খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩০

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩০
আভা ইসলাম রাত্রি

ফজরের নামাজের জন্যে মসজিদে গেছেন আয়ুষ্মান বাড়ির পুরুষরা। শেফালি এবং রেখা রান্নার দিক দেখছেন। চিত্রাকে পাঠিয়েছেন ঘর গুছানোর জন্যে। তরিগরি করে কাজ গুছাচ্ছে সবাই। দুপুরে খাবারের দাওয়াত রয়েছে মেয়েপক্ষের বাড়ি। যোহরের নামাজ পরেই রওনা দিবেন সবাই মেহজাদের উদ্দেশ্যে মেয়ে দেখতে। চিত্রা ভারি দেহ নিয়ে দ্রুতপদে কাজের লোকদের দিয়ে ঘর পরিষ্কার করাচ্ছে।

তবে বাড়ির মহিলাদের মত করে কি কাজের লোকেরা কাজ করে? তাই না চেয়েও চিত্রাকে হাতে হাত লাগাতে হচ্ছে। উঁচু হতে পারে না চিত্রা, পেটে টান পরে। তবুও যতটা পারছে করছে সব। চিত্রা কাজ করার ফাঁকে একবার মেহজাদের ঘরে টোকা দেয়। সারারাত উর্বশীর সঙ্গে আলাপ করে ফজরের একটু আগেই ঘুমিয়েছে সে। ঘুমে এতটাই পাগল ছিল সে, শেহজাদ নামাজে যাবার আগে কয়েকবার ডেকেছে মেহজাদকে। ঘুম ছেড়ে উঠা তো দূরের কথা, জবাব অব্দি দেয়নি সে। শেহজাদ এ নিয়ে কিছুটা চটে আছে বটে। নামাজ শেষে ভাইয়ের সঙ্গে বোঝাপড়া হবে তার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চিত্রা ভারি দেহ টেনে মেহজাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রার কণ্ঠ শুনে মেহজাদ না চাইতেই ঘুমের ঘোরে জবাব দেয়। চিত্রা দরজার ওপাশ থেকে বলে,
‘দেরবজি, আমি। দরজা খুলো। ঘর পরিষ্কার করব।’
চিত্রা আপাতত মেয়ে দেখার ব্যাপার বললো না। মেহজাদ ভেতর থেকে ঘুমঘুম গলায় উত্তর দেয়,
‘ঘুমাচ্ছি ভাবিজান, পরে আসেন।’

চিত্রা দমে থাকল না। শেহজাদ নামাজে যাবার আগে দায়িত্ত্ব দিয়ে গেছে মেহজাদের ঘুম ভাঙ্গানোর। নাহলে যে বাড়িতে যুদ্ধ ঘটে যাবে। তাই ভারি দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হলেও সরে গেল না চিত্রা। দরজায় টোকা দিয়ে আবারও আওয়াজ দিল,

‘আমার পা ব্যথা করছে। আমি কি দাঁড়িয়েই থাকব এভাবে?’
চিত্রার এ কথা শুনে লাফ দিয়ে উঠে বসে মেহজাদ। সে ভুলেই বসেছিল, ভাবিজান গর্ভবতী। এ সময় এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা তার জন্যে কষ্টসাধ্য। মেহজাদ ঘুমে পাগল আপাতত। চোখ দুখানা টকটকে লাল হয়ে আছে। যেকেউ দেখে বুঝে যাবে, সারারাত সে ঘুমায়নি। এলোমেলো চুল কপালে ছড়িয়ে আছে। কোনরকম উদোম গায়ে টিশার্ট পরে দু চোখ ডলা দিয়ে উঠে দরজা খুলে দেয় সে।

‘ভাবিজান, ভেতরে আসুন।’
চিত্রা কাজের লোকের কাছে থেকে ঝাড়ু নিয়ে মেহজাদের ঘরে প্রবেশ করল। জোয়ান পুরুষের ঘরে তো মহিলা মানুষ ঢুকানো যাবে না। তাই নিজেই কাজ শেষ করবে ভাবল। মেহজাদ চিত্রার হাতে ঝাড়ু দেখে বলল,
‘এ সময় আপনি কেন ঝাড়ু দিবেন? কাজের লোক কোথায়?’

চিত্রা এগিয়ে গিয়ে বিছানা ঠিক করতে লাগল। বলল,
‘কাজের লোক লাগবে না, এটুকু আমি করে নেব। তুমি গোসল করে নাও। দুপুরে বের হব আমরা সব।’
মেহজাদ এতকিছু শোনার ধৈর্য্য নেই। এগিয়ে গিয়ে চিত্রার হাতের থেকে বিছানার কোণ নিজের হাতে জোর করে নিয়ে বলল,

‘আপনি বসুন আমি বিছানা ঠিক করছি। এটুকু আমি সবসময়ই করি আমেরিকায়।’
চিত্রা বসতে চাইল না। পুরুষ মানুষ ঘরের কাজ করছে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে জোর করে মেহজাদের হাত থেকে বিছানার চাদর নেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
‘এ কি করছ? দাও দাও, আমি করছি।’

মেহজাদ চিত্রার দিকে চাইল। বিছানার চাদর হাতেই এগিয়ে গিয়ে চেয়ার নিয়ে চিত্রাকে জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দিল। চিত্রার ডাগর ডাগর চোখে চেয়ে দেখল। পরপরই বিছানা ঠিক করতে লেগে গিয়ে বলল,
‘ভাবিজান, আপনার মধ্যে আমার ভাইয়ের একমাত্র ছেলে এবং আমার চ্যাম্প বড় হচ্ছে। কাজ করলে সে শুকিয়ে যাবে, শুকনো শরীরে ও ওর চাচাজানের সাথে বক্সিং করতে পারবে না। কিন্তু আমি তো ওর জন্মের আগেই ভেবে নিয়েছে, ওকে বক্সিং চ্যাম্পিয়ন বানাব। চাচা ভাতিজা মিলে একসঙ্গে বক্সিং খেলব। দারুন না ব্যাপারটা?’

মেহজাদের কথা শুনে আবেগে চোখে জল জমে চিত্রার। নিজের পেটের দিকে চেয়ে হালকা হাসল ও। কত ভাগ্যবান তার সন্তান। জন্মের আগেই ভালোবাসায় কানায় কানায় পূর্ণ হচ্ছে। মেহজাদ ততক্ষণে বিছানা গুছিয়ে নিয়েছে। ঘর ঝাড়ু দিতে শুরু করেছে। চিত্রা চেয়ারে বসে মেহজাদের এসব কাজ দেখে যাচ্ছে। পটু হাতে মেহজাদকে ঘরের কাজ করতে দেখে চিত্রা জিজ্ঞেস করল,

‘আমেরিকায় কাজের লোক নেই? তুমি কাজ করতে কেন? পুরুষরা মহিলাদের কাজ করে কখনো?’
মেহজাদ ঘরের সকল ময়লা ঝাড়ু দিয়ে একপাশে রাখে। সিলিং এবার ঝাড়ু দিতে দিতে উত্তর দিল,
‘সবাই তো আপনার স্বামীর মত নেতা না। ওখানে সাধারণ মানুষরা নিজের কাজ নিজেই করে। ওখানে ছেলে মেয়ে ব্যবধান নেই। যার যার কাজ, তার তার। তাছাড়া আমি তো একা থাকতাম না? ঘর পরিষ্কার থেকে শুরু করে রান্নাবান্না সব আমি করতাম। আমি কিন্তু নানা পদের রান্না পারি। একদিন আমি আপনাকে স্টিক অ্যান্ড বার্বিকিউ করে খাওয়াব। চেকে দেখবেন পুরুষের রান্নার স্বাদ কেমন। আপনার স্বামী কিন্তু রান্না পারে না, আমি আবার সর্বগুণে গুণান্বিত।’

মেহজাদের কথা শুনে চিত্রা শব্দ করে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসে। মেহজাদ ঘর পরিষ্কার করে একদম ঝকঝকে করে ফেলে। তারপর ঝাড়ু এনে চিত্রার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
‘এ বাড়ির পুরুষরাও কাজ করতে জানে, এসব আবার আম্মাজানকে বলতে যাবেন না। খামোকা চেঁচাতে লাগবেন। এটা আমার আর আপনার সিক্রেট, ঠিকাছে?’

চিত্রা হাসল এবং মাথা নেড়ে সায় জানাল। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘সকাল সকাল একটা খারাপ খবর দিতে আসলাম। তোমার জন্যে মেয়ে দেখা হবে আজ, দুপুরে বের হচ্ছি আমরা সবাই।’
মেহজাদ যেন আঁতকে উঠল। সত্যি বলতে এমন কিছু শোনার জন্যে সে এই মুহূর্তে প্রস্তুত ছিল না। সে মৃদু শব্দে চিৎকার দিয়ে দু কদম চিত্রার দিকে এগিয়ে এসে তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘আমি কাজ পারি ঠিকাছে, কিন্তু বউ পালতে পারব না এখন। ওদের না করে দিবেন আপনি। আমি এখন কোনো বিয়ে-ফিয়ে করতে পারব না।’

চিত্রা দু কাঁধ উঁচু করে বোঝাল, তার হাতে কিছুই করার নেই। মেহজাদ ভয়ে আতঙ্কে বিছানায় ধপ করে বসে পরল। মাথার ঘন চুল খামচে ধরে নত মুখে বলল,
‘ওহ নো, গতরাতের কথা ভাইয়া সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছেন। আমি ফেঁসে গেছি। উফ!’
পরপর বিছানা থেকে উঠে চিত্রার দিকে দৌঁড়ে এসে বলল,
‘ভাবিজান, ভাইয়াকে আপনি বোঝান। বউ হয়েছেন না? অধিকার দেখান, বলবেন আপনার ছোট ভাই এখনো অনেক ছোট। সে বিয়ে করবে না এখন। ঠিকাছে?’
চিত্রা অসহায় চোখে চেয়ে উত্তর দিল,

‘তোমার ভাইয়া আমার এ কথা শুনবেন বলে তোমার মনে হয়? তিনি কখনো কারো কথা শুনেন?’
মেহজাদ অধৈর্য্য গলায় বলে,
‘কিন্তু আপনি তো তার বউ। আপনার কথা কেন শুনবে না?’
চিত্রা বিপাকে পরে যায়। এখন তার দেবরকে কিভাবে বলবে, চিত্রার কোলে মাথা রাখার জন্যে যে মানুষ আদ্র গলায় কথা না বলে আদেশ করে বসে, স্ত্রীকে স্পর্শ করার ক্ষেত্রে যে উষ্ণ কথা না বলে আদেশ করে যায় অনবরত, তাকে আদেশ করবে চিত্রা স্বয়ং? চিত্রা মেহজাদের দিকে চেয়ে বলল,

‘দ্রুত উর্বশীর কথা জানিয়ে ফেলো তোমার ভাইকে। নাহলে তোমার ভাইয়া ধরে বেঁধে গ্রামের কারো সঙ্গে তোমার বিয়ে পরিয়ে দেবেন, এতে সন্দেহ নেই। তুমি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করো বসে, আমি আসছি। কাজ আছে।’
চিত্রা মেহজাদের চোখের দিকে চেয়ে ভরসা দিয়ে বেরিয়ে পরল ঘর ছেড়ে। মেহজাদ সটান বিছানায় শুয়ে পরল। দুহাতে চোখ ঢেকে চিন্তা করতে লাগল কি করবে এখন!

আয়ুষ্মান মহলের চৌদ্দ-টা ঘর পরিষ্কার করিয়ে নিজের ঘরে এলো এবার চিত্রা। শেহজাদের বিছানা গুছিয়ে ঘর ঝাড়ু দিতে শুরু করল। সেসময়ই নামাজ শেষ করে পাঞ্জাবি গায়ে ঘরে ঢুকল শেহজাদ। চিত্রাকে ঝুঁকে কাজ করতে দেখে সে এসেই রাগ দেখাল,
‘বাড়িতে কাজের লোক নেই? কতবার বলেছি ঝুঁকে কাজ করবে না।’
চিত্রা শেহজাদের আকস্মিক ধমক শুনে আঁতকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল। শেহজাদ টান মেরে চিত্রার হাত থেকে ঝাড়ু নিয়ে সজোরে ডাকতে লাগল,

‘এ কে আছো? শুনে যাও!’
সঙ্গেসঙ্গে চিত্রা এগিয়ে গেল। শেহজাদের বাহুতে হাত রেখে বলল,
‘কি করছেন? ওদের ডাকছেন কেন? আমিই ওদের না করেছি। এটুকু কাজ আমি করে নেব, বেশি ঝুঁকিনি তো।’
শেহজাদ তীক্ষ্ম চোখে চাইল চিত্রার দিকে। চিত্রা ওমন চাওনি দেখে ঢোক গিলে। শেহজাদের চোখ যেমন একদিকে চিত্রার জন্যে নেশা, তেমনি তার রাগান্বিত চোখ চিত্রার ভয়েরও কারণ। রেগে যাচ্ছেন দেখে শেহজাদের দিকে কিছুটা ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে মিনমিন করে বলল চিত্রা,

‘আমার স্বামীর ঘরে অন্য কারো ছোঁয়া লাগুক, আমি চাইনা। কেউ আপনার সামনে ঝুঁকে কাজ করলে আমার ভালো লাগবে না। ঝুঁকে কাজ করলে শরীরের কত কিছু দেখা যায়। আপনি সেসব দেখেন আমি চাইনা।’
শেহজাদ চিত্রার নত মুখের দিকে চেয়ে আছে। এতক্ষণ তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে থাকা ভ্রু সোজা হয়ে এল। ঠোঁটে ফুটল কৌতুকভরা হালকা হাসি। পরপরই সে হাসি মিলিয়েই গেল। শেহজাদ আলগোছে চিত্রার শাড়ির ফাঁকে কোমরে হাত রাখল।

চিত্রা ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠে সেটে গেল শেহজাদের গায়ের সঙ্গে। শেহজাদ মাথা নামিয়ে ফিসফিস করে প্রশ্ন করল,
‘তুমি কেন ঝুঁকে কাজ করছিলে আমার সামনে? আমি দেখব বলে? গতরাত জান্নাতের সফর করিয়েও শান্তি পাচ্ছ না?’
চিত্রা বিস্মিত হয়। এতকিছু ভেবে এসব কথা বলেনি ও। লজ্জায় চোখ তুলে আর তাকাতে পারে না ও। ধরা গলায় শুধায়,
‘এত কথা কেন বলেন? লজ্জা না দিলে ভালো লাগে না বুঝি?’

শেহজাদ যেন চিত্রার কথায় দারুন মজা পেল। হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘নারীকে লজ্জাতেই মানায়, কঠোরতায় নয়। এখন আমাকে ছাড়বে? নাকি সম্মেলনে যেতে দেরি হব!’
চিত্রা হতভম্ব চোখে নিজের আঙ্গুলের দিকে তাকাল। দুহাতে আঙ্গুল দ্বারা শেহজাদের বুকের পাঞ্জাবি খামচে ধরে ছিল এতক্ষণ। সঙ্গেসঙ্গে চিত্রা ছেড়ে দিল শেহজাদের পাঞ্জাবি। শেহজাদ পাঞ্জাবির কলার টেনে পাঞ্জাবির কুঁচকে যাওয়া ভাঁজ ঠিক করে নেয়। ঝাড়ু ধপাস করে মাটিতে রেখে নতুন পাঞ্জাবি পরতে পরতে আদেশ করে,

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৯

‘আমি বেরিয়ে গেলে কাউকে এনে ঘর ঝাড় দেওয়াবে। একটা কথা মাথায় রাখবে, তোমার স্বামীর এক নারীকে দেখে তৃপ্তি মেটে না। অন্য নারীর শখ পোষার সময় তার নেই। এখন যাও, আমার নাস্তা তৈরি করো। আমি খেয়ে বেরিয়ে যাব।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩১