ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৪২

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৪২
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

মালিহা চৌধুরী আজও এসেছেন তানিশার চেম্বারে।কিন্তু তানিশা রোগী দেখায় ব্যস্ত আছে দেখে তানিশার এসিস্ট্যান্ট মায়া বললো,ম্যাডাম ব্যস্ত আছে এখন।কিছুক্ষণ পরে আসেন।
মালিহা চৌধুরী সেজন্য চেম্বারের বাহিরে রাখা সোফায় বসে থাকলেন।এদিকে তানিশা জানেই না মালিহা চৌধুরী আজকেও এসেছেন।তানিশা তো মনোযোগ দিয়ে নীলার কথা শুনছে।

নীলা বলছে,ম্যাম, আমি এ বাচ্চা কিছুতেই রাখতে পারবো না।আমি এবরশন করতে চাই।
তানিশা সেই কথা শুনে চমকে উঠে বললো, হঠাৎ এ সিদ্ধান্ত কেনো তোমার?
নীলা তখন বললো আমার উডবি হাজব্যান্ড চাচ্ছেন না এই বাচ্চাটাকে।
তানিশা সেই কথা শুনে বললো, একটা বাচ্চার জন্য মানুষ দিন রাত কাঁদছে তবুও পাচ্ছে না,আর তুমি না চাইতেই পেয়েছো।তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
নীলা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললো ম্যাডাম আমি আপনার কাছে এবরশনের ব্যাপারে পরামর্শ নিতে এসেছি প্লিজ আপনি সেই ব্যাপারে পরামর্শ দিন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তানিশা তখন নীলাকে বললো,আমি জানি তুমি সংকোচ করছো।আসলে পরিবারের সবাইকে এই কথা টা বলা ভীষণ লজ্জাজনক ব্যাপার।এজন্য আমি বলি কি তুমি তোমার উড বি হাজব্যান্ড কেই ব্যাপার টা বলতে বলো সবাইকে।উনিই হয় তো কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন।তোমার বাবা মা জানতে পারলে ওনারা নিশ্চয় তাড়াতাড়ি করে বিয়ের ব্যবস্থা করবেন।এভাবে বাচ্চা নষ্ট করা ঠিক না নীলা।বুঝতে চেষ্টা করো।

নীলা এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না।সে তখন কাঁদতে কাঁদতে সত্য কথা টা বলে দিলো।সে বললো ম্যাডাম আমি আপনাকে সেদিন মিথ্যা কথা বলেছি।আমার কারো সাথে বিয়ে ঠিক হয় নি।আমার এক ছেলের সাথে রিলেশন ছিলো।তার সাথে আমার অনেকবার শারীরিক সম্পর্কও হয়েছে।কিন্তু আমার পেটে বাচ্চা আসার পর থেকে সে আর আমার সাথে যোগাযোগ করে না।আমি অনেক কষ্টে তাকে খুঁজে বের করি।কিন্তু সে সরাসরি জানিয়ে দেয় সে আর আমার সাথে রিলেশন রাখতে চায় না।আমি এখন না পারছি কাউকে বলতে না পারছি এই বাচ্চাটাকে রাখতে।এখন আমি কি করবো আপনিই বলুন।কথাগুলো বলতেই নীলা জোরে জোরে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো।

তানিশা নীলার কথা শুনে ভীষণ রেগে গেলো। সে তখন বললো, আমি একটা জিনিস বুঝি না,তোমরা মেয়েরা এতো অবুঝ কেনো?কেনো নিজেদের ভালো বোঝো না?একটা ছেলে দুই দিন একটু পিছে পিছে ঘুরলেই তাকে বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে নাও।আচ্ছা তা না হয় নিলে।কিন্তু প্রেম ভালোবাসার নামে এসব কি ধরনের নোংরামি?ভালোবাসো।ভালোবাসতে নিষেধ করছি না আমি।কিন্তু বিয়ের আগেই কেনো এসব সেক্সুয়েল সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ো?একবারও কি ভেবে দেখো না এই ছেলে টা তোমাকে বিয়ে না করলে তখন তোমার পরিনতি টা কি হতে পারে?

নীলা তানিশার কথা শুনে আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো। সে এতোদিনে বুঝতে পারছে মস্ত বড় ভুল করেছে সে।বিয়ের আগেই এভাবে তার সেক্সুয়াল সম্পর্কে জড়ানো উচিত হয় নি।আজ তাকে সেই ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে।
তানিশা নীলার কান্না করা দেখে ভীষণ আপসেট হয়ে গেলো।সে তখন নীলাকে শান্ত্বনা দিয়ে বললো,এভাবে কেঁদে কোনো লাভ হবে না।ব্যাপার টা সবাইকে জানাতে হবে।তোমার বাবা মাকে জানাতে হবে,ছেলের পরিবারের লোকদের জানাতে হবে।

নীলা সেই কথা শুনে বললো আমি আমার বাবা মাকে এই কথা টা কিছুতেই বলতে পারবো না। ওনারা শুনলে আমাকে জীবিতই পুঁতে ফেলবেন।আমার বাবা ভীষণ রাগী একজন মানুষ। তাছাড়া এই ব্যাপার টা জানাজানি হলে বাবার মানসম্মানেও আঘাত লাগবে।
তানিশা তখন বললো ওকে।আমি তোমাকে হেল্প করবো। তোমার ঐ বদমায়েশ বয়ফ্রেন্ডের বাসার ঠিকানা দাও।আমি ওর গার্ডিয়ানের সাথে কথা বলবো।
নীলা তখন বললো ম্যাডাম!আমি তো ওই ছেলের বাসার ঠিকানা জানি না।

–মানে কি?কিছু না জেনে কিভাবে এই রকম একটা কাজ করেছো?আমি সত্যি অবাক হয়ে যাচ্ছি।
এদিকে মায়া বার বার বলছে ম্যাডাম নেক্সট পেশেন্ট কে কি ডেকে দিবো?
–হ্যাঁ দাও।এই বলে তানিশা নীলাকে বললো ছেলের বাসার ঠিকানা জোগাড় করে আমার সাথে যোগাযোগ করিও।আর হ্যাঁ,ভুল করেও বাচ্চা নষ্ট করার কথা ভাববে না।যাও এখন।

এদিকে নেক্সট পেশেন্ট ডুকে গেছে চেম্বারে।কিন্তু নেক্সট পেশেন্ট কে ঢোকা দেখে মালিহা চৌধুরী এগিয়ে এসে বললো, ম্যাডাম কে একটু বলেন না আদ্রিয়ানের মা দেখা করতে এসেছে।
মায়া তখন বললো দেখছেনই তো ম্যাডাম ব্যস্ত আছে।একটু অপেক্ষা করুন।
মালিহা সেই কথা শুনে আবার বসে পড়লেন সোফায়।তিনি আজ আর আদ্রিয়ান কে সাথে করে নিয়ে আসেন নি।
হঠাৎ নোমান আসলো চেম্বারে।কারন তানিশা কাল থেকে বাসায় যায় নি।কাজের প্রেশার বেশি হওয়ায় বাসায় যেতে পারে নি সে।এদিকে প্রানপ্রিয় বউটিকে না দেখতে পেয়ে ভীষণ অস্থির লাগছিলো নোমানের।ভেবেছিলো আজ একটু কিছুটা সময় তারা এনজয় করবে।কিন্তু সেটা আর হলো না।কারন আজ রাতে আবার নোমানের ডিউটি আছে।সেজন্য সেও আজ বাসায় থাকতে পারবে না।সেজন্য তানিশার সাথে চেম্বারেই দেখা করতে এসেছে।

নোমানকে দেখামাত্র মায়া তানিশাকে বললো,ম্যাডাম!স্যার আসছে।
তানিশা সেই কথা শুনে বললো, ওনাকে একটু wait করতে বলো।এই বলে তানিশা দ্রুত রুমে থাকা পেশেন্টের সমস্যার কথা শুনলো।তারপর তাকে প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে বললো এই টেস্ট দুই টা করে রিপোর্ট টা আমার চেম্বারে দিয়ে যেও।
এদিকে নোমান বাহিরেই দাঁড়িয়ে আছে।ভিতরের রোগী টি বের হলে তখন নোমান বললো,মে আই কাম ইন ম্যাডাম?
তানিশা নোমান কে দেখামাত্র দৌঁড়ে আসলো।আর তাকে জড়িয়ে ধরে থাকলো কিছুক্ষন।মনে হচ্ছে কতদিন ধরে দেখে না তাকে।নোমান তখন নিজেও তানিশাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো আর বললো,মিস করতেছিলে?

–হুম।খুব।
নোমান তখন তানিশার কপালে একটা কিস করে বললো আজ রাতে আবার আমার ডিউটি আছে।আজও আর দেখা হচ্ছে না আমাদের।সেজন্য চেম্বারেই দেখা করতে আসলাম।এখন কি ফ্রি আছো?
তানিশা তখন বললো বাহিরে দেখেন নি কত বড় লাইন?মনে হয় না সন্ধ্যার আগে ফ্রি হতে পারবো?
নোমান তখন তানিশার ঠোঁটে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললো,ইসস,কি ব্যস্ত আমার বউ টা!তা লাঞ্চ করেছো?

–না।
–চলো কিছু খেয়ে আসি।
তানিশা সেই কথা শুনে মায়াকে বললো, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলো সবাইকে।আর বলো,ম্যাডাম লাঞ্চ করতে গেছে।এই বলে সে নোমানের হাত ধরে বের হলো চেম্বার থেকে।
এদিকে মালিহা চৌধুরী নোমান আর তানিশা কে দেখামাত্র দৌঁড়ে এলেন।আর বললেন,আমি অনেকক্ষন ধরে বসে আছি ম্যাডাম।আপনার সাথে একটু দেখা করতে এসেছিলাম।এই বলে মালিহা চৌধুরী নোমানের দিকে তাকালো।আর নোমান ও অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো।নোমান মালিহা চৌধুরীর সাথে কথা বলতেই ভুলে গেলো।

আসলে আপনজন ঠিকই তার রক্ত কে চিনতে পারে।নোমান মালিহা চৌধুরীকে দেখলেই কেনো জানি অন্য রকম এক জগতে হারিয়ে যায়।তার খুব চেনা চেনা লাগে মালিহা চৌধুরীকে।
মালিহা চৌধুরী তখন নিজের থেকেই বললো,বাবা নোমান!কেমন আছো?
নোমানের এতোক্ষনে হুঁশ ফিরে এলো।সে তখন বললো আসসালামু আন্টি।আপনি কেমন আছেন?
মালিহা চৌধুরী তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,জ্বি বাবা ভালো।তবে মালিহার বুক টা ফেটে চৌঁচির হয়ে যাচ্ছে একদম।নিজের ছেলের মুখে আন্টি ডাক শুনে। আবার মালিহা নোমানকে আন্টি ডাকতে নিষেধ করতেও পারছে না।কারণ মালিহা বুঝে গেছে তায়েব তার ছবিও দেখায় নি ছেলেদের। সেজন্য নোমান চিনতে পারছে না মালিহাকে।এতোটাই ঘৃনা করে তায়েব তাকে।

তানিশা তখন বললো আন্টি! আপনার রান্না করা খাবারগুলো জোস ছিলো।এক কথায় অসাধারণ। আমরা সবাই খেয়েছি।সবাই খেয়ে ভীষণ পছন্দ করেছে।
নোমান তখন নিজেও বললো হ্যাঁ আন্টি।দারুন হয়েছিলো খাবারগুলো।একদম অন্যরকম টেস্ট।
মালিহা চৌধুরী সেই কথা শুনে ভুলবশত বলে ফেললো,তোমার শশুড় ও খেয়েছিলো?উনি খেয়ে কিছু বলেন নি?

তানিশা আর নোমান সেই কথা শুনে ভীষণ অবাক হলো।তারা দুইজন দুইজনের দিকে তাকাতেই মালিহা চৌধুরী বললো, না মানে বলতে চাইছিলাম তোমার শশুড় শাশুড়ী ওনারাও কি খেয়েছিলেন?অচেনা মানুষের খাবার খেয়ে কিছু বলেন নি?
তানিশা সেই কথা শুনে বললো, আসলে আন্টি আমার শাশুড়ী নাই।উনি মারা গেছেন।তবে আমার শশুড় খেয়েছেন।
মালিহা চৌধুরী তানিশার কথা শুনে মনে মনে হাসতে লাগলো। আর বললো, হায় রে কপাল!

জীবিত মানুষ কে মৃত বলে চালিয়ে দিয়েছে।আর কত খেলা দেখাবে এরা?সামান্য একটা ভুলবোঝাবুঝির কারনে আমার ছেলেদের এভাবে দূরে রেখেছে।আমাকে মৃত বলে জানিয়েছে।এই অন্যায় আর আমি কিছুতেই হতে দেবো না।এবার যখন খোঁজ পেয়েই গেছি তখন এর শেষ দেখে নিবো।তায়েবের মুখোমুখি হবো আমি।মা আর বোনের কথা বিশ্বাস করে সে আমার কত বড় ক্ষতি করেছে সব বলবো ছেলেদের আমি।ছেলেরা নিশ্চয় বুঝবে আমাকে।তারা কখনোই মাকে অবিশ্বাস করবে না।

মালিহা কে চুপচাপ থাকা দেখে তানিশা বললো, আন্টি আমাদের সাথে চলুন।লাঞ্চ করি একসাথে।
–না মা।তোমরা যাও।তোমাদের সাথে আরেক দিন করবো লাঞ্চ।তবে বাহিরে না।তোমাদের বাসাতে।তোমাদের বাসার ঠিকানা টা দেবে আমাকে?

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৪১

নোমান সেই কথা শুনে তাদের বাসার ঠিকানা দিয়ে দিলো।মালিহা চৌধুরী যে কত খুশি হলো এই ঠিকানা পেয়ে সত্যি তিনি আজ নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না।ছেলেদের খুঁজতে খুঁজতে আর তাদের জন্য দিনরাত কাঁদতে কাঁদতে চোখ টাই নষ্ট করে ফেলছেন তিনি।মালিহা অনেক খুঁজেছে তায়েব আর তার বাচ্চাদের।কিন্তু কেউই তাদের ঠিকানা বলতে পারে নি।কারণ মালিহা আকবরের সাথে পালিয়ে যাওয়ার পর পরই তায়েব তার বাসা চেঞ্জ করেছে।মালিহা তাহমিনার শশুড় বাড়িতেও গিয়েছিলো খোঁজ নেওয়ার জন্য।কিন্তু সেখানে গিয়ে শোনে তাহমিনা আর তার স্বামীর সাথে থাকে না।

ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব ৪৩