কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩২

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩২
লাবণ্য ইয়াসমিন

সৃষ্টিতে যেমন সুন্দর তেমন অসুন্দর কিছু শক্তিও আছে। কালো জাদুও তেমনি একটা শক্তির নাম। আমাদের প্রিয় নবীব উপরেও ইহুদী এক মহিলা কালো জাদু করেছিলেন। যুগ যুগ ধরে নাস্তিকেরা শয়/তানের উপাসনা করে এসব শক্তি হাছিল করে মানুষের ক্ষতি করতে আসছে। তাছাড়া এসব কাজে জ্বীন শয়/তানের এক অংশ সাহায্য করে থাকে।

কহিনুর পাথরকে কালু জাদু সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝিয়ে চলেছে। কিছু কিছু তথ্য ইন্টারনেট থেকে খুঁজে নিচ্ছে। পাথর এসব বিষয়ে খুব একটা জানে না। অর্ধমানব হয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে সেই যন্ত্রণাতেই মরি মরি অবস্থা তবে কখনও ভাবেনি এর থেকে কিভাবে মুক্তি মিলবে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস আছে কিন্তু আল্লাহ মানুষের মধ্যে বিবেক বিবেচনাবোধ জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েছেন সেটা কাজে লাগিয়ে বাঁচার কৌশল মানুষকে খুঁজে নিতে হয়। তাছাড়া কর্ম দ্বারা মানুষ নিজের ভাগ্য বদলাতে পারে। বাকীটা নিয়তি। চেষ্টা করতে দোষের কিছু নেই। কথাগুলো ভেবে পাথর উত্তেজিত হয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে কি করতে হবে শুধু সেটাই বলো। কহিনুর আর পাথর একে অন্যের পরিপূরক। নামের মিলমিশ এটা স্বাভাবিক বিষয়। কহিনুর ভ্রু কুচকে উত্তর দিলো,
আপনার বুদ্ধি জ্ঞান সত্যিই খুব কম। সাঈদ আপনার থেকে হাজার গুণ ভালো। না বলতেই কি সুন্দর বুঝে যায়।
পাথর মুখটা ভার করে ফেলল। এমনিতেই সাঈদকে পছন্দ না তারমধ্যে আবার এরকম ভয়ংকর কথাবার্তা বলছে। কহিনুর ওর দিকে চেয়ে পূণরায় বলল,

আপনার বাবা মায়ের বিয়ের ইতিহাস মনে আছে? দুজন অচেনা মানব মানবি কিভাবে প্রেমে পড়েছিলো আর ঠিক দুদিন পরে অদ্ভুত দুজন ব্যক্তি উনাদের বিয়ে পড়িয়েছিলেন প্রশ্ন জাগে না ওরা কে ছিল? বিয়েটা কাকতলীয় ছিল না। কারণ ছিল আপনার জন্ম। সুলতান পরিবার যেমন আমার জন্মের মাধ্যমে অভিশাপ মুক্ত হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে আপনি পারবেন ওই পরিবারকে মুক্তি দিতে। আপনার দাদুর লোভ লালসা বেশি তাই কখনও চাননি আপনার জন্ম হোক।

তবুও হয়েছে। অদৃশ্য শক্তি আমার সঙ্গে আপনাকে জুড়ে দিয়েছিলো। দুজনে এক হয়ে যাতে কালো জাদুর শক্তিকে হারাতে পারি। সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চার কপালে নানু কহিনুর জ্বলজ্বল করে জ্বলতে দেখেছিলেন। পাথরটা থেকে প্রকাশিত আলোকরশ্মি উনার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। নানুর সঙ্গে সাঈদের আম্মি ছিলেন। উনি প্রথম দেখাতেই বলেছিলেন কহিনুরের পাথর। উনি আপনার নামকরণ করেছিলেন। সেই জন্যই আপনার হাতে খান পরিবারের ক্ষতি হবে ভেবে আপনার স্মৃতিকে আটকে রাখা হয়েছিল। আপনি আমাকে চিনতে পারছিলেন না। অথচ আঁধারকে দেখুন ওকে নিয়ে আপনার দাদুর ভালোবাসার শেষ নেই।

কহিনুর যতটুকু পারে বুঝিয়ে বলল। পাথর কিছু একটা ভেবে প্রশ্ন করলো,
কিন্তু সেদিন আমি যে নিজ চোখে তোমাকে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে দেখেছিলাম। কিভাবে ওরা তোমাকে নিয়ে গেলো? বুঝতে পারছি না।

আমি ওর অনেক আগেই সরে গিয়েছিলাম। আমার মধ্যে থাকা পাথরের শক্তি আমার রূপে ওখানে ছিলো। আপনি ওকেই দেখেছেন। যে জন্ম থেকে আমার সঙ্গে আছে। আমার বিপদের কথা ভেবে আগে থেকে আমার সঙ্গ ও ছেড়ে দিয়েছিলো সেই সুযোগে প্রহেলিকা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। সকলে আমাকে ভেবে ওই শক্তিটাকে দাফন করেছিলো ফলাফল হিসেবে সাঈদ কবরস্থানে থেকে যায়।

সাঈদ কহিনুরের রক্ষক তাই পাথরটা যেখানে থাকবে ও সেখানেই যাবে। কিছুদিন পর প্রহেলিকা কালো জাদু দ্বারা কহিনুর পেয়ে যায় তারপর সাঈদকে আলাদা করে আপনার দাদু বন্ধী করে রাখেন। অল্প সময়ের জন্য কহিনুর পূর্বের মতো শক্তি হারিয়ে ফেলে। আসলে কহিনুর পেলেই হবে না। ওর শক্তিও কাজ করতে হবে। আমি ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলাম সঙ্গে আমার শরীরের রক্ত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল।

চন্দ্র নিশীতে উন্মুক্ত সাগরের তীরে শাণিত খঞ্জরের আঘাতে আমার হৃদপৃণ্ড হতে রক্তিম লাল উষ্ণ তরল যখন ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরবে আমার মধ্যে থাকা কহিনুরের প্রকাশ ঘটবে।ঠিক তখনই কহিনুর সারাজীবনের জন্য আমার সঙ্গ ছাড়বে । তাই এতো ছলাকলা আর অভিনয়। আপনার দাদু আপনার বিয়ে দিয়ে আমার থেকে আপনাকে চিরকালের জন্য দূরে রাখতে চেয়েছেন। আমি আপনার সঙ্গে থাকলেই উনার যত ভয়।

বুঝতে পারছেন এবার? আপনি সঙ্গে থাকলে আমার কিছু হবে না। আমার মধ্যে থাকা শক্তি অদৃশ্য ক্ষমতা বলে মানুষের হৃপিণ্ডে নাম লিখতে পারে। আমার নামের ধারণক্ষমতা কারো নেই শুধুমাত্র আপনি ছাড়া। আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীতে আপনার ক্ষতি করবে এমন কেউ নেই। এই জন্যই আমি আপনাকে নিয়ে খুব একটা চিন্তা করিনা। সাময়িক আঘাত পাবেন কিন্তু প্রাণঘাতী হবে না। যদি হতো এতোদিন খান সাহেব ঠিকই প্রাণ নিয়ে নিতো। শত্রুকে বাঁচিয়ে রাখতো না। ওর ক্ষমতাই নেই আমার নাম যেখানে খোদাই করা সেখানে খ/ঞ্জর চালাবে। এমন খঞ্জর তৈরীর সাহস ও করো হবে না।

পাথর কহিনুরের কথাগুলো শুনে ওকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো। নির্জন রাত আকাশে মেঘ জমেছে। মাঝেমাঝে বজ্রপাত হচ্ছে। খানিকটা পরেই হয়তো ফিসফিস করে বৃষ্টি নামবে। সাঈদ কক্ষে নেই। কাচের জানালা ভেদ করে আলো ভেতরে প্রবেশ করছে। পর্দা নড়ছে। কহিনুর সেদিকে চেয়ে আছে। একটানা কথা বলে কেমন গলা শুকিয়ে আসছে।

পাথর ওর কাধে মুখ রেখে গভীর চিন্তাই মগ্ন। ভেতর থেকে অস্থির হয়ে উঠছে। ওরা ক্ষমতার জন্য মেয়েটার কোনো ক্ষতি না করে দেয়। কি করবে মাথায় আসছে না। এই মেয়েটা কথাও শুনেনা। যেখা যাবে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ওকে কক্ষে রেখে নিজে মাতব্বরি করতে চলে যাবে। কথাগুলো ভেবে ওর মাথা খারাপ হচ্ছে। উত্তেজনা দমিয়ে রাখতে না পেরে বলে উঠলো,

নূর তুমি আমাকে না বলে কখনও কোথাও আর যেতে পারবে না। ওরা জানিনা কতটা শক্তি নিয়ে অপেক্ষায় আছে। চিন্তা হচ্ছে কিছুতেই মন শান্ত হচ্ছে না।
কিছু হবে না। শত্রুর মোকাবেলা করতে সামনে যাওয়াটা জরুরি। পালিয়ে থাকলে বিপদ বাড়বে। যাইহোক অনেক কথা হয়েছে এখন ঘুমান।
ঘুম আসছে না। তুমি ঘুমাও আমি জেগে আছি।

কহিনুর বাধ্য হলো শুয়ে পড়তে। ভেবেছিলো বাইরে যাবে কিন্তু হলোনা। সাঈদ জঙ্গলের দিকে আছে। ভাবতে ভাবতে ও চোখ বন্ধ করো। পাথর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কহিনুর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো ঠিক তখনই জানালায় কারো ছায়া ভেসে উঠলো। পর্দার উপরে কোনো রমণীর ছায়া দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘ কেশগুচ্ছ বাতাসে উড়ছে। এলোমেলো পোশাক ছড়িয়ে আছে।

স্লিম মেদহীন উন্মুক্ত কোমর উষ্ণতা ছড়ানোর প্রচেষ্টাই দিশেহারা। পাথরের কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। বেলকনিতে থাকা দোলনা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে দুলছে। কেউ এসেছে।কিন্তু কে? পাথর একপা দুপা করে সামনে এগিয়ে গেলো। চুপিচুপি গিয়ে ঝট করে পর্দা সরিয়ে থমকে গেলো সেখানে কেউ নেই। দোলনা স্থিরভাবে ঝুলছে। মনের ভুল নাকি চোখের ভুল কে জানে । কথাটা ভেবে পাথর বলকনিতে গিয়ে দাড়ালো আশেপাশে তাঁকিয়ে এক জায়গায় গিয়ে দৃষ্টি থমকে গেলো। দূরে সেই মেয়েটার অবয়ব দেখা যাচ্ছে।

মাঝে আঝে বজ্রপাতের সঙ্গে আলোর ঝলকানিতে চারদিক আলোকিত করে তুলছে। মেয়েটা পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ধনগ্ন অশালীন পোশাক দেখেই পাথর চোখ ফিরিয়ে নিলো। মেয়েটা কে হতে পারে নানারকম চিন্তা করতে করতেই খলখল হাসির শব্দে কান ভরে উঠলো। পাথর বিরক্ত হলো। অনাকাঙ্খিতভাবে শরীরে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। ভেতরে থাকা পশু লাফিয়ে যেকোনো সময় বরিয়ে আসবে। পাথর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। কিন্তু হচ্ছে না। শেষমেশ বেলকনি থেকে সামনের দিকে লাফিয়ে পড়লো। মেয়েটার কাছাকাছি আসতেই হাসির শব্দ থেমে গেলো। পাথর মৃদু কণ্ঠে জিঞ্জাসা করলো,

কে তুমি? কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছো?
পাথরের আওয়াজ শুনে মেয়েটা একটু একটু করে সামনের দিকে চাইলো। পাথর কিছুটা থমকালো। ছোট ছোট নাক মুখ। বেশ মায়া মায়া চোখ। মেয়েটার ওষ্ঠে রহস্যময় হাসি। পাথর পূণরায় কিছু জিঞ্জাসা করবে তার আগেই সুরেলা কণ্ঠে উচ্চারিত হলো,

কেড়ে নিতে এসেছি যা ওর ছিল সব আমার।
পাথর অবাক হয়ে বলল,
কার থেকে কি কেড়ে নিবে? তোমার পরিচয় বলো নয়তো কিন্তু ভীষণ খারাপ হবে বলে দিলাম।
মেয়েটা হাসলো,
কি খারাপ হবে? কিচ্ছু করতে পারবেন না। বরং আমাকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি নিতে থাকুন। আপনি আর আপনার স্ত্রীর পরিবার সবটা আমার। ওকে বলে দিবেন আমি এসে গেছি সবটা কেড়ে নিয়ে ওকে নিঃসঙ্গ করে ধুলোতে লুটিয়ে দিব। আমাকে ঠকানোর জন্য সবাইকে শাস্তি দিব। কেউ ক্ষমা পাবেনা।

পাথর বিরক্ত হলো মেয়েটার এমন এলোমেলো কথা শুনে। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ কোমরে লুকিয়ে থাকা খ/ঞ্জরটা বের করে মেয়েটার দিকে খানিকটা এগিয়ে আসতেই কাছাকাছি কোথাও বজ্রপাতের আওয়াজ শোনা গেলো। তীব্র আলোতে ও চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলো যখন চোখ খুললো সেখানে কেউ নেই। রহস্যময় মেয়েটা হুট করে অদৃশ্য হয়ে গেলো। পাথর আশেপাশে খুজে পূণরায় নিজ কক্ষে ফিরে গেলো।

চুপচাপ বসে আছে দৃষ্টি মন বিশেষ ভালো নেই। আলফার সঙ্গে প্রচুর ঝগড়া হয়েছে । তর্কে জিততে না পেরে দৃষ্টি ওর চুল ধরে টেনে দিয়েছে।কয়েকটা ছিড়ে গেছে সেই জন্য জামসেদ ওকে বকেছে। ঝগড়া মারামারি বাচ্চাদের কাজ কিন্তু ওদের সেদিকে খেয়াল থাকে না। বিনিময়ে প্রচুর বকা শুনতে হলো। সেই থেকে চোখ থেকে পানি ঝরছে। আলফাও অনুতপ্ত বুঝতে পারেনি ওকে এভাবে বকবে নয়তো ও আগেই থেমে যেতো। জামসেদের মেজাজ চড়ে আছে বিয়ে নিয়ে ঝামেলার জন্য।

টেনশন হচ্ছে নতুন কোনো বিপদ হবে কিনা সেটা নিয়ে। তার মধ্যে এদের ঝগড়া ঝামেলা দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। দৃষ্টি দরজা বন্ধ করে খানিকটা সময় বসে ছিল তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকলো। হাতেমুখে পানি দিয়ে বাথটাবে নেমে পড়লো। গলা অবধি ঢুবিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। এভাবে কয়েক মূহুর্তে কেটে গেলো। হঠাৎ ওর মনে হলো পানি কেমন উষ্ণ হতে শুরু করেছে। দৃষ্টি ঝট করে চোখ খুলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। বাথটাবে পানির অস্তিত্ব নেই আছে লাল টকটকে উষ্ণ তরল। ওর চিৎকার বাইরে গেলোনা।

চার দেয়ালের মধ্যে প্রতিধ্বনি হয়ে ঘুরছে। দৃষ্টি বুদ্ধি করে নেমে পড়লো। দৌড়ে দরজা খুলতে গিয়ে আরও চমকে গেলো। যা দেখলো তাতে চিৎকার দিতে ভুলে গেলো। সারা ফ্লর জুড়ে মানুষের শরী/রের অংশ। বিভিন্ন অ/ঙ্গ প্রত/ঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। র/ক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। টেবিলের উপরে এক রমণীর ছি/ন্ন মস্তক চোখ খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। দৃষ্টি আর ভাবতে পারছে না। মাথা ঘুরে বমি চলে আসছে।

থরথর করে শরীর কাঁপছে। কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে ধপাস করে ফ্লরে পড়বে বুঝতে পারছে বাকি নেই কিন্তু পা স্থির হয়ে আটকে গেছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। গলা শুকিয়ে আসছে।এমন ভয়ংকর দৃশ্য কখনও দেখেনি। কয়েক সেকেন্ড পার হতেই কাটা/ছেড়া অংশ গুলো নড়াচড়া করতে শুরু করলো। হাতের কব্জি একটু একটু করে কখন ওর পায়ের উপরে উঠে এসেছে খেয়াল করেনাই। দৃষ্টি প্রচণ্ড আতঙ্কে পা ঝেড়ে শব্দ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।

আলফা এসেছিল ওকে বোঝানোর জন্য। কক্ষে এসেই ওয়াশরুম থেকে চিৎকারের আওয়াজ শুনে থমকে গেলো। তাড়াতাড়ি করে দরজায় আঘাত করতে থাকলো। দৃষ্টি লাফিয়ে লাফিয়ে দরজার কাছাকাছি আসতে চাইছে কিন্তু সেখানে র/ক্তের স্রোত সঙ্গে লাফালাফি করছে পায়ের আ/ঙুল। কি করবে মাথায় আসছে না। আলফা উপাই না পেয়ে ধাক্কা দিতে শুরু করলো। কয়েকবার চেষ্টার পরে দরজা খুলে গেলো। ও কোনো দিকে না দেখে দৌড়ে গিয়ে দৃষ্টিকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

ঠিক আছিস?
দৃষ্টি ফুপিয়ে যাচ্ছে। কথা বলার অবস্থায় নেই। আলফা ওর চোখের দিকে চেয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হতভম্ভ। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডর জন্য চোখ বন্ধ করে যখন খুঁলল সবটা নরমাল। চোখে পড়ার মতো কিছু নেই। আলফা কিছু একটা ভেবে ওকে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। দৃষ্টি থরথর করে কাঁপছে। আলফা ওকে শুকনো পোশাক দিয়ে বলল,
ওটা মনের ভুল ছিল। ওখানে কিছু ছিল না। সবটা নরমাল ঠিক আছে? তুই চেঞ্জ কর আমি বাইরে আছি। কিছু হবে না। আমি আছি তো কেউ আসবে না।
দৃষ্টি ওকে ছাড়তে চাইছে না। একা এক কক্ষে থাকা ওর পক্ষে আর সম্ভব না। গাউন থেকে পানি গড়িয়ে ফ্লর ভিজে যাচ্ছে তাই বাধ্য হয়ে ওকে ছেড়ে দিলো। আলফা দ্রুত দরজা বন্ধ করে ওপাশে গিয়ে বলল,

তাড়াতাড়ি কর হাতে সময় নেই। পাঁচ মিনিট কিন্তু। ভয় পাবিনা আমি এখানেই আছি। যতক্ষণ না হচ্ছে আমি কথা বলতেই আছি।
আলফা এটা ওটা বলে বকবক করছে। দৃষ্টি তড়িঘড়ি চেঞ্জ করে দরজা খুলতে গিয়ে পূণরায় থমকে গেলো। আবারও অস্বস্তিকর দমকা হাওয়া ওর শরীরে এসে লাগলো। কেমন উষ্ণ অনুভূতি সেই সঙ্গে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি তীব্রভাবে অনুভব হচ্ছে। পেছনে কেউ আছে। একটা শীতল হাত ওর কাধে এসে থামলো। দৃষ্টি চমকে উঠে পিছিয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলল,

আমি কিছু করিনি প্লিজ মেরনা আমাকে।
পুরুষালী আওয়াজে সাঈদ বলে উঠলো,
আরে আমি এসেছি। তুমি আমাকে চিনতে পারছো না?
দৃষ্টি পিটপিট করে চাইলো। বুক ঢিপঢিপ করছে। একটার পর একটা চমক লেগেই আছে। হার্টে কুলাচ্ছে না। মনে হচ্ছে বেরিয়ে আসবে। সাঈদকে দেখে কিছুটা কমলেও ওকে ভরসা হচ্ছে না। বন্ধ কক্ষে লোকটা কিভাবে এসেছে সেটাও ধোয়াসা। তাই বিড়বিড় করে বলল,

আপনি সেই লোকটা তাইনা? সত্যি আপির ফ্রেন্ড নাকি সবটা আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা? সত্যি বলুন নয়তো বাইরে ভাইয়া আছে কিন্তু।
সাঈদ হেসে ফেলল দৃষ্টির হুমকি শুনে। মেয়েটা সত্যি ভয় পেয়েছে। আরেকটু আগে আসলে এমন পরিস্থিতি হতোনা। রাগ হচ্ছে নিজের উপরে। ঠিকঠাক কাজটা করতে আপলো না। কহিনুর কতবার বলেছে দৃষ্টির খেয়াল রাখতে কিন্তু পারলোনা। সাঈদ সোজাসুজি গিয়ে দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। পকেটে থেকে একটা লাল রঙের তাবিজসহ সুতা বের করে বলল,

বিশ্বাস করুন বা অবিশ্বাস কিছু যায় আসেনা। আপাতত এটা নিজের সঙ্গে রাখবেন। আজকের বিষয়টা খানিকটা চেপে যাবেন বাড়িতে বলবেন না। আমি আছি ভয় পাবেন না।
সাঈদের কথা শুনে দৃষ্টি ভ্রু কুচকে ফেলল। কাউকে বলবেনা বললেই হবে নাকি। তাই কপট রাগ দেখিয়ে তেড়ে গিয়ে উত্তর দিলো,

এই আপনার মতলব কি বলুন তো? আপনি কি চাইছেন আমি মা/রা গেলে আপনি তখন বাঁচাতে আসবেন? আরেকটু হলে প্রাণ পাখি উড়ে যেত আর এখন আসছেন তাবিজ নিয়ে। ওটা আপনি নিজের গলাতে ঝুলিয়ে রাখুন।
সাঈদ মুখটা কাচুমাচু করে ফেলল। কিছুক্ষণ পূর্বেও যে মেয়ে ভয়ে চুপসে ছিল এখন তার ভয়েজ শুনে হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। এই জন্যই মেয়েদের থেকে মন বোঝা সহজ না। মরে যাচ্ছে কিন্তু তেজ দেখো। সাঈদ ওকে আর ঘাটালো না। নিজের মতো ওর হাতটা টেনে নিয়ে বলল,

ম্যাম এটা আমার দায়িত্ব ছিল। নূর আমাকে আপনার দায়িত্ব দিয়েছেন জানি খানিকটা লেট করেছি কিন্তু প্রমিজ এমনটা আর হবে না। এটা আনতে গিয়েছিলাম। আমি বুঝতে পারিনি ও এখুনি আপনার উপরে আক্রমণ করবে। তাছাড়া ও আপনাকে মারতে চাইছে না প্রথমে ভয় দেখিয়ে ঘাবড়ে দিতে চেয়েছে। এটা ও পেরেছে তবে খুব বেশিও না। প্লিজ অনুরোধটা রাখুন।

দৃষ্টি উত্তর দিলো না। চুপচাপ দেখছে সাঈদের কারবার। ছেলেটা মনোযোগ দিয়ে ওর হাতের কব্জিতে তাবিজ বাঁধছে শুরু করেছে। হঠাৎ খুট করে দরজা খুলে গেলো।আর দুজনেই চমকে উঠলো। মূহুর্ত্তের মধ্যে আলফা গটগট করে ভেতরে এসে দৃষ্টিকে নিজের সঙ্গে আগলে নিলো। লেট হচ্ছে দেখে ওর ভয় হয়েছিলো। মেয়েটার জন্য চিন্তা হয়। আলফা দৃষ্টির কক্ষে অচেনা ছেলেটাকে দেখে পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিলো। হালকা কালো রঙের পাঞ্জাবী পরা চিকন লিকলিকে ছেলেটাকে দেখতে আহামরি সুদর্শন না লাগলেও খারাপ লাগছে না। সাদা ফর্সা তকে কালো রঙটা বেশ ফুটে আছে। আলফা একবার নিজের বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকা দৃষ্টির দিকে চেয়ে আবারও সাঈদকে দেখে নিলো। কপালে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে ধমক দিয়ে বলল,

কে আপনি? ওর কক্ষে কি জন্য এসেছেন? কিসের তাবিজ দিচ্ছেন ওকে? ওই আপনার উদ্দেশ্য কি? অপেক্ষা করুন দেখছি আপনাকে।
আলফা একের পর একটা প্রশ্ন করে সাঈদকে অতিষ্ঠ করে তুলল। সাঈদ নির্বাক,আগেই ভেবে নিয়েছে এমনিই হবে। যেমন ভাই তেমনি বোন। সবগুলো এক না হলে মজা কিসের। সাঈদের জীবন আছে আর প্যারা নেই সেতো অবিশ্বাস্য। এরা একাই একশো। কথাগুলো ভেবে ও মনিমনে কণ্ঠে বলল,

প্লিজ ভুল বুঝবেন না। নূর আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনি ওর থেকে জেনে নিবেন। আপাতত আমার কাজটা শেষ করতে দিন।
বললেই হবে নাকি? প্রমাণ কি?
সাঈদ করুন দৃষ্টিতে চাইলো। দৃষ্টি ঝটপট নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উত্তর দিলো,
ওকে চিনি আমি। এর আগে বাঁচিয়েছিলো একটা দুষ্ট লোকের থেকে। দেখতে হ্যাঙলা কিন্তু কাজের আছে।
সাঈদ মুখটা দেখার মতো হলো। এদের কাজও করতে হচ্ছে আবার হ্যাঙলা উপাধিও নিতে হচ্ছে। জীবন বেদনাতে ভরপুর। সাঈদ আর অপেক্ষা করলোনা। পূণরায় তাবিজটা ওর হাতে বেঁধে দিয়ে বলল,

আপনার জন্যও আছে। অনুমতি দিলে এটাও বাঁধতে পারি। দিচ্ছেন অনুমতি?
আলফা দাম্ভিকতা দেখিয়ে পুরুষালী আওয়াজ তুলে বলল,
ওসব পিশাচ ভুত প্রেত দেখে আমি ভয় করি না। সুলতান আলফা ফারুকী এতোটা ভীতু না। এটা বরং আপনার হতে বেধে নিন কাজে আসবে।
সাঈদ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। এদের বোঝাবে কে? সুলতান টাইটেল নিয়ে এই পরিবারের লোকদের দম্ভের শেষ নেই। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

আপনি সাহসী কিন্তু যখন ঘুমিয়ে থাকবেন বা ড্রাইভ করবেন তখন তো নিজের খেয়াল রাখতে পারবেন না। তাছাড়া এটা নূর হুকুম দিয়েছে। আশাকরি বোনের অর্ডার শুনবেন?
আলফা এবার দ্বিধা ছাড়াই হাত বাড়িয়ে দিলো। সাঈদ চুপচাপ ওটা পরিয়ে দিয়ে বলল,
আমি আসছি। সাবধানে থাকবেন। আর অনুরোধ প্লিজ এটা সঙ্গে রাখবেন। সময়টা খারাপ যাচ্ছে কিন্তু ভরসা রাখুন নূর সবটা ঠিক করে দিবে।
সাঈদ বলতে বলতে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আলফা চমকে উঠলো। অদ্ভুত অদ্ভুত কাহিনি ঘটতেই আছে। মায়ের সঙ্গে আলাপ করবে বলে দৃষ্টিকে বলল,

এই ভুতটাকে তুই আগে থেকে চিনিস?
একবার দেখেছি কিন্তু ও যে ভুত এটাতো জানতাম না। ও আরেকটা ভুতের থেকে আমাকে উদ্ধার করেছিলো। ভাইয়া সত্যি ভুত আছে? ভুত কি ভাইয়া?
আলফা উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা। ওর বোঝা হয়ে গেছে সাঈদ জ্বীন ছিলো। রাগ দেখিয়ে ভুত বলেছে। ও আর অপেক্ষা করলোনা। দৃষ্টির হাত ধরে টানতে টানতে মায়ের কক্ষে গিয়ে হাজির হলো। অধরা বিছানা বই নিয়ে বসে ছিল ওদেরকে দেখে হাসি মুখেই বলল,

কি ব্যাপার দুজনে এক সঙ্গে? কোনো আবদার?
আলফা মায়ের পাশে গিয়ে কাঁধে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। খানিকটা ঝাপটে ধরে বলল,
কোনো আবদার ছাড়া আসতে পারিনা? তুমি জানো আজ কি কি হয়েছে?
কি হয়েছে?
আলফা সবটা বলে দিলো। অধরা চমকে উঠেছে। পিশাচগুলো বাড়ির বড়দের ছেড়ে বাচ্চাদের পেছনে পড়েছে। অধরা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

ভয় নেই কিছু হবে না। তোমরা দুজনেই আজ থেকে আমার সঙ্গে থাকবে। কোনোরকম ভুল করবে না। বাইরে যাওয়া বন্ধ। আমি কথা বলছি যদি কোনো নিরাপদ জায়গা পাওয়া যায় তোমাদের সেখানে পাঠিয়ে দিব।
আলফা মানতে নারাজ। দৃষ্টি চুপচাপ আছে। ভয়ে ওর শরীর এখনো ঠান্ডা হয়ে আছে। বাড়ি ছাড়তে হবে ভেবে আলফা বলল,

তাবিজ নিয়ে লাভটা হলো কি তবে? বোন সামলে নিবে দেখে নিও। চিন্তা করোনা। আমি একা থাকতে পারবো। তুমি বরং ওটাকে নিয়ে ভাবো।
দৃষ্টি অসহায় চোখে থাকালো। ভয় বেশি বলে কটাক্ষ করা হচ্ছে তাই গাল ফুলিয়ে রাখলো। অধরা বুঝতে পেরে ওর মাথায় হাত রেখে উত্তর দিলো,
আমার মেয়েটা যখন বড় হবে তখন আর ভয় থাকবে না। অযথা ওকে বিরক্ত করোনা। চলো খাবার দিব।
আলফা মাথা নাড়লো। দৃষ্টি কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। অধরা বুঝেছে তাই ওকে নিজের সঙ্গে নিয়ে বের হলো।

অফিসের একটা মিটিংয়ে জুবায়ের শহরের খানিকটা দূরে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল। কাজ শেষ করতে করতে অনেকটা সময় লাগলো। রাত আটটার উপরে বাজতে চলেছে। জুবায়ের মিটিংয়ে উপস্থিত সকলের জন্য খাবার অর্ডার দিয়ে নিজে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। অধরার রান্না ছাড়া বাইরের খাবার ওর ঠিকঠাক হজম হয়না। বহুকাল থেকে অধরা ওকে বাইরে খেতে দেয়না তার একটা বিশেষ কারণ ছিল।

জুবায়ের বিষয়টা নিয়ে খুবই সিরিয়াস। আলো ঝলমলে রাস্তা। অসংখ্য গাড়ি যাতায়াত করছে। কর্মব্যস্ত নগরী,এখানে দামি গাড়ি আর উচ্চতর বাড়ির সমাহার। জুবায়ের আপন মনে ড্রাইভ করছে হঠাৎ কোনো বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ওর কানে ভেসে উঠলো। জুবায়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা আনমনা হয়ে গেলো। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। কান্নার আওয়াজ যেনো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কিভাবে সম্ভব এটা? হয় বাচ্চাটা গাড়িতে আছে নয়তো বাচ্চাটা গাড়ির সঙ্গে ছুটে চলছে। জুবায়ের ঠিকঠাক বুঝে গেলো কেউ ওকে আবারও ট্রাপে ফেলতে চাইছে। ও এক হাতে ফোন নিয়ে অধরাকে কল দিলো। রিসিভ হতেই জুবায়ের উত্তেজিত হয়ে বলল,

অধরা শুনতে পাচ্ছো কোনো আওয়াজ?
ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ হচ্ছে না। অধরা ফোন রিসিভ করে চুপচাপ শুনছে। জুবায়ের অধৈর্য হয়ে পড়লো। পূণরায় সেই একই কথা জিঞ্জাসা করতেই কেমন অদ্ভুত কণ্ঠ ভেসে আসলো,
সুলতান জুবায়ের ফারুকীর ভয় করছে বুঝি? বিশ্বাস করুন আপনি ভয় পাচ্ছেন আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩১

কথাটা বলেই মহিলা অট্টহাসিতে মেতে উঠলো। জুবায়ের যা বোঝার বুঝে নিলো। এই বিপদ থেকে উদ্ধার কিভাবে পাবে মাথায় আসছে না। প্রশ্ন জাগলো এই বাচ্চা আর ওই মহিলাটা কে হতে পারে? কোথা থেকে এসেছে ওরা?

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩৩