চৈত্রিকা পর্ব ৪৫

চৈত্রিকা পর্ব ৪৫
বোরহানা আক্তার রেশমী

পিয়াসের কবর দেওয়া হয় যোহরের নামাজের পর। চয়ন, সাদিক, প্রহর, চিত্র পিয়াসের পোস্টমর্টেম করতে দেয়নি। কেনো দেয়নি একমাত্র তারা ছাড়া আর কেউ জানে না। পিয়াসের জানাজায় তেমন একটা মানুষও ছিলো নাহ। পিয়াসের কবর দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়ার পর নীরা আর ঘর থেকে বের হয়নি।

যে মানুষটা মা’রা গেছে সে তো নীরার স্বামী ছিলো। এই মানুষটাকেই ভীষণ ভালোবাসতো নীরা। সময়ের তালে অবহেলায় ভালোবাসা ফিকে পড়ে গেলেও মনের মায়াটা এখনো রয়ে গেছে। সাদা শাড়ি পড়ে জানালার কাছ ঘেষে বসে আছে নীরা। একবার নিজের সাদা রঙের দিকে তাকিয়ে আরেকবার তাকায় আকাশের দিকে৷ হেঁসে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘একসময় চাইতাম তোমার রঙে নিজেকে রাঙাতে। হে আকাশ তাকিয়ে দেখো! তুমি আর আমি আজ শুভ্র রঙে একই রকম ভাবে সেজেছি। আমার ব্যাথা গুলো এভাবে শুভ্র রঙে পরিণত হবে তা আমি জানতাম। তবুও এতো কষ্ট কেনো হচ্ছে? আমার ভেতরটা এভাবে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে কেনো?’

নিজে প্রশ্ন করে নিজেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। উত্তর আসে না। আসবে কেমন করে? নীরা চোখ বন্ধ করে নেয়। চোখের কোণ থেকে টুপ করে দু ফোঁটা জল গড়ায়। নীরা জানালা থেকে সরে এসে টেবিল থেকে নিজের লেখা ডায়েরি হাতে নেয়। এক পলক কভারে তাকিয়ে হাসে। কভারের উপরে সুন্দর করে লিখা ‘আমার প্রিয় পুরুষ!’ নীরা বহুদিন বাদে ডায়েরী নিয়ে বসেছে। ঝাপসা চোখে পৃষ্ঠা উল্টে লিখতে শুরু করে,

‘আমার প্রিয় পুরুষ ছিলেন আপনি। আজ আর নেই। উহু! শুধু প্রিয়র তালিকাতে নয় যে এমন নয়! আপনি এই পৃথিবীতেই আর নেই। আমার ভাবতেও ভীষণ কষ্ট হয় জানেন! আমি কি চেয়েছিলাম আর কি হয়ে গেলো! আপনাকে পুরোটা চেয়েছিলাম আর আপনি আজীবন কল্পনা হয়েই থেকে গেলেন! আচ্ছা আপনার কি কখনোই মনে হয় আমার সাথে আপনার সুন্দর একটা জীবন হতো? হতো তো!

আপনি এতো এতো অ’ন্যায় না করলে আজ হয়তো আপনি আর আমিও ভীষণ সুখী হতাম। ভালো থাকতাম। আপনার জন্য মৃ’ত্যুটাও ভীষণ কম শা’স্তি জানেন তো! অথচ আমার ভেতরটা হাহাকার করছে আপনার শূণ্যতায়। পৃথিবী আমাকে এতো বড় শা’স্তি দিলো আপনাকে ভালোবাসার!

আমিই কেনো এতো শা’স্তি পেলাম? আপনাকে ভালোবেসে আমিই কেনো পেলাম না? কেনো আমার ভালোবাসা শেষ অব্দি হাহাকারেই আবদ্ধ থাকলো? পৃথিবীর ঘৃ’ণ্য মানুষটারও তো অধিকার থাকে ভালোবাসা পাওয়ার তবে আমি কেনো পেলাম না? আমাকে কেনো ভালোবাসলেন না? আমার না ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! দেখুন আমি কাঁদছি! আপনার জন্য কাঁদছি। আপনাকে ভালোবেসে ম’রার জন্য কাঁদছি। আমি ভেতর থেকে র’ক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছি পিয়াস!’

নীরা আর লিখতে পারে নাহ। কলম ফেলে মুখে হাত গুজে ওভাবেই কাঁদতে থাকে। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। পৃথিবীতে ভালোবাসার মতো সুখ যেমন কিছুতে নেই তেমনই এই ভালোবাসার মতো বিষাদও কিছুতে নেই। কি ভীষণ য’ন্ত্রণা! কি অসহ্য রকম হৃদয’ন্ত্রণা!

সারাদিন নিজেকে সামলে রাখলেও পল্লবী ছেলের কবর হওয়ার পর ঘরের দরজা আটকে কাঁদতে থাকে। ছেলে যতোই খারাপ হোক! তবুও তো তারই ছেলে ছিলো। মা সবসময় মা-ই হয়। অর্থি ঘরের বাইরে থেকে মায়ের কান্নার আওয়াজ পেয়েছে। মা’কে বিরক্ত না করে সরাসরি নিজের ঘরে যায়। সেখানে নিবিড় আগে থেকেই শুয়ে ছিলো। বেচারার এমনিতেই জ্বর তারওপর এতো ধকল নিতে পারছে নাহ। অর্থি নিজের কান্না গিলে নিবিড়ের পাশে বসে। কপালে হাত দিয়ে জ্বরটা দেখে ভাঙা গলায় বলে,

‘আপনার তো একটুও জ্বর কমেনি মাষ্টারমশাই। ডাক্তারের কাছে যাবেন না?’
নিবিড় চোখ মেলে অর্থির দিকে তাকায়। মেয়েটার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। যে মেজো ভাই তাকে এক ফোটাও ভালোবাসেনি সেই মেজো ভাইয়ের মৃ’ত্যুতেই মেয়েটা ভেঙে পড়েছে। কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। কন্ঠটা এখনো কেমন ভাঙা! নিবিড় রয়ে সয়ে নিজের মাথাটা অর্থির কোলে রেখে বলে,

‘দেখি! তোমার ভীষণ মন খারাপ তাই না অর্থি? মন খারাপ করো না বোকা মেয়ে। যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়। তোমার ভাই এমন কোনো ভালো কাজ আজ পর্যন্ত করেনি যার জন্য কেঁদে ভাসাতে হবে!’
অর্থি প্রাণহীনভাবে হাসে। নিবিড়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে। চোখ বন্ধ করে ছোট্ট করে বলে, ‘আমি তো অতো শতো বুঝি নাহ মাষ্টারমশাই।

হয়তো মেজো ভাইজানের মৃ’ত্যুটা সবার জন্যই ভালো তবুও সে আমার ভাইজান ছিলো। তাকে আমি বড় ভাইজান আর ছোট ভাইজানের মতোই ভালোবাসতাম। বাসি! আমি জানি উনি ভালো ছিলেন না তবুও উনি আমার ভাইজান ছিলেন। একটা সময় উনিও আমাকে একই রকম ভালোবাসতেন। জানি না বড় হয়ে কেনো বদলে গেলেন! কিন্তু আগে আমাকে সমান ভাবে ভালোবাসতো। আমি তো ভুলিনি সে সব স্মৃতি! তাই আমার মেনে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে।’

নিবিড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে অর্থির চোখের কোনা বেয়ে জল গড়াচ্ছে। মেয়েটা তখনো চোখ বন্ধ করেই রেখেছে। অর্থির চোখের পানি টুপ করে তার কপালের ওপর পড়ে। নিবিড় চোখ বন্ধ করে নেয়। আলগোছে মাথাটা তুলে অর্থির পাশে সোজা হয়ে বসে। এক হাতে অর্থিকে কাছে টেনে নিয়ে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে। অর্থি ভরসার জায়গা পেয়ে, স্বামীর প্রশস্ত বুক পেয়ে মুখ গুজে দেয়। কাঁদতে থাকে।

নিবিড়ের অদ্ভুত প্রশান্তি লাগে। উহু এটা শুধু এখন না! যতবার মেয়েটি তার বুকে মাথা রেখেছে ততবারই তার বক্ষপিঞ্জরের ঝড় থেমে সব শীতল হয়ে গেছে। নিবিড় ঠোঁট বাড়িয়ে অর্থির মাথায় চুমু খায়। অর্থি নিবিড়ের শার্ট চেপে ধরে কাঁদতে থাকে। কান্নার সময় একটু আদুরে অনুভূতি হলেই কান্না পায় মানুষের। এটা বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই হয়।

অর্থিও তাদের দলেরই। হিচকি তুলে কাঁদতে থাকে। নিবিড় শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে। চোখ বন্ধ রেখে বলে,
‘কাঁদবে না অর্থি। তোমার কান্না আমার সহ্য নাহ। তুমি যেখানে মাথা রেখে আছো ঠিক ওখানেই ব্যাথা করে। এই মেয়ে কান্না বন্ধ করো! তোমার মাষ্টারমশাইয়ের যে কষ্ট হয় এটা তুমি বোঝো না?’

অর্থি শুনলো। অন্যসময়ে হয়তো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বলতো ‘এখানে ব্যাথা কেমন করে হয় মাষ্টারমশাই? এখানে হৃদয় থাকে না? হৃদয় কোথায় একটু দেখি!’ কিন্তু এসময় কিছুই বললো নাহ। চুপচাপ পড়ে রইলো নিবিড়ের বুকে। নিবিড় মাথাটা খাটের সাথে এলিয়ে দিয়ে বলে,

‘মেয়ে তুমি আমাকে আজীবন পু’ড়িয়েই মা’রবে। আগেও পু’ড়িয়েছো এখন আমার হয়েও আমাকে পো’ড়াচ্ছো। কবে এই পো’ড়ানো বন্ধ করবে? কবে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আমাকে শীতল করবে? কবে?’

সনিয়া বেগম, আজম আলী কেউই জমিদার বাড়ি থেকে এখনো নিজ বাড়িতে যায়নি। তাদের মানসিক অবস্থার কথা ভেবে এই বাড়ির কেউ যেতেও দেননি। পিয়াসের মৃ’ত্যু খবর পেয়ে সনিয়া বেগম আর আজম আলী যতটা অবাক হয়েছেন ততটাই অবাক হয়েছে পিয়াসকে মা’রার ধরণ দেখে। এতো নৃ’শং’স! আচ্ছা এভাবে মা’রার সময় কি চৈত্রিকার হাত কাঁপেনি?

সনিয়া বেগম ভালো মতোই জানেন এই কাজটা চৈত্রিকা ছাড়া আর কেউ করবে নাহ। তাই সুযোগ বুঝে চৈত্রিকার কাছে আসে সনিয়া বেগম। তখন প্রহর ঘরে নেই। চৈত্রিকা নিজের ঘরে বসে আকাশ দেখছে। ঘরের দরজা খোলা-ই ছিলো। সনিয়া বেগম ঘরে প্রবেশ করতেই চৈত্রিকার এলোমেলো অবস্থা দেখে তাকিয়ে রইলেন। তার মাঝে আর কোনো রকম অনুভূতি কাজ করছে নাহ। মেয়েকে হারিয়ে তার সকল অনুভূতিও যেনো হারিয়ে গেছে। শীতল কন্ঠে চৈত্রিকাকে ডাকে,

‘চৈত্র!’
চৈত্রিকা চমকে ওঠে। পেছনে তাকিয়ে সনিয়া বেগমকে দেখে চোখ পিটপিট করে। সনিয়া বেগম কাছে এসে বসে। চৈত্রিকা শুধু তাকিয়ে থাকে। মায়ের মতো মামীর মুখ থেকে কিছু একটা শোনার অপেক্ষায় থাকে। নিজের মায়ের পর এই মানুষটাই তো আগলে রেখেছে, ভালোবেসেছে। অথচ তার জন্যই আজ এই পরিবারে শোকের ছায়া। বোনের মতো সাথী কবরে শুয়ে আছে। মায়ের মতো মানুষটা কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখের হাল বেহাল বানিয়ে ফেলেছে। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে ১ দিনেই৷ চুল, শাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে। চৈত্রিকা চোখ নামিয়ে নেয়। সনিয়া বেগম বলেন,

‘পিয়াস রেনওয়াজকে তুই মে’রেছিস তাই না?’
চৈত্রিকা উত্তর দেয় না। সনিয়া বেগম নীরবতাকেই সম্মতি ধরে নেন। কেমন অদ্ভুত ব্যস্ত স্বরে বলে, ‘আমার মেয়েটাকে ওই জা’নো’য়া’র’টাই মে’রেছে তাই না? আমার সাথী আ’ত্ম’হ’ত্যা করে নাই তাই না চৈত্র?’
চৈত্রিকা মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকায়। মাথা উপর নীচ নাড়ায়। সনিয়া বেগম পাগলের মতো চৈত্রিকার হাত জাপ্টে ধরে। চৈত্রিকা সনিয়া বেগমের চোখের দিকে তাকাতেই তিনি হাহাকার করে বলেন,

‘ওই জা’নো’য়া’রটা কেন মা’রলো আমার মেয়েরে? আমার মেয়েটা কি ক্ষ’তি করছিলো ওর? চৈত্র তুই তো ওরে ওর প্রাপ্য শা’স্তি দিয়া দিলি! কিন্তু আমার মেয়েটা কি ফিরবো? আমার মেয়েটার সাথেই কেন এমন হলো?’
চৈত্রিকা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সনিয়া বেগমকে। সনিয়া বেগম ডুকরে ওঠে। মেয়েকে হারিয়ে তিনি পা’গল হয়ে গেছেন যেনো! আহারে মা!

মায়েরা সন্তানদের এভাবেই ভালোবাসেন বুঝি! চৈত্রিকার চোখ ভিজে আসে। তবুও কান্না আটকায়। সনিয়া বেগম অনেকক্ষণ কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে চৈত্রিকার কোলেই শুয়ে পড়েন। নিচু স্বরে বলেন,
‘মেয়ে হারানোর শোকে তোরে কাল যা তা বলছি। কিছু মনে নিস না মা!’
‘মায়েরা সন্তানকে বকতেই পারে৷ এই বকাগুলো কিছুই না মামী।’

এরপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিড়বিড় করে বলে, ‘পিয়াস রেনওয়াজের মৃ’ত্যুর কাছে তোমার এই কথাগুলো কিছুই নাহ মামী। তোমার কথাগুলোতে যে পরিমাণ কষ্ট পেয়েছি ঠিক ততটাই শান্তি পেয়েছি শ’য়’তা’নটাকে মৃ’ত্যু দিয়ে। আহা মামী! কেনো যে তুমি চোখ ভরে দেখতে পারলে না সে দৃশ্যটা! কেনো যে মৃ’ত্যুর সময় পিয়াস রেনওয়াজের আ’ত্মার ছটফটানো টা দেখতে পারলে না!’

এর মাঝোই ঘরে আসে প্রহর। সনিয়া বেগম আর চৈত্রিকাকে এক সাথে দেখে একটু হাসে। প্রহরকে দেখামাত্রই সনিয়া বেগম তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ে। কোনো কিছু না বলেই বেড়িয়ে যেতে নেয় ঘর থেকে। প্রহর কিছু বলতে চেয়েও বলে না। চোখ মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে থাকে। চৈত্রিকা একবার সনিয়া বেগমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রহরের দিকে তাকায়। প্রহর গম্ভীর চোখে তাকিয়ে আছে।

চৈত্রিকা চোখ সরিয়ে নিয়ে আগের মতো আকাশ পানে তাকায়। প্রহর আলগোছে এগিয়ে যায় চৈত্রিকার কাছে। চৈত্রিকার পাশে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ঘাড় বাঁকিয়ে চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে দেখে তার কোনো হেলদোল নেই৷ নিজের মতো আকাশ দেখতে ব্যস্ত সে। একবারও ফিরে তাকালো না জমিদার সাহেবের দিকে। আচ্ছা এই কঠিন মনের মেয়েটা কি বুঝতেছে না তার জমিদার সাহেব কি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে! এই যে বুকের বাম পাশের চিনচিনে অনুভূতি বুঝি এই পা’ষাণ মেয়েটি সত্যিই বুঝতে পারে না! প্রহর বড় করে শ্বাস নেয়। শান্ত কন্ঠে শুধায়,

‘জমিদার সাহেবের থেকে বুঝি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছো?’
চৈত্রিকা অনুভূতিহীন হয়ে তাকিয়ে রইলো দুরে। চোখের পলক এদিক ওদিক করলো না। ঠায় হয়ে বসে থাকে নিজ মনে। প্রহর তখনও শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ১ মিনিট, ২ মিনিট করে কয়েক মিনিট চলে যায়। প্রহর অধৈর্য হয়ে পড়ে। অবশেষে চৈত্রিকা ভাঙা গলায় আওড়ায়,

‘এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবেন না জমিদার সাহেব। আমার ভীষণ কষ্ট হয়।’
প্রহর অস্থির হয়ে তাকায়। চৈত্রিকা দৃষ্টি ফিরিয়ে প্রহরের দিকে আনে। সাথে সাথেই প্রহরের মনে হয় তার বুকে কেউ ধারালো ছু’ড়ি বসিয়ে দিয়েছে। প্রিয় নারীর চোখে স্পষ্ট ব্যাথা তার ভেতরটা এফোড় ওফোড় করে দেয়। এতো শক্ত পুরুষ হয়েও তার মনে হলো সে ভেঙে গেছে। ভেঙে পড়েছে!

বার কয়েক ফাঁকা ঢোক গিলে। চৈত্রিকাকে জাপ্টে ধরে বলে,
‘চৈত্র এভাবে তাকিও নাহ। তোমার জমিদার সাহেবের ভেতরটা এফোড় ওফোড় হয়ে যায় যে! তোমার এই ব্যাথা, এই চাপা ঘৃ’ণার দৃষ্টি যে তোমার জমিদার সাহেবকে ভে’ঙে চু’ড়ে দেয়। বোঝো না? এই মেয়ে এক আকাশ ভালোবাসার ভীড়ে আমি কি তোমার ঘৃ’ণার দৃষ্টি পাওয়াটাই প্রাপ্যের খাতায় রাখি? আমাকে এভাবে ভে’ঙে দিও না বউজান। আমাকে আঁকড়ে ধরে রাখো। আমি যে ভীষণ ভালোবাসি তোমায়!’

জমিদার বাড়ি মৃ’ত্যু শোকে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সবাই প্রিয় মানুষ হারানো, তিক্ত সত্য মেনে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। একেকজন একেক ভাবে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। পিয়াসের মৃ’ত্যুর পর নাসিমা আতঙ্কিত হয়ে আছে। বার বার ভাবছে কখন কোন দিক থেকে চৈত্রিকা তাকেই না মে’রে দেয়! নাসিমার এমন ভীতু হওয়া দেখে ভীষণ রকম বিরক্ত সাদিক। নাক মুখ সিটকে বলে,

‘এতো ভয় পাওয়ার কি আছে নাসিমা? তুমি একটু বেশি বেশি!’
নাসিমা খ্যাক করে ওঠে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘এতো কিছুর পরও ভয়ের কি আছে জিজ্ঞেস করছো! তুমি বুঝতেছো না পিয়াসকে যে চৈত্রিকা মে’রে ফেলছে?’
সাদিক ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নাসিমা কাচুমাচু হয়ে বসে। টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে এসে আবার কাচুমাচু হয়ে থাকে। সাদিকের দিকে চেয়ে বলে,

‘তোমার কি মনে হয়? প্রহর আর চৈত্রিকা ছাড়া কখনো কারোর সাহস হবে এতো বড় একটা কাজ করার? আমি প্রহরকে যতটুকু চিনি ‘ও’ কখনোই নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবে না কিন্তু চৈত্রিকা সাথীর মৃ’ত্যুর পর আরো ক্ষে’পে উঠেছে। ওর মাঝে এখন প্রতি’শো’ধের নেশা জ্ব’লন্ত শিখার মতো ফুটছে। বুঝতেছো না?’
‘হ্যাঁ তাহলে এখনো তুমি ভয়ে ম’রো। যত্তসব!’

সাদিক রেগে বের হয়ে যায়। সে মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক না কেনো! পিয়াসের সাথে যা হয়েছে তারপর মনে মনে তারও ভয় বেড়েছে কিন্তু সে তো পুরুষ মানুষ! কখনোই নিচু হবে না একটা মেয়ের কাছে! কখনোই নাহ।
সাদিক চলে যেতেই নাসিমা আরো জড়োসড়ো হয়ে বসে। তার ভেতরটা ভয়ে ছটফট করছে। আশে পাশে যেনো চৈত্রিকা হাজারবার তাকে মা’রার পণ করছে! কানে হাত চেপে পাগলের মতো মাথা নাড়াতে থাকে দুদিকে। বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকে,
‘মা’রিস না চৈত্র। আমাকে মা’রিস নাহ।’

চৈত্রিকা পর্ব ৪৪

(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গত পর্বে কমবেশি সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করেছিলো। আমি সবার মন্তব্য দেখেই ভীষণ অবাক হয়েছি। যেখানে আমি ধরেই রেখেছিলাম সবাই আমাকে বকবে সেখানে সবাই আমাকে সাপোর্ট করেছে। বেশির ভাগ মানুষই বলেছে ‘নিজের যত্ন নেন। নিজের মানসিক অবস্থা ঠিক রাখুন। নিজেকে সময় দেন। তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ আমি ভাবতেই পারিনি আমার চৈত্রিকা আর আমাকে পাঠকমহল এতো ভালোবাসে! এটাই আমার স্বার্থকতা। মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার লো’ভেই লিখালিখি! আমি স্বার্থক আবেগ হারিয়ে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম কিন্তু এতো এতো ভালোবাসা আমার মাঝের কনফিডেন্স দ্বিগুন করে দিয়েছে। অনেক গুলো ভালোবাসা নিবেন প্রিয় পাঠকমহল)

চৈত্রিকা পর্ব ৪৬

1 COMMENT

Comments are closed.