হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৪০

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৪০
সাইয়ারা মম

মিহু আসার পর থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে । কারণ হঠাৎ করেই বিদিশার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা গায়ে হলুদের জিনিস পত্র পাঠিয়েছে আর বলেছে কালকেই বিয়ে হবে । বিদিশার শ্বশুরবাড়ি অনেক বড়লোক হওয়ার কারণে তাদের কথার ওপরে আর কেউ কথা বলতে পারেনি ।

ছেলে বিদেশে চাকরি করে আর হঠাৎ করেই তার আর্জেন্ট কাজ পড়ে যাওয়ার কারণে বিয়েটা তাড়াতাড়ি সারতে চেয়েছে । বিদিশার গায়ে হলুদ করার উপলক্ষ্যে অনেক লোকজন এসেছে সন্ধ্যার দিকে তাই সবাই ব্যস্ত । মিহুও ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে তাই নীলুর খোঁজ নিতে পারেনি । ও ভেবেছে হয়তো আশে পাশেই আছে সবার সাথে । মিহুর রান্নার হাত ভালো হওয়ার কারণে রান্নাবান্নার দায়িত্ব টা ওর কাঁধেই পড়েছে ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-মা আমি কি এতই বোঝা হয়ে গেলাম যে আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ ?
– সে কথা আসছে কেন ? বিয়ে তো এক সময় করতেই হবে সেটা পড়ে হোক আর আগে ।
– মা বিয়ে নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই ।
– তাহলে তোর সমস্যা টা কোথায়?
– তুমি আমাকে কোথায় বিয়ে দিচ্ছ ? বিয়ের আগেই নিজেদের প্রতিপত্ত দেখাচ্ছে । তাদের কথা মতো সাজতে হবে । তাদের কথা অনুযায়ী চলতে হবে ।

– তো তাতে সমস্যার তো কিছুই দেখছি না ।
– মা এসব বাদ দিলেও তারা আমাকে কেন আর পড়াশোনা করতে দেবে না ? আমার তো ইচ্ছা ছিল আমি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াব ।
– শোন মা তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের টাকা পয়সার কোনো শেষ নেই । তুই নিজের পায়ে দাঁড়ানো বলতে তো টাকা কামাইকে বোঝাচ্ছিস । তাদের তো এমন অবস্থা না যে তোর কামাই করা টাকায় চলতে হবে । আর তাদের বাড়ির বৌ দের টাকা ইনকাম করা লাগবে না ।

– মা এসব কথা তুমি কোনোদিন বলতে পারো না । তুমি নিজেই ছোট বেলা থেকে আমাকে শিখিয়েছ মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয় । আর তুমি এখন এই সব কথা বলছো ?
বিদিশার মা বললেন – আমায় ভুল বুঝিস না । তোর ভাইকে দিয়ে লেখাপড়ার বিষয় টা বলিয়েছিলাম কিন্তু তারা তারপরে বলেছে তাদের টাকা পয়সার অভাব পড়েনি যে তোর ইনকাম করা টাকায় চলতে হবে ।
বিদিশার মা চলে যেতে উদ্যত হলেই বিদিশা বলে

– মা আমার ফেব্রিক্সের স্বপ্ন টা ?
– যেখানে তোকে লেখাপড়া ই করতে দেবে না সেখানে এই কথা বলাটা মহা অন্যায়
বলে তিনি চলে গেলেন । বিদিশা ধপ করে বসে পড়ল । একে তো পিয়াস কোনো কথাই বলেনি । আরেক হলো স্বপ্ন ভাঙার প্রহর । বিদিশা কি করবে বুঝতে পারছে না । শুধু চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে ।
পিয়াস এতক্ষণ বিদিশার রুমের পাশে বসে কথা গুলো শুনছিল । তবে কি বিদিশাও ওর মতো স্বপ্ন ভাঙার দলে পড়তে যাচ্ছে ?

পিয়াস কিছু একটা ভেবে বিদিশার ঘরে ঢুকে বলল
– বিদিশা আপনাকে আমি একটা কথা বলবো যদি মত থাকে তাহলে বলবেন
হঠাৎ পিয়াসের আগমনে বিদিশা কিছুটা হলেও থমকে গিয়েছে ।

রাতে বিদিশার গায়ে হলুদের পরে সবার নিজেকে ক্লান্ত লাগছে তাই সবাই ঘুমানোর উদ্দেশ্যে গেল । মিহুর এবার মনে আসল যে নীলু ঘুমাবে কোথায়? এত মানুষের মধ্যে ঘুমাতে পারবে ? তাই সারা বাড়ি খুঁজল কিন্তু কোথাও নীলুকে পেল না । মিহুর মনে ভয় ঢুকে গেল নীলু আসলে ঠিক আছে তো ?
মিহুকে এমন অস্থির হতে দেখে বিদিশার ভাবি জিজ্ঞেস করল – মিহু কিছু হয়েছে ?

– ভাবি নীলুকে কোথাও দেখছিনা । তুমি দেখেছো কোথাও?
– নীলু এখানে আসবে কি করে ? ও তো নাকি বাসায় চলে গিয়েছে ?
– ভাবি একথা আপনাকে কে বলেছে ?
– মাহিন ভাইয়া ই তো বললো নীলু নাকি বাসায় চলে গিয়েছে ।
মিহুর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল । নীলু বাসায় গেল কখন ? বাসায় তো মিহু ছিল । আর মাহিন ভাই ও বা কেন এরকম কথা বলবেন ?

– ভাবি মাহিন ভাই কোথায় ?
– ওনাকে তো দেখলাম বাইরে পুকুর পাড়ের দিকে যেতে ।
মিহু কথাটি শোনা মাত্রই পুকুর পাড়ে দৌড় দিল । মাহিন উদাস মনে বসে ছিল পুকুর পাড়ে । নীলুর কথা মাথা থেকে যাচ্ছিলই না । তখন মিহু এসে হাজির হয় । মিহুকে এমন হাঁপাতে দেখে মাহিন বলল

– মিহু এমন করছিস কেন ?
– ভাইয়া নীলু বাসায় গিয়েছে কথাটি তুমি সবাইকে বলেছো ?
– হ্যাঁ কিন্তু কেন ?
মিহু করুণ চোখে তাকিয়ে বলল – ভাইয়া এমন মিথ্যা কথা বললে কি করে ?
– আমি মিথ্যা কথা বললাম কখন ?
– আমি বাসায় ছিলাম আর নীলু বাসায় থাকলে আমি দেখতাম না ?
মাহিনের প্রাণ পাখি উড়ে গেল কথাটি শুনে । নিজেকে শান্ত করে বলল – তুই ঠিক বলছিস মিহু ?
– হ্যাঁ ভাইয়া । কিন্তু তুমি এরকম কেন করলে ?

মাহিনের রাগ উঠে গেল । তুলির কথায় আগেই বিশ্বাস করা উচিত হয়নি । মাহিন মিহুকে কিছু না বলে তুলির উদ্দেশ্যে বাড়িতে রওনা হলো । মিহুও কান্না করতে করতে মাহিনের পেছনে পেছনে গেল । মাহিন চিৎকার করে তুলিকে ডাকতে শুরু করল । বিদিশার মা দৌড়ে এসে ওকে শান্ত করে বলল
– মাহিন এরকম চিৎকার করছিস কেন ? ঘরে মেহমান আছে । বিদিশার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আছে । তারা এমন অবস্থা দেখলে ভালো মনে করবে ?

– ফুফু আগে তুলিকে এখানে আসতে বলো ।
তুলির মা বলে উঠল – কেন মাহিন ? কি হয়েছে?
– মা নাটক করবে না । আমি জানি তুলি যা করে সব তোমাকে জানিয়ে করে । আগে বলো নীলু কোথায়?
-আজব তো নীলু তো ওদের বাসায় আর সেটা তো তুই নিজেই বলেছিস
মাহিন চিৎকার করে বলে ওঠে – আমাকে তুলি বলেছিল নীলু ওদের বাসায় গিয়েছে কিন্তু নীলু ওখানে নেই । তাহলে নীলু কোথায় গেল ?
মাহিনের চিৎকারে ঘরের প্রতিটা সদস্য জেগে উঠেছে । সবাই তুলি খোঁজ করেও ঘরের কোথাও পেল না । নেহাল চিন্তিত হয়ে বলল

– মাহিন তোমার সাথে নীলুর শেষ দেখা হয়েছিল কোথায় ?
– আমাদের বাসায় ।
মিহু কি করবে বুঝতে পারছে না । আরফানকে অনেক আগেই ফোন দেওয়া উচিত ছিল । কিন্তু কথাটি এখন মাথায় আসায় আরফানকে ফোন দিলেও ফোন বন্ধ শোনা যাচ্ছে । অনেক বার ট্রাই করেও যখন পেল না তখন ও একটা এস এম এস লিখে দিল । নেহাল বলল

– আমাদের মনে হয় তোমাদের বাসায় দেখা উচিত একবার ।
নেহালের কথায় মাহিন সহমত হলো । ওদের সাথে মিহু পিহু ও রওনা দিলে তুলির মা বলে উঠে
– কালকে সকালে গেলে হয় না ? না মানে এখন রাতে কোথায় কি খুঁজবি আর তুলিকেও তো খোঁজা দরকার ।
– জাহান্নামে যাক তুলি ।

– মাহিন ! নিজের বোনকে নিয়ে এরকম কথা বলে ?
মাহিন তেড়ে এসে বলল – নীলুর যদি কিছু হয় না , তাহলে আগে তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াব আর তোমার মেয়েকে কি করব তা ভাবতেও পারছ না ।
তুলির খালা ওর মাকে বলল – দেকছো । তোর পোলায় পরের মাইয়্যার লাইগ্গা নিজের বোইন আর মার লগে কেমন কতা কয় ।

– খালা তুমি বেশি কুটনিগিরি করলে তোমার বোনের সাথে সাথে তোমাকেও লাল দালানের ভাত খাওয়াব ।
মাহিনের থ্রেড শুনে খালা চুপ হয়ে গেল ।
– আমার মেয়ের যদি কিছু হয় তাহলে আমি এর সাথে জড়িত প্রতিটা সদস্য কে শাস্তি দেবো।
রেবেকা এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার শুধু এই কথাটি বললেন । তারপর ওদের সাথে রওনা দিলেন ।
তবে এই সোরগোলের মধ্যে কারো মনেই খেয়াল এলো না ঘরের আরো দুজন সদস্য মিসিং । হয়তো সকাল বেলা সবার টনক নড়বে কিন্তু তখন তাদের হাতে করার কিছু থাকবে না ।

বিদিশা চুপচাপ পিয়াসের সাথে সাথে হাঁটছে । নিজেকে বার বার স্বার্থপর ও মনে হচ্ছে । কারণ যে মা এত কষ্ট করে ছোট থেকে মানুষ করেছে কালকে তাকে অসম্মানিত হতে হবে । তবে একদিক থেকে ভালো লাগছে পিয়াস ওকে ভালো না বাসলেও ওর স্বপ্ন পূরণ করার জন্য ওকে নিজের জীবনে জড়িয়ে নিয়েছে । হোক না সম্পর্কের শুরুটা অন্য কিছু দিয়ে তবে বিদিশার বিশ্বাস পিয়াস একদিন নিশ্চয়ই ওকে ভালোবাসবে ।

কিছুক্ষণ আগেই একটা কাজী অফিসে পিয়াসের বন্ধুদের উপস্থিতিতে ওদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে । এখন পিয়াস নিজের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে । যদিও ও জানে বাসায় গেলে কি হবে । কারণ যেখানে ওকে ওর স্বপ্ন ছাড়তে হয়েছে সেখানে এই বিষয়ে তো ওকে অবশ্যই ঘর ছাড়তে হবে । তবে যতই হোক পিয়াস জানে স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট কেমন তাই নিজে না পারলেও অন্যকে এই একটা বিষয়ে সাহায্য করতে প্রস্তুত ।

– এখন কি করবেন ? আপনার বাবা তো আপনাকে তাজ্য পুত্র করে দিল ।
পিয়াস মুচকি হাসল । তারপর বলল – তোমার কি আফসোস হচ্ছে এখন ? আমাকে বিয়ে করার পরে ?
– না , হচ্ছে নাতো ।
– পারবে আমার সাথে গাছ তলায় থাকতে ?

– আপনি আমাকে ভালো না বাসলেও আমি বাসি । তাই আপনার সব পরিস্থিতিতে আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি ।
– দেখা যাবে । ভালোবাসা কতক্ষণ থাকে । সে যাই হোক তোমার স্বপ্ন পূরণ হলে তুমি চাইলেই আমার থেকে আলাদা হতে পারবে । আমার কোনো আপত্তি থাকবে না । এই নাও এটার এগ্রিমেন্ট পেপার ।
বিদিশা একটু কষ্ট পেল ঠিকই তবে এ কথা গুলো পিয়াস বিদিশা কে আগেই বলেছে । আর বিদিশাও ওর শর্তে রাজি হয়েই এসেছে ।

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৩৯

আরফান নিজের ফোন বন্ধ করে বাসা থেকে অনেক দূরে একটা নিরিবিলি পরিবেশে অবস্থান করছে । ওকে যে করেই হোক এই সব রহস্য জানতে হবে । মিহুকে এই অমঙ্গল থেকে রক্ষা করতে হবে ।

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৪১+৪২