে এল এক গোখরা সাপ। সত্যিকারের সাপ দেখেই শেহজাদ রীতিমত চমকে উঠল। সঙ্গেসঙ্গে মেহজাদের দিকে চেয়ে বলল,

‘এটাত বিষধর সাপ! তুমি এটা পুষেছ?’
মেহজাদ হালকা হাসল। ঝুঁকে সাপ নিজের দুহাতে পেঁচিয়ে নিয়ে শেহজাদের সামনে এগিয়ে এল। শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে একবার সাপের দিকে, আরেকবার মেহজাদের দিকে চেয়ে দেখল। মেহজাদ সাপকে শিখিয়ে দিল,
‘চুচু, ইনি হলেন আমাদের গর্ব, আমার ভাইয়া, এ গ্রামের নেতা! উনাকে তুমি হ্যালো বলো।’

সাপ আলগোছে ফণা তুলে শেহজাদের দিকে চেয়ে ফোঁসফোঁস করল কিছুক্ষণ। তারপর আবার মেহজাদের হাতের মধ্যে পেঁচিয়ে রইল। শেহজাদ বিস্ময়ে কথা বলতেই ভুলে গেল যেন। সে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি উন্মাদ হয়ে গেছো? এ সাপ তুমি কিভাবে পেলে? আর সাপ পোষা কিভাবে শিখলে? সাপ কি পোষার জিনিস?’
মেহজাদ হেসে উঠল ফিক করে। বলল,

‘ভাইয়া, আস্তে! একটা একটা করে প্রশ্ন করো। আমি উত্তর দেব। ১ম প্রশ্ন, না, আমি পাগল হয়নি। সাপ পোষা আমার ভালো লাগে। আমার আমেরিকাতেও সাপ পুষেছিলাম কয়েকবছর। তারপর ওরা মারা যাবার পর আর পোষা হয়নি। ওখানে এসব পোষা খুবই নরমাল একটা ব্যাপার। ২য়, সাপ পেয়েছি আমাদের ঘর থেকেই। সাপুড়ে আনিয়েছিলাম না সেদিন? তখন তাদের থেকে রেখে দিয়েছি একটা। ওরাই শিখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে আগাগোড়া দেশি সাপ পুষতে হয়। দ্যাটস অল! আর কিছু জানার আছে?’

শেহজাদ সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়েও যেন হালকা হতে পারেনি। বারবার নিঃশ্বাস ফেলছে। তার সংশয় হচ্ছে, যদি এ সাপ ঘরের কারো ক্ষতি করে ফেলে? শেহজাদ এবার কিছুটা রেগে যায়। মেহজাদের দিকে চেয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে ধমক দিয়ে বসে,
‘বিদেশি সংস্কৃতি দেশে খাটাবে না। এ সাপ তুমি এক্ষুনি সাপুড়ের কাছে দিয়ে আসবে। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি।’
মেহজাদ আড়চোখে সাপের দিকে চায়। সাপের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘ভাইয়ার কথা অনুযায়ী তোকে দিয়ে আসবো চুচু?’
সাপ কি বুঝল কে জানে। ফণা তুলে শেহজাদের দিকে চেয়ে ফোঁসফোঁস করতে লাগল শুধু। শেহজাদ এসব দেখে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। এমন অদ্ভুত শখ কারো হতে পারে, এটা শেহজাদের মোটেও জানা ছিল না। শেহজাদ চেতে উঠে বলল,
‘ওকে কি জিজ্ঞেস করছ? ও বুঝে কিছু? আমি যা বলছি সেটা করো এক্ষুনি।’
মেহজাদ শুনল না মোটেও। আলগোছে সাপ বানানো কাঠের ঘরের ভেতরে পুড়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর শেহজাদের দিকে চেয়ে বলল,

‘ভয় পেও না। চূচু আমাদের ঘরের মানুষকে ক্ষতি করবে না। ইনফ্যাক্ট ও আদেশ না পেলে কারো ক্ষতিই করবে না। আমি ওকে ট্রেনিং দিয়েছি। আমার এসব পোষার অভ্যাস প্রায় পাঁচ বছরের। ও থাকুক, আমি কথা দিচ্ছি ও আমাদের অনেক কাজে আসবে। যদি ও কারো ক্ষতি করে আমি এর দায়ভার নেব। প্রমিজ!’
শেহজাদ হয়ত এবার কিছুটা আশ্বস্ত হল। তবুও মনের সংশয় শেষ হয় না তার। সে জিজ্ঞেস করল,

‘দরজা লক করে রাখো । ঘরে ছিদ্র থাকলে বন্ধ করো। যেন দরজা কেউ খুলে না দেওয়া অব্দি এটা ঘর থেকে বেরুতে না পারে। আর এ ঘরে এমন এক জায়গায় রাখো, যেন তুমি এবং আমি ছাড়া আর কেউই এটা সম্পর্কে জানতে না পারে। আমাদের প্রকাশ্য শত্রুর চেয়ে গোপন শত্রু বেশি। কার মনে কোন ষড়যন্ত্র চেপে বসে বলা যায় না। এ পোষ্য আমাদের কাজে আসবে অবশ্যই।’

মেহজাদে হালকা হেসে মাথা নাড়ল। শেহজাদ একবার কাঠের ঘরের দিকে চেয়েই উঠোন থেকে ঘরে চলে গেল। মেহজাদে হালকা আওয়াজে বিড়বিড় করে গান গাইতে গাইতে তার বানানো কাঠের ঘর নিজের দুহাতে তুলে চলল তার অতীব গোপন আস্তানায়!

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৬

শেহজাদ ঘরে ঢুকে চেয়ে রইল মেহজাদের চলে যাবার দিকে। ঠোঁটে হঠাৎ ভেসে উঠল কুটিল হাস। মেহজাদে না চাইতেই শেহজাদের হাতে এক চালাক অস্ত্র তুলে দিয়েছে। এখন শেহজাদ যা চাইবে, তাই হবে! যেমন চাইবে, তেমন হবে। শেহজাদ আয়ুষ্মানকে এখন ঠেকায় কে? শেহজাদ হেসে উঠে!

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৮