খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৯

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৯
আভা ইসলাম রাত্রি

গভীর রাতে মেহজাদের ঘর থেকে ক্রমশ নিচু স্বরে চিৎকার–চেঁচামেচির শব্দ আসছে। কদিন ধরে উর্বশীর সঙ্গে বোঝাপড়া ভালো যাচ্ছে না। উর্বশী আগে মেহজাদকে বুঝলেও, দেশে আসার পর উর্বশীর মনে সন্দেহের দানা বেঁধেছে। নারী ততক্ষণই মিষ্টি থাকে, যতক্ষণ তাদের মধ্যে সন্দেহ না আসে। সন্দেহ একটা সম্পর্ককে ম্যাচকাঠির ন্যায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলে। মেহজাদ প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আজ যেন সকল ধৈর্য্যের বাঁধ যেন ভেঙেছে। মেহজাদ মাথা ঠাণ্ডা করে পুনরায় বোঝায়,

‘ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, গার্ল। আমি দেশে রিলেশন করতে আসিনি,ভাইয়া জোর করে এনেছে। এখন ফেঁসে গেছি এ দেশে। বারবার একই কথা বোঝাতে ভালো লাগে বলো?’
উর্বশী এবার মেনে নেয় না এসব কথা। জেদ দেখিয়ে হিন্দি ভাষায় আওড়ায়,
‘তাহলে তোমার পরিবারকে আমার কথা এখনো জানাচ্ছ না কেন? কতদিন আমরা এভাবে রিলেশনে থাকব, আমাদের এবার বিয়ে করা উচিৎ, মেহজাদ।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘বিয়ে করব তো, প্রমিজ। আমাকে সময় দাও। আই উইল! আমার পরিবারের কথা তো তোমায় আগেই বলেছি। তুমি অন্য ধর্মের, আমি মুসলিম। আমাদের ধর্মে বাঁধা আছে আমাদের বিয়ে নিয়ে। ভাইয়া মানবে না। চাচাজানের ছেলের উপর এখনো সবাই ক্ষেপে। আর আমি এটা করলে আমাকে ত্যাজ্য করবে।’
‘করুক ত্যাজ্য। তোমার রেজাল্ট ভালো, আমেরিকায় ভালো চাকরি পাবে, আমিও চাকরি নেব। আমরা একসঙ্গে ছোট সংসার সাজাব। ছেড়ে দাও তোমার পরিবারকে। আমেরিকায় এটা প্রিটি নরমাল।’

উর্বশীর এহেন কথায় প্রচন্ড মেহজাদ রেগে যায়। গলার স্বর আর এবার নিচু থাকে না। সজোরে ধমক দিয়ে বলে,
‘পাগল হয়েছ তুমি? জান চলে গেলেও আমি আমার পরিবারকে ছাড়তে পারব না। তোমার মত হাজারটা মেয়ে বললেও নয়। ছোট থেকে ভাইয়াকে দেখেছি পরিবারের মানুষের জন্যে স্বার্থহীন ভাবে কাজ করতে। আমার পরিবার আমাকে শিক্ষা দেয়নি যে মেয়ের জন্যে পরিবার ছেড়ে দেওয়ার, সেই সঙ্গে এটাও শিক্ষা দেয়নি ভালোবাসার মানুষকে ঠকাতে। তুমি যেমন আমার জন্যে ইম্পর্ট্যান্ট, তেমনি আমার পরিবারও। আমি ভাবতে পারছি না তুমি এটা কিভাবে বললে, হাও কুড ইউ?’

উর্বশী মেহজাদের রাগান্বিত স্বর শুনে কিছুটা দমে গেল। ভয়ের অনুভূতি ছড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গে। আর কেউ না জানুক, উর্বশী জানে মেহজাদের রাগ কেমন! রেগে গেলে পশুর ন্যায় হয়ে যায় মেহজাদ। সে রাগে না দ্রুত, তার রাগ উঠতে সময় লাগে। কিন্তু যখন রেগে যায়, চারপাশ লন্ডভন্ড করে ফেলে। উর্বশী তাৎক্ষণিক নিজেকে সামনে অপরাধবোধ নিয়ে বলে,
‘সরি, ম্যাই ব্যাড। আমি ফ্রাস্টেশনে বলে ফেলেছি। কিন্তু আমার দিক বুঝো তুমি। আমি কতদিন এভাবে থাকব। বাবা–মা বারবার তোমার কথা জিজ্ঞেস করে, আমাদের বিয়ের খবর জানতে চায়। কি উত্তর দেব আমি তাদের?’

উর্বশী নরম মনের মেয়ে। না বুঝে বলে ফেলেছে। মেহজাদ সেটা বুঝে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। দু চোখ বুঁজে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘আঙ্কেল–আন্টির চিন্তা আমি বুঝি। আমি চেষ্টা করছি উর্বশী। পরিবারকে হারানোর ভয় আছে আমার মধ্যে। তেমনি তোমাকেও আমি হারাব না। কিছুটা সময় দাও। বাড়ির সবাই আজকাল খুব চিন্তায়। এরমধ্যে আমি তোমার কথা বলতে পারব না।’

উর্বশী এবার চিন্তিত হয়ে পরে। জিজ্ঞেস করে,
‘কি হয়েছে তোমার বাড়িতে?’
‘ভাবিজানের বাচ্চা হবে। উনার শরীর খুব একটা ভালো না, ডেলিভারিতে রিস্ক আছে। বাড়ির সবাই ভাবিজানকে নিয়ে ব্যস্ত এখন।’

উর্বশী এবার মিইয়ে যায়। মন খারাপী নিয়ে বলে,
‘তোমার বয়সী হয়ে তোমার ভাইয়ার বাচ্চা হবে। আর তুমি এখনো বিয়েই করো নি। বয়স পেরিয়ে গেলে বিয়ে করেই বা কি হবে?’

মেহজাদ উর্বশীর চিন্তার কারণ ধরতে পেরে মনেমনে কৌতুক অনুভব করে। ঠোঁট টিপে হালকা হেসে সে বলে,
‘চিন্তা নেই, ছেলেদের ৬০/৬৫ বছর পর্যন্ত ভরা যৌবন থাকে।’
উর্বশী মেহজাদের কথা শুনে হেসে ফেলে শব্দ করে। মন খারাপি যেন হুহু করে পালায়। উর্বশী নিভু স্বরে বলে,
‘ঠাট্টা করায় উস্তাদ তুমি। আচ্ছা শুনো —-‘
উর্বশীর কথা শেষ হওয়ার আগে মেহজাদের দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। মেহজাদ সতর্ক হয়ে যায় সঙ্গেসঙ্গে। ফিসফিস করে উর্বশীকে বলে

‘কেউ এসেছে, একটু পর কথা বলছি।’
উর্বশী কিছু বলার আগে মেহজাদ কল কেটে ফেলে। সে গলার স্বর ঘুমঘুম করে জিজ্ঞেস করে,
‘কে?’
ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে, ‘আমি,দরজা খুলো।’

শেহজাদের কণ্ঠ শুনে মেহজাদ ভয়ে এক লাফে উঠে বসে পরে। এত রাতে শেহজাদ এ ঘরে এসেছে কেন? মেহজাদ চারপাশ অসহায় চোখে দেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা। শেহজাদ আদৌ সব শুনেছে কি না সন্দিহান সে। শুনলে আজকে আয়ুষ্মান মহলে একটা লাশ বেরুবে, সেটা হচ্ছে মেহজাদ আয়ুষ্মানের। হারাম সম্পর্ক শেহজাদ কখনো গ্রাহ্য করে না। আর যদি সেটা মেহজাদ হয়, তাহলে শেহজাদ আজকে মেরেই ফেলবে তাকে। মেহজাদ কেশে গলার স্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে উঠে দরজা খুলে দেয়। শেহজাদকে ঠাই দাঁড়িয়ে দেখে হামি তুলে ঘুমঘুম কণ্ঠে বলে,

‘এত রাতে আমার ঘরে কেন ভাইয়া? ঘুম ভাঙিয়ে দিলে কেন?’
শেহজাদ আপাদমস্তক মেহজাদকে দেখে নিল। একটু উঁকি দিয়ে ঘরের ভেতর দেখার চেষ্টা করলে মেহজাদ সোজা হয়ে শেহজাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘এত রাতে কার সঙ্গে কথা বলেছিলে?’
আচমকা এ কথায় চমকে যায় মেহজাদ। সে মনেমনে এই ভয়টাই পাচ্ছিল। কিন্তু চেহারায় সেরকম কোনো ভয়ার্ত ভাব না ফুটিয়ে মেহজাদ নিছক স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,

‘কারো সঙ্গে না তো। তুমি ভুল শুনেছ।’
শেহজাদ তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলে,
‘আবারও মিথ্যা বলছ। জানো না মিথ্যা বলা —-‘
‘কবিরা গুনাহ, জানি ভাইয়া।’
শেহজাদ পুরো কথা বলার আগে মেহজাদ তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠে। শেহজাদ আদেশ করে,
‘তোমার ফোন নিয়ে আসো, আমি দেখব কি করছিলে এত রাতে।’
মেহজাদ পেছনে ঘুরে বিছানার উপর নিজের আনলক করা ফোন পরে থাকতে দেখে নেয়। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে শেহজাদের দিকে চেয়ে কথা ঘুরানোর উদ্দেশ্যে বলে,

‘ভাইয়া, ভাবিজানের ডাক শুনলাম। তোমাকে ডাকছেন বোধহয়।’
শেহজাদ বুঝতে পারে মেহজাদের চালাকি। সে পাত্তা না দিয়ে বলে,
‘তোমার ভাবিজান ঘুমে। বোকা বানাবে না আমাকে। ফোন নিয়ে এসো, যাও।’
মেহজাদ হাল ছেড়ে দেয় এবার। ফোন এনে শেহজাদের কাছে তুলে দেওয়া মানে, নিজের মৃত্যুর আদেশ শেহজাদের হাতে তুলে দেওয়া। মেহজাদ না পেরে বলে,

‘আমার ফোনে প্রাইভেট অনেক কিছু আছে। তুমি দেখলে লজ্জা পাবে।’
শেহজাদ হতভম্ব হয়ে পরে এক মুহূর্তের জন্যে। যা ভাবছে তাই সঠিক হয়ে যাচ্ছে দেখে শেহজাদ নিরাশ। সে প্রশ্ন করে বসে,
‘তুমি কি কোনো হারাম সম্পর্কে আছো? নাউজুবিল্লাহ!’
মেহজাদ অসহায় চোখে শেহজাদের দিকে তাকায়। শেহজাদ যা বোঝার বুঝে নেয়। রেগে উঠে সে। মেহজাদের দিকে আঙ্গুল তুলে রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,

‘আল্লাহকে আদৌ ভয় করো তুমি? আমি না দেখি, উপরে একজন দেখছেন সব। হারাম মানে হারাম, সেটাকে কোনোভাবেই হালাল করা যায় না। মেয়েটা কে, কি পরিচয়? আমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দাও। তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দেই। এভাবে হারাম সম্পর্কে থাকলে তুমি যেমন গোনাহগার হবে, অভিবাবক হিসেবে আমরাও সমান গুনাহগার হব। তার চেয়ে বিয়ে করা ভালো।’

মেহজাদ কি বলবে ভেবে পায় না। এখন উর্বশীর সম্পর্কে মিথ্যা বলা সম্ভব না। শেহজাদের লোকবল প্রবল। মুহূর্তেই ধরে ফেলবে উর্বশীর বংশ থেকে শুরু করে তার সমস্ত বায়োডাটা। মেহজাদ কোনো রিস্ক নিবে না। একটা পরিপূর্ন পরিকল্পনা সাজিয়ে শেহজাদকে জানাবে। মেহজাদ তাৎক্ষণিক একটা মিথ্যা কথা বলে,
‘ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে আজকে। শেষবারের মত কথা বলছিলাম। খামোকা এত গভীরে যাবার দরকার নেই।’

শেহজাদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হয়ত বিশ্বাস করার চেষ্টা করছে মেহজাদের কথা। সে ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়ে মেহজাদের চোখের ভেতর দেখে, তীক্ষ কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
‘সত্যি বলছ নাকি —-‘
মেহজাদ হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘সত্যি, তোমার সঙ্গে মিথ্যা বলার সাহস নেই আমার।’

শেহজাদ শুনে। সারাজীবন রাজনীতিতে অনেক রহস্য খোলাসা করায়, মেহজাদের এ কথা তার বিশ্বাসযোগ্য হয়না। আয়ুষ্মান মহলে ইদানিং এমন অনেক কিছুই হচ্ছে যা সম্পর্কে শেহজাদ জানে না। কিন্তু শেহজাদ এটা জানে, কি করে এসব রহস্যের সমাধান করতে হয়। শেহজাদ কিছু একটা ভেবে নেয় সেইসময়ই। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে মেহজাদকে ঘুমাতে বলে সেই সময়ের মত নিজের ঘরে যায়।

চিত্রা বাথরুমে যাবে বলে উঠেছিল রাতে। ঘরে প্রবেশ করে শেহজাদ বিছানায় চিত্রাকে দেখে না। অতঃপর বাথরুমে কলে চাপ দেওয়ার শব্দ শুনে। সে বুক টানটান করে ইজি চেয়ারে গিয়ে বসে। চিত্রা বাথরুম থেকে বেরিয়ে শেহজাদকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে ব্যস্ত পায়ে।
শেহজাদ ইজি চেয়ারে বসে দুলছে। দু চোখ বুঁজে রেখে গভীর কিছু একটা চিন্তা করছে। চিত্রা এগিয়ে গিয়ে শেহজাদের বাহুতে হাত রেখে নরম কণ্ঠে প্রশ্ন করে,

‘ঘুমাবেন না? এত রাতে কি চিন্তা করছেন?’
শেহজাদ চোখ বন্ধ অবস্থায় গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘আগামীকাল তৈরি থাকবে, মেহজাদের বিয়ের জন্যে মেয়ে দেখতে যাব।’
চিত্রা হতভম্ব হল। শেহজাদের দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে শেহজাদের পাশে হাঁটু গেরে বসে বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘হঠাৎ করে?’

চিত্রার দিকে চায় শেহজাদ। এ অবস্থায় চিত্রাকে এভাবে মাটিতে বসা বারণ, তাই শেহজাদ সেটা দেখে বলল,
‘মাটিতে এভাবে বসবে না, ঝুঁকি আছে।’
চিত্রা শেহজাদের কথা শুনে নিজের দিকে তাকাল। পরপর নিজেকে এমন বোকামো করতে দেখে দাঁত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে উঠে দাঁড়াল দ্রুত,

‘বসার জায়গা ছিল না, তাই এভাবে বসে পরেছি। আপনি কি যেন বলেছিলেন?’
চিত্রার কথা শোনার শেহজাদের আপাতত ধৈর্য্য নেই। সে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে নিল। বিছানা চেয়ার থেকে বেশ দূরে। চিত্রাকে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে জেনে কিছু না ভেবেই চিত্রার নরম হাত নিজের শক্ত হাতে চেপে ধরে আলগোছে নিজের কোলে বসিয়ে নিল। ইজি চেয়ার দুলে উঠল। চিত্রা তাৎক্ষণিক এমন আচরণে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল মৃদু শব্দে,

‘কি করছেন? পরে যাব তো। এটা দুলছে কেন এত? পরে যাচ্ছি আমি।’
চিত্রার হম্বিতম্বি আচরণ দেখে শেহজাদ হালকা ঠোঁট টেনে হেসে উঠে। পরপর চিত্রার কোমরে দুহাত পেঁচিয়ে নিয়ে তাকে আগলে নেয়। কানের কাছে ঠোঁট এনে শান্ত কণ্ঠে ফিসফিস করে,
‘স্ত্রীকে দুহাতে আগলে রাখতে এ হাতদুটোই যথেষ্ট। পরবে না, আমি ধরে রেখেছি।’

চিত্রা বরাবরের মত লজ্জায় কাবু হয়। শেহজাদ সদা এমন করে! গম্ভীর, কথা বলে কম আদেশ করে বেশি। কিন্তু যখন স্ত্রীর সংস্পর্শে থাকে, তার কথা যেন লাগাম ছাড়ে। চিত্রাকে অথৈ লজ্জার সাগরে ডুবিয়েই ছাড়ে। চিত্রা আলগোছে কোমরে রাখা শেহজাদের হাতের উপর নিজের হাত রাখে। চিত্রা সলজ্জে মিনমিনিয়ে বলে,
‘আমি ভারি হয়ে গেছি আগের থেকে!’
শেহজাদ হাতের বাঁধন সামান্য শক্ত করে। চিত্রার দিকে চেয়ে গম্ভীর স্বরে জানায়,
‘সামান্যই, এটুকু সহ্য করার দম শেহজাদ আয়ুষ্মানের আছে।’

চিত্রার মুখে আর কথা ফুটে না। নিশ্চুপ শেহজাদের কোলে বসে থাকে। একপর্যায়ে শেহজাদ চিত্রার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে পরম শান্তিতে চোখ বুঁজে। চিত্রার আবেশে ঘাড় সংকুচিত করে ফেলে। শেহজাদ হয়ত বিরক্ত হয়। ঘাড়ে ঠোঁট রেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা। চিত্রা শুনতে পায় না তেমন। লজ্জায় কাবু চিত্রা ডুবে যাচ্ছে শেহজাদের স্পর্শের আগুনে। এক সময় ভারসাম্য রাখতে চিত্রা শেহজাদের বুকে পিঠ দিয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে দু চোখ বুঁজে। নরম কণ্ঠে হঠাৎ শুধায়,
‘আমার যদি কিছু হয়ে যায়, আপনি কি করবেন নেতাশাহ। আরেকটা বিয়ে করবেন?’
শেহজাদ এ কথা শুনে কিছুটা থমকে যায়। চিত্রার কাঁধের থেকে ঠোঁট সরিয়ে চোখ রাখে চিত্রার বুঁজে থাকা দু চোখে। খানিক পর শান্ত স্বরে জানায়,

‘খামোকা চিন্তা মাথায় আনবে না, স্বাস্থের জন্যে ক্ষতিকারক। ঘুমাবে চলো।’
চিত্রার চোখ বেয়ে জল গড়ায়। শেহজাদ দেখে সব। নারী মন বোঝা কার সাধ্য! যেটুকু বুঝে, তাতেই কত রহস্য, কত ছল। শেহজাদ দীর্ঘক্ষণ চিত্রার মুখের অবয়বের দিকে চেয়ে থাকে। চিত্রা চোখের জল মুছে না। দু চোখ বুঁজে আনমনে উত্তর দেয়,
‘ঘুম আসতে চায় না আজকাল। ভয় করে শুধু।’
‘কি ভয়?’

শেহজাদ জেনেও প্রশ্ন করে।
‘এত সুখ হারিয়ে ফেলে নিঃস্ব হবার ভয়।’
শেহজাদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। সে জানে এমন কথাই চিত্রা বলবে। এ কারণেই, শেহজাদ চিত্রার জীবনের ঝুঁকির কথা চিত্রাকে বলতে চায় নি। অথচ মুখে কিছু না বলেও, চিত্রা সব বুঝে ফেলল। শেহজাদ চিত্রার চুলে হাত বুলায় পরম আদরে। বোঝায় তার মত করে,

‘ভয় নেই, শেহজাদ আয়ুষ্মান থাকতে তোমার সুখ কেড়ে নেবার সাহস কারো হবে না।’
চিত্রা হাসে। শেহজাদ এত আত্মবিশ্বাসী দেখে ভয় কিছুটা হলেও মিইয়ে যায় তার। চিত্রা শেহজাদের হাতের উপর হাত রেখে দু চোখ খুলে চায়। সরাসরি চোখ রাখে শেহজাদের নেশালো চোখে। সেই চোখ, যেই চোখে চিত্রা ডুবে যেতে চায় অবলীলায়। এক সময় চিত্রার চোখের নেশায় ডুবে যায় স্বয়ং শেহজাদ।

দুজনের চোখে ঘোর লাগে। শেহজাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে। চিত্রাকে দুহাতে পাজকোলে করে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়। সরে যেতে চাইলে, চিত্রা শেহজাদের ফতুয়ার কলার ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনে। শেহজাদ কিছু বলতে চায়, বলতে পারে না। চিত্রার চোখ যেন শেহজাদের কাতর কন্ঠে ডাকছে। শেহজাদ থমকে যায়। এই দু চোখের উপর শেহজাদ মারাত্মক দুর্বল সবসময়। চোখের মায়ায় ডুবিয়ে শেহজাদের সর্বস্ব হাতিয়ে নিতে সক্ষম এ দু চোখের মালিক।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ২৮

শেহজাদ এগিয়ে যায়। সাবধানে চিত্রার গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। চিত্রা কেঁপে উঠে, দু চোখ বেয়ে জলের রেখা বইয়ে যায়। চিত্রার কান্নার রহস্য শেহজাদ ধরতে পারে। সে আরো নিবিড় ভাবে চিত্রাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়। আজ রাতে চিত্রাকে শেহজাদ কোনো কিছু মনে করতে দেবে না। সমগ্র পৃথিবী থেকে নিজেদের আলাদা করে ফেলবে তারা আজ। অতঃপর ঠিক তাই-ই করল সে। চিত্রা সব ভুলে গেল, শুধুমাত্র মনে থেকে গেল তার স্বামী শেহজাদ আয়ুষ্মান।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩০