তোলপাড় পর্ব ২৬+২৭+২৮

তোলপাড় পর্ব ২৬+২৭+২৮
শান্তনা আক্তার

দেখতে দেখতে এক তারিখ চলে আসলো।রিমি আজ কলেজে জয়েন করবে।গতরাত এক্সাইটেডমেন্টের জন্য ঘুম আসেনি ওর চোখে।মাত্র বাবা মায়ের সাথে কথা বলে দোয়া চেয়ে নিল।এরপর পরই জিসানের কল আসলো।
-অল দ্যা বেস্ট ভাবি!আই উয়িশ তুমি খুব উন্নতি করো লাইফে।
-অল দ্যা বেস্ট তো আমায় তোমাকেও বলতে হবে।কেমন লাগছে বিজনেস সামলাতে?
-তেমন ভালো লাগছে না।কিন্তু ভালো টা লাগাতে হবে।
-এভাবে বলছো কেন?রুশাকে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই নাকি?
-ইচ্ছে তো আছে।তো?

-ইচ্ছে থাকলেই তো হবে না।রুশার ফ্যামিলি এমনি এমনি তো তাদের মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দেবেন না।যতই তোমার বাবার ভুড়ি ভুড়ি ধন সম্পদ থাকুক না কেন।তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড টাই আসল তাদের কাছে।
-হুম বুঝেছি ম্যাম।আপনাকে টিচার হিসেবে আমি ১০০ তে ১০০ দিলাম।
রিমি ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনে বুঝে গেল আহসান বেরুচ্ছে।তাই জিসানকে বায় বলে ফোন কেটে দিল। নইলে কলেজের প্রথম দিনই মন খারাপ করে থাকতে হবে।আহসান টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলল,কার সাথে কথা বলছিলে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-আ আয়া আমি আসলে আব্বু আম্মুর থেকে দ দ দোয়া চাইছিলাম।
-এটা বলতে তোতলাচ্ছো কেন?
রিমি বোকা হাসি দিয়ে বলল,আমি আজ খুব খুশি তো তাই একটু তোতলে য যা যাচ্ছি বারবার।
-ওহ,আজ থেকে তাহলে জয়েন করছো তুমি।
-হুম।
-ওকে রেডি হও আমি তোমাকে কলেজে দিয়ে নাহয় হসপিটালে যাব।

-আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।আসলে আমার কলেজ টাইম ১০ টায়।আর আপনি তখন হসপিটালে থাকেন।
-ওও,এটা তো তাহলে প্রবলেম হয়ে যাবে।ওকে তাহলে আমি আমার ডিউটির টাইমিং টা একটু চেঞ্জ করে নেব।১০ টার দিকে অন্য কেউ ডিউটি করবে আমার জায়গায়।হ্যাঁ এটাই করতে হবে।আমি বরং ফোন দিয়ে বলে দেই।
-আপনি শুধু শুধু এসব ঝামেলা নিতে যেয়েন না। আমার জন্য আপনার কাজের সময় পরিবর্তন করতে হবে না।
-সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না।তুমি একা কিভাবে যাবে?

-দুনিয়ায় আপনার গাড়ি ছাড়াও আরও অনেক গাড়ি আছে ওকে?রিকশা করে যাব আমি।আমার অভ্যাস আছে।
-আমি যেটা বলেছি সেটাই হবে।তাই মাথা থেকে অন্য সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলো।আন্ডার্স্ট্যান্ড?
আহসান কথাটা এতো লাউডলি বললো যে রিমি ভয়ে মাথা কাত করে সম্মতি না দিয়ে পারলো না।আহসান রিমিকে ১০ টার কিছুক্ষণ আগে রেডি হয়ে থাকতে বলে হসপিটালে চলে যায়।যখন ৯ টা বাজে তখন রিমি রেডি হতে শুরু করে।রিমি একটা নীল রঙের জামদানি শাড়ি পড়েছে।সাথে ম্যাচিং থ্রি কর্টার ব্লাউজ।

রঞ্জিত অপমান করার পর অপার থেকে শাড়ি পড়াটা শিখে নিয়েছিল।তাইতো নিজে নিজেই খুব সুন্দর করে শাড়ি পড়ে নিল।চুলে বাকা সিঁতি তুলে খোপা করেছে।মুখে হালকা পাউডার দিল যদিও রিমি এমনিতেই উজ্জ্বল।তবুও কোথাও গেলে ওর পাউডার চাই ই চাই।চোখে হালকা করে কাজল পড়ে নিল।ব্যাস এতোটুকুই যথেষ্ট ওর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলার জন্য।রিমি একটা ব্রেসলেট টাইপ ঘড়ি পড়েছে সাথে চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা।চশমাটা স্টাইল করার জন্য পড়েনি।বইয়ের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে রিমির চোখ দিয়ে পানি পড়ে প্লাস headache শুরু হয়ে যায়।এই প্রবলেম টা ওর ভার্সিটি লাইভ থেকে।ঠিক তখন থেকেই চশমা নেওয়া আরকি।ওদের বাড়ি থেকে ওর সব পছন্দের জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিলো আসার সময়।যাই হোক,রিমি পুরোপুরি রেডি।হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো ৯ টা বেজে ২৭ মিনিট।রিমি নিচু একটা জুতো পড়ে নিচে নেমে আসলো।নিচে নেমে দেখলো রঞ্জিত সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন।রিমিকে দেখা মাত্র মুখটা পেঁচার মতো করে আবারও খবরের কাগজে মন দিল।অপা একটা বাটিতে দই এনে বলল,এই নে এক চামচ দই খেয়ে যা।

-না মা আমার দই ভালো লাগে না।প্লিজ এটা খেতে বলো না।
অপা এক চামচ দই নিয়ে রিমির মুখের সামনে ধরে বলল,এক চামচ খা।জাস্ট এক চামচ।রিমি কোনো উপায় না পেয়ে চোখ কান বুজে খেয়ে নিল।রিমি অপাকে বললো,আমার জন্য দোয়া করো মা।অপা রিমিকে বুকে জড়িয়ে বলল,মায়েদের কাছে দোয়া চাইতে নেই।মায়েরা সবসময় তার সন্তানের জন্য দোয়া করেই যায়।অপা রিমিকে ইশারা করলো রঞ্জিতকে দেখিয়ে দিয়ে।রিমি অপার ইশারা বুঝতে পেরে রঞ্জিতের কাছে গিয়ে বলল,আজ আমার প্রথম দিন কলেজে।আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন বাবা।

রিমি বেশ খুশি মনে কথাটা বললো।এই প্রথম রঞ্জিতকে বাবা বলে সম্মোধন করলো রিমি।কিন্তু রঞ্জিত যা করলো তা রিমি স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।রঞ্জিত গিয়ে কষে এক চড় মারলো রিমির গালে।রিমি,অপা,সম্পা ওরা সবাই যেন গুরতরভাবে আশ্চর্য হলো রঞ্জিতের কারবারে।রিমি গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রঞ্জিত আঙুল উঁচিয়ে রিমির দিকে তাক করে বলল,ফকিন্নির মেয়ে হয়ে আমাকে বাবা বলতে এসেছো!লজ্জা নেই তোমার?কোন সাহসে আমায় বাবা বললে?আর কখনো যেন তোমার মুখে এই ওয়ার্ডটা না শুনি।রিমির চোখ ভরে আসলো রঞ্জিতের কথায়।অপা খুব বেশিই রেগে যায় রঞ্জিতের এমন কুৎসিত আচরণে।

-তুমি কি মানুষ গো?মেয়েটা দোষের কি করলো?বাবাই তো ডেকেছে।তাই বলে মারলে মেয়েটাকে?আমার ভাবতেও লজ্জা লাগছে আমার হাসবেন্ড একজন নির্দয়,পাষাণ আর অহংকারী একটা মানুষ।পড়ালেখা যেহেতু করেছো এটা তো জানোই যে অহংকার পতনের মূল।এতো বাড় বেড়ো না।যাকে একদিন তুচ্ছ করবে দেখবে সেই তোমার প্রয়োজনে আসবে।তার কাছেই মাথানত করতে হবে।রঞ্জিত অপার কোনো কথাই কানে নিলেন না।এরই মাঝে আহসান এসে বলে,রিমি সরি আমি লেট করে ফেলেছি।এবার চলো কুইক নইলে আরও লেট হয়ে যাবে।

-তুমি কার পারমিশন নিয়ে এই সময়ে হসপিটাল থেকে বাড়িতে এসেছো?(চোখ রাঙিয়ে বললেন রঞ্জিত)
-সরি বাপি।আমি এইসময় টায় রিমিকে কলেজে দিয়ে আসবো ভেবেছি।আর তারপর ড্রাইভারকে বলে রেখেছি ওর কলেজ ছুটি হলে বাসায় ড্রপ করে দিতে।
-কেন?এতো মাতামাতি কিসের ওকে নিয়ে?
-বাপি তুমি এটাকে মাতামাতি বলছো কেন?এটা আমাদের রেসপন্সিবিলিটি।
-না এটা আমাদের রেসপন্সিবিলিটি না।রিমি নিজের ইচ্ছেতে জব করছে তাই ও কিভাবে নিজের কর্মস্থলে যাবে না যাবে সেটা টোটালি ওর ভাবার কথা।আমাদের নয়।

-আহসান ওর হাসবেন্ড তাই ওর ওয়াইফের প্রতি ওর সম্পুর্ণ দায়িত্ব আছে।রিমি ওর ইচ্ছেতে জব করবে বলে কি আহসান ওর স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যগুলোকে নস্যাৎ করবে?
-তুমি চুপ করো অপা।একদম আমাদের মাঝে কথা বলতে আসবে না।
-মম ঠিকই তো বলেছে বাপি।তুমি একটু বুঝতে চেষ্টা করো বিষয়টা।
-আমি কিছুই বুঝতে চাইনা।আমাকে কেউ বোঝাতে আসবে না।কারণ আমাকে কেউ কিছুই বোঝাতে পারবে না।আমি যা করি বা ভাবি তা থেকে কেউ আমাকে নড়চড় করাতে পারবে না।
-তুমি এটাই চাও যে আমি রিমিকে কলেজে ছাড়তে যাব না?
-ইয়েস এটাই চাই আমি।

-তাহলে তাই হোক।আমি যাচ্ছি না।রিমি তুমি গিয়ে ড্রাইভারকে বলো তোমাকে কলেজে পৌঁছে দেবে।
-নো মাই সন।ড্রাইভার ও ওকে ড্রপ করবে না।এবার আহসানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।
-ড্রাইভার ও যদি ড্রপ না করে তাহলে ও কিভাবে যাবে বাপি?তুমি কি চাচ্ছো বলোতো?
-আমি চাইনা ও আমার গাড়িতে চড়ে কলেজে যাক।কারণ ও আমার ইম্পর্টেড কারে চড়ার যোগ্যতা রাখেনা।জীবনে তো স্কুল কলেজে গাড়ি করে যায়নি।পায়ে হেঁটেই গিয়েছে হয়তো।

যে যেমন পরিবেশে বড় হয়েছে তাকে সেই পরিবেশেই থাকতে দিতে হয়।কোথায় আছে না গরীবের পেটে ঘি সয়না!ওর ক্ষেত্রেও সেটা হয়ে যাবে।সাপের পাঁচ পা দেখতে শুরু করবে যদিও আমাদের বাড়ির বউ হয়ে দেখেও ফেলেছে।তবে আর না।এবার ওকে ওর আসল জায়গাটা দেখিয়ে দেওয়ার সময় এসে গেছে।রঞ্জিতের প্রতিটি কথা রিমির বুকে গিয়ে বিঁধছে।আর সহ্য করতে পারছে ও।রিমির ইচ্ছে হচ্ছে সেখানেই নিজেকে শেষ করে দিতে।তবুও যেন মনকে বুঝিয়ে ফেলছে।কারণ ওর বাবা মায়ের শিক্ষা আছে ওর মধ্যে।হাত দিয়ে শাড়ি ঘামছে ধরে আছে।চোখ ফুলে গিয়েছে চাঁপা কান্নার প্রভাবে।আজ ও অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে রঞ্জিতকে কিন্তু কোথাও যেন বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে আছে।এই জন্য কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না।ওদিকে আহসান ও রঞ্জিতের কথাগুলো সহ্য করতে পারছে না।

-বাপি তুমি এরকম করো না প্লিজ।আহসানের কথার মাঝেই রিমি বলে ওঠে,থাক আহসান বাবু আপনাকে কষ্ট করে আমার জন্য শাফায়ত করতে হবে না।আমি আপনাকে বলিনি আমাকে নিয়ে ভাবতে।আমি আগেই বলেছিলাম আমি রিকশা করে যাব।আমাকে নিয়ে কাউকে ভাবতে হবে না।আমি আমার দায়িত্ব নিতে পারি এই বলে বেরিয়ে গেলো রিমি।

রিকশার ভাড়া মিটিয়ে কলেজ গেটে পা বাড়ালো রিমি।মুখ ভাড় ওর।একটু হাসির চিহ্নমাত্র নেই ওর মুখে। প্রথম জবের প্রথম দিনটা আনন্দেরসহিত স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলো।কিন্তু সেটা যে বিষাদময় হয়ে উঠবে তা ভাবা ছিলো না।এক দিক দিয়ে এটাও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।চাকরির প্রথম দিনই বাবা তুল্য শ্বশুরের হাতের চড়!বিষয়টা খুব চমৎকার লাগছে রিমির কাছে।বাড়ি থেকে বের হওয়া থেকে শুরু করে এখন অবধি ওর শুধু একটা কথায় বারবার মনে হচ্ছে,কোন পাপের শাস্তি ও পাচ্ছে?কি দোষ ওর?হাঁটতে হাঁটতে প্রিন্সিপালের রুমে পৌঁছে গেল।না চাইতেও নিজেকে স্বাভাবিক করলো।যদিও মনের বিরুদ্ধে গিয়ে।

প্রিন্সিপাল রিমিকে সকল টিচার্সদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।কথাবার্তা শেষ করে রিমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে।রিমির প্রথম ক্লাস ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসে।রিমি একাউন্টিং এর টিচার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।তাই ওর হাতে একাউন্টিং এর বই। সকল শিক্ষার্থী রিমিকে দেখে খুব বিনয়ের সাথে সালাম ও গুড মর্নিং উয়িশ করে।রিমিও জবাব দিল।রিমি প্রথমে নিজের পরিচয় পর্ব দিয়ে কথাবার্তা শুরু করলো।তারপর একে একে সবার কাছে গিয়ে তাদের নাম জিজ্ঞেস করা শুরু করে।একেবারে ক্লাসের শেষ প্রান্তে গিয়ে একটি ছেলেকে দেখতে পায়।ছেলেটি বেঞ্চের সাথে মাথা ঠেকিয়ে পরম শান্তিতে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।নিউ টিচার যে ক্লাসে এসেছে সে দিকে তার কোনোই ভ্রুক্ষেপ নেই।তাইতো নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।রিমির বিষয়টা একদমই পছন্দ হয়নি।ও বেঞ্চ থাপড়ে বলল,এক্সকিউজ মি!এখানে কি ঘুমাতে এসেছো?বাড়িতে কি করো,যে ক্লাস টাইমে ঘুমাচ্ছো?এক্ষুনি উঠে পড়ো নইলে আমি প্রিন্সিপালকে ডাকতে বাধ্য হবো।

পাশ থেকে একটা মেয়ে বলে ওঠে,ম্যাম প্রিন্সিপাল স্যার ওর নিজের বাবা।তাকে কিছু বলে লাভ নেই।মেয়েটা কথা শেষ করতেই ক্লাস শুদ্ধু সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
-হাসি থামাও সবাই,,,,,রিমি চিল্লিয়ে বলে ওঠে।সবাই রিমির ধমকে চুপ হয়ে যায়।রিমি আবারও বলতে শুরু করে।নিজের বাবা প্রিন্সিপাল বলেএ কি পড়াশোনার সময় কেউ ঘুমাবে?এটা কোথাকার নিয়ম?আমি এই নিয়ম মানি না।আমি যেহেতু তোমাদের টিচার সেহেতু তোমাদের সোজা করার পুরো রেসপন্সিবিলিটি আমার আছে।এই বলে একটা বেত এনে ঘুমন্ত ছেলেটির পিঠে দিল দু তিনটা বারি।বারি খেয়ে এক প্রকার লাফিয়ে ওঠে ছেলেটি।
-কার এতো সাহস রে আমায় মারার?এই বলে ঢুলু ঢুলু শরীরে উঠে দাঁড়ালো।

-আমি মেরেছি তোমায়।প্রয়োজন হলে আরও মারবো।ক্লাসটাকে নিজের বেডরুম পেয়েছো নাকি?নাম কি তোমার হুম?
ছেলেটি চোখ কোচলে রিমির দিকে তাকালো।বেত হাতে ভ্রু কুচকে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে রিমি।ছেলেটির মেজাজ খারাপ ছিল কিন্তু রিমিকে দেখার পর ওর সব রাগ যেন নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেল।এক ধ্যানে সে রিমিকেই দেখে যাচ্ছে।ওদিকে যে রিমি গলা ফাটিয়ে কিছু বলছে সেদিকে তার কোনো ইনটেনশন নেই।ও শুধু রিমির ঠোঁট নাড়ানো দেখে যাচ্ছে।আর ভালো করে রিমিকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে।তাই দেখে রিমি এবার খুব জোড়েই দিল আরেক বেত্রাঘাত।ব্যথা পেয়ে ভাবনার জগৎ থেকে বাহিরে বের হয়ে আসলো ছেলেটি।রিমির দিকে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,সো বিউটিফুল।রিমি এবার শরীরের সব শক্তি দিয়ে ছেলেটার হাতে বারি দিয়ে বলল,অসভ্য ছেলে।আমি তোমার টিচার।So behave yourself…what’s your name?

ছেলেটি চুল ঠিক করে বলল,সবাই আমাকে ভালবেসে স্যাম বলে।আপনি ও তাই বলতে পারেন বিউটিফুল লেডি।
রিমি বেত উঁচিয়ে বলল,don’t call me Lady..I am your teacher..so call me mam okkk?
-আপনাকে যে টিচারের মতো লাগছে না।তাই আমি সেটা বলতে পারলাম না। আই এম এক্সট্রিমলি সরি।
-তুমি কি মনে করো নিজেকে হুম?বাবা এই কলেজের প্রিন্সিপাল বলে যা খুশি তাই করবে?নো ওয়ে,আমি এখন আর তা হতে দিতে পারিনা।আগে যা করেছো করেছো।এখন আমি যা বলবো তাই শুনতে হবে।শুধু আমি নই প্রতিটা টিচারের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে।এরপর থেকে যদি আমি তোমায় ঘুমাতে দেখেছি তো তোমার বাবার সামনেই গণধোলাই দেব।যদি এতে আমার জব চলে যায়,যাক।আই ডোন্ট কেয়ার।বাই দ্যা ওয়ে নাম কি তোমার?সার্টিফিকেটে যেই নামটা আছে সেটা বলো।সবাই ভালবেসে কি নাম বললো না বললো সেটা জেনে আমার কোনোই লাভ নেই।

-আই লাইক ইউর attitude..আমি সব ডিটেইলস এ বলছি তাহলে।আমার নাম সামির।বাবা মায়ের একটা মাত্র ছেলে আমি।দু বোন আছে সবার বিয়ে হয়ে গেছে।আমি বাকি আছি।৬ বার HSC তে ফেইল করেছি।আবারও বসতে চলেছি এক্সামে।এবারও যদি ফেইল করি তাহলে শনি,রবি,সোম, মঙ্গল, বুধ,বৃহস্পতি,শুক্র।পুরো সপ্তাহের নাম পূরণ হবে।এবার আপনারটা শুনি?
-নির্লজ্জ বেহায়া ছেলে কোথাকার।নিজের কুকির্তির কথা দাঁত কেলিয়ে বলছে।ছিহ এই বলে সামনে চলে আসলো।এরই মাঝে বেল বেজে ওঠে।রিমি ঘড়ির তাকিয়ে তাকিয়ে বলল,ইশ আজ আর ক্লাস নেওয়া হলো না।স্টুডেন্টস,আজ আর ক্লাস নিতে পারলাম না।আগামীকাল ইনশাআল্লাহ আমরা বই এ হাত দেব।আজকের মতো আল্লাহ হাফেজ এই বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসে রিমি।ওদিকে সামির দুহাতের আঙুল একসাথে ফুটিয়ে পাশের চামচা টাকে বলল,ওই রাফি নাম কিরে মেয়েটার?

-বস উনি আমাদের টিচার।আর যার সাথেই করেন না কেন,ওনার সাথে অন্তত ফ্লার্ট কইরেন না।
-চুপ কর।আমার কাছে টিচার ডক্টর কোনো ফ্যক্ট না।মেয়েটাই ফ্যক্ট।এখন বেশি কথা না বলে বল মেয়েটার নাম কি?
-বস রিমি বলেছিল।সরি মিসেস রিমি বলেছে।উনি ম্যারিড।
-what nonsense!ম্যারিড উনি?
-হুম এইজন্য বাদ দিন বস।

-ম্যারিড হোক আর যাই হোক it’s doesn’t matter…আমার ভালো লেগেছে এটাই ম্যাটার।আর স্যামের কাউকে ভালো লাগলে কি হয়?
রাফি ছেলেটি ঢোক গিলে বলে,তাকে সে পায়।
-হুম,এবার চল বাহিরে যাই।আজকে একটা পার্টি দেবো চল।
-সত্যি বস?(খুশি হয়ে)
-আমি কি মিথ্যে বলি বল?আজ আমি অনেক খুশি তুই যত খেতে পারবি আমি খাওয়াবো। চল ড্যাডের ক্রেডিট কার্ড নিয়ে আসছি আমি।

রিমি খুব ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফেরে।দুপুরের খাবার খেয়ে বুকস নিয়ে বসে।আহসান বাড়িতে এসে দেখলো রিমি বসে বসে বই পড়ছে।আহসান ধীরু পায়ে স্টাডি টেবিলের কাছে গেল।তারপর গলা পরিষ্কার করে বলল,খুব মন খারাপ তোমার তাইনা?রিমি মাথা উঁচু করে আহসানের দিকে তাকিয়ে আবার বইয়ের দিকে তাকায়।
-হুম বুঝেছি খুব বেশি রাগ করেছো।আমি বাপির পক্ষ থেকে তোমায় সরি বলছি।আর আমি তোমার সাথে যেতে পারিনি তারজন্য ও সরি বলছি।তুমি বললে কান ধরে উঠবস করতেও রাজি।

রিমি ঠাস করে বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,আপনাদদের বাপ ব্যাটার কাছে আমি তো মানুষ নই।তাই আমার মন খারাপ কেন হবে?আপনারা তো আমাকে চাকরের চোখে দেখেন।এক কথায় আপনাদের চক্ষুশূল আমি।বলে দিন আমি কাজ করে খাব আপনাদের বাড়িতে।তাও ভালো।তবুও মনকে শান্তনা দিতে পারবো যে আপনার আর আপনার বাবার হাতে মার খাচ্ছি তবে কাজের মেয়ে হিসেবে খাচ্ছি।কাজ ভালো লাগেনি তাই আপনারা মেরেছেন আমাকে।তখন মনে কষ্টও লাগবে না।কারণ আমি আপনাদের বাড়ির কাজের মেয়ে।মারবেন এটাই স্বাভাবিক।

-তুমি এসব কি বলছো?বাপি তোমাকে মেরেছে?আমি এখনি কথা বলছি বাপির সাথে।বাপির এতো বড় সাহস কিভাবে হলো তোমাকে মারার।
-একদম ই না।আপনি তো আমাকে খুব সম্মান করেন তাইনা?আপনি তো কখনো আমাকে মারেননি তাইনা?কথায় আছে না নিজে নামাজ না পড়লেও অন্যকে ঠিকই নামাজের আহ্বান দেয় কিছু মানুষ।আপনার ক্ষেত্রে সেটাই যায়।লাগবে না আপনার অভ্যর্থনা।লাগবে না কোনো সহানুভূতি।আমি একা আছি একাই ভালো।শুভাকাঙ্ক্ষীর প্রয়োজন নেই আমার।
-আমি কতবার ক্ষমা চাইলে তুমি আমার পেছনের ব্যবহার টা ভুলতে পারবে বলতে পারো?আমি খুবই লজ্জিত আমার আগের ব্যবহারে।প্লিজ বাপির জন্য আমাকে ভুল বুঝো না।আমি কথা বলছি বাপির সাথে।

-আপনার কাছে আমি হাত জোর করছি আর অশান্তি পাকাবেন না।আপনি কি চান,আপনি এখন আপনার বাপিকে দুটো কথা শোনাবেন আর আপনার বাপি আমাকে আরও ঘেন্না করুক?এটাই কি চান? উনি তো ভাববে,ছেলে তার বউয়ের জন্য বাবার সাথে ঝগড়া করছে।কেমন বউ এনেছেন তার ছেলের জন্য!প্লিজ আমাকে মাফ করুন আমি আর অশান্তি চাইনা।আপনি যদি এই বিষয়টা নিয়ে আপনার বাপির সাথে কথা বলেন তো আমি সত্যি বলছি এই বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে যাব।এমনকি আপনাদের সবার থেকে অনেক দূরে চলে যাব।নিজের বাপেরবাড়িও যাব না।কাউকে জ্বালাবো না আমি।এখন আপনি বলুন কি চান?

-তুমি খুব কষ্টে আছো তাইনা?এই বাড়িতে আসা পর্যন্ত একদিন ও শান্তিতে জীবন কাটাতে পারনি তুমি।অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছো।তাইনা রিমি?
-হুম তাই।আমি একটুও ভালো নেই।আপনারা আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছেন না।আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি পুরো।বদ্ধ উম্মাদ হয়ে যাচ্ছি।একটা মানুষ কতো অপমান সইতে পারে বলতে পারেন?এই একটা মাসে কি পেয়েছি আমি?অপমান,লাঞ্চনা আর আঘাত।এ ছাড়া আর কিছুই পাইনি।
-আমি কি করলে তুমি শান্তি পাবে রিমি?তুমি কি ডিভোর্স চাও আমার থেকে?কথাটা বলতে গিয়ে আহসানের গলা আটকে আসলো তবুও কষ্ট হলেও বলে দিল।

-রিমি চোখের পানি মুছে বলল,হুম চাই।এটাই এক মাত্র উপায় আপনার আর আপনার বাবার থেকে বাঁচার।সরি ভুল বললাম আপনারাই বরং বেঁচে যাবেন আমার কব্জা থেকে।আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্স এর ব্যবস্থা করুন।আমার ভাগ্যে যা আছে আমি দেখে নেব।
– ঠিক আছে আমি তাই করবো।ডিভোর্স পেয়ে তুমি যদি ভালো থাকো তাহলে বুঝবো একটু হলেও আমার প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে।আমি তাই করবো এই বলে রুম থেকে বেরিয়ে আসে আহসান।

আহসান সেই যে বেড়িয়েছে আর আসার নাম নেই।দুপুর গড়িয়ে বিকেল,বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা,সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত।রাত হয়েছে বটে তবে গভীর রাত।রিমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বাহিরের মেইন গেইট দেখা যায়।রিমির চোখে ঘুম টলমল করছে।কিন্তু ঘুমাতে পারছে না আহসানের টেনশনে।বেশি টেনশন করলে ওর মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়।মাথাটা চেপে ধরে আছে দু হাত দিয়ে।ঘড়ির কাটা যখন রাত দুটোতে নামলো তখন রিমির চিন্তা যেন আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল।সেদিনের মতো দিশেহারা হয়ে গেল বেচারি।তবে আজ যেন চিন্তা টা একটু বেশিই হচ্ছে ওর।কারণ সেদিন আহসানকে ও কিছু না বললেও আজ অনেক ভালো মন্দ শুনিয়ে দিয়েছে।নিজেই নিজের কথায় অনুতপ্ত রিমি।ভয় একটাই আহসান কোনো বিপদে নয়তো!

-আমি যে কেন ওনাকে বেশি কথা বলতে গেলাম?ইদানীং খুব বেশি ধারালো হয়ে গেছে আমার জিভ।একেবারে ধারালো অস্ত্রের ন্যায় ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।আচ্ছা উনি তো অনুতপ্ত ওনার আগের ব্যবহারের জন্য।তাহলে আমি কেন ওনাকে মাফ করে দিচ্ছি না?সত্যি তো ওনার বাবার জন্য আমি ওনাকে কথা কেন শোনাচ্ছি?পা থেকে মাথা পর্যন্ত পাপ করলেও বান্দা যখন মন থেকে আল্লাহর কাছে মাফ চায় তখন আল্লাহ তো তার বান্দাকে খালি হাতে ফেরায় না।সেখানে আমি একজন সাধারণ মানুষ।মহান আল্লাহর সৃষ্টি আমি।মহান আল্লাহ আমাকে এই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন তার বান্দা হিসেবে।

তিনি যদি মহাসাগর সমান পাপকে মাফ করে দিতে পারেন তাহলে আমি এতোটুকু অন্যায়ের জন্য আহসানকে কেন মাফ করতে পারবো না?আমি মানছি উনি খুব অহংকারী,দাম্ভিক,রাগী মানুষ।তবে ছিলেন।এখন অনেকটাই ভালো হয়ে গেছেন উনি।উনি চাইলে আরও ভালো হতে পারবেন।তবে এর জন্য আমার সাপোর্ট প্রয়োজন ওনার।আমি যদি এমন করি তাহলে উনি ভালো মানুষ হতে পারবেন না।তাই আমাকে যে করেই হোক ওনাকে বুঝতে হবে।ওনার সাথে থেকে ওনাকে সাহায্য করতে হবে একটা প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ার জন্য।

না উনি আসুক আমি ওনাকে সরি বলে দেব।কিছুক্ষণ বারান্দায় পায়চারি করার পর রিমি আহসানের গাড়ি গেটের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখতে পেল।রিমি যেন কোনো অমূল্য কিছু দেখে ফেলেছে।ঠোঁটের হাসিটা বেশ চওড়া হয়ে উঠেছে।এক দৌঁড়ে বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে পৌঁছালো।আহসান বেল বাজানোর আগেই রিমি দরজা খুলে ফেলল।আহসান বিষয়টা দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল।আহসানের চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে।দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন কিছুই পেটে পড়েনি।রিমি যেন নিজের মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলল আহসানের এমন হাল দেখে।ওর মুখে যেন তালা লেগে গেছে।আহসান আর রিমি একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে এক ধ্যানে।

দুজনেরই চোখের পলক পড়ছে না।নিরবতা ভেঙে রিমি বলে ওঠে,কোথায় ছিলেন?মুখের একি হাল করে রেখেছেন?সারাদিন কিছু খাননি?আহসান রিমির কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রিমির পাশ কেটে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে।রিমি দরজা লাগিয়ে আহসানের সামনে দাঁড়িয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,কিছু বলছেন না কেন?কোথায় ছিলেন আপনি?হাসপাতালে কি?
আহসান গম্ভীর কণ্ঠে বলে,রাত ১০টা অবধি হসপিটালেই ছিলাম।
-তারপর কোথায় গিয়েছিলেন?এতো রাত করে ফিরলেন যে?
-উকিলের কাছে গিয়েছিলাম।

রিমির বুকটা ছ্যাত করে উঠলো।উকিল নামটা শুনে ওর মনে পড়ে ডিভোর্স এর কথাটা।রিমি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,উকিলের কাছে কেন?রিমি আহসানের উত্তরটা শোনার জন্য গভীর আগ্রহে চেয়ে আছে।ওর মন যেটা বলছে ও সেটা চাচ্ছে না।খুব ভয় লাগছে ওর।আহসান কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে বলল,ডিভোর্স পেপার্স রেডি করতে বলেছি।রিমি যা ভয় পেয়েছিলো তাই হলো।ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে ওর।যেদিন ওর সাথে আহসানের বিয়ে হয়েছিল সেদিনও একই ভাবে ভয় পেয়েছিলো ও।আজ বিয়ের এক মাস প্রায়।এই এক মাসে আরেকটা ধাক্কা খেল যেন আজ।ডিভোর্স যেন ওর কাম্য নয়।রিমির গলা শুকিয়ে এলো ভয়ে।

-আপনি এটা কেন,,,,রিমিকে পুরো কথা শেষ না করতে দিয়েই আহসান বলে ওঠে,তোমার ইচ্ছেই পূরণ হবে।আমি চাইনা তুমি আর কষ্ট পাও।আমি চাইনা তুমি আমার চক্ষুশূল হয়ে থাকো।আমি চাইনা তুমি আর এ বাড়িতে পড়ে থেকে লাথি চড় খাও।
-আপনি কি বলছেন এসব?

-তুমি তো এটাই বলেছিলে আমায়।ডিভোর্স চেয়েছিলে,তাই সেটাই দিচ্ছি।দু দিনের মধ্যে সব কিছু রেডি হয়ে যাবে।আর মাত্র দুটো দিন আমাকে আর আমার বাপিকে সহ্য করো।তাও যদি না পারো আমাকে বলো আমি তোমাকে তোমার বাবার বাড়িতে দিয়ে আসবো ঠিক দুদিনের মাথায় ডিভোর্স পেপারে সাইন করে তোমার বাসায় পার্সেল করে দেব।কথাগুলো অন্য দিকে ফিরে বলল আহসান।রিমি যেন থমকে গেল আহসানের পুরো কথায়।অজান্তেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল ওর।বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে ওর।কিন্তু ও যে সেসব কিছুই বলতে পারছে না আহসানকে।রিমি বলতে চায় ও ডিভোর্স চায়না।

কিন্ত এক অদৃশ্য বাঁধন ওকে যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে।সে বাঁধন ওকে বলতে দিচ্ছে না যে ও ডিভোর্স চায়না।আহসান কিছু না বলে উপরে চলে গেল।রিমি সেখানেই ধপ করে বসে পড়ল।তারপর নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে বলল,আমি তো চাই আপনি আমাকে ডিভোর্স দিন।কিন্তু আমার এতো কষ্ট কেন হচ্ছে?আমার মন বলছে আমি ডিভোর্স চাইনা?কেন আমার সব সিদ্ধান্ত পালটে গেল?আমি তো আপনাকে আজ খুব সহজে বলেছি আমি আপনার থেকে ডিভোর্স চাই কিন্তু এখন কেন মেনে নিতে পারছি না?কেনোই বা মুখ ফুটে বলতে পারছি না আমি ডিভোর্স চাইনা।

আমি এই বাড়িতেই থাকতে চাই।শত অপমান সইতে রাজি তবুও ডিভোর্স চাইনা আমি।কেন?কেন?কেন বলতে পারছি না?রিমি রুমে এসে দেখলো আহসান ঘুমিয়ে পড়েছে।রিমিও ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে উল্টো দিক ফিরে।রিমি উল্টো দিক ফিরে শুতেই আহসান চোখ মেলে ফেললো।আহসানের চোখ মুখ ক্রমশই লাল হতে থাকলো।চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানি ঝরে বালিশে পড়ে।রিমিও ওদিকে যন্ত্রণায় ছটফট করছে।রাত যত বাড়ছে ওদের কষ্টের মাত্রা ততই বেড়ে চলেছে।রাতটা দুজনেরই নির্ঘুমে কেটে গেল।সকালে আহসান নিজ দায়িত্বে হসপিটালে চলে যায়।রিমিকে কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করেনি।রিমির দিকে একটাবার তাকায় ও নি।রিমি আহসানের এমন কঠিন পরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না।রিমির মনে হচ্ছে এর থেকে আহসানের দেওয়া কষ্টই শ্রেয় ছিলো।

-কিরে এসেছে কি রিমি?
-বস আমি দেখছি তো।এখনি ক্লাস শুরু হতে অনেক সময় আছে আপনি এতো ব্যতিব্যস্ত হবেন না।
-তুই বুঝবি না আমার সিচুয়েশনটা।আমার চোখের সামনে এখনো রিমির সেই সুন্দর মুখটা ভেসে উঠছে।রিমিকে দ্বিতীয়বার দেখার জন্য আমি কতটা বিচলিত হয়ে আছি সেটা তুই বুঝবি না রাফি।এই প্রথম কোনো মেয়ে আমাকে এতটা ভাবালো।এই প্রথম কেউ আমাকে তার মায়ায় লেপ্টে দিল।তুই বুঝবি না রাফি,তুই বুঝবি না।
রাফি চিল্লিয়ে বলল,বস রিমি ম্যাম এসে গেছে।

-Really!তাহলে চল গেটের সামনে।সামির আর রাফি মিলে গেটের সামনে গেল।রিমি যেই কলেজে প্রবেশ করলো ওমনি এক গোছা গোলাপ রিমির সামনে তুলে ধরল সামির সাথে ওয়েলকাম উয়িশ করে।আচমকা এরকম কিছু হওয়ায় রিমি বেশ বিভ্রান্তে পড়ে গেল।চোখ রাঙিয়ে বলল,এসব কি?তোমরা এখানে কি করছো?

-আমি তোমাকে ফুল দিয়ে ওয়েলকাম করতে এসেছি রিমি।গতকাল জানতাম না বলে প্রিপারেশন নেইনি। তাই আজ ওয়েলকাম জানালাম।এই নাও তোমার মতো বিউটিফুল লেডির জন্য রোজেস।যদিও এটা তোমার থেকে বেশি বিউটিফুল নয়।রিমি প্রচন্ড রেগে গিয়ে সামিরের হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে নিল।তারপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল,ম্যানারলেস ছেলে কোথাকার।এতো বড় সাহস কোথ থেকে পাও আমাকে তুমি করে বলার?তার উপর আমার নাম ধরে ডাকা!গতকাল না বলেছি আমাকে ম্যাম বলবে।মার গুলো কি ভুলে গেছ?নাকি আরও খাবে?

-মারো যত ইচ্ছে হবে তোমার।তোমার আগে কেউ কখনো আমাকে মারার দুঃসাহস দেখায়নি।তাই এটা আমার জন্য নিউ এক্সপেরিয়েন্স।তোনার যত ইচ্ছে মারো আমি বাধা দেবনা।
-অসভ্য বেহায়া ছেলে কোথাকার!আজ ক্লাসে এসো চাপকে পিঠের ছাল তুলে ফেলবো।রিমি রাগে গিজগিজ করতে করতে চলে গেল।
-দেখলেন বস উনি আপনাকে মোটেও পছন্দ করেন না।আমি বলি এতো বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই।উনি ম্যাম মানুষ,ওনাকে উত্ত্যক্ত করুন অন্য টিচারদের যেভাবে করেন।কিন্তু ওনার সাথে ফ্লার্ট ছি ছি মানাচ্ছে না।
-তুই চুপ কর।বেশি বকবক করলে আজকে এক গ্লাস পানি অবধি কিনে খাওয়াবো না।
রাফি ৩২ টা দাঁত কেলিয়ে বলল,না বস আমি কিছুই বলিনি।আপনার যা ইচ্ছা করেন আমি কিছুই বলবো না এই যে মুখে তালা লাগালাম।

যে সামির লাস্ট বেঞ্চ ছাড়া কখনো ক্লাসরুমে বসেনি সে আজ সবার সামনে বসেছে একেবারে হোয়াইট বোর্ড বরাবর।সেখানে যে বসেছিল তাকে উঠিয়ে দিয়ে ও বসেছে সাথে ওর চামচা রাফিকেও বসিয়েছে।রিমি ক্লাসে এসে ক্লাস নিচ্ছে।সামির এক ধ্যানে রিমিকে দেখছে।রিমি সর্বপ্রথম প্রশ্নটা সামিরকেই জিজ্ঞেস করলো।
-বলো হিসাবের প্রাথমিক বই কাকে বলা হয়?সামির উত্তর দিল,ম্যাম আপনার শাড়ির কালারটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।আপনাকে মানিয়েছে।রিমি ও সামির বাদে ক্লাসের সবাই হেসে ওঠে।

-কিপ সাইলেন্স!এসব কি ধরনের বেয়াদবি?তুমি কি শুধরাবে না?আজ প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলতেই হবে।এই বলে প্রিন্সিপালের রুমে গেল রিমি।প্রিন্সিপালকে সব কিছু বলার পর উনি বললেন,সামিরকে অবুঝ ভেবে ক্ষমা করে দিন ম্যাম।আসলে ও এখনো অবুঝ।বয়স ঠিকই হয়েছে কিন্তু বোধ বুদ্ধি হয়নি।আপনি পারলে ওকে নিজের মতো শায়েস্তা করুন আমি কিছুই বলবো না।কিন্তু আমাকে এই বিষয়ে জড়াবেন না প্লিজ।নইলে খুব অভিমান করবে আমার উপর।আমার একটাই ছেলে বুঝতেই তো পারছেন কত আদরের।তাই আমি কিছু হেল্প করতে পারলাম না।আপনি ওকে নিজের মতো করে ভালো করুন।আমি যেমন সামিরকে কিছু বলবো না,তেমনি আপনাকেও কিছু বলবো না।

-আপনার ছেলেকে মেরে মেরে সোজা করতে হবে দেখছি।
-এই ভুল করবেন না।ওকে মেরে লাভ নেই।তাছাড়া মারই সব সমস্যার সমাধান নয় ম্যাম।আপনি কৌশলে বোঝান এতে আপনার জন্যই ভালো।আমি যতদূর জানি সামির মার খেয়ে ভালো হওয়ার ছেলে নয়।ওকে অন্য কোনো উপায়ে বোঝান।আপনি যদি ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এবার পাশ করাতে পারেন তো আমি আপনাকে আমাদের কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল বানাবো।কথা দিচ্ছি। তখন কলেজটা শুধু আমার নয় আপনারও হাফ হয়ে যাবে।আপনি যদি সামিরের মতো ত্যাড়া ছাত্রকে বাধ্য বানাতে পারেন তো আমি বুঝবো এই পুরো কলেজের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা আপনার আছে।আপনি পারবেন তো আমার এই চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করতে?ভালো করে ভাবুন।পরে কিন্তু পিছপা হতে পারবেন না।

রিমি কিছুক্ষণ ভেবে বললো,হুম পারবো।আপনার ছেলে কেন এই কলেজের প্রতিটি স্টুডেন্টকে সোজা করার দায়িত্ব আমি নিজ কাঁধে নিলাম।ইওর চ্যালেঞ্জ একসেপ্টেড স্যার, ধন্যবাদ।
রিমি বাড়িতে এসে আহসানের পছন্দের খাবার নিজ হাতে রান্না করলো।এই বাড়িতে এই প্রথম রিমি রান্না করলো।অপা আর সম্পাকে আজ রেস্ট নিতে বলে নিজে হাতে সব কিছু রান্না করেছে।দুপুরে সবাই খাবার টেবিলে বসলো।সবাই বলতে আহসান,রঞ্জিত ও অপা।রঞ্জিত সেই প্রথম থেকেই খাবরের ঘ্রাণ শুকে তারিফ করে যাচ্ছে।আহসান তেমন রিয়েকশন দিচ্ছে না।মন ভালো নেই বলে।তবুও কাউকে বুঝতে দিতে চাচ্ছে না।এইজন্য কোনো কিছু না ভেবে খেতে বসে গেল।নইলে অপা হাজারটা প্রশ্ন ছুড়ে দিত।খাবে না কেন?কি হয়েছে হ্যান ত্যান।রঞ্জিত সবগুলো রান্নার আইটেম দেখে আরও খুশি হয়ে গেলেন।জিভে তার পানি চলে আসলো।রঞ্জিত ওর মতো নিয়ে খেতে লাগলো।

তোলপাড় পর্ব ২৩+২৪+২৫

-বাহ চমৎকার রান্না।একদম আমার মায়ের মতো হয়েছে।অনেকদিন পর অন্যরকম টেস্ট পেলাম রান্নায়।সবই দেখছি আমার আর আহসানের পছন্দের খাবার। আমি আজ ইম্প্রেস হলাম অপা।ম্যানি ম্যানি থ্যাংকস। আহসান কিছু বলছে না ও নিজ বিরুদ্ধে গিয়ে খাচ্ছে।সব স্বাদ যেন বিষাদময় হয়ে উঠেছে ওর কাছে।
এতোটাই মন খারাপ যে নিজের পছন্দের খাবার গুলোর দিকেও তাকাচ্ছে না।
-তুমি আমার প্রশংসা করছো কেন বলোতো?
-এতো ভালো রান্না করেছো আর আমি কিনা প্রশংসা করবো না!ট্যালেন্ট এর কদর করতে হয় বুঝলে?
-তা বুঝলাম।কিন্তু এতসব রান্না আমি করিনি।

-তাহলে নিশ্চয়ই সম্পা করেছে?ও কোথায়,আজ ওকে খুশি হয়ে বখশিশ দেব আমি।
রান্নাঘর থেকে রিমি সব কিছু লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে।আর মনে মনে খুশি হচ্ছে রঞ্জিতের ওর হাতের রান্না পছন্দ হয়েছে বলে।
-বখশিস দেওয়ার হলে রিমিকে দেও।কারণ ওই সব রান্না নিজ হাতে করেছে আজ।কথাটা শুনে রঞ্জিতের মুখের রং উড়ে গেল।হাত ধুয়ে উঠে যেতে নেবে কি আহসান বললো,এখন উঠে যাচ্ছো কেন?রিমি রান্না করেছে বলে কি এতোক্ষণের সব প্রশংসা মাটিতে মিশে যাবে!

-আমার কাছে একটুও ভালো লাগেনি আমি সব বানিয়ে বানিয়ে বলেছিলাম।এই খাবার মুখে দেওয়াই যাচ্ছিলো না। আগে জানলে এভাবে মিথ্যে প্রশংসা করতামই না।এই বলে চলে গেলেন রঞ্জিত।আহসান আর অপা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে।ওদিকে রিমির ও বেশ খারাপ লাগলো।ভেবেছিল এই বুঝে রঞ্জিত ওকে একটু হলেও ভালো জানবে।কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো রিমির।ওর খুশি মানে ক্ষণিকের একটা মন মাতানো বাতাস।বাতাস শেষ হওয়া মাত্র ওর মনটা আবারও সেই চিরস্থায়ী মন খারাপের দেশে ফিরে আসবে।

তোলপাড় পর্ব ২৯+৩০+৩১