তোলপাড় পর্ব ৩+৪

তোলপাড় পর্ব ৩+৪
শান্তনা আক্তার

রিমি গোসল করে কোনোরকম শাড়িটা পেঁচিয়ে খাবার খেতে বসে যায়।গপগপ করে এক নিমিষেই প্লেট সাফ করে ফেলল।প্লেটটা চেটেপুটে খেয়ে পানিটা খাওয়া মাত্র ওর কলিজা ঠান্ডা হলো।বেচারি পুরো রাত না খেয়ে ঘুমিয়েছে।তাই এভাবে তাড়াহুড়ো করে খেলো।তারপর এঁটো প্লেটটা নিয়ে ধীর পায়ে নিচ অবধি যায়।খাবার টেবিলে প্লেট টা রেখে যেই ঘুরতে যাবে ওমনি শাড়ির সাথে পা বেঁধে পড়ে যায়।রুমি দেখতে পেয়ে ফিক করে হেসে দেয়।রান্নাঘর থেকে অপা বেরিয়ে এসে বলে,তুই হাসছিস কেন রুমি?কি হয়েছে?
-আমাগো নুতান ভাবি তো চিৎপটাং হয়ে পড়েই গেছে হিহিহি।

অপা নিচিয়ে তাকিয়ে দেখল রিমি নিচে পড়ে আছে।গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে দাঁড়ানোর জন্য।কিন্তু এমন ভাবে শাড়ি পেঁচিয়েছে যে কোনো কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না।
-হায় আল্লাহ!তুমি এখানে কি করছো বলে রিমিকে ধরে উঠায়।রিমি কোনো মতে দাঁড়িয়ে আছে অপার হাত ধরে।লজ্জায় যেন ওর মাথা কাটা যাচ্ছে।এমন অবস্থায় এন্ট্রি মারলো রঞ্জিত তালুকদার,মানে রিমির শ্বশুরমশাই।
-এসব কি হচ্ছে এখানে?
(রাগান্বিত স্বরে বললেন)
-আসলে মেয়েটার জ্বর তাই পড়ে গেছে আর এদিকে রুমিরানী তা দেখে হেসে চলেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-সেকি জ্বর বাধিয়ে ফেলেছে!জ্বর বাঁধিয়ে নিচে আসার কি প্রয়োজন ছিলো?কি দরকারে নিচে নেমেছো তুমি?(ধমক দিয়ে বলে)।ধমক খেয়ে রিমির পরাণ যায় যায় অবস্থা।একে উদ্ভট ভাবে শাড়ি পড়ে লজ্জাজনক সিচুয়েশনে আছে,তার উপর ধমক খাচ্ছে।সব মিলিয়ে রিমির নাজেহাল অবস্থা প্রায়।রিমিকে চুপ করে থাকতে দেখে রঞ্জিত আবার জিজ্ঞেস করে,এই মেয়ে আন্সার দিচ্ছো না কেন?রিমি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।বিয়ের প্রথম দিন শ্বশুরের ধমক খেতে হবে তা ওর ভাবনার ও অনেক বাহিরে ছিলো।
-আহা!এভাবে বোকো না মেয়েটাকে।এমনি শরীর ভালো নেই।আমি জিজ্ঞেস করছি ওয়েট।তুমি এখানে কেন এসেছিলে রিমি?
রিমি ধির গলায় বলে,আমি এঁটো প্লেট রাখতে এসেছিলাম।

-অপা ওকে বলে দাও আমাদের বাড়িতে কাজের লোকদের মাস গেলে স্যালারি দেই।বসে বসে বেতন নেয়না তারাএসব কাজ তারাই করে।তাই কাউকে এসব কাজ করতে হবে না।অবশ্য ওদের বাড়িতে তো আর কাজের লোক নেই,তাই নিজের কাজ নিজেই করে ওরা।যে যেমন পরিবেশে বড় হয়েছে তার স্বভাব তো তেমনি হওয়ার কথা।কিন্তু আমি একটা কথা বলে রাখলাম,ও কিন্তু এখন আমার বাড়ির বউ তাই ওকে আমাদের বাড়ির নিয়ম অনুসারে চলতে হবে।আর এভাবে শং সেজে দাঁড়িয়ে আছে কেন?এটা শাড়ি পড়েছে নাকি অন্য কিছু?এখনি গিয়ে ঠিক করতে বলো।আর রুমি আমাকে খেতে দে হসপিটালে যেতে হবে।

-দিতাছি সাহেব।
রঞ্জিত বেশ কড়া ভাবে কথা গুলো বলে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলো।অপা রিমিকে ওর রুমে নিয়ে গেল।
-তুমি কিন্তু কিছু মনে করো না।তোমার শ্বশুর একটু কড়া টাইপের মানুষ।কিন্তু মনটা বেশ ভালো।
-আমি বুঝতে পেরেছি আন্টি।
-সেকি! আন্টি কেন বলছো?মা বলবে আমায়।আমি তোমার শ্বাশুড়ি বুঝেছো।
-ঠিক আছে মা।
-এইতো লক্ষী মেয়ে।আচ্ছা,তুমি এভাবে পেঁচিয়ে শাড়ি পড়েছো কেন?
-না,মানে,ইয়ে আমি,
রিমিকে আমতা আমতা করতে দেখে অপা বলে,
-বুঝেছি শাড়ি পড়তে জানো না।
রিমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উওর দিলো।

শাড়ি পড়ে রিমি চুপিচুপি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে রঞ্জিত তালুকদারের ভয়ে।অপার রুম থেকে বেরনের সময় নিয়ত করেছিলো যাতে রঞ্জিতের সামনে পড়তে না হয়।তেমনটাই হলো।রঞ্জিত মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলো,এই সুযোগে উপরে উঠে যায় ও।
-যেমন বাপ তার তেমন ছেলে।আরে আপনারা যখন আমাকে এতোই অপছন্দ করেন,তাহলে ঘরের বউ কেন করলেন আমায়!আমরা তো বলিনি আমাকে তাদের বাড়ির বউ করতে।ওনারাই তো আত্মসম্মানের দায়ে আমার সাথে ওই ভ্যাম্পায়ার টার বিয়ে দিলেন।মনে হচ্ছে জীবন টা আমার নরক হয়ে যাবে।ছেলে আর বাবা দুটোই এক।আমাকে শুধু অপমান করে কথা বলতে জানে এরা।ছেলে যেভাবে নিঁচু ক্লাস বলে খোটা দিল,সেম বাপটাও দিল।আমরা কাজের লোক রাখিনা বলে কি আমরা কাঙালি নাকি হু!মন চাচ্ছে এই বাপ ব্যাটাকে মাথায় তুলে আছাড় দেই।

-কাকে আছাড় দেওয়ার কথা বলছো তুমি?
আওয়াজটা শুনে রিমির কলিজা প্রায় পানিশূন্য।চোখ দুটো বড় বড় সাইজ করে পেছনে ফিরতেই রিমি আহসানকে দেখতে পায়।আহসানকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে ওঠে রিমি।চোখের পলক না ফেলে একই রিয়েকশনে তাকিয়ে আছে রিমি।তা দেখে আহসান পুনরায় জিজ্ঞেস করে,এই মেয়ে!বলছো না কেন কাকে আছাড় দিবে?
-আমি তো মশাকে বলছিলাম।খুব জ্বালাচ্ছে আমায়।হুশ হুশ দূরে যা মশার বাচ্চা মশা।
জীবন বাঁচানো ফরজ।এই ভেবে মুখে যা আসলো তাই বলে দেয় রিমি।

-হাও পিকুলিয়ার!এখানে কোনো মশা আসতে পারবে না ওকে?এখানে mosquito protection আছে।আমার কাছে সময় নেই ফার্স্ট বের হতে হবে আমাদের।
রিমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলে,কোথায় বের হবো আমরা?
-শপিং করতে হবে।মাত্র বাপি বললো আপনাকে নিয়ে শপিং এ যেতে।
-কেন?

-আপনার জন্য ড্রেস কিনতে বলেছে।শাড়ি নাকি পড়তে পারেন না তাই।কোথায় ভাবলাম একটু রেস্ট করবো তার ও উপায় নেই।সব তোমার জন্য হলো এই বলে রাগে গজগজ করতে করতে ওয়াশরুম চলে যায় আহসান।
-আজব তো!আমি কি বলেছি যে আমায় নিয়ে শপিং এ যান!এতো অদ্ভুত কেন উনি!কখনো তুমি বলে,আবার কখনো আপনি।মাথায় ঘোড় গন্ডগোল আছে বুঝলাম।থাকবেই তো ভ্যাম্পায়ারদের লিডার যে উনি।একটা মস্ত দানবের হাতে পড়েছি রে বাবা।আগে জানলে স্রুতির বিয়েতেই আসতাম না।ভুল হয়ে গেছে বিয়ে খেতে এসে।জীবনে ভুলের খাতায় এই ভুলটাই উপরের কাতারে লিখা আছে মনে হচ্ছে।

পুরো শপিংমল জুড়ে কোলাহল।মানুষের বেশ ভীড়।এটাই তো স্বাভাবিক।আহসান রিমিকে নিয়ে কখনো ড্রেসের শপে যাচ্ছে।আবার কখনো জুয়েলারির।প্রায় দু ঘন্টা ধরে ওরা মলে।কিন্তু এখনো অবধি একটা সুতোও কেনা হয়নি।এর কারণ আর কেউ নয়,রিমি নিজে।ওর যেন কিছু পছন্দই হচ্ছে না।পছন্দ হচ্ছে না বললে ভুল হবে।রিমির পছন্দ ঠিকই হচ্ছে তবে দাম শুনে ওর সব পছন্দ অপছন্দে পরিনত হয়ে যাচ্ছে।ওর যেটা পছন্দ হচ্ছে সেটার দাম শুনে একই কথা বলছে,তেমন ভালো লাগছে না।আহসান টলার করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে বলেই ফেলল,তুমি কি ডাইমন্ড বা গোল্ডের ড্রেস নিতে চাচ্ছো?
আহসানের এমন উদ্ভট প্রশ্নে রিমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।আহসানের কথা বুঝতে না পেরে রিমি জিজ্ঞেস করে,কেন?
-তুমি যে এতো এক্সপেন্সিভ ড্রেসগুলো ইগনোর করছো তাই বললাম।তোমার কি ডাইমন্ড বা গোল্ডের ড্রেস লাগবে!লাগলে বলো তাই নেই।

রিমি বুঝতে পারলো আহসান বিরক্ত হয়ে কথাটা বলেছে।
-আসলে আমি,রিমিকে থামিয়ে আহসান বলে,থাক আমি কিনে দিচ্ছে আমার পছন্দ মতো। তোমাকে পছন্দ করতে হবে না।
রিমি মনে মনে বলে,এই কাজটা আগে করলেই হতো।সময় তো নষ্ট হতো না আপনার।তাছাড়া আমি যেগুলো পছন্দ করেছি সেগুলো খুব দামি।পরে আপনিই বলতেন আমাদের মতো মিডিলক্লাস,থার্ডক্লাস মেয়েদের এসব মানায় না।
-কি ভাবছো!আমি কিন্তু বাড়িতে চলে যাব এখন।(বিরক্তি নিয়ে)
-কিছু ভাবছিলাম না।আপনি যা কিনে দেবেন তাই হবে।
আহসান ওর পছন্দ মতো কিছু থ্রি পিস টপ্স আর কিছু প্লাজু কিনে দেয়।তারপর সেগুলোর সাথে কিছু জুয়েলারিজ ও জুতো কিনে দিলো।

ওরা শপিং সেরে বাসায় আসা মাত্র ড্রইং রুমে কিছু অচেনা লোকজন দেখতে পায়।তারা অপার সাথে কিসব বলাবলি করছে। আহসান গিয়ে অপাকে জিজ্ঞেস করে,মম who they are?
-ওহ তুোমরা চলে এসেছো!এনাদেরর কালকের রিসিপশনের জন্য কথা বলতে ডাকা হয়েছে।কিছু লোক রান্না,কিছু লোক ডেকোরেশন আর কিছু লোক আমাদের সবার জন্য ড্রেস বানাবে তার মাপ নিতে এসেছে।
-reception!কিসের?
-তোমাদের বিয়ের।কালতো বউভাত তাই তোমার বাপি এনাদের ডেকেছেন।
-আবার নিউ ড্রামা শেট!আহসান বিরক্তিকর ফেস করে উপরে চলে যায়।আর রিমি এদিকে ওর জিনিসপত্রের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

-তুমিও উপরে যাও মা।এসব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন!এই রুমি,
-জ্বি খালা কন।
-রিমিকে সাহায্য করো ব্যাগগুলো নিয়ে যেতে।
-না মা,আমি পারবো নিয়ে যেতে।তুমি তোমার কাজ করতে পারো,আমি যেতে পারবো রুমিকে বলে ও রুমে চলে আসে।এসে দেখে আহসান ঘুমিয়ে পড়েছে।রিমি ব্যাগগুলো থেকে একটা থ্রি পিস বের করে শাড়ি বদলে আসে।নিজেকে নিজে আয়নায় দেখে বলে,বাহ!ড্রেসটা খুব সুন্দর তো!সব ড্রেসই ভালো লেগেছে আমার।ভ্যাম্পায়ার টার চোখ আছে বলতে গেলে।কথাটা বলে জিভে কামড় বসায়।তারপর উঁকি দিয়ে দেখে আহসান জেগে আছে কিনা।আহসানকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে রিমি যেন জীবন ফিরে পেল।তারপর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,যাক বাবা উনি ঘুমাচ্ছেন।

নইলে আমি যেতাম চলতি ট্রেনের নিচে।হুহহ।
কিছু সময় পর রুমি দুজন ফ্যাশন ডিজাইনারদের নিয়ে আসে আহসানের রুমে।রিমি তখন বারান্দায় বসে ওর আম্মুর সাথে কথা বলছিলো।রুমির ডাকে রুমের ভেতর যায়।তারপর বলে,কি হয়েছে!কিছু বলবে আমায়?
-এনাগো নিয়া আইছি আপনার আর ছোটসাহেবের জামাকাপড়ের মাপ নিব।ছোটসাহেবরে ডাক দেন। আমি যাই গিয়া দেহি রান্নার কি অবস্থা।একনাগাড়ে বকবক করে চলে যায় রুমি।
-ম্যাম আপনি একটা লেহেঙ্গা চুজ করুন এই বলে ছেলে ডিজাইনারটা একটা বই এগিয়ে দিলেন।
রিমি বইটা হাতে নিয়ে বলে,
-লেহেঙ্গা বানাতে বলেছে?

তোলপাড় পর্ব ১+২

-জ্বি মিসেস রঞ্জিত আপনাকে লেহেঙ্গার ডিজাইন দেখাতে বলেছেন।আপনি আপনার হাসবেন্ডকে ডাকুন।উনি শেরোয়ানির ডিজাইন পছন্দ করার পর আমরা মাপ নেব।
-আমি কিভাবে ডাকবো!আপনি ডাকুন।
-সরি ম্যাম,আপনি ডাক দিলে ভালো হতো।প্লিজ কুইক। আমাদের আরো অনেক কাজ করতে হবে।(মেয়ে ডিজাইনারটা বলল)
-আচ্ছা ডাকছি আমি।
মুখে খুব সহজে বলে দিল রিমি কিন্তু ভয়ে ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে ইতোমধ্যে।রিমি ধীর গলায় বলল,শুনছেন!আপনাকে ডাকছে।এতো আস্তে বলেছে যে ও নিজেই শুনতে পেল না।
-ম্যাম একটু লাউডলি বলুন প্লিজ।

-জ্বি বলছি।রিমি আহসানের কানের কাছে গিয়ে খুব জোড়ে বলল,উঠুন। আহসান লাফিয়ে উঠে চিল্লানি শুনে।আহসান কানের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল।তারপর উচ্চস্বরে বলল,এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন?তোমার জন্য কি শান্তিতে ঘুমাতে পারবো না!ননসেন্স কোথাকার।
রিমি দু কানে হাত চেপে বলে,আমি কিছু করিনি।
এনারা ডাকতে বলেছে।তাদের দেখিয়ে দিয়ে বলল।
আহসান তাদের দেখে নিজের রাগকে সংযত করে বলে,আপনারা কি করছেন এখানে?

-আমাদের মিসেস রঞ্জিত পাঠিয়েছেন,আপনাদের দুজনের ড্রেসের মাপ নেওয়ার জন্য।আপনি চাইলে পরে নেব।এখন আসি।ওনাদের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে কতটা ভয় পেয়ে আছেন।রিমি যে কেন আহসানকে ডাকতে চায়নি সেটাও বেশ ভালো করে বুঝতে পেরেছেন ওনারা।
-নো প্রবলেম, আপনারা আপনাদের কাজ করতে পারেন।
তারা তাদের সব ফরমালিটিস শেষ করে চলে যান।তারা চলে গেলে আহসান ধমক দিয়ে বলে,মাথায় কি আছে তোমার?এভাবে কেউ কাউকে জাগিয়ে তোলে!আর ইউ ফুল ইউ সিলি গার্ল?প্রায় আধ ঘন্টা ধমক আর ঝাড়ির লেকচার দিয়ে চুপ হয়ে যায় আহসান।

তোলপাড় পর্ব ৫+৬