ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ১২+১৩

ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ১২+১৩
মৌমি দত্ত

আরভিদ সাহেব বসে আছে তাহজিবের সামনে। জ্বর গা নিয়েই বাড়ির বাইরের বাগানে আসিফের সাথে বাস্কেটবল খেলছে রুহি। আর তাহজিব জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে। একটু আগেই এসেছে আরভিদ সাহেব।
একটু আগে,,
ঘুমের মাঝে যখন রুহি বুঝলো তার আশপাশে কেও নেই। সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসলো। উঠে বসেই দেখলো তাহজিব বাঁকা হেসে খাটের সামনে বরাবর একটা চেয়ার নিয়ে তাতে বসে আছে এটিট্যুড নিয়ে। ভয় পেয়ে গেলো রুহি। পরক্ষনেই একরাশ হেসে ছুটে গিয়ে তাহজিবের কোলে উঠে মাথা গুঁজে বসে পড়লো। তাহজিব তো হা হয়ে গেলো। সে ভেবেছিলো রুহি ধরা পরে ভয় পাবে।

– ভাবছো তো আমি ভয় কেন পাইনি??
তাহজিব তখনও হা হয়ে আছে। যখন হুশ হলো দ্রুত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো রুহিকে। রুহি মাথা তুলে বিরক্ত হয়ে তাকালো তাহজিবের দিকে।
– কি সমস্যা?? বিচুটি পাতা লাগিয়েছো নাকি ভুল করে গায়ে??
তখনই আরভিদ সাহেব রুমের বাইরের থেকে কেশে উঠলেন। রুহি সেদিকে তাকিয়ে হাসিমুখেই ডাকলো ” বাপি ” বলে। তাহজিব যুদ্ধ শুরু করে দিলো রুহিকে নামাতে। আফটার অল বাবার সামনে মেয়েকে তো কোলে নিলে অদ্ভুত লাগবেই।
– স্যার আসবো??
আরভিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন। তাহজিব অপ্রস্তুত হেসে বললো,,
– আসুন আরভিদ সাহেব।
আসিফ আরভিদ সাহেবের পিছু পিছু রুমে এসে তাহজিবের কোলে রুহিকে ওভাবে বাচ্চাদের মতো মাথা রেখে বসে থাকতে দেখে বুক চেপে ধরে আবারও বের হয়ে যাচ্ছিলো। তাহজিব ” আসিফ ” বলে ডাকতেই আবার দরজার কাছ পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে আসলো তাহজিবের কাছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আরভিদ সাহেব বুঝলো তাহজিবের অস্বস্তির কারণ।
– মা!! তাহজিব স্যারের না প্রচন্ড পা ব্যাথা ছিলো কাল। তুমি বসলে পা ব্যাথা বেড়ে যাবে না??
রুহি চমকে তার বাবার দিকে তাকালো। দ্রুত পায়ে নেমে তাহজিবের পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পা টিপে দিতে লাগলো।
– তুমি আগে বলবে না পায়ে ব্যাথা তোমার?? এতোক্ষন কোলে রাখার কি দরকার ছিলো??
আসিফ এই লাস্টের কথা শুনে খালি গলায় বিষম গেলো। আর তাহজিব তো হা। কথার ধরণ তো শুনো রুহির। যেন রুহিকে জোড় করে কোলে নিয়েছে তাহজিব।

– আসিফ!! রুহিকে নিয়ে বাইরে যা!! আমার কথা আছে আরভিদ সাহেবের সাথে।
– আমি কোথাও যাচ্ছি না। তোমাকে ছেড়ে তো না,, না,, না।
তাহজিব তো রাগে লাল হয়ে গেলো। তার মুখে না বলছে এই মেয়ে??
– এই মেয়ে?? বললাম না তোমার বাবার সাথে আমার কথা আছে??
– তুমি আমার সামনে বলবে?? নাকি নিজের মতো পাগলামি শুরু করবো??
তাহজিব ঘাবড়ে গেলো। মিনমিনে স্বরে বললো,,
– একটু নিচে যাও!! বিজনেস নিয়ে কথা আছে।
নাক মুখ শিটকালো রুহি।

– কাজকর্মের মতো শরীরের দিকে নজর দিলেও তো পারো। আসিফ ব্রো,,, চলো তো আমরা বাস্কেটবল খেলি। এরপর তোমার স্যারের ব্রেকফাস্ট,, লাঞ্চ আর ডিনার রুটিন বানিয়ে দেবো আমি।
রুহি আরভিদের দুই গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেলো চোখ বন্ধ করে। এরপর তাহজিবের কাছে এসে তাহজিবের গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেলো। তাহসিফ তো হা!! এটা কি ছিলো??
– এই মেয়ে বাপের সামনে চুমু খেতেও ছাড়লো না??
মনে মনে ভাবছে তাহজিব। আসিফ ভ্যাবলার মতো একবার তাহজিবের দিকে তো একবার রুহির দিকে তাকাচ্ছে। মাথা চুলকাতে চুলকাতে আসিফ চলে গেলো রুহির সাথে পিছু পিছু।
বর্তমানে,,

আরভিদ সাহেব হাতের উলটো পিঠে ঘাম মুছে নিলেন।
– পুলিশ কমিশনার নিজের মেয়ের খবর জানেনা!! দেশ সামাল দিবে কিভাবে??
আরভিদ ঢোক গিললো শুকনো দেখে।
– কিছু বলুন আরভিদ সাহেব। মুখ দেখতে ডাকিনি।
– স্যার!! মেয়েটা তো আর বেশিদিন নেই। তাই চাপ দিইনা কিছুতে।
বেশিদিন নেই কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে এলো তাহজিবের। নিচে খেলতে থাকা রুহির থেকে চোখ সড়িয়ে আরভিদ সাহেবের দিকে তাকালো।

– আমার মেয়ের বয়স তখন ৭ যখন ওর মা মারা যায়। আমার মেয়েটা তবে থেকে কেমন যেন চুপ হয়ে যায়। আমাকেও কম বিরক্ত বা কষ্ট দেওয়ার দিকে ওর নজর ভালো ছিলো। এতোই ভালো নজর ছিলো যে কখনো আমার সাথে কিছু শেয়ার করার কথা ভাবলোই না। আমিও পুলিশ মানুষ প্রায়ই ট্রান্সফার হতেই থাকি,, ব্যস্ত থাকি। বারবার ট্রান্সফারের কারণে হয়তো মেয়েটা সুযোগও পায়নি কোন বান্ধবী বানাবার। এই শহরে আসলাম ৬ মাস। মেয়ে প্রথম কয়েকদিন স্কুলে যাওয়ার পর একদিন আপনাকে দেখলো। রাস্তায় তুমুল ফাইটিংয়ের মাঝে ফাইটিং করছিলেন আপনি। আমাকে বাসায় গিয়ে বললো। তখন অবশ্য আমি,,,
চুপ হয়ে গেলো আরভিদ সাহেব। তাহজিব এতোক্ষন আরভিদের সামনের চেয়ারে বসে সব শুনছিলো। আরভিদকে চুপ হয়ে যেতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

– আপনি কি??
আরভিদ তাও চুপ রইলো। চোখে মুখে কেমন যেন ভয় দেখা যাচ্ছে তার। ধমক দিয়ে উঠলো তাহজিব।
– কি হলো?? বলুন আপনি কি??
– আমি বলে ফেলেছিলাম যেন আপনার মতো মাফিয়া মানুষদের থেকে দূরে থাকে। ভালো হোক বা খারাপ,, মাফিয়া তো!!
তাহজিব হা হয়ে তাকিয়ে আছে আরভিদ সাহেবের দিকে। পরক্ষনেই মুখ বন্ধ করে তাচ্ছিল্য হাসলো। এই মাফিয়া হওয়ার কারনেই তার ইনায়াত তার হলো না।
– আপনি বলতে থাকুন।

– এরপর!! একদিন স্কুল থেকে কল এলো মেয়ে অসুস্থ। দ্রুত গেলাম স্কুলে। মেয়েকে নিয়ে চলে গেলাম ডাক্তারের কাছে। প্রায় ৭/৮ দিন পর জানতে পারলাম মেয়ের লিউকেমিয়া আছে। মেয়ে আমার সেদিন প্রথমবার কান্নাকাটি করলো তার মা মারা যাওয়ার পর। আর চাইলোও একটাই জিনিস,,, যেন আপনার এই শহর ছেড়ে না যাই। তখনই আন্দাজ করেছিলাম মেয়ে আমার ভুল কিছু আশা করছে। পরবর্তীতে দিন কাটতে লাগলো আর বুঝলাম সে আপনাকে আশাই করছে না। সে আপনাকে চায় না,,

শুধুই ভালোবাসে আড়াল থেকে। চুপ থাকলাম। এরপর আপনার সাথে দেখা হয়ে বুঝলাম আপনার গার্লফ্রেন্ড হারিয়ে গেছে। আপনাকে নিজের চোখের সামনে পাগলামী করতে দেখলাম। মেয়ের সাথে ফ্রি হওয়াতে মেয়েকে ঘরে গিয়ে বলতাম আপনার ব্যাপারে। মেয়ে আমার কখন যে আপনার বাসায় এসে এসব করেছে আমি জানিনা। তবে স্যার আমার বিশ্বাস আমার মেয়ে বুঝবে। আমার মেয়ে এই রোগ সম্পর্কে জেনে খুব বাস্তববাদী হয়ে গেছে। কেননা তার জানা আছে তার বাবার মতো সৎ পুলিশ মানুষের পক্ষে বিদেশে নিয়ে গিয়ে ট্রিটমেন্ট করানো সম্ভব না। তাই সে খুব চঞ্চল হয়ে গেছে যাতে করে আমার মাথায় তার রোগের কথাটা না আসে। আর আমি কান্না না করি।

আরভিদ সাহেব মুখ চেপে কেঁদে ফেললেন। পুরুষ মানুষ নাকি কাঁদে না। মিথ্যে কথা!! পুরুষ মানুষেরও মন থাকে। তাদেরও ব্যাথা হয়। একজন পিতা হয়ে সেই ব্যাথা লুকিয়ে কোন বাহাদুরি দেখাবার মতো ইচ্ছে আরভিদ সাহেবের নেই।তাহজিবের চোখ লাল হয়ে আছে। জোড়ে একটা শ্বাস নিয়ে তাহজিব বললো,,
– আপনার মেয়েকে নিয়ে বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। সব খরচা আমি দেবো।
– তার কোন দরকার নেই স্যার!! বাপি আমার কথার বাইরে এক পাও দেবে না। আর আমি আপনার এই প্রস্তাব রিফিউস করছি।
– দেখো রুহি!! বাচ্চামো করো না। লিউকেমিয়া অনেক কঠিন রোগ!! হেলাফেলা করা ঠিক না।
রুহি আর আসিফ রুমে ঢুকলো। রুহি তাচ্ছিল্য ভরে হেসে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। তার একদিকে তাহজিব বসা আরেকদিকে আরভিদ।

– এই একটাই রিজন বেঁচে থাকবার জন্য??
তাহজিব অবাক হলো। রুহি খিলখিল করে হেসে উঠলো। এরপর বললো,,
– আমার কাছে হাজারও রিজন আছে যা বেঁচে থাকা বাধ্যতা হিসেবে গ্রহন করে না। আচ্ছা!! আমার বাবা পুলিশ কমিশনার। তাই না?? কখনো যদি বাপির কিছু হয়ে যায়?? আমার তো আর কেওই নেই আগেপরে। আমার কি হবে?? সরকারের সম্মান বা সঞ্চিত টাকা দিয়ে কি আমি ভালো থাকবো??
তাহজিব হা করে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে এতো ছোট বয়সে এতো বড় ভাবনা করে কিভাবে??
– আচ্ছা ধরলাম,, বাবা ঠিক আছে। কিন্তু এরপর?? আমি বড় হবো,,, পড়ালেখা চলতে থাকবে। আর আমার বিয়ে হবে। তারপর?? বাবাকে কে দেখবে?? বাবার কি হবে??
তাহজিব হা করে তাকিয়ে আছে রুহির দিকে।

– আচ্ছা ওসব বাদ দিন। আর আপনি এটা ভাবছেন না তো আমি আপনাকে চাই বা সামথিং লাইক দ্যাট?? যদি তাই ভেবে থাকেন তাহলে ভুল ভাবছেন। আপনি আপনার লাইফ আপনার মনের মতো বিন্দাস কাটান। ব্যাপার না!! কারণ আমি আপনার লাইফের কোণায় কাণায় চোরের মতো উঁকি দেওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
– এতোকিছু বুঝো!! এতো বাস্তব বাদী!! অথচ এটা বুঝলে না তোমার বয়সের দোষই এটা। এটা ভালোবাসা না। আকর্ষণ ছাড়া কিছুই না।
রুহি বাঁকা হাসলো।
– আগের যুগে ৮/৯ বছরে বিয়ে আর ১৫/১৬ তে ভালোবাসা হয়ে যেতো স্যার। ওরা সবাই ভুল ছিলো?? সবাই?? ভালোবাসা বয়স বা শরীর দেখে হয় না। ভালোবাসা আর অভিজ্ঞতা হয় জীবন থেকে। আকস্মিক হয়ে যায়। আমার অনুভুতিগুলোর মূল্য আপনার কাছে না থাকুক। অপমান করবেন না প্লিজ।

– বুঝার চেষ্টা করো। আমি একজন মাফিয়া।
– আপনি মাফিয়া না স্যার!! আপনার প্রফেশন এটা,, এটা আপনি না। আজকে হাতে বন্দুক ধরে আপনি মাফিয়া,, কাল হাতে কলম ধরলে আপনি লেখক,,, পরশু হাতে ফুল ধরে আপনি অভিনেতা,, এভাবেই বদলাতে পারবেন। আমার ভালোবাসায় আমার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে যা আপনাকে বদলাতে পারবে। আমি ইতোমধ্যেই আপনাকে বদলে দিয়েছি।
অবাক হলো তাহজিব। মেয়েটা আবার কি বদলেছে??
– এই যে দেখুন,,, ধমক দিয়ে বা বন্দুক দেখিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া আপনি আজকে একটা মেয়ের পিছনে খরচ করছেন এতোগুলো শব্দ তাকে এটা বুঝানোর জন্য যে সে আপনাকে ভালোবাসে এটা মিথ্যা।
তাহজিব অবাক হলো খুব৷ সত্যিই তো!! আরভিদ গর্বে চোখের কোনের জল মুছে নিলো।

– কিন্তু কি বলুন তো স্যার!! আমার তো বিশ্বাস আছে আমার ভালোবাসায়। ঐ উপরওয়ালার বিশ্বাস ছিলো না হয়তো। তাইতো আমাকে এই রোগ দিলো। আমি তাই আপনাকে পেতে চাইনা। আপনি পরিবারের ভালোবাসা পাননি। আমি আপনার খুশী থাকাটা চাই,, তাই আমি এও হাসিমুখেই চাইতে পারি যেন আপনি একটা সুন্দর পরিবার পান নিজের। জানেন স্যার!! আমি এতোদিন আসতাম কারণ আপনি ঘুমাতে পারতেন না। ঘুম আসবার পরেও আপনি খুব ছটফট করতেন। তাই আসতাম আমি। কিন্তু এখন আর আসবো না। দোয়া করতাম আর করি যেন আপনি আপনার ভালোবাসা পেয়ে যান। ভালো থাকবেন।
রুহি উঠে দাঁড়ালো। তাহজিবের কপালে একটা চুমু খেলো চোখ বন্ধ করে। তাহজিব চোখ বন্ধ করে নিলো। টুপ করে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা জল।

– বাপি!! আমার শরীর খুব বেশি খারাপ করছে। পায়ে পড়ি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো।
কথাটা বলতে না বলতেই নাক বেয়ে রক্ত পড়তে লাগলো রুহির। রুহি নাক চেপে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এলো। তাহজিব আর আরভিদ অস্থির পায়ে মেয়েটার পিছু পিছু সিড়ি বেয়ে তো নামলো। কিন্তু ততোক্ষনে নিজের আনা সাইকেলে বসে চলে গেছে রুহি।

আফিমের জন্মদিনের রাত বলে আহসান মঞ্জিল আলোয় ঝলমল করছে। প্রতিটা মানুষ সব কারুকার্যের প্রসংশা করছে। কিন্তু যে এতোসব কিছু করলো,, ইনায়াত?? সে তো নেই। আফিম সবার সাথে কুশল বিনিময় করছে ঘুরে ঘুরে। জোসেফ আর লাবিবাও তাই করছে। আফরা বিরক্তি নিয়ে আফিমের কাছে গেলো।
– ভাইয়া!! ভাবী কল ধরছে না কেন??
– আমিও জানিনারে!! আমারও ধরছে না।
আফরা চলে যাচ্ছিলো। তখনই চিন্তিত মুখে আফিম বলে উঠলো,,
– তোর ভাবী কল ধরলে জানাস
আফরা অবাক হয়ে তাকালো আফিমের দিকে। আফিম থতমত খেয়ে গেলো নিজের কথায়। আমতা আমতা করতে করতে অন্যদিকে চলে গেলো।

– স্যার!! আমাদের মানুষ আফিমের বাসায় ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন ভাবে। প্রতিটা ক্যামেরা পার্ফেক্ট ফোকাস নিয়েই আছে। কিন্তু ম্যাম তো এলো না।
– কিইই?? কেন গেলো না??
– স্যার!! জানিনা তা!!
– আমার বোনকে খুঁজো। আমার ইনুমনি আসলে আমাকে কল করে জানাবে। আর সাবধানে!! কেও যেন না জানে।
এস.এ ইনায়াতের ভাই,,,, আপনারা ঠিক ধরেছেন। আর শুনুন,,, আফিমকে বদলে দেবে ইনায়াত নিজের মায়া দিয়ে। আর তাহজিব পাবে শ্রেষ্ঠ কিছু। তাহজিব পাবে এমন একটা মানুষকে যে তাকে এর থেকেও বেশি ভালোবাসবে,, যতোটা সে ইনায়াতকে বাসে। আমরা যাকে ভালোবাসি তার পিছনে দৌড়ানো উচিত না। আমাদের যে ভালোবাসে সে আমাদের জন্য বেস্ট। কালকে সকালে গল্প দিতে একটু লেইট হবে। সরি!!! সাথে থাকবেন,, পাশে থাকবেন।

– আফিম চল,, কেক কেটে ফেলবি। এরপর ইনায়াত গান ও নাচের ব্যবস্থা করেছে।
জোসেফ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো। লাবিবা অস্থিরমুখে বললো,,
– কিন্তু ইনায়াত কোথায়?? এতোসব ব্যবস্থা করে মেয়েটা কি নিজেই উধাও হয়ে গেলো??
– ওয়াও ভাবী!!!
লাবিবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আফরার মুখে ভাবী ডাক শুনে আফিম সহ সবাই সেদিকে তাকালো। নীল রঙ্গের সিল্কের একটা শাড়ি,, সাথে কালো ব্লাউজ ফুল হাতা। ঘন চুলগুলো খোলা। সাজগোজ বলতে আইলাইনার,, লিপস্টিক আর টিপ কিন্তু এতেই অসাধারণ রুপশী লাগছে ইনায়াতকে। আফিমের মুখে হাসি ফুঁটলো তার অজান্তেই। আফিম গিয়ে কেক কাটলো। ইনায়াত আফিমের কাছে গেলো না। আফিম আড়চোখে ইনায়াতকে দেখে নিলো।

– এই মেয়ে আমাকে ইগনোর করছে নাকি আমার কথা মেনে চলছে??
নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলো আফিম। একটা কেক হাতে তুলে নিলো। লাবিবা,, জোসেফ আর আফরাকে খাওয়ালো। কিছু একটা ভেবে এগিয়ে গেলো ইনায়াতের দিকে। আফিমকে নিজের দিকে আসতে দেখে ইনায়াত হাতে টিস্যুর বক্স নিয়ে দাঁড়ালো। আফিম আসতেই টিস্যুর বক্স এগিয়ে দিলো ইনায়াত। আফিম বাম হাতে টিস্যুর বক্সটা নিয়ে কিছু বলতে যাবে ততোক্ষনে ইনায়াত চলে গেছে অন্যদিকে। যাবে নাই বা কেন?? ইনায়াতের স্পষ্ট মনে আছে আফিম তাকে সকালে বলেছে আফিম ইনায়াতের মুখ দেখতে চায় না।
– ঠিক আছ কণা ভালো ছিলো না,, নীলা আপু কষ্ট পেয়েছে একটা মেয়ের জন্য। কিন্তু আফরা আপুও একটা মেয়েই তো। আর আমি তো জাস্ট উনার পিএ। বৌ তো হতে যাচ্ছি না। অদ্ভুত!!
মনে মনে বলতে লাগলো ইনায়াত।

নিজের বোনকে দেখতে পেয়ে স্পন্দনের মন যেন ভরে গেলো। নিজের রকিং চেয়ারে বসে মৃদু হেসে বললো,, ” আমার বোনু,, আমার আদুরি বোনু “। ডুবে গেলো সুদর্শন যুবকটি অতীতে। বাবা মায়ের ঝগড়া দেখে বড় হয়েছে স্পন্দন আজাদ। বাবা হাবিব আজাদ খুব ভেঙে পড়েছিলেন যেদিন পালিয়ে গেলো তার স্ত্রী মহুয়া আজাদ। মানুষের অপমান আর কথা শুনে বেঁচে থাকার মতো কঠিন কাজ তার দ্বারা সম্ভব না করা। তাই আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। দশ বছরের স্পন্দন তখন থেকে নিজেকে আস্তে আস্তে গড়ে তুলেছে। মাফিয়া লাইফটা তার বোনকে খুঁজে বের করতেই জয়েন হয়েছে। কিন্তু আসলেই সে ভালো একজন হার্ট সার্জন। হুশ ফিরলো স্পন্দনের। মৃদু হেসে বললো,,

– খুব শীঘ্রই আমার পুতুল বোনুটা আমার কাছে ভালোবাসায় আর যত্নে থাকবে। আমি আসছি বোনু।
বাবার প্রতি কোন অভিযোগ নেই স্পন্দনের। আর মায়ের প্রতি অভিযোগ থাকলেও বোনকে সে অনেক ভালোবাসে। কখনো কাছে যাওয়ার সুযোগ না পেলেও আড়ালে অনেকবার দেখেছে আদরের বোনটিকে। ইরশাদ যখন নিজের রুপে চলে এলো। তখন নিজের বোনের আড়ালে থেকে আর কি করবে স্পন্দন?? সেও নিজের আসল রূপ নিয়ে যাবে তার বোনের কাছে। তার বোনটা একদমই মায়ের মতো হয়নি। বাবার ছোঁয়া না পেলেও ইনায়াত যে হাবিব আজাদের মতোই হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই স্পন্দনের।

পার্টি ভালোই ভালোই শেষ হলো। রাত প্রায় ১২ টা বাজে। আফিম যেন এটাই চাইছিলো। ইনায়াতকে থেকে যেতে বলবে। এতে করে ইনায়াতকে সরি বলা যাবে। কিন্তু আফিমের মুখ দিয়ে সরি তো বের হতেই চায় না!! সব কাজ শেষ করে লাবিবা,, আফরা সোফায় বসলো। ইনায়াত সবাইকে পেমেন্ট করছে। আফিম ডাইনিং টেবিলে বসে কেক খাচ্ছে চামচে তুলে তুলে। অবশ্য কেকের প্রতি কোন মন নেই তার। সে ভাবছে ইনায়াত কখন বের হতে যাবে আর সে আটকাবে। জোসেফ সাহেব ফ্রেশ হয়ে এসে লাবিবার পাশে সোফায় বসলেন। ইনায়াত সব শেষে এগিয়ে আসলো জোসেফ ও লাবিবার কাছে।

– স্যার!! ম্যাম!! আমি আসছি। কালকে অফিসের জন্য চলে আসবো।
জোসেফ আর লাবিবা অবাক হলো খুব। ইনায়াত এখন কেন স্যার বা ম্যাম বলছে?? আফিম উঠে দাঁড়ালো। কোট ঠিক করতে কর‍তে বললো,,,
– ইনায়াত এখন অনেক রাত হয়েছে। তুমি থেকে যেতে পারো।
কোন উত্তর না পেয়ে মাথা তুলে তাকালো সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আশেপাশে কোথাও ইনায়াত নেই। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ আসলো। ইনায়াত জোসেফ আর লাবিবাকে কথাটা বলেও দ্রুত পা চালিয়ে বের হয়ে চলে এসছে।
– ইনায়াত তো গেছে বাবা!! তুই আর কোন ইনায়াতকে বলছিস??

লাবিবা বোকা মুখ করে জানতে চাইলো। আফরা মুচকি মুচকি হাসছে। এমন অবস্থায় কি করতে হয় তা জানা নেই আফিমের। তাই সবগুলো দাঁত দেখিয়ে একটা বোকা হাসি দিয়ে পা চালিয়ে উঠে গেলো নিজের রুমে।
ফ্রেশ হয়ে এসে রাগে ফুসতে ফুসতে মদের বোতল হাতে তুলে নিলো আফিম। হঠাৎই চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছেলেরূপী ইনায়াত কিভাবে তার সাথে মদের বোতল নিয়ে কাড়াকাড়ি করতো না খাওয়ার জন্য। আফিম রেগেমেগে মদের বোতলটা রেখে দিলো আবারও।
– মেয়েটা একদম ভাইরাসের মতো। আমার লাইফে একটা মিনিটও কি বাকি রাখেনি যেখানে আমি একটু আরাম করে সময় কাটাতে পেরেছি একা একা???
আফিম বিরক্তি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।

সকাল সকাল কেও আফিমকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে সমানতালে। মৃদু চোখ খুলে ঘুমের ঘোরেই বুঝলো কোন ছেলে অবয়ব। আফিম ঘুমের মাঝেই কোনমতে উঠে বসে জড়িয়ে ধরলো সেই অবয়বকে।
– ইউ আর ফায়ার্ড ইনায়াত। ইউ আর ফায়ার্ড। বাট আই মিসড ইউ ইয়ার। তোমার এই রুপ,, এই কথাবার্তা গুলো মিস করেছি খুব।
– স্যার,,, ছাড়ুন। ও স্যার!! ছাড়েন না স্যার!!
আফিম এতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো যে দীপ না থাকতে পেরে কেঁদেই দিতে লাগলো। পিছনে লাবিবা,, আফরা আর ইনায়াত দাঁড়িয়ে আছে। লাবিবা আর আফরা তো হা। আর ইনায়াত হা হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। পরক্ষনেই অস্বস্তিতে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।

– মাথাটা গেছে স্যারের।
মনে মনে বললো ইনায়াত নিজেকে নিজে। কি আর করার!! গায়ের ওরনা ভালো করে কোমড়ে গুঁজে এগিয়ে গেলো আফিমের খাটের দিকে। দীপকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলতে লাগলো,,,
– স্যার!! ও স্যার উঠুন!! স্যার দেরি হচ্ছে অফিসের!! স্যার!!! স্যার উঠুনন নায়ায়ায়ায়ায়ায়া!!!
ইনায়াতের ধাক্কাধাক্কিতে আফিমের ঘুম ভাঙলো আর দীপকে ধরে রাখা হাত ছুটে গেলো। আফিম বিরক্তি নিয়ে ইনায়াতের দিকে তাকিয়েই দীপকে আবারও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,,
– ইউ আর ফায়ার্ড ইনায়াত!! ইউ আর ফায়ার্ড!!

– স্যার!! আগুন পানি ফায়ার্ড,, ওয়াটার্ড সব পরে করবেন। আজকে আমাদের আজাদ গ্রুপে সাথে ডিল আছে তো স্যার!!!!!!!!!!! ‌‌
আফিম মৃদু বিরক্তি নিয়ে নিজের ধরে রাখা মানুষটার দিকে তাকাতেই দেখলো দীপ কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আফিমের দিকে। আফিম যখন দেখলো আফিম দীপকে জড়িয়ে ধরে আছে। আফিম দ্রুত ছেড়ে দিলো এক ঝটকায়। দীপ গিয়ে দাঁড়ালো লাবিবার পিছনে। আফরা হো হো করে হেসে ফেললো। লাবিবা এখনো হা হয়ে তাকিয়ে আছে ইনায়াত আর আফিমের দিকে। ইনায়াত যে আসলে এতো যুদ্ধ করে এতোদিন তার ছেলেকে জাগিয়েছে তা জানা ছিলো না তার। আফিম কিছু না বলে অস্বস্তি নিয়েই চলে গেলো ওয়াসরুমের ভেতর। ইনায়াত টাওয়েল হাতে দ্রুত দৌড়ে বললো,,

– টাওয়েল!!
ইনায়াতের এভাবে দৌড়ে এসে টাওয়েল দেওয়ার দৃশ্য দেখে লাবিবার মুখে কেমন এক হাসি ফুঁটে উঠলো। আফিম অস্বস্তি নিয়ে একবার লাবিবা আর আফরার দিকে তাকালো। পরমূহুর্তেই রাগ নিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে টাওয়েল একপ্রকার কেড়ে নিয়ে ঢুকে গেলো ওয়াসরুমে। ইনায়াত দীপের দিকে ঘুরে বললো,,
– আর্লি ব্রেকফাস্ট রেডি করো। নাহয় তোমাদের স্যার খাবে না আর।

ইনায়াত দ্রুত পায়ে দৌড়ে দৌড়ে রুম গোছাতে লাগলো। বিছানা ভাঁজ করে আফিমের জামাকাপড় বের করে খাটের উপর রাখলো। জোসেফ এতোক্ষন ইনায়াতের কাজগুলো লাবিবাদের সাথেই দাঁড়িয়ে হা হয়ে দেখছে। দীপ ততোক্ষনে ট্রে করে লাবিবা,,, আফরা,, ইনায়াত,, জোসেফ আর আফিমের ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসছে। আফিম বাথরুম থেকেই আওয়াজ দিলো ” আমার চেঞ্জ “। ইনায়াত পুরো ঘর ছিমছাম করে ফেলেছে ততোক্ষনে। আফিম ডাক দিতেই বিছানার উপরের কাপড়চোপড় গুলো নিয়ে আফিমের বের করে রাখা হাতে দিয়ে দিলো। এরপর এসে ক্লান্ত হয়ে ধুপ করে চেয়ারে বসতেই খেয়াল হলো ৩ জোড়া চোখ হা হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইনায়াত আবারও তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। সবার এমন চাহনী দিয়ে একটা বোকা বোকা হাসি দিলো,,

– এই কাজগুলো কি তুমিই করো নাকি ভাবী??
আফরার প্রশ্ন। ইনায়াত কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ জানালো।
– কয়দিন ধরে করো??
লাবিবার গম্ভীর প্রশ্ন। ইনায়াত অবাক হলো।
– কেন ম্যাম!! যেদিন জবে জয়েন করেছি এই ৩ দিন পর থেকেই করি। মানে প্রায় আড়াই সপ্তাহ।
লাবিবা অবাক হয়ে জোসেফের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে ইশারা করলো কিছু একটা।
– আফিম কিছু বলে না??
– নাতো!!
জোসেফ প্রশ্নের উত্তর না পাবে তা আশা করেনি। তখনই আফিম ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে ভেজা টাওয়েল খাটে ছুড়ে মেরে দিলো। ইনায়াত দ্রুত গিয়ে ভেজা টাওয়েলটা উঠিয়ে নিজ জায়গায় গুছিয়ে রাখলো। সবাইকে নিজের রুমে দেখে আফিম অবাক হলো।
– কোন সমস্যা??

– ভাবীই তোর সব কাজ করে দেয়?? সকাল থেকে রাত??
আফরা ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে বললো। আফিম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে বললো,,
– হ্যাঁ!! তোর ভাবীই করে দেয়। কেন??
লাবিবা আর জোসেফ তো হা। এখন ইনায়াতও হা। আফিম কেন ” তোর ভাবী ” বলছে??
– তোর জিনিসে ওকে হাত লাগাতে দিস??
লাবিবা প্রশ্ন করলো।
– ও করে দেয় বলেই তো চিন্তা করতে হয় না।
– ও তোর পিএ হয় নাকি বৌ??
জোসেফ প্রশ্ন করলো। আফিম তখন থেকে নিজের মতো করে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েও সে চুপ হয়ে গেলো। ইনায়াত আর আফিম একবার একে অপরের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি নিয়ে হাসার চেষ্টা করলো।

ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ১০+১১

তাহজিব আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে উঠে দেখলো তার বুকের মাঝেই গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে রুহি।
– আজকে আবারও??
মৃদু শব্দে জিজ্ঞেস করলো তাহজিব। চোখ বন্ধ অবস্থায় রুহি বলে উঠলো,,
– বাসার বিছানাটা চেঞ্জ করাচ্ছে তাই ঘুমোতে এসছি।
– এই পিচ্চি,, বাসায় আর রুম ছিলো না??
– বাসায় রুম,, বিছানা সব ছিলো। আপনি ছিলেন না।
রুহি উঠে পড়লো।

– আমি ব্রেকফাস্ট বানিয়েই রুমে এসছি। নিচে সার্ভ করছি। ফ্রেশ হয়ে নিন। আজ যে মিটিং আছে ইম্পর্ট্যান্ট মাথায় আছে তা??
তাহজিবের মনে পড়ে গেলো। দ্রুত নেমে পড়লো খাট থেকে। রুহি টাওয়েল এগিয়ে দিলো তাহজিবের দিকে। তাহজিব তা নিয়েই ঢুকে পড়লো ওয়াসরুমে। রুহি সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,,
– আমি আপনাকে টাওয়েল এগিয়ে দিলাম,, আপনার বুকে ঘুমালাম। আপনি বিরক্ত হলেন না কেন??
কিন্তু তাহজিব ততোক্ষনে ওয়াসরুমে। তাই শুনলোই না।
তাহজিব আর রুহি?? পিচ্চি রুহি নিজের ভালোবাসার রঙ্গ কিভাবে লাগাবে তাহজিবের মনে?? আফিম কিভাবে বুঝবে ইনায়াতের প্রতি তার অনুভুতি??

ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব ১৪+১৫