নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৪
Mousumi Akter

গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠ কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্রই রজনী তড়িৎ গতিতে পিছনে ঘুরে তাকাল। কণ্ঠটা যেন তার চেনা চেনা মনে হলো। যা ভেবেছিল সেই আশংকা-ই সত্য হলো; সে প্রথমে যাকে ভেবেছিল– সত্যিই সে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হলেও লাইটের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে প্রান্তিকের মুখের অবয়ব। প্রান্তিক খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে বুকে হাত বেঁধে। রজনী তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই বলে উঠল,

“অমাবস্যার রাতে এক টুকরো পূর্ণিমার চাঁদ জমিনে, পৃথিবীর ইতিহাসে বোধহয় আমিই একমাত্র ভাগ্যবান পুরুষ; যার কি না জমিনে আলো ছড়ানো চাঁদ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আকাশের চাঁদ তো সবাই দেখেছে; কিন্তু জমিনের চাঁদ দেখার সৌভাগ্য ক’জনের হয়েছে! সেদিক থেকে নিঃসন্দেহে আমি একজন সৌভাগ্যবান পুরুষ।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রান্তিকের এহেন কথাবার্তায় রজনী বিস্মিত হলো। ভয়ার্ত চোখে তাকাল প্রান্তিকের দিকে। এই রাতের বেলা সে একা বাড়িতে।সাথে এই ভয়ঙ্কর মানুষ। কী করবে এখন? যদি কোনো ক্ষতি করে! নিশ্চয়ই ক্ষ’ তি করতেই এসেছে। না হলে কেন আসবে? ভ’য়ে সমস্ত শরীরে কম্পন ধরেছে, কণ্ঠস্বরও যেন এঁটে গেল, শরীর ভারী হয়ে এলো। চিৎকার দেওয়ারও শক্তি নেই। হৃৎপিণ্ডটা ভ’ য়ে ঢিপ ঢিপ করছে ।

মুখটাও কেমন চুপসে এসেছে। অন্যদিকে প্রান্তিকের চোখ-মুখ জুড়ে মুগ্ধতা। প্রান্তিকের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে রজনীর গাঢ় লাল লিপিস্টিক পরা ওষ্ঠ পানে। মুগ্ধ হয়ে দেখছে। রজনীর ঠোঁট দু’টো একটু বেশি সুন্দর। প্রান্তিক বিমোহিত হয়ে যায় এই ঠোঁটের দিকে তাকালে। রজনীর স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে এই ওষ্ঠজোড়া যেন একেবারেই নিখুঁত সৃষ্টি। প্রান্তিকের ঠোঁটজুড়ে মৃদু হাসি। দেখার পিপাসা যেন মিটছে না। এর আগে অজস্র ঠোঁট সে দেখেছে তবে এতটা বিমোহিত হয়নি।

রজনী এদিক-ওদিক তাকাল। এই মুহূর্তে আশেপাশে কাউকে দেখলেই ডাকবে।রজনীকে এদিক-ওদিক তাকাতে দেখে প্রান্তিক ধীর পায়ে এগিয়ে এলো রজনীর সামনে। এসে সোজা হয়ে দাঁড়াল। হুডির পকেটে দুই হাত গোঁজা। প্রান্তিক রজনীর দিকে তাকিয়ে দুই ভ্রু উঁচু করল। নিচের ঠোঁট কামড়ে আরও গভীর দৃষ্টিতে তাকাল রজনীর মুখশ্রীতে। প্রান্তিক যেন হারিয়ে যেতে চায় রজনীর সুন্দর ওষ্ঠদ্বয়ের গভীরে।বিশেষ কিছু আছে নিশ্চয়ই এই চোখে-মুখে- ওষ্ঠে। চোখ দশ সেকেন্ড বন্ধ করে অদ্ভুতভাবে সুবাস নিল। রজনীকে দেখার পর থেকেই এই সুবাস সে পায়। মোহনীয় এক সুবাস– প্রান্তিককে মাতোয়ারা করে তোলে।

রজনী আস্তে করে পেছনের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছে। এখনি সে দৌড় মারবে। প্রন্তিকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যেন কিছুই এড়িয়ে যায় না। রজনী দৌড় মারবে মারবে ভাব তখনি প্রান্তিক রজনীর হাত চেপে ধরল। রজনীর ভ*য় আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সমগ্র কায়ায় ভয়ানক কম্পন সৃষ্টি হলো। প্রান্তিক রজনীকে সাহস জোগাতে বলল,
“তুমি এভাবে কাঁপছ কেন, রজনীগন্ধা? অ্যানি প্রব্লেম? আর ইউ অ্যাফ্রেইড? বাই এনি চান্স, কোনো কারণে ভ*য় পাচ্ছ তুমি? লুক অ্যাট ইওর সিস্টার।”

রজনী তাকাল। তাকিয়ে দেখল ছয় বছরের জুঁই তাকিয়ে হাসছে। জুঁই তার চাচার মেয়ে।শ্রাবণ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।কেউ এদিকে আসে কি না সেটাই লক্ষ রাখছে।
প্রান্তিক আবার বলল, “তুমি ভ*য় পাবে বলেই তোমার বোনকে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। বোন থাকতে আবার ভ*য় কীসের? আমার তোমাকে নিয়ে খারাপ উদ্দেশ্য নেই, ইভেন থাকতেই পারে না। রজনী ফুলের সুবাস আমি অমৃত্যু গ্রহণ করতে চাই।

এই ফুল আমার। ফুল নষ্ট হলে সুবাস হারিয়ে যাবে। এই ফুলের সুবাস ছাড়া আমি এক সেকেন্ডও শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারব না।কেমন যেন এই ফুলের নিঃশ্বাস ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসছিল। দম বন্ধ হওয়া প্রাণে অক্সিজেন-এর খুব অভাববোধ হচ্ছিল। সেই অক্সিজেন নিতেই এখানে ছুটে আসা। আমার অক্সিজেনই রজনীগন্ধ্যার স্নিগ্ধ সুবাস।”
রজনী ভ’ য়ার্ত কণ্ঠে শুধাল, “আপনি কী চান আমার কাছে?”
প্রান্তিক নেশা জড়ানো কণ্ঠে বলল, “সুবাস চাই।”

“ কী!-কীসের সুবাস?”
“তুমি একটা ফুল, আর ফুল মানেই তো সুবাস। তুমি যে সুবাসটা ছড়াও এটা অতি মোহনীয় লাগে আমার কাছে। প্রচণ্ডরকমের নেশালো।”
রজনী আরও বেশি ভ*য় পেয়ে গেল। ভ-য়ে কেঁপে উঠল ওর আত্মা। এই বাজে মানুষটা কী বোঝাতে চাইছে তাকে? আমতা আমতা করে বলল,

“দে ‘দেখুন, আমাকে যেতে দিন। আমার কিছু করবেন না প্লিজ।”
“কে বলেছে কিছু করব? তুমি কিন্তু আমাকে এক-প্রকার চরিত্রহীনই বলছ। তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে একদমই জিভ ছিঁ’ড়ে ফেলতাম। প্রান্তিক চৌধুরীকে চরিত্রহীন বলে কেউ পার পেয়ে যাবে; এটা ইজি ব্যাপার নয়। প্রসঙ্গ যেখানে তুমি– হিসাবটা সেখানে একদমই ভিন্ন। তোমার জন্য সব ছাড়।

যা কিছু বলতে পারো।নিজের অজান্তে এই অধিকারটা আমি তোমাকে দিয়ে দিয়েছি। বাট ওয়ান মোর কোয়েশ্চন, আমি গ্যারান্টি দিতে পারি– বিয়ের আগে আমি তোমাকে কিছুই করব না। তবে বিয়ের পরে ব্যাপারটা ভিন্ন। ওই ব্যাপারে একদমই কথা দিতে পারছি না। বিয়ে করা বউ হবে আমার আর আমি কিছুই বলব না। অনেস্টলি বউ হলো পৃথিবীর সব থেকে হালাল জিনিস। একজন দায়িত্ববান পুরুষের উচিত– নিজের বউকে প্রচুর আদর করা।”

রজনীর কেমন যেন প্রান্তিকের স্পর্শ একদমই সহ্য হচ্ছে না। প্রান্তিকের এসব কথাও কর্ণকুহরে একদম বিশ্রী শোনাচ্ছে। ঘৃণায় শরীর ছাঁৎ করে উঠছে। মানুষ কত খারাপ হলে এসব বলতে পারে! রজনী আবারও আমতা আমতা করে বলল,
“আমার হাত ছাড়ুন, আমাকে যেতে দিন প্লিজ।”
প্রান্তিক রজনীকে আরও একটু টেনে কাছে নিয়ে এলো। পকেট থেকে সাদা ধবধবে রুমাল বের করে বলল,
“বিশেষ একটি কাজে তোমাকে ডেকেছি।”

“কী কাজ?”
প্রান্তিক নিজের রুমাল দিয়ে রজনীর ঠোঁটের গাঢ় লাল লিপিস্টিক মুছে দিয়ে বলল, “স্রষ্টার দেওয়া এত সুন্দর ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁটে এত জঙ্গল করে রাখার কী প্রয়োজন? ফুল দেখতে জঙ্গল পরিষ্কার করে দিলাম। এখন চোখের তৃপ্তি পেলাম। শোনো রজনীগন্ধা, একদমই ঠোঁঠে লাল লিপিস্টিক লাগাবে না। এই ঠোঁট এমনিতেই সুন্দর। আমি যেন কখনো আর লিপিস্টিক লাগাতে না দেখি।”

“আ’ আচ্ছা।”
প্রান্তিক ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী আচ্ছা? আর লাগাবে লিপিস্টিক?”
“না।”
“ওকে যাও, বাট নাচবে না কিন্তু। আমার মতো কঠিন ছেলে তোমার নাচ-গান দেখে উ’ন্মা’দ হয়ে গিয়েছে। নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সব ছেলেই পা’গ’ল হবে।”
“আচ্ছা নাচব না।”

“একদমই নাচবে না তুমি। আর এত ফরসা পেট বের করে রেখেছ কেন?”
“শাড়ি সরে গিয়েছে।”
“সেফটিপিন লাগিয়ে নাও ভালোভাবে। কাল পর্যাপ্ত পরিমাণ সেফটিপিন পেয়ে যাবে।”
“আচ্ছা।”

“ ’আচ্ছা’ কী জাতীয় ল্যাংগুয়েজ?”– কথাটি বলেই প্রান্তিক রজনীর শাড়ির কুঁচি থেকে সেইফটিপিন খুলে কোমর পর্যন্ত শাড়ি টেনে ভালোভাবে কোমর-পেট ঢেকে সেইফটিপিন লাগিয়ে দিল। রজনী ভয়ে বাঁধাও দিতে পারল না। কারণ চেঁচামেচি করলেই গ্রামের মানুষ একটা কলঙ্ক রটাতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।
এত সময় যেন রজনীর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যাচ্ছিল। চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকছে।যেন কোনভাবে এই বিপদ থেকে সে রক্ষা পেয়ে যায়। প্রান্তিক রজনীর বন্ধরত চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে অতিরিক্ত ভ*য় দেখে বলল,
“নারী, তুমি সত্যি বড্ড সরল। জানো না– পুরুষ সরলতার প্রেমে বেশি পড়ে।”

প্রান্তিকের কথা শুনে রজনী চোখ মেলে তাকাল। প্রান্তিকের ঠোঁটে মৃদু হাসি বিদ্যমান। ঠোঁটে হাসি নিয়েই বলল, “মেহেদি পরবে না?”
“না।”
আমার নাম ছাড়া তোমার হাত বড্ড বেমানান, ফিঁকে, রঙহীন লাগছে। কিছু একটা নেই নেই মনে হচ্ছে। যে হাতে ড্যাশিং বয় প্রান্তিকের ছোঁয়া নেই সে হাতের সৌন্দর্য কীভাবে ফুটে উঠবে? আমি পরিয়ে দিচ্ছি মেহেদী।
প্রান্তিক পেছনে তাকিয়ে বলল, “শ্রাবণ, মেহেদীটা দিয়ে যা। তোর ভাবির হাত মেহেদী ছাড়া ভালো লাগছে না।”

শ্রাবণ এগিয়ে এসে বলল, “ভাই, আপনি কিন্তু অনেক রোমান্টিক হয়ে গিয়েছেন। আর আজ একটু বেশিই ড্যাশিং লাগছে আপনাকে।”
“আসলেই লাগছে।”
“জি ভাই, ভাবির পাশে হেব্বি লাগছে আপনাকে।”
প্রান্তিক তার নিজের নামটা সুন্দর করে লিখে দিল রজনীর হাতে।
“ ‘প্রান্তিক’ নামটা হাতে লিখে দিলাম। এটা খুব শিঘ্রই তোমার মনে লেখা হয়ে যাবে।এমনভাবে লেখা হবে তোমার প্রতিটা নিঃশ্বাসে বইবে প্রান্তিকের নাম।”

এদিকে ক্রামগত প্রান্তিকের ফোন বেজেই চলেছে। এতক্ষণে পনেরো বার বেজেছে।রজনী এবার অতিষ্ট হয়ে বলে উঠল, “আ আ’পনার ফোন…
প্রান্তিক বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করল।ভিডিয়ো কল ছিল। রজনী খেয়াল করল স্ক্রিনে ভাসছে কামিনী ফুলের সুবাস। রজনীর একটি বাজে ধারণা সৃষ্টি হলো প্রান্তিকের প্রতি। ফোনের স্কিনে সাদা ফকফকা চেহারার একটি মেয়ে। গায়ে খুব একটা ভালো পোশাক নয়। নাইটি পরা তবে একটু বেশিই খোলামেলা। প্রান্তিক বিরক্ত হয়ে বলল, “অর্ধউলঙ্গ হয়ে আমাকে ফোন দিয়েছ কেন?”

“তুমি বোঝ না কেন?”
“না বুঝি না।”– কাটসাট উত্তর প্রান্তিকের
“তোমাকে দেখাব বলে।”
“তাহলে ফেসবুক লাইভে যাও। ভালোভাবে সবাইকে দেখাতে পারবে।”
“ইশ! কীসব বলো তুমি? তোমার জিনিস অন্য কেউ কেন দেখবে? উম্মম্মম্মম্মম্মম্মম্মা।”
“এসব কী হচ্ছে?”
“কী হচ্ছে বোঝো না? বাসায় কেউ নেই। মিস করছি তোমাকে, আসবে?”
“হোয়াট!”

“সেদিন তো এসে জাস্ট অল্প আদর নিয়ে চলে গেলে। আজ কিন্তু এসে ফোন অফ রাখবে।”
রজনীর শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠল। ছি! ছি! বলে উঠে চলে গেল।
প্রান্তিক রা’গে অতিষ্ট হয়ে বলল, “ওহ শিট! এগেইন ভুল বুঝল।”

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৩

“কে ভুল বুঝল?”
“ধ্যাৎ শালী! ফোন রাখ।”– বলেই প্রান্তিক রজনীর পিছনে গেল।

নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৫