তোলপাড় পর্ব ৯+১০

তোলপাড় পর্ব ৯+১০
শান্তনা আক্তার

ফাংশন শেষে মেহমানরা যে যার মতো চলে গেলে সবাই যার যার রুমে চলে আসে।আহসানের পিছু পিছু রিমিও রুমে যায়।রিমি প্রবেশ করতেই আহসান ঠাশ করে দরজা লাগিয়ে দিল।জোড়ে শব্দ হওয়ায় রিমি খানিকটা কেঁপে উঠল।রিমি আরও ভয় পেয়ে গেল আহসানের ভয়ংকর চাহনি দেখে।হঠাৎ আহসান এসে রিমির চুলের মুঠি ধরে ফেলল।রিমি ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে ও মা বলে আর্তনাদ করতে লাগলো।রিমির কান্না দেখেও আহসানের মায়া হলো না বরং ও বলল,কাঁদ বেশি করে।খুব শখ সাজার তোর তাইনা,এই বলে রিমির চুল ছেড়ে দেয়।তারপর ঠোঁটের লিপ্সটিক আঙুল দিয়ে ঘষে ঘেটে দেয়।তারপর চোখের সব সাজ ও বিগড়ে দেয়।রিমি বুঝতে পারছে না আহসান এমন কেন করছে।ওর কাছে আহসানকে হিংস্র জানোয়ারের ন্যায় লাগছে।রিমি কান্নাজড়িত গলায় বলে ওঠে,আপনি এসব কি করছেন?আমার ভুলটা কি?কি করেছি আমি?

আহসান এবার রিমির গলা টিপে ধরে,তোর দোষ তুই এতো সাজলি কেন?এতো সেজে কাকে দেখালি?
-আমি সত্যি বুঝতে পারছি না কিছু।আপনি কি বলতে চাইছেন?আমি সেজেছি বলে এতো রিয়েক্টই বা কেন করছেন?
আহসান আঙুল উঁচিয়ে বলে, আর কখনো সাজবি না বলে দিলাম।আমি যেন আর সাজতে না দেখি তোকে।
-আমি কি ইচ্ছে করে সেজেনি নাকি?আপনারাই তো পার্লারের লোক এনে সাজালেন আমায়?আমি কি করেছি বলবেন প্লিজ?আমার সাজে আপনি এতো রিয়েক্ট কেন করছেন?(রিমি বারবার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে)

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-রিয়েক্ট করছি কারণ তোর মতো মিডিলক্লাস মেয়ের এতো সাজ মানায় না।আর এতো সব অর্নামেন্টস পড়ার যোগ্যতা তোদের নেই এই বলে এক টানে গলার নেকলেসটা খুলে ফেলল।খুব শক্তি দিয়ে টান দেওয়ায় নেকলেসটার চেইন ছিড়ে যায় ফলে রিমির গলার কিছু অংশ কেটে যায়।এক এক করে রিমির গায়ের সব গহনা খুলে ফেলে আহসান।যেখানের গহনা খুলেছে সেখানের কিছু অংশ ছিলে গেছে বা কেটে গেছে।রিমি বার বার আঘাতের উপর আঘাত পাচ্ছে।ওর চোখ বেয়ে পানির ধারা অবহিত হচ্ছে।ওর মুখ দিয়ে আর কথা বের হচ্ছে না।

চোখের পানি টুকুই যেন হাজারো নালিশ জানাচ্ছে।আহসান রিমির দুবাহু ধরে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,এবার যাও সামনে থেকে।চেঞ্জ করে নাও,তোমাকে আর দেখতে ইচ্ছে করছে না আমার।রিমিকে একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহসান আবারও বলল,কি হলো!যাচ্ছো না কেন?রিমি ধিরু পায়ে ওয়াশরুমের ভেতর চলে যায়।ওয়াশরুমের দরজা অফ করে উচ্চস্বরে কেঁদে দেয় ও।আয়নায় কাটা জায়গাগুলো দেখছে আর কান্নার মাত্রা বাড়াচ্ছে।খুব কষ্টে জামা বদলে মুখে পানির ছিটা দিয়ে নিজেকে শক্ত করে নেয় রিমি।তারপর বলে,অনেক সয়েছি আপনার অত্যাচার।তবে আর না।এবার আপনাকে উচিত শিক্ষা দিতেই হবে।নাহলে আপনার মতো অত্যাচারী পার পেয়ে মাথায় উঠে যাবে।আমি একজন শিক্ষিত নারী হিসেবে এই জুলুম আর মানবো না।

রিমি বাহিরে এসে দেখে আহসান শেরোয়ানি বদলে শুয়ে পড়েছে।শেরোয়ানিটা মাটিতে পড়া ছিলো রিমি সেটা উঠিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখে তারপর সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।সারারাত ঘুমের জন্য ছটফট করে বেচারি,তবে একটুও ঘুমাতে পারলো না।কিভাবে ঘুমাবে শরীরের বিভিন্ন স্থানের ক্ষত নিয়ে?ব্যাথায় কাতরেছে সারারাত।কেউ নেই ওকে দেখার।সেই অবস্থায় ফজরের নামাজ আদায় করে ও।তারপর আবারও ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করল।একেবারে ভোরের দিক দিয়ে ঘুম আসলো রিমির।তাও বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারলো না।রিমির হঠাৎ করে অনুভব হলো ওর শরীরে কারো হাত বিচরণ করছে।চোখ মেলতেই আহসানকে দেখতে পেল।দেখল আহসান ওর ক্ষত স্থানে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে খুব যত্ন সহকারে।রাতের কথা মনে পড়তেই রিমি এক চট করে উঠে বসলো।তাই দেখে আহসান বলে,উঠে পড়লে কেন?আরেকটু বাকি ছিলো তো।

আহসানের কথায় রিমির পুরো শরীরে আগুন জ্বলে উঠে।ও বলে,কি করতে এসেছেন আপনি?মলম লাগাতে!নিজেই ব্যাথা দিবেন আবার নিজেই উপশম করতে চাইছেন!হাহ,কোনো দরকার নেই।আপনি পারলে আরও দু তিনটা আঘাত করুন।কারণ এটা কাজটাই আপনাকে যায়।কারো উপশম ঘটানোর ক্ষমতা আপনার নেই।সরি আপনি তো একজন গন্যমান্য ডাক্তার।আপনার দায়িত্ব রুগির সেবা করা।কিন্তু তাই বলে সবার সেবা করার অধিকার আপনার নেই।আমার ক্ষেত্রে তো একদমি নেই।তাই সরে যান এখান থেকে।(কড়া করে বলল)

-আমারই ভুল।এইসব ফকিন্নি মেয়েদের মাথায় তুলতে নেই বলে উঠে দাঁড়ায় আহসান।
কয়েক মিনিট পর আহসান রেডি হয়ে চলে যাচ্ছিলো সেই মুহুর্তে জিসান রুমে প্রবেশ করে।এসেই বলে,গুড মর্নিং ভাইয়া,ভাবি।রিমি কাপড় গোছাচ্ছিল জিসানকে দেখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,গুড মর্নিং।
-তুই কি করতে এসেছিস এখানে?(আহসান)
জিসান উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,

-তুই কি এখন হসপিটালে যাচ্ছিস?
-হুম,কেন?
-না এমনি।আর আমি এখানে ভাবির সাথে গল্প করতে এসেছি।গতকাল তো কিছুই বলা হয়নি সেভাবে।তাই এখন চলে আসলাম।তুই যা এখন।

আহসান দাঁতে দাঁত কামড়ে বলে,আমার ইচ্ছে আমি কখন যাব না যাব।তোকে বলতে হবে না।
-ওকে বাবা ভুল হয়েছে এই বলে রিমির কাছে গিয়ে বলে,ব্রেকফাস্ট করেছো?
রিমি হালকা হেসে উত্তর দিল,হুম করেছি সম্পা কিছুক্ষণ আগে দিয়ে গিয়েছিল।
-তুমি নিচে আসোনি কেন?আমরা একসাথে ব্রেকফাস্ট করতাম।
-সম্পা রোজ দিয়ে যায় তাই আর যাওয়া হয়না।

-না এটা কিন্তু ভালো না।এখন থেকে আমরা একসাথে ব্রেকফাস্ট,লাঞ্চ,ডিনার করবো।ঠিক আছে তো?
-আচ্ছা ভাই করবো।
-এই ভাই কাকে বললে হুম?দেবরজি বলবে বুঝলে!
-ওকে দেবরজি।
আহসান ওদের কথপোকথন আর শুনতে না পেরে রাগে গিজগিজ করতে করতে চলে গেল।
‘আচ্ছা তাহলে স্রুতির অনিক নামের একটা ছেলের সাথে রিলেশন ছিলো।'(সেন্টারফ্রুট চাপাতে চাবাতে বলে জিসান)
-হুম,ছেলেটা খুবই ভালো।সরকারি চাকরি করে।আমি বলেছিলাম পরিবারের সবাইকে জানালে তারা না করবে না কিন্তু,বলে থেমে যায় রিমি।

-কিন্ত কি ভাবি?
-তোমার ভাইয়া আর স্রুতির বিয়ে নাকি আগে থেকেই ঠিক করা।তাই নাকি স্রুতি কিছু বলতে পারেনি।
-That’s true..আচ্ছা ভাইয়ার সাথে কি তোমার আগে থেকে পরিচয় ছিলো!নাকি বিয়ের দিনই দেখা হয়েছে?
-আগেই দেখেছিলাম।স্রুতি বলেছিল তোমার ভাইয়া Australia থেকে আসার পর ওদের ফ্যামিলি ওদের দুজনের বিয়ে দেবে ঠিক করেছে।তারপর স্রুতি তো কান্না শুরু করে দিয়েছিল অনিককে ছাড়া বাঁচবে না,মরে যাবে হ্যান ত্যান।তারপর আমি ওকে আইডিয়া দিলাম আহসানের সাথে দেখা করে ওর আর অনিকের ব্যাপারটা বলে দিতে।

-ওহ,তারপর?
-তারপর স্রুতি আহসানকে ডেট করতে ডাকে।আমার হাতে পায়ে ধরে আমাকেও সেদিন সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলো।আমি বন্ধুত্ব রাখতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।সময় মতো আমরা গ্রিনলাইন রেস্টুরেন্টে গিয়ে আহসানের জন্য ওয়েট করতে থাকি।তারপর আমি স্রুতিকে বলি।

‘বাবা বকবে অনেকটা সময় ওয়েস্ট হয়ে গেছে। তোর হবু বর আসছে না কেন এখনো?
-মুখ সামলে পেতনীর সতিনী।আমার হবু বর শুধু অনিক আর ওই হবে।আমরা এটা ওটা নিয়ে ঝগড়া করছিলাম তখন তোমার ভাইয়া এসে আমাকে বলে, এক্সকিউজ মি!আর ইউ স্রুতি?আমার চোখ তোমার ভাইয়ার চোখে পড়তেই খুব বড়সড় একটা শক খেয়েছিলাম সেদিন।জীবনে কখনো কেউ আমায় ক্রাশ খাওয়াতে পারবেনা শপথ করেছিলাম।কিন্তু তোমার ভাইয়াকে দেখার পর আমার সব শপথ মাটিতে মিশে গেল।

-হাউ রোমান্টিক ভাবি!তো কি দেখে ক্রাশ খেলে আমার ভাইয়ার উপর?
-রোমান্টিক না ছাই(মনে মনে)।কেন খেয়েছিলাম জানি না।
-স্ট্রেঞ্জ!লাইক সিরিয়াসলি?ক্রাশ খাওয়ার কোনো না কোনো কারণ থাকে।সেটা তোমাকে বলতে হবেই।সো নো চিটিং।
-আসলে আমি ওনার মুখের চাপ দাড়ি আর নীল চোখ দেখে ক্রাশ খেয়েছিলাম।তাছাড়া বরাবরই আমার উজ্জ্বল শ্যামলা ছেলেদের ভালো লাগে।তবে রিয়ালে কাউকে ভালো করে দেখিনি।জাস্ট সিনেমার হিরোদের ছাড়া।এইসব মিলিয়ে ক্রাশ খেয়ে ফেলেছিলাম।(অপরাধী ফেস করে)

-ok then?
-তারপর আমি বললাম আমি স্রুতি নই।আমি স্রুতিকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম।
-স্রুতির ফেস আমার স্পষ্ট মনে আছে আর ভাইয়ার নিজের ফুপির মেয়ে ও তাও চিনতে পারলো না?
-এই সেম প্রশ্নটা আমিও করেছিলাম।তারপর তোমার ভাইয়া বলেছিল খুব ছোটবেলায় নাকি উনি স্রুতিকে দেখেছিল।তারপর ফরেন যাওয়ার পর নাকি ওদের মধ্যে কোনো যোগাযোগই হয়নি।

-কথা ঠিক।আমার সাথেও ভাইয়ার তেমন কথা হয়নি।জাস্ট ঈদের দিন ছাড়া।
-তাইতো চিনতে পারেনি।আর উনি যেদিন ফরেন থেকে এসেছিলেন সেদিন আমাদের একটা ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টি ছিলো।তাই স্রুতির বাবা মা আসলেও স্রুতি আসেনি এ বাড়িতে।
-ওহ,লেট ইট পাস্ট।তারপর কি হলো?

-তারপর স্রুতি আর আহসান একে অপরের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলো।স্রুতি যখন আহসানকে অনিকের কথা বলবে ঠিক করলো ঠিক তখনি আহসানের ফোনে একটা কল আসে।আহসান কি জানি কাকে বকাঝকা করছিল।ওর মুড ভালো ছিলোনা তখন।তাই স্রুতি ভয়ে কিছু বলতে পারেনি।ভেবেছে পরে বলবে।আমি স্রুতিকে অনেক বুঝিয়েছিলাম আহসানকে বিয়ে করার জন্য কিন্তু ও অনিককে ছাড়া কাউকে বিয়েই করবে না বলে দিয়েছে।

-স্রুতি তাহলে ভাইয়াকে বলেনি সত্যিটা?
-না বলতে পারেনি ফ্যামিলির ভয়ে।তারপর বিয়ের দিন প্লান বানালো পালাবে।আমাকে ওর শাড়িটা পেচিয়ে দিয়ে বেলকনিতে একটা দড়ি ঝুলিয়ে নিচে নেমে যায় চলে যায় অনিকের সাথে তারপর সবাই এসে দেখে স্রুতি নেই আমি ওর জায়গায় বসে আছি।
-সবাইতো খুব বকেছে তোমায়!তোমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে স্রুতি পালিয়ে গেল।এটা তো ভালো করেনি ও।
-হুম বকা তো খেয়েছি খুব।কি করতাম আমি?বেস্টফ্রেন্ড এর ধর্ম পালন করতে গিয়ে নিজেকে বলি দিতে হলো আমায়।আমি সেই সময় টায় খুবই হেল্পলেস ছিলাম

তোলপাড় পর্ব ৭+৮

-তারপর সবাই মিলে তোমার আর ভাইয়ার বিয়ে দিল তাইতো?
-হুম,তোমার ফুফার একটা প্রেস্টিজ আছে।প্রেসের লোকজন ও এসেছিলো।বিয়ে হবে না জেনে একেক জন একেক কথা বলছিলো।তাই মান সম্মান বাঁচাতে আমাদের বিয়ে দিয়ে দেন।আমি আব্বুর এক ধমক খেয়ে বিয়ের পীড়িতে বসে গিয়েছিলাম।তোমার ভাইয়াও মেবি তার বাবার কথা রাখতেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো।

-তার মানে তোমরা একে অপরকে লাইক করোনা।
-ওনার মতো ভ্যাম্পায়ারকে কেই বা লাইক করবে?আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খেলে উনি শান্তি পায়।(বিরবির করে বলল রিমি)
-What are you saying vabi?
-না কিছু বলিনি তো।

ওদিকে আহসান কাজে মন দিতে পারছে না।বারবার রিমি আর জিসান কি বলাবলি করছে সেই খেয়ালই আসছে ওর মাথায়।
-এভাবে আর বসে থাকা যাচ্ছে না।আমি বরং রিমিকে একটা কল করি এই বলে ফোন বের করে।পরক্ষণেই ওর মনে পড়ে রিমির নাম্বার তো ওর কাছে নেই।ওহ নো আমার কাছে তো রিমির নাম্বারই নেই।জিসানকে কল দেব?না থাক আমি এখন ফ্রি আছি রিপোর্ট গুলো একটা নার্সকে বুঝিয়ে দিয়ে বাড়িতে যাই।Yeah! That’s a good idea..আহসান একটা নার্সকে ডেকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।

তোলপাড় পর্ব ১১+১২+১৩