তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৪

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৪
সুরাইয়া আয়াত

গাড়ি চালাচ্ছে আয়াশ, পাশে বসে আছে নূর, কৌতুহল বশত প্রশ্ন করলো,
‘আচ্ছা ওই বউটা কি আপনার ভাবী? ‘
‘হুম। কেন মনে হয় না? ‘
‘না তেমনটা না, ওনারাও কি এই বাসায় থাকেন? ‘
আয়াশ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
‘কেন তোমার কোন সমস্যা? ‘
‘নাহ। ‘

কথাটা বলে বাইরের দিকের দৃশ্য দেখতে মনোযোগ দিল নূর। তার মানে এই প্যারা গুলোকে তার সহ্য করতে হবে সারাজীবন, একই ছাদের নীচে তাদের সাথে কাটাতে হবে। নূর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজকে ও বাসায় গেলে সহজে আয়াশের সাথে ফিরবে না ও, কিছুদিন সেখানেই থাকবে। নতুন জীবন শুরু কারার জন্য একটা মানসিক স্থিতির প্রায়োজন যা নূরের কোনভাবেই আসছে না। নূর সিটে হেলান দিল আরাম করে, ঘুম পাচ্ছে তার।
নূরের চোখ ঘুমের ঘোরে ঢলে আসতে নিলেই আয়াশ বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ভাইয়া আর ভাবী এখানে থাকেন না। ওনারা খুলনা থাকেন। তবে মাঝে মাঝে ইচ্ছা হলে দেখা করতে আসেন। ‘
নূরের ঘুম ভেঙে গেলে আয়াশের কথাতে। মনে মনে বেশ খুশি হলেও তা বেশি প্রকাশ করলো না। আর আপনার ওই দাদী, উনি কি আপনার বাসায় থাকে?

‘নাহ, দাদী পুরান ঢাকাতে থাকেন, ওনার সংসার আছে তবে শান্তি নেই। সারাদিন বাসার লোকের ওপর কিচকিচ করতে থাকেন। উনি যেদিন এসেছেন সেদিন ওনার বাসার প্রত্যেকটি সদস্য আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন যেন এক মাসের পূর্বে ওনাকে বাসায় না পাঠায়।’
‘আচ্ছা। উনি খানিকটা রাগী, আর একটু, যাই হোক। ‘
কথাটা বলে নূর পুনরায় ঘুমে মনোযোগী হতে গেলেই আয়াশ আবার প্রশ্ন করলো,
‘তোমার মা কোথায়? ‘

মা কোথায় কথাটা শুনতেই নূরের মন খারাপ হয়ে গেল। এই প্রশ্নটা ওর কাছে খুবই বেদনাদায়ক। আয়াশ কি তাহলে জানে না ওর মা নেই, তাহলে তার বাবা এই কথাগুলো আয়াশকে জানায়নি!
নূর ধরা কন্ঠে জবাব দিল।
‘নেই। মারা গেছেন। তাকে কেমন দেখতে ছিল তা ও জানি না। ‘

আয়াশ জবাব দিল না। নূর চোখ বন্ধ করে রইলো, কষ্ট হচ্ছে ভীষনরকম। আবার সে সেখানেই ফিরে যাচ্ছে যেখানে তাকে প্রত্যেকটা মুহূর্তে তার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়, চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা নোনা জল ও গড়ালো।
চোখ মুছে আয়াশকে জিজ্ঞাসা করলো,
‘আপনার মা নেই শুনেছি। তবে আপনার বাবা এমন অসুস্থ কবে থেকে? ‘
আয়াশ হাসলো। হেসে জবাব দিল,

‘আমার বাবা আমার মা কে হারিয়ে এমন পাগল হয়ে গেছেন।’
নূর ক্ষীণ স্বরে জবাব দিল,
‘তাহলে উনি আপনার মা কে খুব ভালো বাসতেন নিশ্চয়ই, নাহলে এতোটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তেন না কখনোই।

আয়াশ হাসলো পুনরায়, সে কিছু জবাব দিল না। নূরের বলা প্রত্যেকটি কথার পরিবর্তে আয়াশ হাসছে দেখে নূরের খানিকটা রাগ হলো,
‘হাসছেন যে, আমি কি ঠাট্টা করে কিছুটা বললাম, আমি তো কেবল বললাম, আপনার বাবা আপনার মা কে সম্ভবত ভীষণ ভালোবাসচেন তাই হয়তো ওনাকে হারিয়ে এমন হয়ে গেছেন। সবাইকে নিজের মতো ভাবা টা বন্ধ করুন। ‘
নূর মুখ ফিরিয়ে নিল আয়াশের দিক থেকে, অপর দিক থেকে কেবল একটাই উত্তর এল,
‘সেটাই। ‘

নূর চোখ বন্ধ করে আছে, আয়াশের ওপর খানিকটা রাগ লাগছে তার। সে ঘুমানোর চেষ্টা করতে গেলেই আয়াশ তাকে বারবার বিরক্ত করছে, তবে এবার আয়াশ ডাকলেও সে আর সাড়া দেবে না। তবে তেমন কিছু হলোও না, আয়াশ আর নূরকে ডাকলোও না একটিবারের জন্য।

হাতটা এপিঠ ওপিঠ করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো মায়া, হাতের ব্যান্ডেজ করা দেখে বলল,
‘ভাগ্যিস আয়াশকে বলেছিলাম নাহলে তুই তো হাতের যত্ন নিতিস না, আর এ ব্যাথা সহজে কমতোও না। যাক সে আমার কথাটা রেখেছে, অন্তত তোর খেয়াল তো রাখছে, বাবার মতো খারাপ ব্যাবহার তো তোর সাথে করছে না। ‘
নূর ই জানে যে এই একটা রাতের ব্যাবধানে তার সাথে কি কি ঘটে গেছে, চেয়েও মায়াকে কিছু বলতে পারলো না সে, কারন বললে মায়া কষ্ট পাবে।
নূর কথা ঘোরানোর চেষ্টা চালালো।

‘ভাবী তোমার গহনা গুলো আমি আনতে পারিনি বুঝলে তো। আসলে আমি ব্যাগ গুছিয়েছিলাম, কিন্তু অশান্তি এতো তাড়া দিলেন যে ব্যাগ কেন, একটা জিনিস পত্রও নিয়ে আসতে দেননি। না ওনার না আমার নিজের। ‘
মায়া ভ্রু কুঁচকালো,
‘অশান্তি টা আবার কে? ‘
নূর বুঝলো যে তার দেওয়া সিক্রেট নামটা তার ভাবীকে সে বলে ফেলেছে, তবুও মায়াকে তো বলায় যায়।
‘কে আবার, উনি। ‘

মায়া হো হো করে হেসে উঠলো, ‘কেন সে আবার কি করলো? ‘
‘কি আবার, সবসময় বিরক্ত করে। তাই ওনার স্পেশাল নাম অশান্তি। তবে উনি জানেন না। ‘
‘তা বেশ বেশ। তোরা দুজনে একরাতেই যা মারপিট করে ফেলেছিস তাতে তোদের দুজনের অবস্থা ই খারাপ। ‘
নূর বুঝতে পারলো না যে মায়া কোন অর্থে তা বোঝালো তাই ও চুপ করে রইলো।
‘দাঁড়া তুই এখন, বাবাকে আর তোর অশান্তি কে এই চা আর মিষ্টির প্লেট টা ধরিয়ে দিয়ে আয়, দেখ তোর অশান্তি যদি এবার একটু মিষ্টি মিষ্টি কাজ করে। ‘
নূর মুখ গোমরা করে বলল,

‘ ভাবী তুমিও এবার মজা নিচ্ছ আমাকে নিয়ে? ‘
মায়া হাসতে হাসতে বলল,
‘একদম না। ‘
কথাটা বলে মায়া উঠে চলে গেল। নূর অপেক্ষা করতে লাগলো চা মিষ্টি আনার।
বেশি দেরি হলো না, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মায়া একটা বড়ো ট্রে এনে হাজির। নূর তা নিয়ে যেতে লাগলো ড্রয়িং রুমের দিকে, সেখানেই তার বাবা আর আয়াশ বসে কথা বলছে।

সেদিকে যাওয়া মাত্রই কথা কানে এলো, আরাফাত আহেব আয়াশকে প্রশ্ন করছেন,
‘তা বাবা তুমি এখন কি করছো? না মানে, আমি জানি যে তুমি অনেক শিক্ষিত। ‘
‘জ্বি আঙ্কেল আমি এখন তেমন কিছুই করি না, ভাইয়ার বিজনেস এ একটু আধটু হেল্প করি আর সাথে পি এইচ ডি করছি। ‘
উনি হেসে জবাব দিলেন ‘ তা বেশ বেশ।

তোমার বাবার সাথে অনেকদিন কোন যোগাযোগ নেই। থাকবেই বা কি করে বলো, তোমার বাবা আচমকাই নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিলেন, তোমার মা মারা যাওয়ার পর থেকেই কেমন একটা হয়ে গেলেন। আগে তোমাদের বাসায় সবসময় যেতাম, তোমার হয়তো মনে নেই। তবে এখন আমারও বয়স হয়েছে তারপর এখন আমারও আর যাওয়া হয় না। ‘
আয়াশ কোন জবাব দিল না কেবল মাথা নাড়ালো।
উনি আবার বললেন,

‘নূরকে আমি ছোট থেকেই খুব আদর যত্ন সহকারে মানুষ করেছি। ওকে একটু আগলে আগলে রেখো বাবা। ‘
নিজের বিষয়ে বানিয়ে বানিয়ে বলা মিথ্যা কথা নূর সহ্য করতে পারলো না, এতক্ষন আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কাজ শুনতে থাকলেও, এবার সম্মুখে এসে বেশ শব্দ করে ট্রে টা রাখলো, তাতে চায়ের কাপ থেকে চা টেবিলে খানিকটা ছড়িয়ে গেল আর খানিকটা আয়াশের হাতের ওপর। নূর রাগে কটমট করে চলে যেতে নিলেই আরাফাত সাহেব আবার নিজের আসল ব্যাবহার দেখালেন,

‘চোখে কি দেখতে পাও না? একেবারে অন্ধ হয়ে গেলে নাকি? ‘
বেশ মেজাজ নিয়ে কথাটা বলে সামনে আয়াশের দিক তাকালেই দেখতে পেলেন আয়াশ অবাক হয়ে আছে ওনার ব্যাবহারে। তারপর হঠাৎ নিজের ব্যাবহার পরিবর্তন করে নরম কন্ঠে নূরকে প্রশ্ন করলেন,
‘ দেখে শুনে ট্রে টা আনবি তো মা। দেখছিস তো আয়াশের হাতে পড়েছে, হাতটা কতোখানি পুড়ে গেছে গরম চায়ে। ‘
আয়াশ আর কোন কথা বললো না, হাতে পানি দেওয়ার নাম করে উঠে চলে গেল।

তারপর উপরে উঠে সরাসরি গেল নূরের ঘরের দিকে। গিয়ে দেখলো জানালার দিকে মুখ করে নূর বাইরে তাকিয়ে আছে। নূরের সামনে গিয়ে সেও নূরের মতো করে হেলান দিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, এমনটা দেখাতে চাইলো যে সে নূরের কপি ক্যাট।
নূর দেখেও না দেখার ভান করতেই আয়াশ বলে উঠলো,
‘আফুসোনা।’

নূর এমন একটা ভাব দেখালো যে সে কিছু শুনতেই পাইনি, বরং একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালো। আয়াশ এবার নূরের মুখের ওপর আছড়ে পড়া চুলগুলো কানের পাশে গুজে দিয়ে বলল,
‘রেগে আছো ঠিক আছে, কিন্তু আমাকে রাগিয়ে দেবে না যা তোমার জন্য বিপদজ্জনক। ‘
নূর হাতটা ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে বলল,
‘আমি ভাবছিলাম যে আপনিই হয়তো একমাত্র অভিনেতা, কিন্তু আপনার সাথে যে আর এক অভিনেতা যুক্ত হয়েছে সেটা জানতাম না। আসলে আমার জীবনটাই নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। তবুও কোন অভিযোগ নেই আমর জীবনের প্রতি। এরপর ও বলবো জীবন সুন্দর। ‘

‘চলো বাসায় ফিরে যাবো, রেডি হয়ে নাও। ‘
‘আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না। আপনি আর এক দফা আমার জীবনটাকে ক্রমাগত এলোমেলো করে দিচ্ছেন। ‘
কথাটা বলে নূর আয়াশকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে চলে যেতে নিলেই আয়াশ নূরকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরলো, নূর রেগে বলল

‘হ্যাঁ, দেওয়ালের মাঝেই আমাকে ঢুকিয়ে দিন, বার করবেন না আর। ‘
আয়াশ বেশি কিছু বলে সময় নষ্ট করলো না, নূরের কাধের ওপর আছড়ে পড়া চুলগুলো সরিয়ে নূরের কাধে মুখ গুজে দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ।
আয়াশের নিশ্বাস প্রশ্বাসের ক্রমন্বয়ে ছন্দপতন নূর অনুভব করছে বেশ। আয়াশ খুব বড়ো বড়ো শ্বাস নিচ্ছে। নূর ভেবেছিল আয়াশ তাকে হয়তো কামড়ে নেবে কারন যতবার সে রেগে গেছে ততবার সে তাকে কামড়ে দিয়েছে। আচমকা আয়াশ নূরের কাছ থেকে সরে এলো,

আয়াশকে এমন ভাবে দেখে নূরের ঠিক লাগলো না, সে কিছুটা আন্দাজ করতে করতেই পিছু ডাকলো,
‘আপনার কি মন খারাপ? ‘
আয়াশ একবার নূরের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,
‘শাফিয়াত আয়াশের মন খারাপ হয় না। ‘

এক অপরিপক্ক উত্তর দিয়ে বেরিয়ে গেল আয়াশ। নূরের কাছে বিষয়টা ঠিক না লাগলেও সে আর মাথা ঘামালো না না বিষয়টিতে
কারন সে যত বেশি আয়াশের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করবে আয়াশ তাকে ততটা কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করবে, তাই দূরত্ব বজায় করে চলায় শ্রেয়।
নূর ও বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, তখন খুশি খুশি মুখ করে মায়া আসতে আসতে বলল,
‘ তোমার ভাইয়া বাসায় ফিরছে কালকে, আমি যে কি খুশি বলে বোঝাতে পারবো না নূর। তোমার জন্য নাকি সারপ্রাইজ রাখছে কিছু। ‘

নূর শুনে খুশি হলো, অনেক দিন হয়ে গেলো ভাইয়ার কাধে মাথা রেখে ও ওর মনের কথা বলে মনের ভোধটাকে হালকা করতে পারে না। মায়া আবার বলে উঠলো,
‘আর রাতে সাওন আসছে। আমি রান্না বসিয়েছি। তুমি একটু হেল্প করো। ও জানে না যে তোমার বিয়ে হয়ে গেছে, জানলে একদম চমকে যাবে। ‘

মায়া চলে গেল, সাওনের নাম শুনতেই নূর খানিকটা কেঁপে উঠলো,নূর কি করে সেই মানুষটার মুখোমুখি হবে?
নূর আয়াশকে খোঁজার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলো, ঘরের বাইরে বার হতেই দেখলো আয়াশ বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্মোক করছে, সিগারেটের গন্ধে বরাবরই নূরের শরীর পাক দিয়ে ওঠে, তবুও এখন তা দূরে সরিয়ে নূর পিছন থেকে বলে উঠলো,
‘চলুন বাসায় ফিরে যাবো। ‘

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৩

আয়াশ পিছন ফিরে তাকালো আর নূরের চঞ্চল আর কম্পিমান শরীরের অবস্থা দেখে সুর করে টেনে বলল,
‘আফুসোনা, আমরা তো কোথাও যাচ্ছি না এখন। ‘

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৫