ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৪১

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৪১
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

তানিশা দুপুর বেলা সরল মনে খাবারগুলো নিয়ে বাসায় ফিরলো।সে ভাবতেই পারে নি এই খাবার দেখে সবাই এতো বাজে রিয়েক্ট করবে।সবাই তানিশাকে বোকা বলে সম্বোধন করতে লাগলো।সবাই বলতে লাগলো তানিশা কি করে একজন অচেনা মানুষের খাবার এভাবে বাসায় নিয়ে এসেছে।

তানিশা সেই কথা শুনে বললো, মহিলাটি অচেনা হলেও একদম আপন জনের মতো ব্যবহার করে আমার সাথে।
সেজন্য কেউ না খেলেও আমি একাই খাবো।আর নোমানের জন্যও রেখে দেবো।কিন্তু ওর ও যদি ইচ্ছা না করে তাহলে ও খাবে না।এই বলে তানিশা বিসমিল্লাহ বলে একটা পিঠায় কামড় দিলো।যতই হোক অচেনা মানুষের দেওয়া খাবার,তার ও কিন্তু ভয় লাগছে।পরে আবার ভাবছে দূর,উনি তানিশার কেনো ক্ষতি করতে চাইবেন?তাছাড়া মহিলাটি কত যত্নে রেঁধেছেন খাবারগুলো।সেজন্য তানিশা একাই খাওয়া শুরু করলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জাস্ট অসাধারণ হইছে এই বলে তানিশা পিঠা খাওয়ার পর এবার একটু পায়েস ও খেয়ে নিলো।
এদিকে নোমানের নাম নিতেই নোমানও এসে হাজির।নোমান তানিশাকে এভাবে চারটি বক্স ভর্তি খাবারের সামনে দেখে বললো, কি ব্যাপার তানিশা?খাবারের দোকান দিয়েছো নাকি?
তানিশা তখন বললো কেনো নিবেন নাকি?নিতে চাইলে নিয়ে যান।ফ্রি তে দিয়ে দেবো।
নোমান সেই কথা শুনে বললো মাত্র ফিরলাম বাসায়। ফ্রেশ হয়ে নেই আগে।তারপর খাবো।এই বলে নোমান শুধু এক চামুচ পায়েস খেলো।আর খাওয়ামাত্র বললো বাহঃ দারুন হইছে তো।

তাহমিনা নোমানের মুখে খাবারের প্রশংসা শুনে বললো,খাবার গুলো কে রেঁধেছে সেটা তো জিজ্ঞেস কর আগে?
নোমান তখন আরেক চামুচ পায়েস মুখে দিয়ে তানিশাকে বললো কে রেঁধেছে তানিশা?
তানিশা তখন বললো ওই যে সেদিন চেম্বারে বাচ্চা সহ এক মহিলা এসেছিলো, আপনার গা মাথা ছুঁয়ে দোয়া করলো উনি রেঁধে দিয়েছেন খাবারগুলো।

তানিশার কথা শুনে নোমান একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো।সে বুঝতে পারলো না ঐ মহিলা কেনো হঠাৎ এভাবে খাবার দেবে তানিশাকে?মুহুর্তের মধ্যে নোমান ভাবনার জগতে চলে গেলো।
নোমানকে এভাবে ভাবতে দেখে তানিশা বললো,কি হলো?আপনিও সবার মতো আবার ভয় পাচ্ছেন নাকি খেতে?সবাই তো আমাকে বকাঝকা করছে কেনো নিয়ে এসেছি আমি এ খাবার?

নোমান তখন বললো যার খেতে ভয় লাগবে সে খাবে না।এ নিয়ে বাড়তি কথা বলার কি আছে?উনি কত কষ্ট করে ভালোবেসে রেঁধে দিয়েছেন, সেই খাবার নষ্ট করা মোটেও ঠিক হবে না।কেউ না খেলে আমি খাবো।
তাহমিনা নোমানের কথা শুনে বললো,তোর একটুও ভয় করছে না?যদি খাবারে পয়জন মিক্সড করে থাকেন উনি?
নোমান সেই কথা শুনে বললো,যা হবার তা তো হবেই।তাছাড়া আমি তো খেয়েছিই।এখন আর বলে কি হবে?এদিকে আবার তানিশাও খেয়েছে।এখন কিছু হলে দুইজনের একসাথেই হবে।বউ মারা গেলে স্বামী একা একা বেঁচে থেকে আর কি করবে?এই বলে নোমান তার রুমে চলে গেলো।

নোমানের কথা শুনে শিরিন বললো, আহারে বালুবাসা!কি মহব্বত!দুইজন একসাথে মরতে চায়।তাহলে আমরা একা একা বেঁচে থেকে কি করবো?দাও আমাদের কেও দাও।আমরাও খেয়ে একটু মরি।
তানিশা শিরিনের কথা শুনে মনে মনে নোমান কে বকতে লাগলো।এই ছেলে সবার সামনে কখন কি বলে নিজেও তা জানে না।
অন্যদিকে শিলা তানিশার প্রতি নোমানের এই ভালোবাসা দেখে হেসে উঠলো।সে মনে মনে ভাবতে লাগলো তাকেও যদি কেউ এভাবে ভালোবাসতো?কি প্রেম দুইজনের মধ্যে!

তানিশা নোমানের জন্য অপেক্ষা করছে।দুইজন একসাথে বসে খাবে।নোমান কিছুক্ষন পর ফ্রেশ হয়ে আসলে তানিশা হাঁসের মাংস আর পোলাও তুলে দিলো নোমানের প্লেটে।খাবার গুলোর কেমন যেনো অন্য রকম এক টেস্ট।খুবই মজা লাগলো নোমানের।সেজন্য সে আরো এক প্লেট খেলো।
এতোক্ষন বাসার কেউই খেতে সাহস পাচ্ছিলো না।কিন্তু তানিশা আর নোমানকে মজা করে খাওয়া দেখে তানিয়া বললো, দে আমাকেও দে।যা হবার হবে।এই বলে তানিয়া নিজেই একটা পিঠা তুলে নিয়ে খেতে লাগলো।অন্যদিকে শিরিন মনে মনে ভাবলো সে কেনো অযথা বসে থাকবে?সেজন্য শিরিন এক বাটি পায়েস শিলা কে দিলো আর সে কয়েকটি পিঠা তুলে নিয়ে খেতে লাগলো।

তাহমিনা চৌধুরী এদের সবার খাওয়া দেখে শুধু বিড়বিড় করে বকছে ।তিনি মনে মনে বলছেন জীবনে মনে হয় এসব খাবার খায় নি এরা।সেজন্য অন্যের দেওয়া খাবার খেতে হবে?
এদিকে ইশা তন্নির কানে কানে বলছে,মা,আমিও একটা পিঠা খাবো। তন্নি সেই কথা শুনে যেই হাত দিয়েছে পিঠায় তখনি তাহমিনা চৌধুরী চিৎকার করে বললো, খবরদার তুই খাবি না এসব বাহিরের মানুষের খাবার।
তন্নি সেই কথা শুনে বললো সবাই খাচ্ছে তো!আমি খেলে কি সমস্যা?

–হ্যাঁ তোর সমস্যা হবে।আমি বলছি তুই খাবি না।পিঠা খেতে মন চাইছে তোর?পায়েস খাবি?কি খেতে মন চায় বল।আমি এক্ষুনি রেঁধে দিচ্ছি।
তন্নি তখন বললো মা,আমি খাবো না।ইশা কাঁদছে খাওয়ার জন্য।
–না,তোদের কারো খাওয়া যাবে না।এই বলে তাহমিনা চৌধুরী তন্নি আর ইশাকে নিয়ে রুমে চলে গেলেন।
তাহমিনা চৌধুরীর এমন বাজে ব্যবহার দেখে সবাই ভীষণ অবাক হলো।তারপর সবাই ফিক করে হেসে আবার খাওয়া শুরু করলো।কারণ তাহমিনা যে সবসময় একটু বেশি বোঝে সেটা সবাই ভালো করেই জানে।

কিছুক্ষন পর অফিস থেকে তায়েব চৌধুরী বাসায় ফিরলেন।তিনি তো রুমে ঢুকেই বললেন, আজ দেখি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পড়ছে।তা কি কি এতো রান্না করা হয়েছে?পুরো ঘর দেখি খাবারের গন্ধে মউ মউ করছে।
তানিশা তায়েব চৌধুরী কে আসা দেখেই বললো বাবা আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।আমি খাবার রেডি করছি।
–ওকে।এই বলে তায়েব চৌধুরী তার রুমে চলে গেলেন।
এদিকে তানিশা তায়েব চৌধুরীর জন্য খাবার রেডি করে রাখলো।
এক এক করে সবার খাওয়া শেষ হলে কিছু খাবার বেচে গিয়েছিলো।সেজন্য তানিশা সেগুলো ফ্রিজে রাখবে বলে রান্না ঘরে নিয়ে গেলো।

এদিকে তায়েব চৌধুরী ফ্রেশ হয়ে এসে দেখেন টেবিলে ভাত,মসুরের ডাল,চিংড়ি মাছ ভুনা,পাবদা মাছের ঝোল,শুটকি ভর্তা আর করলা ভাজি রাখা আছে। কিন্তু তায়েব চৌধুরী তো পোলাওর ঘ্রাণ পেলেন।সেজন্য তিনি তানিশাকে বললেন,কি ব্যাপার মা?পোলাও মাংস কই?
তানিশা তায়েব চৌধুরী কে বলতে ভয় পাচ্ছিলো।কারণ তায়েব চৌধুরীও যদি তাহমিনা চৌধুরীর মতো বকাবকি শুরু করে দেয়। তানিশা চুপচাপ থাকা দেখে তায়েব চৌধুরী হেসে হেসে বললো,শেষ হয়ে গেছে বুঝি?
–না,বাবা।আরো আছে খাবার।কিন্তু খাবার গুলো আজ আমাদের বাসাতে রান্না হয় নি।আমার চেম্বারের একজন রোগীর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো উনি রেঁধে নিয়ে এসেছেন আমার জন্য।

তায়েব চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো, ও।তা ভালো তো।খুব বেশি পছন্দ করে বুঝি তোমাকে।
–জানি না বাবা।মহিলাটির সাথে আমার মাত্র এক দিন দেখা হইছে।আর তাতেই পোলাও,মাংস,পায়েস আর পিঠা বানিয়ে দিয়েছে।
তায়েব চৌধুরী এই বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা বললেন না।কারন এটা একদম নরমাল বিষয়। কেউ ভালোবেসে রেঁধে দিতেই পারে।

তানিশা তায়েব চৌধুরী কে চুপ থাকা দেখে বললো,বাবা আপনার না হাসের মাংস পছন্দ।দুই টুকরো কি দেবো?
–দাও।
তানিশা সেই কথা শুনে তায়েব চৌধুরী কে দুই টুকরা মাংস তুলে দিলো।তারপর খাওয়া শেষ হলে একটু পায়েস ও দিলো।তায়েব চৌধুরী কিছু মনে না করে চুপচাপ খেলেন।বাট তিনি কোনো কথা বললেন না।একবারের জন্য বললেনও না কেমন হয়েছে খাবার টি।

নোমান বেলকুনিতে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে।তানিশা নিজেও বেলকুনিতে চলে গেলো।আর নোমানকে জড়িয়ে ধরে বললো কখন যাবেন চেম্বারে?
নোমান তখন হঠাৎ করেই বললো, আচ্ছা তানিশা আমরা কবে মা বাবা হবো?আমার না ভীষণ ইচ্ছা বাবা হওয়ার।
তানিশা সেই কথা শুনে নোমানের সামনে গিয়ে বললো,একজন ডাক্তার মানুষ হয়েও যদি আপনি এমন অবুঝের মতো কথা বলেন তাহলে তো কিছু বলার নাই।

নোমান তখন বললো, বিশ্বাস করো তানিশা আমার কেনো জানি এখনি বাবা ডাক শুনতে ইচ্ছে করছে।আর সেই বাচ্চা সারাক্ষণ তোমাকে মা মা বলে ডাকবে।আবার ভয় ও হয়।যদি সেই বাচ্চা কিছুদিন মা বাবা ডেকে আর না ডাকতে পারে।
তানিশা বুঝতে পারলো নোমান তার মায়ের কথা বলছে।সে যে তার মাকে ডাকতে পারে নি।সেই আফসোস টা তার মনের মধ্যে ভীষণভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে।তানিশা তখন নোমানকে জড়িয়ে ধরে বললো,মন খারাপ করবেন না প্লিজ।আপনাকে মন খারাপ দেখলে আমার ভালো লাগে না।যান এখন চেম্বারে।
নোমান তখন তার চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো তুমি যাবে না?

–না এখন আমার কোনো ডিউটি নাই।তবে আজ রাতের দিকে হয় তো বাসায় আসতে পারবো না।ইমারজেন্সি কয়েকটা অপারেশন আছে।
নোমান সেই কথা শুনে তানিশার কপালে একটা গভীর চুমু দিয়ে বললো,আমি তাহলে আসছি।তুমি সাবধানে যেও।এই বলে নোমান অফিসে চলে গেলো।

এদিকে তায়েব চৌধুরী ওনার রুমে গিয়ে মিসেস মালিহা চৌধুরীর একটা ফটো বের করে দেখতে লাগলেন।ফটো টা তিনি একসময় ছিড়ে ফেলে দিয়েছেন।কিন্তু পরে আবার জোড়া লাগিয়ে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছেন।।কারণ আজ তায়েব চৌধুরী আর মিসেস মালিহা চৌধুরীর বিবাহবার্ষিকী ছিলো।তায়েব চৌধুরী খাবার গুলো খেয়ে চুপচাপ ছিলেন এই কারনেই।কারণ মালিহা প্রতি বছর তাদের বিবাহ বার্ষিকিতে এইভাবে রান্না করে খাওয়াতো তাকে।বহু বছর পর ঠিক আজকের এই দিনেই সেই খাবার খেয়ে তায়েব চৌধুরী ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু ওনার তো ইমোশনাল হলে চলবে না।ওনাকে শক্ত হতে হবে।এই বলে ছবিটা আবার গোপন জায়গায় রেখে দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলেন তায়েব চৌধুরী।

তায়েব চৌধুরী জানেন মালিহা আকবরের সাথে পালিয়ে গেছে।যে স্ত্রী তার দুইটা সন্তান রেখে পুরাতন প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায় তার প্রতি কখনোই কোনো স্বামীর ভালোবাসা জন্মাবে না।তার প্রতি শুধু ঘৃনারই সৃষ্টি হবে।সেজন্য তায়েব চৌধুরী আমান আর নোমান কে বলেছে যে তাদের মা মারা গিয়েছে।কারণ তিনি কখনোই চান নি তাদের মায়ের এই অপকর্ম শুনে ছেলেরা তার কষ্ট পাক।মালিহা এখন যে সম্মান পাচ্ছে কিন্তু তার সম্পর্কে আসল সত্যটা শুনলে ছেলেরা তাকে হয় তো ঘৃণা করা শুরু করে দিবে।

তায়েব চৌধুরী আর মালিহার সংসার টা একদম সুখে ভরপুর ছিলো।তায়েব চৌধুরী কত ভালোবেসে ছিলো মালিহাকে।কিন্তু মালিহা একদিনের জন্যও বলে নি যে তার প্রাক্তন আছে।তায়েব চৌধুরী তো ভেবেছে মালিহাও তাকে মনে প্রাণে ভালোবাসে।কিন্তু সেই ভালোবাসার বউ এভাবে যে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে সত্যি তিনি কল্পনাও করেন নি।
জীবনে অনেক বড় একটা ধোকা খেয়ে তায়েব চৌধুরী আজ ভীষণ ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা করেন।তিনি মনে করেন যে যাকে ভালোবাসে তার তাকেই বিয়ে করে নেওয়া উচিত।তা না হলে মাঝখান থেকে চার টা মানুষের জীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৪০

জীবনে অপরিসীম সুখ ভোগ করার পর,সেই সুখ যখন তার নিমিষেই বিলীন হয়ে যায়,তখন দুঃখকে সারাজীবনের জন্য গ্রহন করা মানুষ টি জানে বেঁচে থাকা কত টা কঠিন।যেমন ভাবে বেঁচে আছে তায়েব চৌধুরী।তিনি মালিহাকে এতোটাই ভালোবেসেছিলেন যে দ্বিতীয় কাউকে গ্রহন করতে পারেন নি।মালিহা যে তার সাথে প্রতারণা করেছে তবুও এখনো তাকেই এক তরফা ভাবে ভালোবেসে আসছে।

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৪২