তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৫

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৫
সুরাইয়া আয়াত

নূর আয়াশের সামনে থেকে দেখলো সে সিগারেট ধরিয়েছে, সিগারেটের গন্ধে তার সবসময় দম বন্ধ হয়ে আসে, এবার ও তার ব্যাতিক্রম হলো না। আয়াশ বাসায় ফিরবে না কথাটা শোনা মাত্রই নূর ওড়না দিয়ে মুখটা চেপে ঘরের দিকে ছুটলো, আয়াশ বুঝলো যে নূর অস্বস্তি বোধ করছে তবুও সে একটি পা ও নড়লো না সেখান থেকে।

নূরের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সে, ভীতর থেকে নূরের কাশির আওয়াজ আসছে, দম নিয়ে কাশি।
আয়াশ একের পর এক টান দিতে লাগলো সিগারেটের, দরজা বন্ধ থাকায় ধোঁয়া অনায়াসে ঘরে প্রবেশ করছে। সিগারেট টা শেষ হবে হবে প্রায় এমন সময় ঘর থেকে কোনরুপ আওয়াজ আসা বন্ধ হয়ে গেল। আয়াশ খানিকটা কিছু আন্দাজ করতেই সিগারেট টা বাইরের দিক ফেলে নিস্তব্ধতা সহকারে ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢোকা মাত্রই দেখলো নূর বিছানায় পড়ে আছে নিথর হয়ে। আয়াশ নূরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, নূরের থেকে কোনরকম সাড়াশব্দ পাচ্ছে না সে, এমনকি নড়াচড়াও না,
আয়াশ পরিস্থিতি বোঝার জন্য ডাক দিল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আফুসোনা, ওঠো। ‘
আয়াশের কথা শুনেও নূর কোনরকম সাড়া শব্দ করলো না, আয়াশ আবার ডেকে উঠলো,
‘ আফুসোনা, দেখো তোমার ভাইয়া এসেছে, তোমাকে নীচে ডাকছে। ‘
ভাইয়ার কথা শুনেও নূরের কোন সাড়া শব্দ নেই দেখে আয়াশ এবার খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেল। নূরকে টেনে তুলতে গেলেই নূরের শরীর নেতিয়ে পড়লো। আয়াশ নূরকে নিজের সাথে জাপটে জড়িয়ে ধরে রাখলো, তবুও নূর পড়ে যাচ্ছে বারবার। আয়াশ নূরের গালে হাত রেখে ডাকতে লাগলো,

‘এই আফুসোনা, ওঠো। ‘
নূর বেহুশ। আয়াশ একটা বালিশ টেনে নূরকে শুইয়ে দিয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিল, প্রথমাবস্থায় কোন কাজ না হলেও বেশ কয়েকবার পানি দিতেই নূর লম্বা শ্বাস নিয়ে উঠলো। আয়াশ নূরের হাতটা ধরে উদগ্রীব স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
‘তোমার ইনহেলার কোথায়? ‘

নূর আয়াশের দিকে তাকিয়ে থেকে বড়ো বড়ো শ্বাস নিতে লাগলো কেবল। আয়াশ পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো,
‘আফুসোনা তোমার ইনহেলার কোথায়? ‘
নূর টেবিলের দিকে ইশারা করতেই আয়াশ আর দেরি করলো না, দ্রুত টেবিলের ওপর হাতড়াতেই নূরের ইনহেলারটা পেয়ে গেল। আয়াশ নূরকে ধরে বসিয়ে, তার মাথা ওর বুকের মাঝে জড়িয়ে রেখে ইনহেলারটা দিল,

ইনহেলার নিয়ে নূর খানিকটা লম্বা প্রশ্বাস নিল, ধীরে ধীরে তার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলো, আয়াশ তাকে আগের মতো করেই জড়িয়ে ধরে রেখেছে। নূর কিছুক্ষণ সেভাবেই চুপটি করে রইলো, যখন বুঝলো সে আয়াশের বুকের মাঝে তখনই টনক নড়লো তার, আয়াশকে ধাক্কা মেরে বিছানা থেকে ফেলে দিল, এবং তাকে ফেলার জন্য বেশ খানিকটা বল প্রয়োগ করতেই সে নিজেও খানিকটা পড়ে যেতে যেতেও সামলে নিলো, এবার তার শান্তি লাগছে। এটা তার বিয়ের দিন রাতেই করা উচিত ছিল।

আয়াশ পড়ে গেল মেঝেতে, নূরের দিক খানিকখন শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, নূর আর কোন জবাব না দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে ঢুকে গেল। তার শরীর ভিজে গেছে।
আয়াশ আর কিছু বললো না, নূরের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো অপলক। নিজে মেঝে থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে গেল।
নূর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে রুমের মধ্যে কারোর উপস্থিতি লক্ষ্য করলো না, সে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলো, তখনই পিছন থেকে নূরের ভাবী মায়া ডেকে উঠলো,

‘নূর নীচে চলো, সবাই নীচে অপেক্ষা করছে। আর তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। ‘
সারপ্রাইজের কথা শুনে নূর দু পা পিছিয়ে গেল। তার আশঙ্কা সত্যি হয়তো।
সাওন এসেছে। নূর আমতা আমতা করে বলল,
‘ভাবী আমার শ্বাসকষ্ট টা আবার বেড়েছে বুঝলে তো। আমার হাটাচলা করতেও কষ্ট হচ্ছে। তুমি সবার খাওয়া হয়ে গেলে খাবারটা আমার ঘরে পাঠিয়ে দেব?

‘আচ্ছা আমি দিয়ে যাবো, তুমি রেস্ট নাও। ‘
কথায় কথায় মায়ার ইনহেলার টার দিক এ চোখ যেতেই বলল,
‘এই ইনহেলারটা পুরোনো টা না? নতুনটা ইউজ করছো না? ‘
‘নাহ আসলে নতুনটা রেখে দিয়েছি। আর ওটাই হাতের কাছে ছিল, অশান্তি ওটাই এনে দিল।
‘ইউজ করো নতুনটা, এটা আর ব্যাবহার করতে হয় না। ‘
নূর মাথা নাড়ালো,

মায়া নীচে চলে গেল। নূরের মাঝেকার অস্বস্তি বাড়তে লাগলো।
নূরের মনে পড়ে গেল আবার পুরানো কথা। সাওন মায়ার চাচাতো ভাই, মায়ার নিজের কোন ভাই নেই তাই সাওনকেই নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসে।

মায়ার বিয়ে হয়েছে দুই বছর হতে যায়, সাওন কে নূর তখন থেকেই চেনে।
সায়ন নিত্যান্তই একজন সুদর্শন পুরুষ, তাই তাকে ভালো লাগাটা খুব একটা অবাক করা বিষয় না। নূরের ও তাকে ভালো লাগে তবে তা প্রকাশ করেনি। তারপর সাওনের সাথে কথাবার্তা শুরু হলে সম্পর্কটা বেশ খানিকটা এগোতে থাকে, এবং প্রস্তাব টা সাওনের থেকেই প্রথম আসে। নূর আর সাওনের মাঝে সম্পর্ক গড়ে ওঠে ধীরেধীরে।

প্রায় এক বছরের রিলেশনশিপ ছিল তার আর শাওনের মাঝে। তবে মাঝে একবার নূরের বাবা নূরের বিয়ের তোড়জোড় করতে লাগলেন তখন নুর সাওনকে সে কথা জানায় এবং তাদের মাঝে কার সম্পর্কের কথা সবাইকে জানতে বললে সাওন খুব কঠোরভাবে তার থেকে দূরে সরে আসে নানান অযুহাতে। তারপর থেকে আজ চার মাস হয়ে গেল, তাদের মাঝে যোগাযোগ বন্ধ। নূর অনেকটাই ভুলতে পেরেছ সাওনকে, অনুভূতি গুলো আর আগের মতো নেই তাই চাইলেও আর সে কখনো সাওনের কাছে ফিরবে না।

যে মানুষ হারানোর ভয় পায় না, সে মানুষ পেয়ে গেলে খুব সহজেই অবহেলা করতে দ্বিধাবোধ করে না।
বিছানায় বসে এক অস্থিরতার সম্মুখীন হচ্ছে নূর। আচমকা কারোর পদধ্বনি শুনে নূর কেঁপে উঠলো, বুঝলো যে এটা মায়া নয় অন্যকেউ, সম্ভবত আয়াশ।

নূর দরজার দিক এ তাকিয়ে তার অশান্তির মুখ দেখার জন্য সেদিক পানে চেয়ে থাকতে থাকতে দেখলো সাওন আসছে। সাওনকে আসতে দেখে নূর চারশো ভোল্টের শক খেলো যেনো। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ানো মাত্র সাওন তার কাছে এসে তার দু বাহু শক্ত করে চেপে ধরলো,
‘এটা আমি কি শুনছি নূর। তোমার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে। আর ওই নাট আর স্টুপিড টাইপ ছেলেটা নাকি তোমার হাজবেন্ড। লাইক সিরইয়াসলি! ‘

নূর দাঁত কিড়কিড় করে জবাব দিল,
‘আমি ব্যাথা পাচ্ছি। হাত ছাড়ো সাওন। ‘
সাওন হাত ছাড়লো না, উপরন্তু আরও শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
‘আগে আমি উত্তর চেয়েছি। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও আগে। সত্যিই কি ওই ছেলেটা তোমার জামাই? ‘
নূর ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে নিল, মাঝে মাঝে তার ভীষন জানতে ইচ্ছা করে তার হাতটা কি কোন সরকারি হাতে যখন তখন যে কেউ এভাবে চেপে ধরে।

নূর না পেরে জবাব দিল,
‘হ্যাঁ ওই নাট আর স্টুপিড টাইপ লোকটাই আমার জামাই। হ্যাভ ইউ এনি প্রবলেম? ‘
সাওন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
‘যেই দেখলে আমি বিয়ে করছি না ওমনি অন্য একটা ছেলেরা গলায় ঝুলে পড়লে?’

‘ঝুলে পড়েছি তো পড়েই গেছি। তো? এখন তোমার সমস্যা টা কোথায়? তুমি তো এটাই চেয়েছিলে। তুমি আমাকে কখনোই বিয়ে করতে চাওনি। চাইলে সেদিন রাগ করে আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেও পরে আমার সাথে ঠিকই যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে, তুমি তা করোনি। বেশ তো ফেসবুকে নিজের মেয়ে ফ্রেন্ডগুলোর সথে ছবি দিতে, ঘুরতে যেতে, ভালো ভালো ক্যাপশন দিতে। আমি তো অভিযোগ করিনি আর। আর তুমি এখন কোন অধিকারে আমাকে এইসব কথা শোনাচ্ছ?
‘আমি তোমাকে আজ সরি বলতে এসেছিলাম, আর সরি হিসাবে তোমার জন্য গিফট ও এনেছি। ‘

‘তোমার গিফট তুমি তোমার পকেটে রাখো। চলে যাও এখান থেকে। ‘
কথাটা বলে হাতটা ঝাড়ি মারতেই দেখলো আয়াশ দরজার ওপারে কেবল তার দিকে ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে আছে। সাওনের দিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। নূর আয়াশকে দেখা মাত্রই ঘাবড়ে গেল, সাওনকে দূরে সরিয়ে দিতেই সাওন বলল,

‘তোমার তো সাহস কম না। ‘
সে আরও কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই নূর বলল,
‘আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন যে! ভিতরে আসুন। ‘
সাওন ও তাকালো আয়াশের দিকে।
আয়াশ খুব বোকা বোকা একটা হেসে বলল,
‘বাইরের বাতাসে খাবার ঠান্ডা করছি, তুমি তো আবার গরম খাবার একদম খেতে পারো না আফুসোনা। ‘
সাওন নূরকে বিড়বিড় করে বলল,

‘দেখো কেমন স্টুপিড, কিভাবে খাবার ঠান্ডা করছে।’
নূর সাওনের কথা তোয়াক্কা না করে বলল,
‘আপনি নিয়ে আসুন আমার ক্ষিধে পেয়েছে। ‘
আয়াশ ঘরে ঢুকে বিছানায় খাবারটা রেখে নূরকে বসালো,আচমকা নূরের কপাল আর গালে স্পর্শ করে নরম কন্ঠে বলল,
‘তুমি এখন ঠিক আছো আফুসোনা? আর কষ্ট হচ্ছে? আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। এভাবে কেউ ভয় পাইয়ে দেয়! ‘
কথাটা বলে নূরের মাথাটা নিজের বুকের মাঝে ইচ্ছাকৃতভাবে চেপে নূরকে জড়িয়ে ধরলো, সাওন তাকিয়ে আছে তাদের দিকে, সাওনের মতো নূর ও হয়তো বুঝে উঠতে পারছে না কি হচ্ছে।

আয়াশ নূরকে ছেড়ে বলল,
‘দাঁড়াও তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না, আমি খাইয়ে দিচ্ছি। তোমাকে কষ্ট করতে দেখলে আমার ভালো লাগবে না একদম। ‘
কথাটা বলে এক লোকমা ভাত মেখে সে নূরের মুখের সামনে ধরলো, নূর ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যে আপনাআপনিই কি থেকে কি হচ্ছে। এই আয়াশ হঠাৎ এমন ব্যাবহার করছে কেন তার সাথে।

সাওন এদিকে রেগে চোখ মুখ লাল করে আছে, সহজ ভাষায় আয়াশের এই আদিক্ষেতা তার আর সহ্য হচ্ছে না।
নূর আয়াশের খাওয়ানোর ধরন দেখে বুঝতে পারলো যে এই ছেলে আজ অবধি কাউকে কখনো খাইয়ে দেয়নি। তবে বেশি কিছু না বলে নূর খেয়ে নিল, নূরের ঠোঁটের কোনে খাবার লেগে থাকলে, আয়াশ সেটাকে মুছতে নূরের ঠোঁটের কাছে নিজের ঠোঁট নিয়ে যেতে নিলেই নূর চমকে উঠলো, সাওনের সামনে এই লোক হঠাৎ এমন অদ্ভুত ব্যাবহার করছে কেন। সে বুঝলো এই লোক এখন সাওনের সামনে লজ্জাদায়ক কিছু করতে চলেছে, আয়াশ নূরের অনেকটাই কাছে চলে গেছে তা দেখে সাওন আর সহ্য করতে পারলো না,

‘ ননসেন্স’ কথাটা বলে সাওন রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
নূরের এখনও হৃদস্পন্দন বাড়ছে। আয়াশ নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ওর ঠোঁটটা মুছিয়ে এক ঝটকায় সরে এলো। সরে এসে প্লেট টা একহাতে ছুড়ে মেঝেতে ফেলে বেরিয়ে গেল,

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৪

‘যাওয়ার আগে বলল,
‘ আই ডোন্ট হ্যাভ এনি ফিলিংস ফর ইউ, সো দূরে দূরে থাকবে। ‘
নূর অবাক দৃষ্টিতে আয়াশের বেরিয়ে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো।

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৬