দুঃখবিলাসী পর্ব ৫

দুঃখবিলাসী পর্ব ৫
তানিশা সুলতানা

একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের চেহারা কখন মিলে যায়? যখন তাদের মধ্যে রক্তের কোনো সম্পর্ক থাকে। এই যে এতিম খানার একটা ফুটফুটে বাচ্চার চেহারার সাথে শিহাবের চেহারার হুবহু মিল পাওয়া যাচ্ছে। বাচ্চাটার বয়স কতো হবে? তিন চার।

যে কেউ দেখে বলবে এই বাচ্চাটার সাথে শিহাবের রক্তের কোনো সম্পর্ক আছে। দুজনের আদলখানি, কথা বলার ধরণ এমন কি হাঁটাচলার ধরণটাও একই রকম। এই যে এক দৌড়ে চলে আসলো আবুলের কাছে। আধোআধো গলায় গাল ফুলিয়ে কথা বললো। সবটা যেনো শিহাবের ফটোকপি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাইশা শুধু অবাক হয়ে বাচ্চাটাকে দেখছে। এই বাচ্চাটার সাথে শিহাবের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
এই এতিম খানার দেখা শোনা করেন আবুল নামের একটা লোক।
রিয়াদ মাইশার দায়িত্ব আবুলকে দিয়ে চলে যায়। তার তাড়া আছে। আয়রাকে স্কুল থেকে আনতে যেতে হবে। যাওয়ার আগে মাইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়

“আমি বিকেলে আসবো৷ চিন্তা করবেন না আপনি। পাপাও আসবে রাতে। যা প্রয়োজন হবে বলবেন। এবং সাবধানে থাকবেন।
মাইশা শুধু মাথা নারিয়েছিলো। কোনো কথা বলে নি। এবং তাকায়ও নি রিয়াদের দিকে। এতে রিয়াদ একটু আশাহত হয়। দুঃখ পায়।

আবুল এই এতিম খানার দায়িত্বে আছে আট বছর যাবত। বউ মারা যাওয়ার পরে একমাত্র সঙ্গী ছিলো এতিম খানার বাচ্চা গুলো। কোনো সন্তান হয় নি তাদের। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো। এবং বিয়ের পরপরই জেনেছে তার বউ কখনোই মা হতে পারবে না। পরিবার এবং বউ নিজেও কতো বলেছে আবুলকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে। কিন্তু আবুল রাজি হয় নি। ৩০ টা বছর এক সাথে সংসার করে গিয়েছে। বলা বাহুল্য এই ৩০ বছরে তাদের কখনো সিরিয়াস ঝগড়া হয় নি। বউয়ের গায়ে কখনোই হাত তুলে নি। প্রতি দিন অনন্ত এক বেলা বউকে নিজে হাতে খাইয়ে দিতো আবুল। বড্ড ভালোবাসতেন তিনি তার প্রেয়সীকে।

এবং এখনো বউ মারা গিয়েছে নয় বছর হবে। প্রতিদিন অন্তত এক ঘন্টা বউয়ের কবরের পাশে বসে সময় কাটায়। গল্প করে বউয়ের কবরের দিকে তাকিয়ে।
আবুলের কোলে যে বাচ্চাটি রয়েছে। সেই বাচ্চার চেহারার সাথেই শিহাবকে মেলাচ্ছে মাইশা। নিজের কৌতুহল না দমাতে পেরে প্রশ্ন করে ফেলে

“চাচা এই বাচ্চাটিকে কোথায় পেয়েছেন?
আবুল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। তাকায় বাচ্চাটির মুখপানে। এই বাচ্চাটির প্রতি আবুলের মায়া বেশি। তাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলো ময়লার স্তুপে। চিৎকার করে কাঁদছিলো। আবুল বুকে টেনে নিয়েছিলো বাচ্চাটিকে। নিয়ে এসেছিলো এতিম খানায়।

” পেয়েছিলাম রাস্তায়। কেউ হয়ত ফেলে রেখে গিয়েছিলো।
মাইশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। দুনিয়াটা কতো জটিল। দুইদিনের দুনিয়ায় কতো রং তামাশা দেখা যায়। স্বার্থের জন্য মানুষ কতোটা নিচে নেমে যায়।

“আম্মা আসুন আপনি। ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।
মাইশা আবুলের পেছনে যায়। অনেকখানি জায়গা নিয়ে এই এতিম খানা অবস্থিত। এখানে খেলার মাঠ আছে। চার জন মহিলা বাচ্চাদের দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে। এবং দুজন মহিলা রান্নার দায়িত্ব পালন করে।
আমিনুল ইসলাম এতিম খানার পেছনে প্রচুর টাকা খরচ করে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
আবুল মাইশাকে একটা কামড়ার সামনে নিয়ে আসে। এবং ভেতরে গিয়ে রেস্ট নিতে বলে। মাইশা দ্বিমত করে না। বাচ্চাটার দিকে এক পলক তাকিয়ে কামড়ায় ঢুকে পড়ে।

শিহাবের বোন সুমাইয়া আত্মহত্যা করেছে। মজিবুর (শিহাবের বাবা) মেয়ের মৃত দেহখানা জাপ্টে চিৎকার করে কান্না করে যাচ্ছে। শিহাবও বাবার পাশে বসে কান্না করছে। শুধু পানি নেই শিরিনের চোখে। তিনি যেনো বিরক্ত এসবে।
মুহুর্তে পুরো পাড়া ছড়িয়ে পড়ে সুমাইয়ার মৃত্যুর সংসাদ। ছুটে আসতে থাকে মানুষ জন শেষ বার সুমাইয়ার মুখখানা দেখতে।

সুমাইয়ার প্রথম স্বামী সোহেল সেও এসেছে। তাকিয়ে দেখছে প্রিয়তমার মুখখানা। তাদের বিচ্ছেদ হয়েছে তিন বছর হবে। তারপর সুমাইয়ার আরও দুইবার বিয়ে হয়েছিলো। এসব জেনেও সোহেল দ্বিতীয় বিয়ে করে নি। সুমাইয়ার স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছে।

ভালোবাসার কমতি ছিলো না তাদের সংসারে। কমতি ছিলো টাকা পয়সার। টাকার কাছে হেরে গিয়েছিলো ভালোবাসা। আলাদা হতে বাধ্য করেছিলো তাদের।
পুলিশ আসার খবর শুনে শিরিনের চোখে পানি দেখা যায়। স্বামীর পাশে বসে কান্না করতে থাকেন তিনি।
শিরিনের কার্যকলাপ নজরে রেখেছিলো সোহেল। এই মহিলাকে সে ঘৃণা করে। পৃথিবীর এক মাত্র মা তিনি যে সন্তানের সুখে সুখী হতে পারেন না।

পুলিশ আসে৷ তদন্ত শুরু করে। জিজ্ঞেসাবাদ করেন সকলকে। আত্নহত্যা কেনো করতে পারে সে? কি দুঃখ ছিলো তার?
শিরিন কান্না করে জবাব দেয়
“এই ছেলেটার জন্য আত্মহত্যা করেছে (সোহেলের দিকে আঙুল তুলে)

উপস্থিত সকলে অবাক হলেও সোহেলের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা যায়।
সোহেল এমন একটা মানুষ যাকে এই পাড়ার সকলে আদর্শ পুরুষ বলে মানে। সকলের প্রশংসায় সকলেই পঞ্চমুখ। সোনার খাঁদ থাকতে পারে কিন্তু সোহেলের মধ্যে কোনো খাঁদ নেই এটাই সকলের ধারণা।
পুলিশ অফিসার আবারও প্রশ্ন করে

” আপনার কেনো মনে হচ্ছে? আপনার মেয়ের মৃত্যুর জন্য এই ছেলে দায়ী?
আপনি নিজেই বছর খানিক আগে এই ছেলের নামে মামলা করেছিলেন। এবং আপনার মেয়ে আমাদের হাতে পায়ে ধরে মামলা তুলে নিয়ে ছিলো। এবং সে বলেছিলো তার কিছু হয়ে গেলে তার দায় সম্পূর্ণ আপনার।
চমকায় শিরিন। আড়চোখে তাকায় সুমাইয়ার মৃত দেখখানার দিকে। মরে গিয়েও ফাঁসিয়ে দিয়ে গেলো।
পুলিশ অফিসার তাকিয়েই আছে শিরিনের মুখের দিকে।

শিহাব বুঝতে পারে তার মা ফেঁসে যাচ্ছে।
চোখের পানি মুছে বলে ওঠে
“অফিসার।
আমার বোন এই ছেলেটাকে ভীষণ ভালোবাসে। তাকে বাঁচানোর জন্য যা খুশি করতে পারে।
আমার মাকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন না। ভুলে যাবেন না আমার মায়ের জন্যই সুমাইয়া দুনিয়ার আলো দেখেছিলো।

পুলিশ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। প্রমাণ ছাড়া তারা কখনোই কোনো স্টেপ নিতে পারবে না। আর এখানে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মেয়েরা আত্নহত্যা করেছে। মেয়েটার গলায় এখনো ওড়না বাঁধা রয়েছে।
তবে প্রশ্ন একটা থেকেই যায়।
মেয়েরা সুইসাইড করার ডিসিশন কেনো নিলো?

কেউ কি তাকে বাধ্য করেছে আত্মহত্যা করতে?
মাইশার কানেও পৌঁছে যায় সুমাইয়ার খবরটা। দ্বিতীয় ধাক্কা খায় মাইশা৷ সুমাইয়াকে ভীষণ ভালোবাসে। এই দুনিয়াতে সুমাইয়াই একমাত্র মানুষ যে মাইশাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতো।

একমাত্র আশ্রয় ছিলো। সুমাইয়া সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা আছে মাইশার। এবং এটাও জানে সুমাইয়া আত্মহত্যা করে নি। তাকে খুন করা হয়েছে।

দুঃখবিলাসী পর্ব ৪

কিন্তু ভীতু মাইশা এই কথা কারো কাছে বলার সাহস পাচ্ছে না।
শিহাবকেও বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু শিহাব শুনে নি।
তবে আজকে আমিনুলকে সে সব কথা বলতে চায়।

দুঃখবিলাসী পর্ব ৬