তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৭

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৭
সুরাইয়া আয়াত

দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুইয়ে দিল নূরকে। আয়াশ নিজেও বিছানায় ঘুমাতে গেলে নূর রাগী আর অভিমানী কন্ঠে বলল,
‘মন থেকে যখন কিছু অনুভব ই করেন না তখন এমন লোক দেখানো ভালোবাসার কি মানে? ‘
আয়াশ ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,

‘আফুসোনা ঘুমাও। ‘
‘আপনি প্লিজ আমার থেকে দূরত্ব বজায় করে থাকবেন। ‘
আয়াশও বলল,
‘আপনি প্লিজ আমার থেকে দূরত্ব বজায় করে থাকবেন। (২)
নূর রেগে গেল, এই লোক তাকে রাগিয়ে দিচ্ছে। আসলে এই লোক চায় কি?
নূরের ইচ্ছা হলো তার শরীরের সমস্ত বল প্রয়োগ করে তাকে ধাক্কা মারতে। ইচ্ছা দমিয়ে রেখে নিজে ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অনেকক্ষণ নিরবতা। নূরের চোখ তন্দ্রাচ্ছন্ন। আয়াশ নূরের দিকে ফিরে ঘুমালো। আধো কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
‘তুমি হ্যাপি নেই তাইনা? ‘
নূরের দিক থেকে কোন জবাব এল না কারন সে এতক্ষনে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। আয়াশ নূরের আধোআধো খোলা চোখ হাত দিয়ে বন্ধ করে বলল,

‘একদিন তোমার এই সব ভালো-খারাপ সব স্মৃতি আমি মুছে দেবো আই প্রমিস। ‘
আয়াশ নিজে উঠে গেল নূরের পাশ থেকে, বিছানা ছেড়ে বাইরে চলে গেল। লাইটার দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে দিতে লাগলো, এ বিষাক্ত বাতাস কোনভাবেই দরজা ভেদ করে নূর এর নিদ্রাভঙ্গ করবে না। আয়াশ চোখ বন্ধ করে নিল, স্মৃতিচারন করতে লাগলো পুরানো দিনের কথা, প্রথমেই ভেসে উঠলো তার মায়ের মুখ।

আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগের কথা, তখন আয়াশের বয়স ১৪। আয়াশের বাবা মেহেরব অহমেদ, উনি ছিলেন দেশের একজন নাম করা বিজ্ঞানী। সবসময় নিজের কাজ নিয়ে ব্যাস্ততা থাকলেও পরিবারের প্রতি কখনো অবহেলা করেননি।
তখন আয়াশ ক্লাস ৭, স্কুল থেকে বাসায় ফিরতেই তার মা ইন্দ্রাণী তার কাধ থেকে ব্যাগটা খুলে নেন। আয়াশের মা ছিলেন হিন্দু ধর্মের, তবে ভালোবেসে বিয়ে করার পর নিজের ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলাম ধর্ম গ্ৰহণ করেন।
ইন্দ্রাণী আয়াশের কাধ থেকে ব্যাগটা খুলে ছেলের জন্য খাবার বাড়তে যান, আয়াশ ফ্রেশ না হয়েই তার বাবার ল্যাবে প্রবেশ করে।

তার বাবার ল্যাবটা ছিল দুই তলা ঘরের সমান উঁচু, যাতে বসানো কত মেশিন, আর এদিক ওদিক ঘুরলেই পাওয়া যেত ফর্মালিন ও ক্যামিক্যাল এর উগ্ৰ গন্ধ। তবে এতদিন সে বাসায় থাকতে থাকতে সেসব গন্ধ তাদের সহ্য হয়ে গেছে।
আয়াশ তার বাবার ল্যাবে ঢুকলো বেশ অনেকদিন পর। তার বাবা সচরাচর সেখানে কারোর অবাধ বিচরন পছন্দ করেন না তবুও কৌতুহল বশত আয়াশ সেখানে প্রায়ই যেত।

আয়াশ গিয়ে দেখলো তার বাবা কিছু লেখালেখি করছেন একটা কাগজে। তার বাবার ইংরেজি হরফে লেখা প্রতিটা শব্দ বোঝা আয়াশের কাছে হাতের বাড়িতে ইট ভাঙার ন্যায় সমান, আজ সে হাতের লেখা সে নিজেও রপ্ত করেছে। দেখলেন উনি পেজের পর পেজ লিখেই চলেছেন। তার বাবা তার প্রতিদিনের এক্সপেরিমেন্ট এর পর তার রেজাল্ট লিখে রাখতেন, তবে এতো অল্প বয়সে তা বোঝা আয়াশের বোধগম্য ছিল না। সে গিয়ে তার বাবার পাশে বসতেই উনি মুচকি হেসে পেনের কালিতে জিঞ্জাসা চিন্হ বসিয়ে লেখা শেষ করলেন।

আয়াশ ওনার শেষের দেওয়া প্রশ্ন বোধক চিন্হ দেখে প্রশ্ন করলে, দিকে তাকিয়ে বলল,
‘লেখার শেষে এই প্রশ্ন বোধক চিন্হ টা দাও কেন? ‘
মেহেরব সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন,
‘তুই আজও আমাকে বাবা বলে ডাকলিনা? ‘
‘যতদিন না তোমার আর মায়ের ঝামেলা শেষ হবে ততদিন আমি ওনাকে মা আর তোমাকে বাবা বলে কখনোই ডাকবোনা। যাই হোক বলো এটার অর্থ কি? ‘

ছেলের এমন কথাতে উনি হতাশ হয়ে উঠলেন, উনি তার ছেলেকে এখন কি করে বোঝাবেন যে সম্পর্কগুলো আর আগের মতো নেই। উনি আয়াশের উত্তর দিতে বললেন,
‘ এই প্রশ্নবোধক চিন্হ দেওয়ার একটা বিশেষ কারন আছে। আমি এক বিশেষ কিছু আবিষ্কার করতে চাইছি, আর রোজ কতোটা কি করলাম তার সবটা লিখে রাখি, আমি আমার কাজে কতোটা সাফল্য হয়েছি সেটা আমি তখনই বুঝবো যখন এই প্রশ্ন বোধক চিন্হ একটা ডট বা বিন্দুতে গিয়ে শেষ হবে। এই চিন্হ টাই আমাকে রোজ মনে করিয়ে দেয় যে আমার কাজ এখনও অসম্পূর্ণ, এখন বাকি, আমাকে আরও খানিকটা ছুটতে হবে এর পিছনে। আমাকে আরও চেষ্টা চালাতে হবে। ‘

আয়াশ ওনার কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনলো, তার বাবা তার কাছে একটা আদর্শ একজন। তবে তার বাবাকে সে দিনকে দিন ভেঙে পড়তে দেখছে, তার একমাত্র কারন তাদের স্বামী – স্ত্রীর মনোমালিন্য। এতদিন সে এটুকু অনুধাবন করেছে যে পরিবারের উদ্ধে কখনোই কোন কিছুকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়।

আয়াশের বাবা অনেকক্ষণ আয়াশের দিক তাকিয়ে রইলেন, তার নিজের মতো আর ছেলেরও চোখের বর্ন বাদামী। তার ছেলের সবরকম চারিত্রিক গুণাবলী আর বৈশিষ্ট্য যেন তার মতোই। উনি আয়াশের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘আমি জানি তুইও একদিন বড়ো কিছু করবি। সেদিন আমিও তোর জন্য গর্ব বোধ করবো। ‘
আয়াশ ওনার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালো, আচমকা রাসভারী কন্ঠে বলল,

‘মা খেতে ডাকছে। চলে এসো। ‘
কথাটা বলে আয়াশ চলে যেতে নিল, দরজার সামনে গিয়ে যাওয়ার পূর্বে বলল,
‘আমি কখনোই তোমার মতো হবো না বাবা। আমি কখনোই নিজের কাজের জন্য নিজের স্ত্রীকে দুঃখী রাখবো না। ‘
অতীত থেকে ফিরে এলো আয়াশ। কথাটা মনে আসতেই হো হো করে হেসে উঠলো আয়াশ, দরজার ওপারে গভীর নিদ্রায় নূর।

আয়াশ কি আদতেও তার বাবাকে দেওয়া কথা রেখেছে? সে তো নিজেই নূরকে দূরে দূরে সরিয়ে রাখে।
আয়াশ সিগারেটটা ফেলে বলল,
‘ আমি কখনোই আমার বাবাকে দেওয়া কথা রাখবো না যতদিন না আমি সবটার সমাধান করতে পারি। আই এম সরি আফুসোনা। ‘

আয়াশ রুমে ঢুকলো, নূর ঘুমাচ্ছে। আয়াশ পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। এক টানে নূরের শরীর থেকে চাদরটা টেনে নিজের শরীরে জড়িয়ে বলল,
‘কখনোই না। ‘

সকাল সকাল মায়া নূরকে সাওনের দেওয়া গিফ্টটা দিয়ে গেছে, সাওন নূরকে একবার টেক্সট ও করেছে যেন আজ বাইরে যাওয়ার আগে সে সেই জামাটা পরে, নাহলে সে সবাইকে সবটা জানিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।
সাওনের প্রতি নূরের মনে জমে থাকা ঘৃনাটা যেন দ্বিগুন হয়ে গেল। ইচ্ছা না থাকলেও জামাটা পরার সিদ্ধান্ত নিল।
জামাটা বিছানার ওপর রেখে ওয়াশরুমে ঢুকলো নূর।

আজ তারা শপিং এ যাবে। নূরের ভাইয়া আর কিছুক্ষন পর বাসায় ফিরবে তাই মায়া যাবে না। সাওন নূর আর আয়াশকে যাওয়ার কথা বললো। কিন্তু সকাল থেকে আয়াশ লাপাতা। নূর আর তাকে খোঁজার ও চেষ্টা করেনি একবার ও। নূর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো বিছানার ওপর ড্রেস টা নেই। চিন্তায় তার কপালে ভাজ পড়লো। এদিক ওদিকে খুঁজেও পেল না।

আচমকা আয়াশ এসে জিজ্ঞাসা করলো,
‘কি খুঁজতে আফুসোনা? ‘
নূর সাত পাঁচ না ভেবে বলল,
‘ড্রেসটা খুঁজছি। ওটা পরবো বলে একটু আগেই তো বিছানার ওপর রেখে শাওয়ারে গেলাম, এখন খুঁজে পাচ্ছি না। ‘
আয়াশ ও নূরকে খুঁজে দেওয়ার নাটক করে বলল,

‘তুমি কি ওই রেড কালারের ড্রেসটা খুঁজছো আফুসোনা? ‘
‘জ্বি। ‘
নূর চারিদিকে ছানবিন করে কথা খুঁজে পাচ্ছে না জামাটা। আচমকা আয়াশ কপাল চাপড়ে বলল,
‘ইশশ। ওই জামাটা! সেটা তুমি আগে বলবে না। ‘
নূর খোঁজাখুঁজি বন্ধ করে বলল,
‘মানে? আপনি দেখেছেন? ‘

‘আরে আর বলিও না আমি যে কি ভুল করে ফেল্লাম। ‘
আয়াশ ইচ্ছাকৃতভাবে কথা ঘোরাচ্ছে দেখে নূর বলল,
‘ধ্যাত, আপনি মেয়েদের মতো এতো কথা ঘোরাচ্ছেন কেন। কি হয়েছে সরাসরি বলুন না। ‘
‘আসলে তোমাদের বাসার যে কাজের বুয়া রয়েছেন উনি এসেছিলেন আমাকে চা দিতে। তো আচমকা আমার হাত থেকে চা পড়ে যায়। আর সামনে দেখলাম বিছানার ওপর লাল রঙের একটা ন্যাতা জাতীয় জিনিস রয়েছে।

আমি বুয়াকে বললাম সেটা দিয়ে পরিষ্কার করতে। উনি তো আমার কথামতো ওটা দিয়ে পরিষ্কার করলেন। আমি তো বুঝতেই পারিনি তুমি ওটা পরে যাবে। ওটা তো ঘর মোছার বাতিল কাপড় জাতীয় দেখাচ্ছিল। ইস্ সরি আফুসোনা। আমি যদি জানতাম ওটা সাওন দিয়েছে তো কখনোই নষ্ট করতাম না কাপড়টা। হোয়াট আ ড্যামেজ। ‘

নূরের রাগ এবার তার রন্ধে রন্ধে ছড়িয়ে পড়লো যেন। রেগে গিয়ে আয়াশের কলার ঘরে ঝাকুনি দিয়ে বলল,
‘আপনি কি আমাকে পাগল পেয়েছেন? আমার বাসায় কাজের বুয়া কোথায় পেলেন আপনি! আপনি ইচ্ছা করে আমার জামাটা নষ্ট করেছেন আমি জানি। বলুন কেন করলেন। ‘

আয়াশ আচমকা নূরের হাত দুটোই মুঠিবদ্ধ করে বলল,
‘আমার যেটা করতে ইচ্ছা হয়েছে আমি সেটাই করেছি। আর তুমি কিসের থেকে এতো পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করছো আফুসোনা। যেখানেই পালিয়ে যাও সেই তো ফিরতে হবে আমার কাছেই। ‘
কথাটা শুনতেই নূর চুপ হয়ে গেল। সে কোনভাবেই চায় না সাওন আর তার সম্পর্কের কথা কোনভাবে জানাজানি হোক। কিন্তু সাওন কি উদ্দেশ্যে তার পিছু ছড়ছে না এতকিছুর পরও তা নূর বুঝে উঠতে পারছে না। আয়াশ নূরকে ছেড়ে দিল।
‘বাইরে ওয়েট করছি। জলদি এসো। ‘

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৬

নূর বুঝে উঠতে পারলো না এবার তার কি করা উচিত।
ওয়াড্রব খুলতেই দেখলো ওপরে একটা লাল রঙের শাড়ি রাখা। ওটা আগে তো ছিল না। সম্ভবত মায়া রেখে গেছে। কথাটা ভেবে নূর শাড়ি টা পরতে আরম্ভ করলো। না জানি এই অশান্তি আবার সাওনকে দেখে নতুন কোন অশান্তি ঘটায়।

তুমিই আমার প্রিয় নেশা সিজন ২ পর্ব ৮