ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ৮+৯

ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ৮+৯
মৌমি দত্ত

ট্রেইনে থাকাকালীন আফিম ড্রাইভারকে ফোন করে কাওকে কিছু না জানিয়ে রেলস্টেশনে চলে আসতে বলে রেখেছিলো। ইনায়াত আর কোন কথা বলেনি বাকি পথে। কোন মুখেই বা বলতো?? যে মানুষগুলো তাকে বিশ্বাস করেছে,, ভালোবাসা দিয়েছে,, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই মানুষগুলোর সাথেই সে কতো বড় বিশ্বাস ঘাতকতা করে ফেললো। আফিমও আর ইনায়াতকে ঘাটায়নি। ইনায়াতকে স্বাভাবিক হবার জন্য সময় দেওয়া দরকার বলেই ভেবেছে আফিম। একটা ক্লাস টেনের মেয়ে,, উঠতি বয়স,, সেই সময়ে এতো মানসিক অত্যাচার?? আর টানা ৪ বছর ধরে সেই অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করা অতো সহজ না।
ট্রেইন থামলো রাত ১১ টার দিকে। ইনায়াত দাঁড়িয়ে আফিমের পাশের সিট থেকে উইগ নিতে হাত বাড়াতেই খপ করে ইনায়াতের হাত ধরে ফেললো আফিম।

– কি করছো??
জানতে চাইলো আফিম। ইনায়াত অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,,
– উইগ নিচ্ছিলাম স্যার!!
– উইগ পড়তে হবে না।
– কিন্তু স্যার!!
– বললাম তো পড়তে হবে না।
– স্যার তাহলে তো,,
– লিসেন,,, তোমার আশিক তাহজিবের মতো মাফিয়া না হলেও অনেক বড় একটা বিজনেসম্যান আমি। তাই কিছুটা ক্ষমতা আমারও আছে। ওকে??

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আফিম এটুকু বলেই জানলার বাইরে ছুড়ে ফেললো উইগটা। ইনায়াত হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো। অবশ্য তার খারাপও লাগলো ” তোমার আশিক তাহজিব ” কথাটা শুনে। এটা কেমন কথা?? সে কি কখনো তাহজিবকে মেনেছে?? নাকি ছেলেটাকে পছন্দ করেছে?? অনেকটা দিন মাস্ক,, উইগ আর হুডি পড়ে পড়ে বদঅভ্যেস হয়ে গেছে তার। এখন ট্রেইনের বাইরে যেতেও অস্বস্তি লাগছে ইনায়াতের। আফিম হয়তো ব্যাপারটা বুঝলো। তাই উঠে দাঁড়িয়ে হাইটে পিচ্চি ইনায়াতের দিকে হালকা ঝুঁকে পড়লো। বিষ্ময়ে ফাঁটা ফাঁটা চোখে তাকিয়ে থাকলো ইনায়াত। তা দেখে আফিম বাঁকা হাসলো। ইনায়াতের চুলগুলো কোনমতে ঠিক করে পিছনে নিয়ে মাথাায় হুডি তুলে দিলো। আর সাথে করে ইনায়াতের মাস্ক পকেট থেকে বের করে পড়িয়ে দিলো।

– আজকেই লাস্ট টাইম। কাল থেকে নো হুডি,, নো মাস্ক। ওকে মিস ইনায়াত??
ইনায়াত ভ্যাবলার মতো মাথা নাড়ালো। ট্রেইন থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে দুইজন কুলি ডেকে নিলো। সব জিনিসপত্র আফিমের কল করে আনানো গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো। ইনায়াত সবশেষে কুলিদের টাকা দিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসতে গেলেই আফিম খুকখুক করে কেশে উঠলো। ইনায়াত একবার আফিমের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটের দরজা লাগিয়ে দিলো। আর গিয়ে আফিমের পাশের সিটেই বসে পড়লো।
গাড়ি চলতে লাগলো ধীর গতিতে। ইনায়াত জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলো। আর আফিম মনে মনে হাসতে লাগলো এটা কল্পনা করে যে লাবিবা ইনায়াত মেয়ে এটা জানতে পেরে কি পাগলামী শুরু করবে??

গাড়ি এসে পৌছালো আহসান মঞ্জিলে। গাড়ির আওয়াজ শুনে দুইজন সার্ভেন্ট দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। আফিম গাড়ি থেকে বের হয়ে তাদের ইশারা করলো ডিকি থেকে জিনিসগুলো নিয়ে যেতে ভিতরে। তারা সেই কাজই করতে লাগলো। ইনায়াত নামছে না দেখে আফিম ভ্রু কুঁচকে মাথা নামিয়ে জানলা দিয়ে ইনায়াতকে দেখতেই বুঝলো ইনায়াত মুখ দুই হাতে চেপে কাঁদছে। আফিম বিরক্তির একটা শ্বাস ফেলে বললো,,
– এইইই মেয়ে!! এতো কান্না আসে কোথা থেকে তোমাদের??
এটুকু বলেই আফিম দরজা খুলে ইনায়াতের হাত টেনে বের করে আনলো। এরপর ধুপধাপ পা ফেলে ঢুকে গেলো বাড়ির ভেতরে। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছেন জোসেফ ও লাবিবা। আফিম দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো লাবিবাকে।
– সারপ্রাইজ মা!!
– তোর মা আর আমি জানতাম তুই চলে আসবি। বেশিদিন মাকে ছাড়া থাকা তোর দ্বারা সম্ভব না। নেহায়েত আমার ছোট ছেলে ইনায়াতটা আছে বলে।

এই বলেই জোসেফ হেসে ফেললো। ইনায়াতকে ছেলে বলতে শুনে আফিম বাঁকা হাসলো।
– আচ্ছা শুনো!! তোমাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ এখনো বাকি আছে।
– আবার কি সারপ্রাইজ?? আর ইনায়াত?? তুই ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?? আমার কাছে আসবি না??
জানতে চাইলো লাবিবা। ইনায়াত মাথা নিচু করেই চোখের জল ফেলছে। আফিম উঠে ইনায়াতের কাছে আসলো। ইনায়াত হালকা মাথাটা তুলে অসহায় ভাবে তাকালো আফিমের দিকে। কিন্তু লাভ হলো না।
– মা,, বাবা!! তোমাদের সারপ্রাইজ হলো এটা!!!

এই বলেই আফিম ইনায়াতের হুডি খুলে ফেললো,,, মাস্ক খুলে ফেললো। আর চুলগুলো বাইরে এনে দিলো। ইনায়াতের বেশে একজন মেয়েকে দেখে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন জোসেফ। লাবিবা হা করে তাকিয়ে আছে ইনায়াতের দিকে। দীপ খাবার টেবিলে সার্ভ করছিলো। বাইরে এসে এতোক্ষন সবটা শুনে যেই না মেয়েরুপী ইনায়াতকে দেখলো। অমনি তার হাত থেকে ধুপ করে চামচ পড়ে গেলো। সবাই ঘাড় ঘুড়িয়ে দীপের দিকে তাকাতেই। দীপ দ্রুত চামচটা তুলে একদৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে ধুয়ে আবারও নিয়ে এলো সবটা দেখবার জন্য।
– ইনায়াতের কাপড়চোপড় পড়া এটা কে আফিম??
প্রশ্ন করলো লাবিবা। জোসেফ একবার লাবিবার দিকে তাকিয়ে বললো,,
– ইনায়াত কোথায় আফিম??

– কুল ডাউন গাইজ!! মিট মাই পিএ,, মিস ইনায়াত মির্জা চাঁদ। ডটার অফ ইরশাদ মির্জা।
এই কথা শুনে লাবিবা দাঁড়িয়ে পড়লো। আর জোসেফ ধপ করে বসে পড়লো। দীপ আবারও হাত থেকে চামচ ফেলে দিলো। সবারই এমনটা অবস্থা হবে তা জানা ছিলো আফিমের। কিন্তু এতোটাও ওভার একটা ব্যাপার হবে তা জানা ছিলো না। ইনায়াত মুখ চেপে কেঁদে ফেললো। হিচকি তুলতে লাগলো সমানে কাঁদতে কাঁদতে। দীপের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকালো আফিম। দীপ চামচটা আবারও তুলে রান্নাঘরে দৌড়ে নিয়ে গিয়ে ধুয়ে আনলো। আফিম এবার বিরক্ত হয়ে তাকালো জোসেফ আর লাবিবার দিকে। ইনায়াতের কান্না থামছে না। আফিম ইনায়াতের হাত টেনে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। নিজের পাশের রুমটার দরজা খুলে ইনায়াতকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। ইনায়াতের হাত ছেড়ে কাবার্ড খুলে দেখিয়ে বললো,,

– এগুলো সব আফরার জামাকাপড়। এখান থেকে নিয়ে গোসল করে চেঞ্জ করে নাও। ওকে?? নিজেকে স্বাভাবিক করে নিচে আসো।
এই বলেই আফিম রুম থেকে বের হয়ে এলো। ইনায়াত খাটে ধুপ করে বসে পড়লো কাঁদতে কাঁদতে। ইরশাদ আর রানার কথা মনে পড়ছে তার খুব। তাহজিব তাদের কি অবস্থা করেছে কে জানে!! ইনায়াতের ভয় হচ্ছে এখন। লাবিবা আর জোসেফ তাকে ভুল বুঝবে না তো?? তাদের স্নেহ মায়া মমতা যা এতোদিন পেয়ে এসেছে। সব হারিয়ে ফেলবে না তো ইনায়াত?? আর আফিম??
– কে কি করবে জানিনা। বাট স্যারকে আমি একটু হলেও তো চিনেছি। আমার বিশ্বাস স্যার আমাকে ভুল বুঝবে না। উনি তো আমার পাশে থাকবেন বলেছেন। উনি আমাকে ভুল বুঝবেন না আমি জানি।

অদ্ভুত এক আশা আর ভরসা নিয়ে চোখের জল মুছে নিলো ইনায়াত। কিন্তু কেন?? কিসের এই বিশ্বাস আর ভরসা একটা চরিত্রহীন মানুষের জন্য?? আফিমের বিচ্ছিরি চরিত্র সম্পর্কে জানা আছে ইনায়াতের। তাহলে তার কি ভয় পাওয়া উচিত নয় নিজের ইজ্জত নিয়ে? দেখা যাক আগে আগে কি হয়!!
ইনায়াত চোখের জল মুছে কাবার্ডের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তখনই মাথায় ভেসে আসলো আফিমের বলা কথা।
– আফরা?? আফরা কে??
বিড়বিড়িয়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো ইনায়াত। কিন্তু বেশিক্ষন সে প্রশ্নটা তার মাথায় ঘুরলো না। অনেকটা সময় থেকে থেকে কান্না করাতে চোখগুলো ব্যাথা করছে তার। একটা কালো জর্জেটের গাউন থ্রিপিস সেট নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে পড়লো।

আফিম রুমে এসেই দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিলো। ইনায়াত নিচে যাবার আগে লাবিবা আর জোসেফকে সবটা জানাতে হবে তার। যাতে লাবিবা আর জোসেফ বুঝতে ভুল না করে কিছু। এসব ভাবতে ভাবতে ওয়াসরুমের দিকে যেতে গিয়েও থেমে গেলো আফিম। অনেকদিন বাদে আজকে আফরার রুমে ঢুকেছে। আফরার কথা মনে হতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো আফিমের।
– এতো জেদ তোর বোন?? তোকে দূরে রাখতে পারিনা বলেই তো সেদিন বকেছিলাম। তাই বলে এই ৩ সপ্তাহে একটা কল করলি না??
নিজেকেই নিজে বিড়বিড়িয়ে বললো আফিম। পরক্ষনেই মুখ ফুলিয়ে বললো,,
– ঠিক আছে!! আমিও তোর বড় ভাই। আমিও দেখি কার জেদ বেশি!!
ওয়াসরুমে ঢুকে পড়লো আফিম।

যে আফিমের ফ্রেশ হতে ৪০/৫০ মিনিট লেগেই যেতো। আজ সেই ছেলেই মাত্র ২০ মিনিটের মাথায় ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে এসেছে দেখে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকা লাবিবা আর জোসেফ হা হয়ে গেলো। দীপ আবারও চামচ ফেলে দেবার ভয়ে এবার চামচটা বুকপকেটে ঢুকিয়ে নিলো। আফিম এসে বসলো নিজের চেয়ার টেনে। লাবিবা,, জোসেফ আর দীপ উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে আফিমের দিকে সবটা জানতে।
– আমি জানি তোমাদের কৌতুহল হচ্ছে খুব। আমি সবটা বলছি। জাস্ট ভুল বুঝো না ইনায়াতকে!!
আফিম এক এক করে সবটাই খুলে বললো যা যা সে ইনায়াতের থেকে শুনেছে। লাবিবা,,,জোসেফ আর দীপ তো হা হয়ে গেলো একদমই। একটা মেয়ে এতোকিছু সহ্য করেছে?? কতোটা কষ্ট হয়েছে মেয়েটার নিজের আসল স্বত্তা লুকিয়ে এতোগুলো দিন কাটানোতে?? লাবিবার মনে পড়ে গেলো আফরার কথা। একবার আড়চোখে আফিমের দিকে তাকিয়ে দেখলো আফিম গম্ভীর মুখে বসে আছে। মুচকি হাসলো লাবিবা। একমাস হওয়ার আগেই যখন কাল হুট করে চলে আসবে আফরা,, তখন আফিম কতোটা বাচ্চামো করবে তা ভাবলেই হাসি পাচ্ছে তার।

– আশা করছি তোমরা ওকে ভুল বুঝবে না। প্লিজ মা,, প্লিজ বাবা!!
তখনই সিড়ি বেয়ে নেমে ডাইনিং টেবিলে কাছে এলো ইনায়াত। দীপের চোখ গেলো সবার আগে ইনায়াতের দিকে।
– ওয়াও ইনায়াত স্যার!!
দীপ হা করে তাকিয়ে রইলো। দীপের কথা শুনে সবাই ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো ইনায়াতের দিকে। সবার মুখ হা হয়ে গেলো একদম। গুলুমুলু গোলাপী গোলাপী গাল,, ডাগর ডাগর চোখ,,, গোলাপী ঠোঁট,,, খুব আদুরি একটা মেয়ে দেখতে ইনায়াত। আফিমের চোখ ও ইনায়াতে স্থির। ভেজা চুলে সব মেয়েকেই স্নিগ্ধ লাগে। ইনায়াতকেও খুব পবিত্র আর মায়াময়ী লাগছে আফিমের। আফিম মূহুর্তেই ভ্রু কুঁচকে চোখ সড়িয়ে নিলো। অতিরিক্ত সুন্দরী মেয়েগুলো হয় মনের দিক দিয়ে নাহয় অন্য অভ্যেসের দিক দিয়ে খারাপই হয় বলে নিজেকে শাসাতে লাগলো রীতিমতো। লাবিবা উঠে ইনায়াতের কাছে গেলো। ইনায়াতের দুই গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেলো।
– খুব আদুরি তুই মা!! একদম পুতুলের মতো!!

ইনায়াত চমকে উঠলো। সে তো ভাবছিলো লাবিবা আর জোসেফকে কিভাবে বোঝানো যায়। আর এখানে এদের এমন ব্যবহার যেন কিচ্ছু হয়নি। লাবিবা ইনায়াতের হাত টেনে এনে নিজের পাশের চেয়ারে বসালো। দীপ সবাইকে খাবার সার্ভ করে দিতে লাগলো। আফিম ইনায়াতের দিকে আর পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো খাচ্ছে। ইনায়াত খাচ্ছে না কিছুই। শুধুই চামচ নাড়ছে। তা দেখে লাবিবা বললো,,
– কি হলো মা?? খাচ্ছিস না কেন??
ইনায়াত চমকে তাকালো লাবিবার দিকে। আফিমের দিকে তাকাতেই আফিম চোখে চোখে ইনায়াতকে আস্বস্ত করলো যে সব ঠিক আছে। ইনায়াত মাথা নিচু করে নিলো। সব ঠিক থাকলেও তার যে অপরাধবোধ হচ্ছে খুব। মিনমিনে স্বরে ইনায়াত বললো,,
– সরি আন্টি,, সরি আংকেল। আমি সত্যিই হ্যাল্পলেস ছিলাম। আমি ইচ্ছে করে আপনাদের সাথে এমন অন্যায় করিনি। আপনাদের কাছে আমি অনেক আদর,, স্নেহ পেয়েছি। সব জায়গায় আপনারা আমাকে নিজের আরেক ছেলে বলে পরিচয় দিতেও দ্বিধা করেননি। আর আমি,,,

ইনায়াত চুপ হয়ে গেলো। চোখ বেয়ে পড়লো এক ফোঁটা জল। আফিম একবার সেদিকে তাকিয়ে আবারও নিজের খাওয়ারে মনোযোগ দিলো।
– ইনায়াত যেহেতু একটা মেয়ে। সেহেতু ওকে আমার থেকে দূরে তাড়াতে হবে। ওকে এখন ভালো মনে হচ্ছে। আবার পড়ে রূপ বদলাতেও পারে। সুন্দরী মেয়েরা সব পারে।
মনে মনে এসব ভাবলো আফিম।
– তো কি হয়েছে মা?? এতোদিন তোকে সবার কাছে ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতাম। এখন মেয়ে হিসেবে পরিচয় দেবো।
ইনায়াত ঝট করে মাথা তুলে তাকালো জোসেফের কথা শুনে। জোসেফ মিষ্টি হেসে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে ইনায়াতের পাশের চেয়ারে বসলো।

– আমরা তোর সাথে আছি মা। আমরা দেখে নেবো ঐ তাহজিবের কি ব্যবস্থা করা যায়। তোর বাবাকেও ছাড়িয়ে আনবো। ততোদিন নাহয় আমাকে তুই ও আফরার মতোন বাপি বলে ডাকবি। কি?? ডাকবি না??
আফরা নামটা শুনে অবাক হলো ইনায়াত। এটা আবার কে তা ভাবতে লাগলো। আর এদিকে আফরা নামটা শুনেই মুখ ফুলিয়ে ফেললো আফিম। ধুপধাপ পা ফেলে উঠে গেলো সিড়ি বেয়ে নিজের রুমে। খাবার বাদবাকিটা পড়ে রইলো প্লেইটে। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো লাবিবা। ইনায়াত কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। জোসেফের একটা কল আসাতে সে উঠে চলে গেলো। ইনায়াত লাবিবার দিকে তাকালো কৌতুহলী চোখে। লাবিবা মৃদু হাসলো,,
– আফরা কে ওটাই ভাবছিস তো??
ইনায়াত মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ জানালো।
– খেয়ে আমার রুমে আয়। সব বলবো তোকে!!

লাবিবার রুমে বসে আছে ইনায়াত। লাবিবা আলমারি থেকে একটা ফ্যামিলি এলবাম বের করে ইনায়াতের পাশে বসলো।
– এটা আমাদের ফ্যামিলি এলবাম। আয় দুজনে দেখি। তারপরে আফরাকে নিয়ে বলছি।
এলবামের শুরুতেই লাবিবা আর জোসেফের সিঙ্গেল দুটো ছবি। পড়ের পৃষ্ঠায় লাবিবা আর জোসেফের কাপল ছবি। এরপরে দুয়েক পাতাতেও লাবিবা আর জোসেফের কাপল ছবি। এরপরের পাতা উল্টে ইনায়াত হা হয়ে গেলো। ছবিটা হাসপাতালে তোলা। খাটে শুয়ে থাকা লাবিবার হাতে একটি বাচ্চা। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জোসেফের হাতেও একটা বাচ্চা। ইনায়াতকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে লাবিবা তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো।
– দুটো বাচ্চা দেখে অবাক হচ্ছিস?? এই যে আমার কোলে,, ওটা আফিম। আর জোসেফের কোলের বাচ্চাটা নীলা। আফিমের জমজ বোন।

ইনায়াতের কানের কাছে যেন বজ্রপাত হলো। সে তো জানতো আফিম বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। এমনকি পুরো পৃথিবীও তাই জানে। তাহলে এই নীলা কে??
হ্যালো!! নীলা কে,, নীলা কে?? প্রশ্নের অবসান পরের পর্বে হবে। সাথে থাকুন,, পাশে থাকুন ❤️ আর হ্যাঁ ভাই হ্যাঁ!! আমি হিন্দু ? একই প্রশ্ন আশা করি আর করবেন না।
– নীলা আর আফিম। দুজনেই জমজ। আফিম নামটা আমার পছন্দের। আর নীলার নাম ঠিক করেছিলাম আফরা। কিন্তু নীলার নীল নীল চোখ দেখে জোসেফ ওর নাম নীলা রাখলো। এই দেখ নীলার কলেজ লাইফে তোলা ছবি।
লাবিবা ইনায়াতকে পাতা উলটে আরো একটা ছবি দেখালো। যেখানে নীল চোখের এক মেয়ে মুচকি হেসে আফিমকে জড়িয়ে ধরেছিলো। আর আফিম মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। ইনায়াত অবাক হয়ে সবটা দেখছিলো আর শুনছিলো। ইনায়াতের মনে প্রশ্ন জাগলো। তাহলে কি সে নীলা অর্থাৎ আফরার জামা পড়েছে??

– নীলা কোথায় আন্টি??
ইনায়াতের প্রশ্নে ব্যথিত নজরে তাকালেন লাবিবা ইনায়াতের দিকে।
– ও আর নেই।
কথাটা শুনে চমকে উঠলো ইনায়াত। লাবিবা শাড়ির আঁচলে নিজের চোখ মুছলেন।
– এখন যে আফিমকে সবাই চেনে গম্ভীর,,, রুড,, অভদ্র। আমার ছেলে আগে অমন ছিলো না। আমার ঘরটা সারাদিন হাসিঠাট্টাতে ভরে থাকতো আফিম আর নীলার জন্য। উল্টো আফিম খুব দুষ্টু ছিলো। নীলাকে ঐ কাঁদাতো,, ঐ হাসাতো। নীলা ছিলো আফিমের কলিজার টুকরা। যদিও জমজ ছিলো ওরা। কিন্তু আফিম বড়ভাইয়ের মতো ভালোবাসতো নীলাকে। নীলাকে বোনু ডাকতো ও। আর নীলাও আফিমকে বড় ভাইয়ের মতো দেখতো। আমার মেয়েটা খুব সহজ সরল ছিলো রে। তাই হয়তো শেষ হয়ে গেলো ওভাবে।
ইনায়াত বুঝলো না কিছুই। কি শেষ হলো?? কি হয়েছিলো??

– কি হয়েছিলো আন্টি?? নীলার সাথে কি হয়েছিলো??
– ক্লাস ওয়ান থেকে আফিম আর নীলার দুটো ফ্রেন্ড জুটে গেছিলো। কণা আর মাহিম। ৪ টা ছেলে মেয়ে সারাদিন একসাথে থাকতো। ওদের ৪ জনকে দেখলেই সবাই বুঝে যেতো ওরা বেস্টফ্রেন্ড। দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিলো সবার। ৪ জনে স্কুলের গন্ডি পার করে কলেজে উঠলো। কলেজ লাইফের শেষের দিকে কণা আফিমকে পছন্দ করে বলে জানায়। আফিমও কণাকে পছন্দ করতো। তাই দুজন একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। অসাধারণ সুন্দরী কণা সবার কাছে ছিলো অনেক ভালো একটা মেয়ে। কিন্তু কে জানতো ওটা ঐ মেয়ের ছলনা??
লাবিবা এটুকু বলেই কিছুক্ষন চুপ থেকে আবারও বলতে লাগলেন।

– তখন কণার সাথে আফিমের সম্পর্কের খুব সম্ভব ৩/৪ মাস চলছে। কণার জন্মদিন ছিলো সেদিন। কণার জন্য সারপ্রাইজ পার্টি আর আফিম ও কণার ক্যান্ডেলাইট ডিনার প্ল্যান করেছিলো নীলা। কণাকে আগে ভাগে না জানিয়েই চলে গেলো ওদের বাসায়। নীলা বাসায় ঢোকবার আগেই কণাকে দেখলো কোথাও যাওয়ার জন্য রিক্সায় উঠতে। নীলা ভাবলো চমকে দেবে কণাকে। তাই কণার পিছু নিলো। কণা সেদিন হোটেলে গেছিলো। তা দেখে অবাক হয় অনেক নীলা।

কণার পিছু নিতে নিতে পৌছে যায় একটা রুমের ভেতর। এভাবে একটা হোটেলে কণা কেন এলো তা মাথায় আঘাত করতে লাগলো নীলার। ও ঐ রুমের দরজার সামনে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলো। পরে আগপিছ না ভেবেই দরজায় টোকা দিলো। দুয়েকবার টোকা দিতে না দিতেই দরজা খুললো মাহিম খালি গায়ে। নীলা যেন আকাশ থেকে পড়লো। দরজা থেকেই স্পষ্ট দেখা গেলো খাটে চাদর পেঁচিয়ে শুয়ে থাকা কণাকে। মাহিম নীলাকে আশা করেনি,, কণাও না। নীলা পালিয়ে আসতে চাইছিলো। তখনই মাহিম ওকে পাকড়াও করে রুমের ভেতর নিয়ে যায়। কণাকে আফিমের সাথে টাইম স্পেন্ড করতে বলে পাঠিয়ে দেয় মাহিম। যাতে কিছু সময়ের জন্য নীলার কথা আফিমের মাথায় না আসে। কণা বেরিয়ে যেতেই ঐ জানোয়ার মাহিম আমার মেয়েটাকে,,,

আর কিছু বলতে পারলো না লাবিবা। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। ইনায়াতের চোখেও জল। ইনায়াত লাবিবাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। ফোঁপাতে ফোপাঁতে লাবিবা বললো,,
– আমার মেয়েটাকে শেষ করে দিয়েছিলো মাহিম। ওর বাজে ভিডিও বানিয়ে ওকে ব্ল্যাকমেইল করেছিলো যেন কাওকে কিছু না বলে। কিন্তু আমার মেয়েটা যে নিজের ভাইকে খুব ভালোবাসতো। আবার তার হারানো সম্মানের ধাক্কাটাও নিতে পারছিলো না কোনভাবে। আমার মেয়েটা এতোকিছু সহ্য করতে না পেরে সেদিন রাতেই আত্মহত্যা করলো ফাঁস খেয়ে।
ইনায়াতের বুকে একপর্যায়ে বাচ্চাদের মতো নাক টানতে লাগলো লাবিবা। এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে সে। কিছুটা সময় চুপ থেকে আবারও বলতে শুরু করলো সে।

– আফিম খুব ভেঙ্গে পড়েছিলো নীলার মৃত্যুতে। এর উপর নীলার সুইসাইড নোটে লেখা পড়ে আরো ভেঙ্গে পড়েছিলো সে। মাহিমকে পাগলের মতো মারধর করেছিলো আফিম। মাহিমের মাথায় এতোজোড়েই আঘাত করেছিলো যে মাহিম মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এখন মাহিমকে ওর বাবা মা লন্ডনে নিয়ে গেছে অনেক বছর। মাহিমের সবটা শুনে তারা মাহিমকে মেনেই নিতো না যদি মাহিম স্বাভাবিক হতো।
– আর কণা??
ইনায়াত জিজ্ঞেস করলো। লাবিবা ইনায়াতের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো।
– আল্লাহ কাওকে ছাড় দেন না। কণা ঘটনার পর পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। ওর শাস্তি হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড । কিন্তু এর মাঝখানেই কণার ব্রেইনটিউমার ধরা পড়ে যা দীর্ঘ সময় ধরে কণার ছিলো কিন্তু সে বুঝতে পারেনি। কণা কারাগার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
ঘড়ির কাটায় ১২ টার জানান দিতেই হুশ ফিরে ইনায়াতের। চোখে পানি টলমল করছে তার। জোসেফ রুমে প্রবেশ করলো। ইনায়াত কোনভাবে চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালো।

– অনেক রাত হয়েছে। আমি আসছি আন্টি।
– কিন্তু মা,, এখন এতো রাতে যাবি তুই?? এতো রাতে বাইরে থাকা সেইফ না।
জোসেফ বলে উঠলো উদ্বিগ্ন কন্ঠে। ইনায়াত মুচকি হাসলো।
– কিন্তু আংকেল,,,
ইনায়াত আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। তখনই দীপ এলো ছুটে।
– ইনায়াত স্যার!! উফফ সরি!! ম্যাম!! একটু কথা ছিলো।
জোসেফ আর লাবিবা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ইনায়াত এগিয়ে গেলো। দীপ ইনায়াতের কানে কানে বললো যে আফিম অন্যদিনের তুলনায় আজকে অতিরিক্ত নেশা করে ফেলেছে। দীপ সামলাতে পারছে না আফিমকে।
ইনায়াত দ্রুত বের হয়ে এলো জোসেফদের রুম ছেড়ে। আর আজকে থেকে যেতেও রাজী হলো। ইনায়াত ছুটলো আফিমের রুমের দিকে। আফিমের নেশা করা আর ঢিলা চরিত্রের কথা লাবিবা আর জোসেফ জানেনা। দীপই জানে আর ইনায়াতই জানে। দীপের আগে আফিমদের অনেক পুরানো এক ড্রাইভার ও সার্ভেন্ট ছিলো বয়স্ক। সে জানতো,, কিন্তু এখন সে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে।

– স্যার!! কি করছেন আপনি?? ওহ মাই গড!! ২ বোতল শেষ করে ফেলেছেন?? ইশশ!! স্যার ছাড়ুন বোতলটা।
আফিমের রুমে ঢুকেই দেখলো আফিম মদের বোতল হাতে নিয়ে তাকিয়ে আছে ঢুলতে ঢুলতে। ইনায়াত ছুটে গিয়ে তাই কাড়াকাড়ি শুরু করলো।
– হেই ইউ!! গেট আউট। তুমি এখন আর ছেলে ইনায়াত নেই যে আমি তোমাকে বন্ধু ভাববো বা কথা মেনে চলবো। ওকে?? তুমি এখন একটা মেয়ে!! আর আমি আমার মা,, আমার বোন নীলা আর আফরাকে ছাড়া কোন মেয়েকে সহ্য করতে পারিনা। মেয়েদের জায়গা আমার জন্য এই বিছানা পর্যন্তই। সো জাস্ট গেট আউট।

বিছানায় বাড়ি মেরে কথাগুলো বললো আফিম মাতাল কন্ঠে। দীপ তখন লেবুর শরবত করে এনেছে কোন চিনি বা লবন ছাড়া। ইনায়াত আফিমের রাগ বা কথার পাত্তা দিলো না। যদিও তার মনে ঘুরতে লাগলো একটাই প্রশ্ন নীলা আর আফরার নাম আলাদা আলাদা উচ্চারণ করলো কেন আফিম?? নেশায় আছে বলে??
ইনায়াত নিজের ওড়নাটা ভালো করে কোমড়ে পেঁচিয়ে দীপের থেকে গ্লাসটা নিলো। এরপর দীপকে ইশারা করলো আফিমকে চেপে ধরতে খাটে। দীপও গিয়ে আফিমকে চেপে ধরলো শক্ত করে। আফিম হাত পা ছুড়াছুড়ি শুরু করলো।
– হেই!! কি করছো তোমরা?? হোয়াট ননসেন্স!! ছাড়ো বলছি আমাকে। ছাড়,,,

ছাড়ো বলবার আগেই ইনায়াত আফিমের নাক টিপে ধরে গ্লাসের শরবত আফিমের মুখে ঢালতে লাগলো। বাধ্য আফিম শ্বাস নেওয়ার চেষ্টায় গিলে ফেললো সবটাই। আফিমকে ছেড়ে দিলো এরপর দীপ। গ্লাস নিয়ে চলে গেলো সে। ইনায়াত সবসময়কার মতো আফিমকে টেনেটুনে শুইয়ে দিলো। গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে আফরার রুমে চলে এলো। এই রুমেই থাকতে বলা হয়েছে তাকে। রুমে এসে বিছানায় শুয়ে ভাবতে লাগলো ইনায়াত।

– তাহলে কি স্যারের এমন নেশাখোড় আর মেয়েবাজ হবার কারণ এই মানসিক ধাক্কাগুলোই?? হুম!! হতে পারে। নাহয় একটু আগে ওসব হাবিজাবি কি বলছিলো?? তবে যাই হোক না কেন!! আমি এতোদিন ভাবতাম ছোট থেকেই বাবার টাকার হাওয়া লেগে বিগড়ে যাওয়া মানুষ উনি। কিন্তু উনি তো আর তেমন না। আচ্ছা!! উনাকে ভালো করা যায় না?? মদ,, মেয়েবাজি এসব ছাড়ানো কি খুব কঠিন?? ধ্যাত!! মাথাটাই ব্যাথা করছে। এখন ঘুমাই।
এসব ভেবেই ঘুমানোর মতো মহান কাজে মনোনিবেশ করলো আমাদের ইনায়াত।

– ইরশাদ!! তোর ভালোর জন্যই বলছি। বলে দে কোথায় আমার চাঁদ। নাহয় তোকে মারতে আমার এক সেকেন্ডও লাগবে না।
তাহজিবের এমন কথা শুনে ইরশাদ ভয় পাওয়ার জায়গায় হো হো করে হেসে উঠলো। তাহজিব হাত মুঠো করে ফেললো রাগে।
– তোকে তো আমি নিজের হাতেই মারবো। আগে আমার চাঁদকে খুঁজে নিই।
এই বলেই তাহজিব হনহন করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। আজকে রাতে বড্ড ঘুম পাচ্ছে তার। কেন তা জানা নেই। তার তো ঘুম পায়নি এতোদিন। একরাশ নীরব হাহাকার নিয়ে সময় পার করেছে সে তার চাঁদকে দেখে। কিন্তু আজ ঘুম পাচ্ছে কেন তার?? তাহজিব নিজের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

– রানা!! সে কি এখনো আসেনি??
– জানিনা স্যার!!
– আমাকে ছাদে নিয়ে চলো। এতোক্ষনে তো তার চলে আসবার কথা।
রানা হুইলচেয়ার ঠেলে ছাদে নিয়ে গেলো ইরশাদকে। ছাদে একটা সোফায় বসে আছে এস.এ,, ইন্টারন্যাশনাল মাফিয়া। আর তাছাড়াও একজন ডাক্তার। ফর্সা গায়ের রঙ,, মুখে চাপ দাঁড়ি,, ঘন চুলগুলো বাতাসে দুলছে। চাহনীতে তার অসাধারণ এটিট্যুড। এস.এ’র পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে কামাল। ইরশাদের চেয়ার ঠেলে রানা সোফার কাছে নিয়ে গেলো।
– হ্যালো এস.এ। আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো।
– কাজের কথায় আসি??

– বাহ!! বেশ,, বেশ। সবটা তো জানেনই। তাহজিবকে সড়িয়ে দিতে হবে। ইনায়াতের জন্য ওর পাগলামী সীমা ছাড়িয়ে গেছে যা আমার উদ্দেশ্য পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ও শেষ হয়ে গেলেই আমি ইনায়াতকে নিয়ে আসবো। প্রোপার্টি পেপারসে সাইন করিয়ে নিয়ে আমার কাজ শেষ। এখন ডিলের কথায় আসা যাক!! টাকা আপনার অঢেল আছে। তাই আপনাকে টাকা দিয়ে ছোট করবো না। এর বদলে আপনাকে সম্পূর্ন ভার্জিন,, অপরুপ সুন্দরী আমার মেয়েটাকে দিতে পারি। এবার বলুন!! আপনি রাজি তো এস.এ।
কামাল আর রানা হা হয়ে তাকিয়ে আছে। কামাল যা জেনে এস.একে ইনফর্ম করেছিলো তার সাথে তো এখনের ইরশাদের কথার কোন মিলই নেই। আর রানা ভাবছে ইরশাদ কি বলছে এসব?? নিজের কলিজার টুকরা মেয়েকে নিয়ে এমন কথা কোন মুখে বলছে ইরশাদ??

– স্যার!! আপনি এসব কি বলছেন?? আপনি ঠিক আছেন??
– উফফ!! সব কিছুতে নাক গলিয়ো না রানা। আমি ঠিক আছি। আর তাই আমার এতোদিনের উদ্দেশ্য এখনো ভুলিনি।
রানার বিষ্ময় ভাব কাটলো না। এস.এ’র কোন ভাবান্তর হলো না।
– আপনার কি মনে হয়?? আমি সত্যিই মেয়েবাজ?? লিসেন!! বিয়ে,, ভালোবাসা,, সম্পর্ক,,, বন্ধন এসবে আমি বিশ্বাস করিনা। কিন্তু মেয়েরা পিছু ছাড়ে না। তাই নিজের নামে এই গুজব রটিয়েছি। যদিও এতে কাজ হয় না কোন। বাট সব কথার শেষ কথা এই যে এসব মিথ্যে। তাই আমার আপনার মেয়েকে লাগবে না। তবে হ্যাঁ!! আমি সবটা জানতে চাই। কেন আর কি জন্য আপনি এমন করছেন। নাহয় আমি কাজটা রিফিউস করছি।

ইরশাদের মুখটা শুকিয়ে গেলো। তবুও শুকনো একটা ঢোক গিলে বলতে শুরু করলো,,
– আরে!! ও তো আর আমার রক্ত না!! ওর মা ছিলো খুব পার্টিবাজ এক মহিলা। সংসার ধর্মে মন ছিলো না তার। ঘরে দশবছরের ছেলেকে রেখে সে পার্টিতে মত্ত থাকতো। স্বামীর ঘরের বেশ ধন দৌলত সে ভালোবাসার নাটক করে পেয়েইছে। বাপের ঘরেরও কম ছিলো না একমাত্র মেয়ে হওয়াতে। বেশ কয়েক পার্টিতে আমি ওর মায়ের পিছু নিয়েছিলাম। এরপর ভাবলাম একে নিজের জালে ফাঁসাতে পারলে জীবন সেট। যেই ভাবা সেই কাজ!! ওর মা আমার প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগলো।

নিজের স্বামী সন্তানকে ফেলে আমার কাছে চলে এলো। কিন্তু আমার কাছে আসার পর পরই জানতে পারলাম ইনায়াত ওর পেটে আছে। কোন প্ল্যানিং করে না হলেও কনসিভ করেছিলো ও। আমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে সংসারের স্বপ্ন দেখা গাধা মেয়েটি বাচ্চাটাকে নষ্ট করলো না। আমিও জোড় দিলাম না। কেননা আমার লক্ষ্য ছিলো ওর প্রোপার্টি। ও কনসিভ করেছে। আমি ওর কাছে নিজেকে অনেক ভালো বাবা আর স্বামী তো দেখাতাম। কিন্তু বাইরে এঞ্জয়মেন্টও ফুল চলতো। কিভাবে কিভাবে যেন সন্দেহ হয়ে গেলো ওর। ডেলিভারির দিন থেকে ও আমার সাথে কথা বলা,,, থাকা কমিয়ে দিলো।

আমি চেষ্টা করতাম ওকে আমার নকল ভালোবাসায় বাঁধতে। কিন্তু কাজ হতো না। ইনায়াতের তখন দুই বছর। একদিন ঘরে যাওয়ার পর ও আমার মুখে ছুড়ে দিলো কিছু ছবি। আমারই ছবি,, অন্য মেয়েদের সাথে বিভিন্ন হোটেল রুমে এঞ্জয় করবার সময়। আমি ঘাবড়ে গেলাম। ওকে বশ করতে চাইলাম। কিন্তু হলো না। সেদিনই রাগের মাথায় ওর থেকে জানতে পারলাম ও নিজের সব সম্পত্তি ইনায়াতের নামে করে দিয়েছে। যা ১৮ বছর বয়সে ইনায়াতের নামে হবে। তবে ইনায়াত কখনো যদি বিয়ে করে তাহলে তার অর্ধেক সম্পত্তি ইনায়াতের স্বামীর নামে চলে যাবে। এতোগুলো দিনের কষ্ট বৃথা কিভাবে যেতে দিতাম?? তখন আর ওর দরকার ছিলো না আমার। তাই ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই আমি ওকে। ইনায়াতের হাতে আর পায়েও পাথরের ঘষা দিয়ে কেটে দিই। আর সবার কাছে বলি অসাবধানতার কারণে ও ইনায়াতকে নিয়েই পড়ে গেছে। ইনায়াতকে বাঁচিয়ে রাখি। আর ডাক্তারকে বলে মেরে ফেলি ঐ পাগল মহিলাকে।

এটুকু বলেই থামলো ইরশাদ। এস.এ এতোক্ষন চোখ বন্ধ করে শুনছিলো সবটা। রানা মেঝেতেই ধুপ করে বসে পড়েছে।
– একি সর্বনাশ করলাম আমি?? এই জন্যই আপনি তাহজিবের সাথে মেনে নিতে পারছিলেন না ইনায়াতকে। কারণ তাহজিব সত্যিই খুব ভালোবাসে ইনায়াতকে। হা খোদা!! এ কি পাপ করলাম আমি??
হাহাকার করে উঠলো রানা আকাশের দিকে তাকিয়ে। কামালও আশ্চর্য হয়েছে অনেক। একটা মানুষ এতো নিকৃষ্ট হতে পারে তা জানা ছিলো কামালের। কিন্তু নিজের চোখে দেখা হাতে গুনা দুয়েকজনের মধ্যে সবথেকে বেশি নিকৃষ্ট যে ইরশাদ তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই কামালের কাছে। এস.এ উঠে দাঁড়ালো সোফা ছেড়ে।

– আমি আপনার কাজটা করছি না। সরি!! এমনিতে আমার দয়ার শরীর তাই কোন কিছুর বিনিময় ছাড়াই কাজটা করে দিতাম। তবে এখন হাজার জিনিসের বিনিময়েও আমি এই কাজ করবো না।
এই বলেই এস.এ উঠে নিজের শার্টের হাতা ফোল্ড করতে লাগলো। কামাল গর্বে বুক ফুলিয়ে তার স্যারের দিকে শ্রদ্ধাপূর্ণ নজরে তাকালো। এস.এ ছাদ থেকে বের হওয়ার জন্য সিড়ির কাছে এগিয়ে যাচ্ছিলো,,

– ভেবে দেখো এস.এ। তুমি যদি এই কাজ না করো তাহলে অন্য কেও করবে ঐ মেয়ের বিনিময়ে। আর এখন যেহেতু আমার সবটা সত্যি তুমি জেনেই গেছো। তাই তোমার ব্যাপারটাও আমার কাওকে না কাওকে দিয়ে সামাল দিতে হবে।
কামাল তেড়ে যাচ্ছিলো ইরশাদের দিকে। এস.এ হাতের ইশারায় মানা করলো। এরপর পিছু ফিরে একটা ডেভিল হাসি দিলো৷ অন্ধকারে অতোটাও স্পষ্ট বোঝা না গেলেও হাসিটা আবছা দেখেই গা শিউরে উঠলো ইরশাদের। এস.এ কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিলো। তখনই রানা ছুটে গিয়ে এস.এ’র পা ধরলো।

ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ৬+৭

– আপনাকে আমি কিছুই দিতে পারবো না স্যার। আমার উপর দয়া করুন। ইনায়াত মামনিকে বাঁচিয়ে দিন। প্লিজ স্যার!!
– রানা??
এক হুংকার ছাড়লো ইরশাদ। রানা পাত্তা দিলো না। এস.এ নিচু হয়ে রানাকে তুললো। এরপর ইরশাদের দিকে একনজর তাকিয়ে বের হয়ে এলো ছাদ থেকে। এস.এ এসেছে সবাই অচেতন হবার পর মেইন দরজা দিয়ে। যাবেও সেভাবেই।

তোহ!! আফিম বিদ্বেষী মানুষগুলা কোথায় আছো?? সামনে আফিমের প্রেমেই তোমাদের ডুবিয়ে ছাড়বো। এবার বুঝেছেন কেন তাহজিব পা কাটলো ইরশাদের?? এখন প্রশ্ন আসবে রানা কি দোষ করেছে,, ওর আঙ্গুল কেন কাটলো?? ওটার উত্তরও জেনে যাবেন। এস.এ কি নায়িকার প্রেমে পড়বে?? তার উত্তরও কয়েক পার্ট পর জানবেন। আর হ্যাঁ,, কনফিউসড হবেন না প্লিজ। নায়ক আসলে কে তাই হচ্ছে গল্পের রহস্য।

ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ১০+১১