তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৯

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৯
সুরাইয়া আয়াত

আজ সকালে আয়াশ ও নূর বাসায় ফিরেছে, বাসায় ফেরার পর থেকে নূর কথা বলছে না আয়াশের সাথে। আয়াশ নিজে থেকে একবার কথা বলতে গেলেও নূরের হাবভাবে সে এবার গা ছাড়া ভাব দেখালো।
এ বাসায় এসে আয়াশের দাদীমাকে নূর আর দেখেনি, উনি সেদিনই রাগ করে বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, যাওয়ার পূর্বে বলে গেছেন যে নূর যদি তার কাছে ক্ষমা না চায় তো সে আর এই বাসায় কখনো ফিরবে না। ওনাকে ফেরানোর জন্য হলেও হয়তো নূরকে নত স্বীকার করতে হবে তার কাছে।

নূর ঘরটা গোছাতে লাগলো, ঘরটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি অগোছালো। নূর নিজের কিছু জিনিসও টুকটাক গোছাতে লাগলো। আয়াশ কখন বেরিয়েছে নূর জানে না। সকাল এ আসার পর থেকে সে একটা ভাতের দানা অবধি মুখে তোলেনি, আর কেউ সেদিকে খেয়াল ও করেনি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এ বাসায় ঢুকে নূর আয়াশের ভাইয়া আর ভাবীকেও দেখলো না। যতদূর জেনেছে ভাইয়ার নাম আহান ও ভাবীর নাম ইপশা। ইপশা ভাবী আর ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে তিন বছর প্রায়, তিনি এখনও এমন ভাবে নিজেকে পরিপাটি রাখেন যে প্রথমাবস্থায় তাকে দেখে বলা বাহুল্য যে তিনি নতুন বউ, এই ভ্রান্ত ধারনাটি নূরের মাঝেও কাজ করেছিল।
সামনে থেকে সকলকে সুখী মনে হলেও আসলে মানুষ ভারত থেকে প্রকৃত সুখী থাকে না, কেবল ভালো থাকার ছলনা করে প্রতিনিয়ত।

ইপশা ভাবী আর আহানের মাঝের সম্পর্কটাও ঠিক তেমনই। ইশপা আর আহান সন্তান নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিগত দুই বছর ধরে, ফলাফল শূন্য। তাই আহানের সংসার বিমুখ মনোভাব দেখে ইপশার বাবা আহানকে টাকা পয়সা দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছেন, এমনকি সে থাকে ঘর জমাই হয়ে। নামে একটা বিজনেস শুরু করে রেখেছে যেটা আয়াশ নিজে মাঝেমাঝে নজরদারি করে।

আর আয়াশের বাবা তিনি বিছানাগত হয়েছেন প্রায় ১২ কি ১৩ বছর ধরে, যেদিন আয়াশের মা মারা গেছেন সেদিন থেকে ওনার পৃথিবীটা পাল্টে গেছে। তারপর থেকে উনি একপ্রকার মানসিক রোগীতে পরিনত হয়েছেন দিন দিন, এখন আর কারও সাথে কথা বলেন না, সারাদিন নিজের ঘরেই থাকেন আর শারিরীক অসুস্থতা ওনাকে জড় পদার্থে পরিণত করেছে।

এই সব কথাগুলো বারবার নূরের মনে পড়তে লাগলো, এই সব কথা গুলো সে শুনেছে এই বাসার কাজের বুয়ার থেকে, ওনার নাম রহিমা, উনি আয়াশদের বাসাতে বিগত দশ বছর ধরে কাজ করেন, তাই এতদিনে বাড়ির খুটিনাটি সব খবরই উনি পেয়ে গেছেন।

নূর বাসায় আসতেই নূরের সাথে ওনার ভাব জমেছে বেশ, অতঃপর উনি নিজেই নূরকে সমস্ত কথা জানিয়েছেন।
নিজের জামা কাপড় গুলো কোন আলমারিতে রাখবে নূর ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। এই ঘরের আসবাবপত্র একজনের জামা কাপড় রাখার উপযুক্ত দুই জনের নয়, তবে এখন তো রাখার ব্যাবস্থা করতে হবে তাই সবটা খুলে কুলে দেখছে কোনটাতে অল্পবিস্তর জামা সরিয়ে তার নিজের জিনিস রাখা যায়।

নূর প্রত্যেকটা আলমারির দরজা খুলেছে, প্রত্যেকটাতে আয়াশের শার্ট প্যান্ট আর পাঞ্জাবি তে পরিপূর্ণ। নূরেরও বোধহয় এতো জামা নেই যতোটা সে আয়াশের সাথে তুলনা করছে। এতো জামার মধ্যে তার জামা কাপড়ের স্থান করে দিতে হলে তাকে একটু হলেও কিছু সরাতে হবে। নূর এক এক করে সব জামা নামাতে লাগলো, এটা দিক ফাঁকা করে ফেলল প্রায়। জামাকাপড়ের শেষে একটা প্যাকেট হাতে পেতেই তা খানিকটা শক্ত অনুভব হতেই নূর তা খুলতেই দেখলো বেশ কয়েকটা চিঠি, যা একত্রিত করে শক্ত বোর্ডের মতো জিনিসের মধ্যে সংরক্ষণ করে রেখেছে।

নূর কৌতুহল বশত খোলার কথা ভাবতেই তার মনে হলো অন্যের জিনিস দেখা ঠিক নয়, তবুও বেরিয়ে আসা একটা কাগজে তার বাবার নামের নামে একজনকের নাম দেখে খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেল সে। চিঠিটা খুলে পড়তেই দেখলো, পুরো একটা পাতা জুড়ে লেখা,

‘ আপনি আমার চিঠির জবাব দিলেন না আরাফাত। আপনি কি আমাকে দেওয়া আপনার কথা টা ভুলে গেছেন? ‘
এতোটাই লেখা ছিল সেই কাগজে। কাগজের রঙ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এ চিঠি বহু বছর পুরানো।
নূর যতদূর জানে আয়াশ এবং তার বাবা একে অপরের বন্ধু, তাহলে কি চিঠিটা তার বাবাকে উদ্দেশ্যে করেই লেখা? তবে এটা কার লেখা? বাকি আরও চিঠি গুলো পড়ার চেষ্টা করতে গেলেই বেশ উচ্চ শব্দ সহকারে নূরের ফোন বেজে উঠল।
নূর চিঠিগুলো হাতে নিয়ে ফোনটা ধরতেই দেখলো তার বাবা। ফোনটা কানে ধরে নূর নিরব হয়ে রইলো। আরাফাত সাহেব নিজে থেকে বললেন,

‘ মেহেরবের ভালো করে দেখাশোনা কর। যতই হোক ও তোর শ্বশুর হয়। ওই বাড়ি থেকে তোর নামে যেন কোন কমপ্লেইন না শুনি আমি। ‘
নূর বাকা হাসলো, ওনাকে শুনিয়ে বলল,
‘তুমি কবে থেকে অসুস্থ মানুষের প্রতি এতো দয়াশীল হলে বলতে পারো? যে আমাকে ফোন করে আমার শ্বশুরের দেখভাল করার কথা বলছো। ‘

‘আর একটাও বেশি কথা বললে তোর জিভ আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। তোর মুখ এখনও বন্ধ হয়নি। আমাকেই কিছু করতে হবে দেখছি। ‘
নূর ভীষন রেগে গেল, তার নিজের প্রতি তার তীব্র বিতৃষ্ণা কাজ করতে লাগল, খানিকটা জোরেই চিৎকার দিয়ে বলল,
‘ একেবারে মেরেই ফেলো আমাকে তাহলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়। তোমাদের কারোর পথের কাটা থাকবে না। না তোমার না ওই আয়াশ নামের লোকটার। ‘

‘মানে টা কি? আয়াশ তোকে পছন্দ করে না? সে তে তোকে নিজে থেকে বিয়ে করলো তবে! আমার কাছে মিথ্যা বলা! ‘
নূর বুঝলো যে তার সত্যির কোন মূল্য নেই, চোখ মুছে বিধায় বলল,
‘নাহ, উনি আমাকে ভালোবাসেন। খুব ভালোবাসেন। এতো ভালোবাসেন যে তোমরা হয়তো কল্পনাও করোনি। এটা শুনে এবার নিশ্চিয়ই তুমি অখুশি কারন তুমিই তো চাইতে আমি কখনো যেন ভালো না থাকি।
উনি রাগ দেখালেন।

‘যেভাবে পারিস ওকে হাতে রাখ। ওকে যত হাতে রাখবি, যত মোহ মায়ায় ভুলিয়ে রাখতে পারবি ততই লাভ। স্বামীকে খুশি রাখতে পারলে তোর ভাত কাপড়ের কোনদিন অভাব হবে না, আর এরপর যদি আমাদের কাছে আবার ফিরে আসিস তো তোকে দায়িত্ব সহকারে দাফন করার দায়িত্ব আমার। ‘
কথাটা বলে উনি ফোনটা রেখে দিলেন। নূরের বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। উনিই হয়তো প্রথম বাবা যিনি নিজের সন্তানের মৃত্যু কামনা করেন।

না চাইতেও নূরের চোখ দিয়ে জল গড়ালো। ফোনটা বিছানায় রাখতেই দেখলো আয়াশ আসছে। তাকে দেখে দ্রুত চোখটা মুছে নিল সে। চিঠিগুলো যথাস্থানে রেখে দিল। আয়াশ কিছু বলল না, সে এসে নিরবতা নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। নূর তার দিকে একবার তাকিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিল, এর মধ্যে রাখা চিঠি গুলো যে আবার পরে সময় নিয়ে পড়বে এমন মনোস্তাব করতে লাগলো।

আয়াশ তার সাথে একেবারেই কথা বলছে না তা নিয়ে নূরের বিন্দুমাত্র আফশোষ নেই। সে তো কোন অন্যায় করেনি। অন্যায় করলে তা আয়াশ করেছে। তার তো উচিত হয়নি তাকে এভাবে মাঝ রাতে ভয় দেখানো। নূর এক পাশ ফিরে শুয়ে আছে, পেটে ব্যাথা করছে তার তবুও মুখ বুজে সহ্য করছে।

এ বাসায় তার কোন শুভাকাঙ্ক্ষী নেই। ফোনটা নাগালের থেকে অনেকটাই দূরে ছিল, হাতড়ে হাতড়ে ফোনটা নিয়ে মায়ার কাছে কল ধরালো, কিছুক্ষণ পর মায়া কল ব্যাক করে বলল,
‘ কি গো ননদিনী কেমন আছো? ‘
নূর হাসলো। পাল্টা প্রশ্ন করলো,

‘সেটা তো আমার তোমাকে জিজ্ঞাসা করার কথা তাইনা? ‘
‘আমি তো খুব ভালো আছি। জামাই ফিরে এসেছে আর কি চাই। তোমার জামাই তো সবসময় তোমার আগে পিছেই ঘুরঘুর করে, চোখ এর আড়াল হতে দেইনা, নাহলে বুঝতে জামাই ছাড়া থাকতে কেমন লাগে।’
মায়ার কথা শুনে নূর উচ্চস্বরে হালো। হাসি পাচ্ছে তার। সত্যিই কি তাই? আয়াশ আর তার সম্পর্কটা ঠিক কেমন তা যদি নূর বোঝাতে পারতো সবাইকে, তাহলে সকলের ভুল ধারনাটা দূর হতো।
নূর হাসি থামিয়ে বলল,

‘বাদ দাও ভাবী সেসব। সাওন কেমন আছে এখন? ‘
‘আগের থেকে সুস্থ, জ্ঞান ফিরেছে তবে কথা বলতে পারছে না। ডাক্তার বলেছে সুস্থ হতে মাস দুয়েক তো লাগবেই। ‘
সাওনের এমন অবস্থার জন্য নূর নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলো, এক অপরাধবোধ খুব জাকালো ভাবে চেপে বসেছে তার মাঝে। তাই ভাবলো সে মায়াকে আজ সবটাই জানাবে। এ অপরাধের বোঝা সে আর বহন করতে পারছে না। সবটা জানতে মায়াকে বলল,

‘ সাওনের এই অবস্থার জন্য ও দায়ী নয়। ‘
নূর আরও কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই মায়া বলল,
‘সেটা তুমি এখন বললেও বিশ্বাস করছি না। ওর এমন অবস্থার জন্য ও নিজেই দায়ী। ‘
‘মানে? ‘

‘মানে টা বললেই বুঝবে। সাওন আর ওর খালাতো বোনের মাঝে বিয়ে ঠিক ছিল অনেক আগে থেকেই, ওদের দুজনের প্রায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও ছিল, তো ওরা নিজেরা বিয়ে করে নেই কাউকে না জানিয়ে, মেয়েটা ছিল তখন প্রেগনেন্ট, তবে সে বেবিটা রাখতে চাই না। এ নিয়ে দুজনের মাঝে সমস্যার সৃষ্টি হয়। মেয়েরা বাচ্চা নষ্ট করে আর ওকে বিয়ে করবে না বলে। তাই এই কয়েকমাস ধরেই মানসিক অশান্তিতে ভুগছিল ও।

ডক্টর ও দেখিয়েছিল। তবে জোর করে তো আর বিয়ে দেওয়া যায় না তাই বাসার লোক ও আর জোর করেনি কোনরকম। যখন মেয়েটা বেবি নষ্ট করতে চাইছিলো তখন ওর নিজের বাসাতে বলা উচিত ছিল যে ওরা বিয়ে করেছে। আর এখন ওর ব্যাবহার ও অনেক বদলে গেছে, আগের মতো আর নেই। ডাক্তারের দেওয়া ঔষধ ও ঠিকমতো খেতো না। তাই এবার তুমিই বলো এখানে কার দোষ? ‘

নূরের গলার আওয়াজ সম্পূর্ণ রুপে দমে গেল, মুখ থেকে কথা বার হতে চাইলো না, তবুও কাঁপা কন্ঠে বলল,
‘এটা কতদিন আগের ঘটনা ভাবী। ‘
‘এই তো, ছয় মাস আগের। আমি নিজেও জানতাম না, আমি জানলাম এই দুইমাস আগে। এটা আর তোমাকে বলতে চাইনি তুমি তাকে কি ভাবতে তাই। আর এখন তো সব জানাজানি হয়েই গেছে। তোমার ভাইয়া তো ভীষণ রেগে আছে ওর ওপর। কালকেই বাসায় ফিরে যেতে চাইছে। আচ্ছা তুমি ভালো আছো? ‘

সাওন তাকে ঠকিয়েছে, খুবই বিশ্রি ভাবে ঠকিয়েছে, তার ওপর এভাবে ওকে হুমকি দেওয়া এতো কিছুর পরও। নূরের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। নূর আর কথা বলার মুডে নেই। তার পেট ব্যাথা যেন উবে গেল নিমেশেই। নূর এবার বুঝতে পারলো যে এত মাস পর আবার সাওন কেন তাকে ফিরে আনতে চাইছিল। মায়ার আথে আরও কিছু কথা বলে ফোন রাখলো নূর, তার রাগ লাগছে ভীষন। হাতের কাছে রাখা ফুলদানিটা বাইরের দিকে ছুড়ে মারতেই দেখলো আয়াশ ঘরে ঢুকছে আপন মনে।

চোখ তুলে তাকাতেই তাকে এভাবে দেখে আয়াশ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ অলিম্পিক এ তির ছুঁড়তে যাচ্ছো নাকি? তবে ওটা ঠিক করে ধরো, এঙ্গেলটা ভুল আছে। ৪৫ ডিগ্ৰি এঙ্গেলে মারো, বেশি দূর যাবে। ‘
কথাটা বলে আয়াশ শিশ দিতে দিতে ঘরে ঢুকলো।
নূর আয়াশকে দেখে বলল,

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ বোনাস পর্ব 

‘ আজ তাহলে এই অশান্তিকেই মারবো আমি। ‘
আয়াশ এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
‘হু ইজ অশান্তি আফুসোনা? ‘

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ১০