তোমার নেশায় আসক্ত সিজন ৩ পর্ব ৬ || Suraiya Aayat

তোমার নেশায় আসক্ত সিজন ৩ পর্ব ৬
Suraiya Aayat

হঠাৎ আরিশ আরুকে নিজের থেকে সরিয়ে আরূকে ওর সামনে দাঁড় করিয়ে আরূর দুই গালে হাত রেখে নেশা ভরা কন্ঠে বলল,,,,
__” আরুপাখি আমার একটা কথা রাখবে ? আমি তোমার কাছে আজকে একটা জিনিস চাইবো শুধুমাত্র একটি বারের জন্য আর কখনো হয়তো তোমাকে বলবো না আর না করবো তোমার কাছে কোন আবদার ৷ কথাটা রাখবে ?”
আরু কিছু বলছে না চুপ মাথা নিচু করে কেবল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ৷
আরূর নিস্তব্ধতা দেখে আরিশ বলে উঠলো,,,,

__” অনেক সময় নিস্তব্ধতা সম্মতি কে প্রকাশ করে তাই আমিও বলেই ফেলি তোমাকে কথাটা !”
__” আমি কি কেবল আজকের একটি দিনের জন্য নিজের করে নিতে পারি ? ভালোবাসতে পারি ? ”
কথাটা শুনেই আরূ দূরে সরে গেল আর আরিশের গালে সপাটে একটা চড় মারলো ৷
আরিশ গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, নিস্তব্ধ হয়ে আছে, হয়তো এমন একটা সময়ে চড়টা ও আশা করে নি ৷
আরু এবার খানিকটা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,,,

__” আপনি কি ভাবছেন আপনার মিষ্টি মিষ্টি কথায় আমি ভুলে গেছি ? কিছু ভুলিনি আমি, সবটা মনে আছে আমার, আর আপনার লজ্জা করেনা এতকিছুর পরেও আপনি এমন একটা কথা রাখার জন্য বলছেন আমাকে ৷ আমি এবার বুঝেছি আপনি আমাকে ভালোবেসে নয় আমার শরীরটাকে ভালোবেসে আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন ৷ তাহলে এটাও জেনে রাখুন না কখনো আমি আপনার ছিলাম না আর না হবো…..”
আজ আরিশের চোখের কোনে জল আর তা আরু দেখেও হয়তো দেখছে না ৷
আরিশ গাল থেকে হাতটা নামিয়ে আরুর দিকে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,,,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

__” অনেক রাত হয়েছে তুমি ঘুমাও, আর কখনো এমন কিছু বলে তোমাকে বিব্রত করব না ৷”
__” আপনি একদম আমার পাশে ঘুমাবেন না, আপনাকে আমি বিশ্বাস করি না ৷”
কথাটা বলা মাত্রই আরিশ বলে উঠলো,,,,
__” আমি জানি আমার উপস্থিতিতে তুমি নিজেকে সুরক্ষিত ফিল করবে না ইনসিকিউর হবে নিজের প্রতি, আমি তোমারি ইনসিকিউরিটি আর বাড়াতে চাই না , তাছাড়া এমনিতেও আম্মুকে বলেছিলাম যে বাসায় ফিরবো, তাই না ফিরলে আম্মুও চিন্তা করবে ৷”

আরূ কিছু বলছে না মনের মধ্যে কোথাও না কোথাও আরিশের প্রতি রাগ জমে আছে , এতকিছুর পরও সব টাকে ভুলতে পারছেনা এত সহজে ৷
আজ আরিশ ওর জীবনে না থাকলে ওর জীবনটা হয়তো আরু সুন্দর হতো , ও যাকে নিজের জীবনের সাথে বাধতে চেয়েছিল সেও আজ ওর জীবনে থাকতো একরাশ ভালোবাসা নিয়ে ৷
চোখের কোনে জমে থাকা জলটা শার্টের হাতা দিয়ে মুছে নিয়ে আরুর রুম থেকে বেরিয়ে গেল ৷
বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, যদিও বাইরের আবহাওয়ার থেকে আরিশের কষ্টটা আরো বেশি ভয়ঙ্কর….
আরিশ চলে যেতেই আরু খাটে বসে রেগে ফুঁসে উঠছে, মনে মনে কেবল মাত্র একটাই কথা ভাবছে যে,,,,
__” ওনার এত সাহস হয় কি করে ! আমাকে এসমস্ত কথা বলেন ! উনাকে আর কতবার বোঝাবো যে আমি ওনাকে ভালোবাসি না ৷”

দুই পাশে ঘন জঙ্গল মাঝখানে আরিশের গাড়ির হেডলাইটের টিপটিপ আলো জ্বলছে ,একবার জ্বলছে আবার বন্ধ হচ্ছে , জঙ্গলের গাছের দমকা হাওয়া বয়ে গাড়ির কাচের ওপর আছড়ে পড়ছে, চারদিকে ঝড়ো হাওয়ার শো শো শব্দ শোনা যাচ্ছে ৷
আরিশের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট তা থেকে ক্রমাগত ধোঁয়া উড়ে গাড়ির ভিতরে বাতাসটাকে ক্রমাগত বিষাক্ত করে চলেছে ৷
সিগারেটের ফুক দিয়ে আরিশ বেশ ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলে উঠল,,,,,

__” সব কিছু সবার জন্য নয় আরূপাখি, তেমনি আমিও তোমার যোগ্য নই ৷ তোমাকে ইলমাজের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া টা আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল , আর তার প্রায়শ্চিত্ত টা আমি করবো, ফিরিয়ে দেবো তোমাকে ইলমাজের কাছে ৷
যদিওবা জানি তোমার চোখে আমার প্রতি ঘৃণা টা কমবে না কখনো তবুও তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে তোমার জীবনে পাবে এটাই আমার জীবনের সবথেকে বড় খুশি ৷ তোমাকে নিজের জীবনে আনতে চেয়েছিলাম নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম ,আমি পেয়েছি আর আমার কোন চাওয়া পাওয়া নেই ৷ জীবনটাকে নিজের গতিতেই চলতে দেবো, তাকে আর আমি নিজে থেকে বয়ে নিয়ে যাব না আরুপাখি ৷ আর এমন ভালোবাসা আমার চায়না যেখানে আমার প্রিয় সে নিজে কষ্ট পায় ৷ দেখাবো না তোমার উপর কোন অধিকার , থাকবে না কোন বাহ্যিক চাওয়া পাওয়া , তবে ভালোবাসাটা হয়তো সুপ্ত হয়েই থেকে যাবে , হারিয়ে যাবে কেবল মানুষটা ৷ শুনছি ভালোবাসার নাকি কখনো মৃত্যু হয় না তাই এটুকু ভেবেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে রাখবো যে আমি নাই বা থাকলাম আজীবন কিন্ত তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটাতো আজীবন থাকবে !”

রাত যত গভীর হয়ে আসছে আরিসের জ্বলন্ত সিগারেটের উষ্ণতাটাও ততো বেড়ে চলেছে , এখন থেকে হয়তো সিগারেটটা কেই নিজের কাছের একজন বলে মনে হচ্ছে আরিসের, আর আরুর নেশা থেকে ওর মুক্তি হতে গেলে সিগারেটের নেশায় নিজেকে আসক্ত করতে হবে ওকে ৷

আকাশে মেঘের গর্জন টা আর নেই ,ছিটে ফোঁটা বৃষ্টি টা ও আর নেই , তার সাথে উড়ে গেছে আরূর চোখের ঘুম ৷ খাটের সাথে হেলান দিয়ে চুপচাপ নীরবে বসে আছে, চোখের নোনা জলগুলো একসময় গড়িয়ে পড়তে পড়তে তা শুকিয়ে গেছে চোখের এক কোনে, আজ ইলমাজের কথাগুলো টা বড্ড মনে পড়ছে আরুর , কতোদিন হলো তাকে দেখে না, তার কাছে দুষ্টু মিষ্টি আবদার গুলো করা হয় না ওর , আদো আদো লজ্জামাখা কন্ঠে বলা হয়না যে ভালোবাসি ৷
সেদিন ছিল ফাল্গুনের প্রথম দিন , আর ইলমাজের সাথে আরূর প্রথম সাক্ষাতের দিন ৷
ধানমন্ডি লেকে এসে অনেকখন ধরে বসে ছিল আরু, অনেকক্ষণ হয়ে গেল বসে আছে তবে ইলমাজের আসার নাম নেই, ছেলেটার আসার কথা ছিল সাড়ে দশটার সময় কিন্তু এখন 10:55 বাজে ৷
ইলমাজের সাথে আরূর সম্পর্কটা প্রায় ছয় মাসের , এর আগে ফোনে কথা হয়েছে কিন্তু কখনো সামনাসামনি দেখা হয়ে ওঠেনি

ইলমাজের বাড়ি মিরপুরে ৷ ইলমাজের সাথে আরুর সাক্ষাৎটা নেহাতই কাকতালীয় ৷ একদিন আরু শপিং এ গিয়েছিলাম সেখানেই ইলমাজ ওকে প্রথম দেখে কিন্তু আরু ইলমাজকে দেখেনি তারপর সেদিন ৷ ইলমাজ অনেক খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে আরু কলেজে পড়ে ওর থেকে অনেকটাই ছোট বয়সে এবং শিক্ষাগত দিক থেকেও, তবুও ভালোবাসার কাছে এগুলো সব সময় হার মানে ৷ তারপর থেকে অনেক খোঁজ নিয়ে আরুর নাম্বার জোগাড় করে, প্রথমে আরু ইলমাজকে ইগনোর করলেও ধীরে ধীরে কথা বলতে বলতে ইলমাজের মায়ায় জড়িয়ে পড়ে ৷

ফাল্গুনের প্রথম দিনে আরু একটা হলুদ রঙের শাড়ি পড়ে আছে, চুলে বেলি ফুলের মালা, আর হাতে চুড়ি , কপালে ছোট্ট লাল টিপ ৷ ইলমাজকে সারপ্রাইজ দেবে বলেই আরু শাড়ি পরে এসেছিল , যদিও কখনো ইলমাজ আরুকে কোন বিষয় নিয়ে জোর করত না,অন্যরা যেটা করে যে এটা করো ,ওটা করো ,এটা পরোনা, ওটা পোরোনা, ওখানে যেয়োনা, সব বিষয়ে স্বাধীনতা দিয়েছিল আরুকে ইলমাজ ৷
একটা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরে হাতে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে হাটতে হাটতে এসে আরুর পাশে ফুল টা রেখে আরূ পিছন থেকে আরুর চোখটা চেপে ধরল ৷ প্রথমে আরু খানিকটা ভয় পেয়ে গেলেও তারপর ইলমাজের হাতে স্পর্শ করে কিছুটা হলেও বুঝতে পারলো যে এটা আর কেউ নয় তার প্রিয় মানুষটাই ৷
আরু চোখ বন্ধ রেখেই বলল,,,,

__” আপনার উপর আমি রেগে আছি, আপনি আমাকে এতক্ষণ অপেক্ষা কেন করালেন ?”
অল্পবয়সী মেয়েটার বড়োদের মতো এমন আবেগী কথা শুনে ইলমাজ মুচকি হেসে বলল,,,,
__” আমার প্রেয়সী কি জানে না যে অপেক্ষার ফল সবসময় মিষ্টি হয় ৷”
আরু এবার খিলখিল করে হেসে দিয়ে বললো,,,,
__” আচ্ছা ঠিক আছে , এবার সামনে আসুন , আপনাকে দেখি হলুদ পাঞ্জাবিতে আপনাকে কেমন দেখাচ্ছে ৷”
ইলমাজ এবার আরুর চোখটা ছেড়ে ফুলগুলোকে হাতে নিয়ে আরুর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসতেই হঠাৎ কোথা থেকে আরিশ এসে ইলমাজের মুখ বরাবর একটা পাঞ্চ করলো, ইলমাজ দূরে ছিটকে পড়ে গেল, আর ফুলটা ছিটকে জলের মাঝখানে পড়ে গেল ৷

হঠাৎ এমন হওয়াই আরু ভয় পেয়ে পাশে তাকাতেই দেখলো আরিশ রক্তচক্ষু নিয়ে দাড়িয়ে আছে ৷ বড় ভাই হিসেবে আরিশকে খুব ভয় পায় আরূ ৷
সেদিন আরিশের চোখমুখ দেখে আরু ভয় পেয়ে গেল ৷ আরিশ রেগে গিয়ে আরুর গাল চেপে ধরে বলতে লাগলো,,,,
__” এতো কিছু হয়ে গেলো আর আমি জানতেও পারলাম না ৷ তোর সাহস কি করে অন্য একজনের সাথে নিজেকে কল্পনা করার , এই জন্যই কি তোকে আমি এত স্বাধীনতা দিয়েছি ? কিছু বলি না বলে যা খুশি তাই করবি ?”
ইলমাজের গাল কেটে রক্ত বইছে , ইলমাজ এবার কোনক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে আরূর মুখ থেকে হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,,,

__” ভাইয়া আপনি যা বলার আমাকে বলুন আরূকে কেন কিছু বলছেন?”
আরিশ আরুকে ছেড়ে ইলমাজকে মাটিতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বেধড়ক মারতে লাগলো ৷আরু আরিশকে থামানোর চেষ্টা করছে কিন্ত আরিশের সাথে কোন ভাবেই পেরে উঠছে না, ইলমাজ ও পারেনি সেদিন নিজেকে বাঁচাতে ৷ যতক্ষণ লোকজন এসে আরিশকে থামালো ততক্ষনে ইলমাজ অর্ধমৃত ৷
আরু কাকুতি-মিনতি করেই চলেছে যেন ইলমাজকে ছেড়ে দেই কিন্ত আরিশ সেদিন কারোর কথা শোনেনি, প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয়টা সেদিন প্রচন্ডভবে ও মাঝে আকড়ে ধরে ছিলো ৷
শেষে ইলমাজের মুখে একটা ঘুষি মেরে ওর রক্তাক্ত গাল দুটো চেপে ধরে বলেছিলো,,,,,

__” আরু পাখি শুধু আমার , ও শুধুমাত্র আমার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে আর কারো জন্য নয় ৷”
বলে আরুর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে গিয়েছিল ৷
ইলমাজের হলুদ পাজ্ঞাবীটা লাল রঙে রাঙিয়ে গিয়েছিলো, সেদিনের ফাল্গুনটা হয়তো ইলমাজের জন্য ছিলো না ৷
আরু সেদিন ইলামাজের রক্তাক্ত হাতটা ধরতে চেয়েছিল কিন্তু আর হলো না ইলমাজের হাতটা ৷
কথাগুলো ভাবতেই আরু শিঁউরে উঠলো , সেই দিনের পর থেকে আরুর আরিশের প্রতি তীব্র ঘৃণা ৷ এই দু বছরে ইলমাজের সামনে যাওয়ার সাহস পায়নি আরু , কেবলমাত্র একটা কথাই ভাবতো যে আবার যদি কখনো ইলমাজের সাথে দেখা করে তাহলে আরিশ যদি আবার কখনো ইলমাজের কোনো ক্ষতি করে তখন!

তোমার নেশায় আসক্ত সিজন ৩ পর্ব ৫

আরু এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো, কেন এই ত্রিকোণ প্রেমের সাথে ওর জীবনটা জড়িয়ে গেল ? কেন? কেন ইলমাজকে ভালোবাসার পরিনতিতে এতটা কষ্ট পেতে হলো ? আর আরিশই বা কেন ওকে এতো ভালোবাসে? ইলমাজ যদি ওর না হওয়ার ই ছিলো তাহলে তাকে কেন ওর জীবনে আসতে হলো ?

বৃষ্টি শেষ হয়েছে ভোরের দিকে ৷আরিশ গাড়ি থেকে নামল , বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে, জ্বলন্ত সিগারেটটায় ফুক দিয়েই তার ধোঁয়া বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইল ৷ রাস্তাটা নেহাতই নির্জন তাই হয়তো খুব একটা মানুষের আনাগোনা নেই ৷

হাতে সিগারেট টা শেষ হতেই মুহুর্তেই আর একটা সিগারেট নিয়ে ধরালো আরিশ ৷ যতদিন বেঁচে থাকবে আরুর কাছে ভালোবাসার এক জন হয়ে উঠতে না পারলেও ঘৃণার মানুষ হয়ে থাকবে বাকি দিনগুলো ৷ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিল যে আর কখনো আরুর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবেনা, দেখাবে না কখনো কোন অধিকার ৷ ইলমাজকে আরুর জীবনে ফিরিয়ে দিয়ে ও নিজে আরুর. জীবন থেকে হারিয়ে যাবে আর থেকে যাবে কেবল ওর সুপ্ত ভালোবাসা ৷

তোমার নেশায় আসক্ত সিজন ৩ পর্ব ৭