কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩৩

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩৩
লাবণ্য ইয়াসমিন

বিপদের সময় মানুষ ভুল করে মস্তিষ্ক কাজ করে না। জুবায়েরের অবস্থাও সেম। একদিকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজে কান ভারি হচ্ছে অন্যদিকে ফোনের দিকে চেয়ে থমকে গেলো। অধরার নাম্বারে কল না করে অচেনা নাম্বারে কল করে এগুলো অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শুনতে হলো। জুবায়ের পূণরায় যখন সঠিক নাম্বারে কল দিল তখন নাম্বার বন্ধ দেখালো। মেজাজ চরম খারাপ হচ্ছে বাঁচার রাস্তা বন্ধ প্রায়।

জুবায়ের মনে মনে আল্লাহর নাম নিচ্ছে। মনে থেকে খারাপ কিছু ঘটার ইঙ্গিত দিচ্ছে।বারবার অনূভব হচ্ছে কঠিন কোনো বিপদ হতে যাচ্ছে। তার মধ্যে আরেক ঝামেলা এসে জুটেছে। গাড়ি থামছে না ওর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। একের পর এক অন্যান্য গাড়ি ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। বারবার ওকে ধাক্কা দিতে গিয়েও দিচ্ছে না বেঁচে যাচ্ছে। অন্য কোনো শক্তি অদৃশ্য থেকে ওকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জুবায়ের আল্লাহকে স্মরণ করে মাঝেমাঝে দোয়া কলমা পড়ছে তবে অতিরিক্ত টেনশনে সেটা সঠিক হচ্ছে না। এবার বুদ্ধি করে ফোনের ডাউনলোড অপশনে গিয়ে কয়েকটা সূরা ডাউনলোড করে প্লে করে দিলো। একের পর এক কোরআন তেলোওয়াত শুরু হলো। সেই সঙ্গে হঠাৎ গাড়ির গতি স্বাভাবিক হয়ে গেলো। কান্নার আওয়াজ বন্ধ হয়ে সবটা নরমাল। আপাতত এখন আগের মতো স্বাভাবিক।

জুবায়ের হাফ ছেড়ে বাঁচলো তবে তেলোওয়াত বন্ধ করলো না। শহরের বাইরের দিকে চলে এসেছে দেখে আবারও গাড়ি ঘুরিয়ে রাজধানীর দিকে এগিয়ে চললো। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজোড়া চোখ অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো। শিকার পেয়েও হাতছাড়া হয়ে গেছে ভেবে রাগে শরীর জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটাকে আঘাত করে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

জুবায়ের আর অপেক্ষা করলোনা। একবারে সুলতান ভিলার সামনে এসে বুকে হাত রেখে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বাঁচলো। একটুর জন্য বেঁচে ফিরেছে। কেউ গভীর ষড়যন্ত্র করছে ভেবেই ভয় লাগছে। মানুষের সঙ্গে শত্রুরা করে জেতা যায় কিন্তু অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে কিভাবে জিতবে? জুবায়ের যখন গাড়ি থেকে নামছিলো ঠিক সেই সময়ে ওর পাশ থেকে একজন বলে উঠলো,

স্যার আপনাকে কিছু বলার ছিল।
জুবায়ের পাশে তাকিয়ে হতভম্ভ হলো। সাঈদ বসে আছে নির্বাক ভঙ্গিতে। চোখে মুখে কোনো ভয় ভীতি বা অনুতাপ নেই। জুবায়েরের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। কৌতূহল নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বলল,

সাঈদ তুমি এখানে? কিছুক্ষণ পূর্বে যেটা হলো তুমি দেখেছো? আর ওটা কি ছিল?
সাঈদ মাথা নিচু করে ফেলল। হাত বাড়িয়ে একটা তাবিজ বের করে বলল,
দুঃখিত আমি তখন আপনার পাশে ছিলাম না। আসতে লেট করেছি। ক্ষমা করবেন কিন্তু এর পর থেকে এমন ঘটনা আর ঘটবে না। এটা আপনার জন্য।
সাঈদ তাবিজটা জুবায়েরের হাতে বেঁধে দিয়ে আরেকটা সঙ্গে দিয়ে পূণরায় বলল,

এটা মালকিনের জন্য। ওটা কে ছিল সেটা এখন বলতে পারছি না। চিন্তা করবেন না ও আর আপনার বিরক্ত করতে পারবে না। তবে এইটুকু জেনে রাখুন আপনার একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ও এমন ক্ষেপেছে। তবে আপনার সিদ্ধান্ত আমার কাছে ভুল ছিল না। নিজেকে দোষী ভাববেন না। আপনি উচিত কাজটাই করেছেন। আমাকে যেতে হবে। তাবিজটা সঙ্গে রাখবেন।
কথাটা বলে সাঈদ গাড়ি থেকে নেমে গেলো।

জুবায়ের ওর পিছু পিছু নামলো কিন্তু ওকে আর পেলোনা। পাবেনা এটা ওর জানা ছিলো। সাঈদের সম্পর্কে ওর ভালো ধারণা আছে। তাই আর খোঁজ করলোনা। ভেতরে প্রবেশ করলো। মাহিম রিজুয়ান নিখোঁজ খবরটা পেয়ে বিয়ের কার্যক্রম খানিকটা থেমে ছিলো কিন্তু রিজু ফোন করে জানিয়েছে ওর এক ছেলে নিখোঁজ তাঁতে কি আরেক ছেলে আছে। ওর সঙ্গেই বিয়ে হবে তারপর থেকে আবারও কাজ চলছে। বাড়িটা পূণরায় রঙ করানো হচ্ছে। নীল আকাশের নিচে সাদা রঙের রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িটা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

দেখেই চোখ জুড়িয়ে আসছে। জুবায়ের দ্রুত নিজের কক্ষে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। শাওয়ার নিয়ে যখন বের হলো অধরাকে ওয়াশরুমের বাইরে দাঁড়ানো অবস্থায় পেলো। চোখে মুখে বিস্ময়। জুবায়ের সাধারণত বাইরে থেকে ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে অধরাকে বিরক্ত করে কিন্তু আজকে লোকটা সোজাসুজি ওয়াশরুমে এটা ওর কাছে অন্যরকম লাগছে। জুবায়েরকে পেয়েই ও প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,

আপনি ঠিক আছেন? কিছু হয়েছে?
জুবায়ের মিষ্টি করে হেসে টাওয়েলটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিছানার দিকে টেনে নিয়ে গেলো। অধরাকে বসিয়ে নিজেও ওর সামনে বসে পড়লো। অধরা ওর চুলে টাওয়েল রেখে আবারও প্রশ্ন করলো,
কিছু জিঞ্জাসা করেছি উত্তর দিন। কেমন অস্থির লাগছিলো। কতবার ফোন করেছি নাম্বার বন্ধ। টেনশনে আমার অবস্থা খারাপ আর আপনি রহস্য করে মিটিমিটি হাসছেন? বলবেন কি হয়েছে?
জুবায়ের এবারও চুপচাপ। পাশে রাখা তাবিজটা নিয়ে অধরার বাম হাতে বাঁধতে বাঁধতে এবার মুখ খু /ললো

তোমার মনে আছে সেই বাচ্চাটার কথা? যাকে আমরা একটা অনাথাশ্রমে রেখে এসেছিলাম। ওখানে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সেখানে ও নেই। কেউ দত্তক নিভে এমন কথাও ছিল না।
অধরার চোখেমুখে আতঙ্ক খেলা করছে। চোখ ছোট হয়ে আসছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। তবুও ঢোক গিলে বলল,

ওকে খুঁজে পেয়েছেন? কোথায় ও?
জুবায়ের কাজ শেষ করে অধরার হাতটা নিজের হাতের মুষ্টিমেয় করে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। অধরার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,

পাইনি তবে আমার মনে হচ্ছে ও ফিরে এসেছে। আমাকে নিজের দোষী ভাবছে। কিন্তু তখন আমার কি করার ছিল বলো? আমার আদরের বোনটার এমন পরিণতি আমি মানতে পারছিলাম না। ওই পিশাচগুলো ওর সঙ্গে এমনটা করবে আমি কখনও কল্পনাও করিনি। জাহান্নামের কিট আমার ফুলের মতো বোনটার জীবনটাকে নরকে পরিণত করলো কিছু করতে পারিনি। কত হাহাকার নিয়ে বোনটা আমার পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলো। ভেবেই দুঃখে আমার মরে যেতে মন চাই। এমন অপদার্থ ভাই আমি।

জুবায়ের ফুপিয়ে উঠলো। ছেলেদের চোখে পানি সত্যি শোভা পায়না। অধরা ব্যস্ত হয়ে উঠলো। স্বামীর অসহায়ত্ব ওকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। তাই মাথায় হাত রেখে ধরা গলাই বলল,
অহেতুক নিজেকে দোষারোপ করছেন। ওর নিয়তিতে যা লেখা ছিল তাই হয়েছে। বাচ্চাটাকেতো আমরা কাছে রাখতেই চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন ও কে ছিলো? ওর পরিচয় আপনার অজানা না। সবটা বিবেচনা করেই ওকে দূরে রেখে এসেছি কিন্তু কে জানতো ওই পিশাচগুলো বেঁচে ছিলো। এখন সেসব কথা বাদ দিন না।

জুবায়ের কথা শুনলো না। বহুকাল পরে বোনের কথা মনে পড়ছে। মারিয়াকে ও নিজের কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলো ।খুব আদরের ছিল মেয়েটা। বড়দের অনাদর কখনও জুবায়ের ওকে অনুভব করতে দেয়নি। পুতুলের মতো কাছে রেখে ভালো খারাপ বুঝতে শিখিয়েছিলো।

শেষ অবধি কাছে রাখতে পারলোনা। হুটহাট রেগে যাওয়ার স্বভাব ওর ছোট থেকে তবে কখনও ভুলেও বোনকে আঘাতের চিন্তা মাথাতে আসেনি। সেই বোনটার এমন পরিণতি ওকে খুব করে যন্ত্রণা দেয়। জুবায়ের রাস্তায় ঘটে যাওয়া ঘটনা অধরার থেকে লুকিয়ে গেলো অহেতুক চিন্তা করবে ভেবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জোবায়ের স্বাভাবিক হয়েগেলো। চোখে রাজ্যের ঘুম এসে জমা হয়েছে। কয়েক মূহুর্ত্তের মধ্যেই ও গভীর ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো।

কফি হাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে আলফা। দুদিন ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া হয়নি। বন্ধুদের থেকে নোট নিয়ে রেখেছে সেটা একবার হলেও দেখতে হবে। আগামী বছর দেশের বাইরে যাওয়ার চিন্তা আছে। দৃষ্টিকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।মেয়েটাকে একা ছাড়তে কিছুতেই মন সাড়া দিচ্ছে না। ভেবেছে যেখানে যাবে সঙ্গে নিবে আবার পরিবারের কথা ভেবে সবটা কেমন ফেকাশে হয়ে যাচ্ছে।ভাইয়েরা বুঝি এমনিই হয়।

সঙ্গে থাকলে সারাদিন ঝগড়া মারামারি খুনসুটি লেগেই থাকে অথচ হৃদয়ের কোনে সুপ্ত ভালোবাসা অতি গোপনে পাহাড় সমান জমা হয়ে থাকে। যেটার হদিস পাওয়া কঠিন। আলফা কথাগুলো ভেবে কফির কাপে ওষ্ঠ ভিজিয়ে দূরে দৃষ্টি রাখলো। সুলতান ভিলা কখনও অন্ধকার হয়না। বাড়ির পেছনের দিকে ওদের টেনিস কোর্ডের পাশে কয়েকটা চেয়ার আর একটা ছোট ট্রি টেবিল রাখা আছে। অদ্ভুত কারণে বারবার আলফার দৃষ্টি সেখানে গিয়েই পতিত হচ্ছে।

কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে যখন ও কফিতে চোখ বুলিয়ে পূণরায় সেদিকে তাকালো থমকে গেলো। এলোমেলো চুলে এক মানবি সেখানে বসে আছে। মুখ খানিকটা নিচু করে রেখেছে তাই অবয়ব ঠিক চেনা যাচ্ছে না। মেয়েটার দীর্ঘ সোনালী কেশ গুচ্ছ মাটিতে ছুঁয়ে যাচ্ছে। শরীরে সাদা রঙের শুভ্র পোশাক। আলফার মেয়েদের পোশাক সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই তবে দৃষ্টির সঙ্গে শপিং করে কিছুটা শিখেছে। তবে এই মেয়ের পোশাক সম্পর্কে ও অবগত না। আলফা কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলোনা। প্রায় ছুটে বেরিয়ে আসলো। করিডোর ধরে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলো বাগানের রাস্তায়। মেয়েটা এখনো ঠাই বসে আছে। আলফা এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে মেয়েটার পাশে গিয়ে হাপাতে হাপাতে বলল,

কে আপনি? ভেতরে কিভাবে আসলেন পরিচয় দিন। বাইরে সিকিউরিটি নেই?
মেয়েটা প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে চাইলো। আলফা কয়েক সেকেন্ড সেদিকে চেয়ে দিশেহারা হলো। নির্জন নিশীতে রূপের পসরা সাজিয়ে মায়াবীনী দুঃখ বিলাসে মেতেছে। ছোট ছোট চোখ নাম মুখ আল চেহারায় পিচ্চি পিচ্চি ভাব। আলফা চোখ নামিয়ে নিলো। কাউকে এভাবে মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়না। তাছাড়া মেয়েটার পরিচয় ওর জানা নেই। ভুত প্রেত পিশাচের উনরে ক্রাশ খেয়ে ভুল করার মতো ছেলে ও না। আলফা প্রশ্ন করে নিজেই বোকা হয়ে গেলো। উত্তর না পেয়ে ভাবলো সিকিউরিটি কে ডাকবে সেই উদ্দেশ্যে যখন ও পা তুলবে ঠিক তখনই রিনরিনে নারী কণ্ঠে উচ্চারিত হলো,

থামুন ওদিকে যাবেন না।
আলফা ফিরে আসলো। ইশারা করলো প্রশ্নের উত্তর দিতে। মেয়েটা কুঠিলো হেসে হাত বাড়িয়ে বলল,
মায়াবী মোহ, আমার নাম আপনি মোহ বলেই ডাকবেন আমি খুশি হবো। আমি পাশের বিল্ডিং এর চতুর্থ ফ্লোরে থাকি। প্রায় আপনাকে কফি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে আসার লোভ সামলাতে পারিনি। প্লিজ ভুল বুঝবেন না।
মেয়েটার লজ্জা মিশ্রিত মুখের দিকে চেয়ে আলফা হাসলো। মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি ঘুরছে সেটা কাজে লাগিয়ে তাবিজ বাঁধা হাতটা মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

হাই আমি সুলতান আলফা ফারুকী, সুলতান জুবায়ের ফারুকীর একমাত্র পুত্র।
মেয়েটা ওর হাতের দিকে চেয়ে থতমত খেয়ে গেলো। মনে হচ্ছে ভয় পাচ্ছে। আলফা ওকে আরও খানিকটা ভড়কে দিতে খপ করে মেয়েটার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো আর মূহুর্তে শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠলো। মেয়েটার চিৎকারে কান ভারি হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ আগে দেখা ফর্সা গালদুটো রক্তিম আকার ধারণ করেছে। হাত কাড়াকাড়ি চলছে। মেয়েটা এবার কর্কশকণ্ঠে চিৎকার করে বলল,

নিজের ভালো চাইলে ছেড়ে দাও আমার হাত নয়তো তোমাকে হ\ত্যা করতে আমার সময় লাগবে না। তাবিজ নিয়েছো বাঁচার জন্য। পারলে ওটা খুলে ফেলো। কাপুরুষতা দেখিয়ে আমার সঙ্গে লড়তে এসেছো।
আলফা মৃদু হেসে উত্তর দিলো,

সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে পিশাচের সঙ্গে প্রেমগাথা রচনা করার মোটেই আমার সখ নেই। তাবিজ খুঁলে বীরত্ব করবো তেমন জনবল নেই। একটা মধুর সুর শুনবে? আচ্ছা থাক আমি নিজেই বলছি।
আলফা তেলোওয়াত করতে শুরু করলো। হাতের মুঠোয় বন্ধি মেয়েটার শক্তি কমে আসছে। হয়তো অচেতন হয়ে যাবে ঠিক সেই মূহুর্তে অন্যদিক থেকে কেউ একজন আলফাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আলফা পড়তে গিয়েও পড়লোনা। লক্ষ করলো ওর ঠিক পেছনে দৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার চোখে মুখে আতঙ্ক খেলা করছে। এখানে ঘটে যাওয়া সবটাই ও দেখেছে ভেবে আলফার রাগ হলো। ধমক দিয়ে বলল,

মাতব্বরি করে বাইরে কেনো এসেছো তুমি? থাপ্পড় দিব বেয়াদব মেয়ে?
দৃষ্টি ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে উঠলো। এই একটা আহ্লাদী হয়েছে। বকাবকি করলে দূরে গিয়ে কাঁদবে তানা কাছে এসেই যত আহ্লাদ দেখানো লাগবে। আলফা মহা বিরক্ত এর উপরে কিন্তু কিছু করার নেই। শেষমেশ ওর মাথায় হাত রেখে বলল,

রাতে বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলাম না? বাচ্চাদের মতো আচরণ করে আমাকে বিরক্ত কেন করিস? ওরা তোর ক্ষতি করতে পারতো তখন কি হতো?
দৃষ্টি নাক টেনে উত্তর দিলো,
বেলকনি থেকে তোমাকে দেখেই এখানে এসেছি। কিন্তু মেয়েটাকে পুরোপুরি দেখতে পাইনি। ও কে ছিল ভাইয়া?
আলফা উত্তর দিতে পারলোনা। কে ছিল সেটা ওর অজানা। মেয়েটার হাতের ছোঁয়া এখনো কেমন জীবন্ত হয়ে আছে। আলফা আনমনে বলল,

কক্ষে চল ঘুমাতে হবে। আর কখনও রাতে বাইরে আসবিনা। তোর জন্য পাহারা বসাতে হবে ভাবছি। ভয়ে কাঁপুনি থামেনা অথচ তর্ক করতে উস্তাদ।
আলফার তাচ্ছিল্যপূর্ণ বাক্যে দৃষ্টি আহত হলো। গাল ফুলিয়ে সামনের দিকে হাটা ধরলো। আলফা দৌড়ে গেলো ওর দিকে। ছোট থেকে এক সঙ্গে বড় হওয়ার দরুন দুজনের মধ্যে বেশ ভাব তবে ক্ষণেক্ষণে ঝগড়া তর্কাতর্কি লেগেই থাকে।

এই নিয়ে জামসেদের আফসোসের শেষ নেই। মেয়েটাকে আদর দিয়ে বাদর তৈরী করেছে ভেবে হাই হুতাশ করে। আলফার ত্রুটি ওর চোখে পড়েনা। ভাইয়ের ছেলের প্রতি এহেন ভালোবাসা দেখে দৃষ্টি শোকাহত। তবে জুবায়ের বরাবর মেয়েদের পক্ষে। দৃষ্টির প্রতি ওর আলাদা নজর আছে। কহিনুরকে হারিয়ে দিশেহারা অবস্থার মধ্যে দৃষ্টিকে পেয়েছিলো। তবে দুজনেই এই বাড়ির প্রাণ।

ওয়াশিম খানের তৈরী অট্টালিকার নির্জন কক্ষে বসে আছে পাথর। মাথায় নানারকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। অরিত্রীর বডি এখানে রাখা আছে সেটাই নষ্ট করতে এখানে আসা। বডি না থাকলে কেউ ওকে ব্যবহার করতে পারবে না। সাধারণত অর্ধমানবদের শারীরিক মৃ/ত্যু ঘটলেও আত্মার মৃ/ত্যু হয়না। মেয়েটার বডি ব্যবহার করে কহিনুরের ক্ষতি করতে চাওয়া পিশাচের এমন কুটিল পরিকল্পনা পাথর কখনও সফল হতে দিবে না।

দাদুর কাছে ভালো হতে গিয়ে কতগুলো মিথ্যা বলতে হয়েছে। এছাড়া কিছু করার ছিল না। পাথর কিছুক্ষণ ভেবে বেরিয়ে আসলো। পাশের কক্ষে তুমুল ঝগড়া চলছে আঁধার আর ঐশ্বর্যের মধ্যে। পাথর সেদিকে উঁকি দিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিলো। আঁধার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে কিন্তু রাতের একটা প্রহরে ও নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। নানা রকম কুকর্মে জড়িয়ে পড়ে। সেটা নিয়ে ঐশ্বর্যের সঙ্গে বিবাদের সৃষ্টি হয়।

তাছাড়া কহিনুরের ছুরিকাঘাতে বেচারার দফারফা অবস্থা। পাথর ওর কথা ভেবে দ্রুতগতিতে দাদুর গোপন কক্ষে গিয়ে হাজির হলো। দরজা বন্ধ করে মায়াবী ঝর্ণার দিকে গেলো। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট দরজা। এখানে কেউ প্রবেশ করলে পাহাড়ের দরজা খুঁলে যায় আর পাগলা অর্ধমানবেরা বেরিয়ে আসে। ওদের মধ্যে মায়া মমতা নেই বেললেই চলে। পাথর ডান দিকে চেয়ে একটা নতুন বক্স পেলো।

চুপিচুপি সেখানে গিয়ে দরজা খুঁলে কিছুটা পিছিয়ে আসলো। অরিত্রীর লা*শ এখানে রাখা আছে কিন্তু ওর চোখ খোলা ওষ্ঠে হাঁসির রেখা।এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। শরীরের কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই যেমন ছিল তেমনই আছে। এই লাশের দাফন করা উচিত ভেবেও ও অন্যচিন্তা করলো। পকেট থেকে কয়েকটা মোমবাতি বক্সের উপরে রেখে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। মূহুর্তে আগুন লেগে সবটা দাওদাও করে জ্বলে গেলো। পাঁচে যাওয়া লাশ হতে ভয়ানক গন্ধে আসছে বমি আসার লক্ষণ। পাথর নিজের কাজটা করে বেরিয়ে আসলো। আরও একটা কাজ অবশিষ্ট আছে সেটা করতে হবে ভেবে দাদুর কক্ষে প্রবেশ করলো। ওয়াশিম খান পায়ের উপরে পা রেখে ফোনের দিকে চেয়ে আছে।পাথর সোজাসুজি উনার সামনে গিয়ে পুরুষালী কণ্ঠে বলে উঠলো

আমার বিয়ে নিয়ে আপনার অনেক চিন্তা তাইনা? যদি অনুমতি দেন তবে আমার চেনাশোনা একটা ভালো মেয়ে আছে।
পাথরের কথা শুনে দাদু খানিকটা চমকে গেলেন কিন্তু পরক্ষণে বললো,
তুমি সত্যি বিয়ে করবে? যদি পূণরায় বিয়ে করতে রাজি থাকো তবে যেকোনো মেয়েকে মানতে আমি প্রস্তুত। নাম ধাম পরিবারের অবস্থান ওসব নিয়ে চিন্তা করোনা। তুমি শুধু বিয়েটা অন্তত করো।

ঠিক বলছেন তো? পরে কিন্তু কথার খেলাপ করলে চলবে না।
একদম না। তুমি সময় নষ্ট করছো কেনো? নিয়ে এসো সেই মেয়েকে আমার সম্মুখে। নিশ্চয়ই দেখতে ভীষণ সুন্দরী হবে?
পাথর মাথা নাড়িয়ে বক্র হাসলো। লোকটা এতোটাই বোকা নাকি বোকার অভিনয় করে? সবটা কেমন উল্টোদিকে ধাবিত হচ্ছে। পাথর ওখান থেকে ফিরে আসলো।

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩২

খান ভিলার পেছনের দিকে নেমে থতমত খেলো। অরিত্রীর অগ্নিদগ্ধ শরীর সেখানে পড়ে আছে। লা/শ একা এখানে এসেছে নাকি আনা হয়ছে কোনটা? পাথর দ্রুতগতিতে বডি চেক করে শান্ত হলো। লাশ ক্ষত সৃষ্টি করে ফেলেছে। কোনো পিশাচ ক্ষতপূর্ণ শরীরে প্রবেশ করে না। তফসিল মেহেরুন এবার কার শরীর দখল করবে?

কহিনুর তৃতীয় খণ্ড পর্ব ৩৪