প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৯

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৯
ইলমা বেহরোজ

নিঝুমের কি করা উচিৎ?কেমন মেজাজ দেখানো উচিৎ? বুঝে উঠতে পারছেনা।নিশা নিঝুমের শার্ট খামচে ধরে কেঁদেই চলেছে।নিঝুম কেনো জানি বার বার তিতলির দিকে তাকাচ্ছে।নিঝুমের সাথে তাল মিলিয়ে তিতলিও বার বার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।পরিবারের প্রত্যেকটি মেম্বার হতভম্ব।নিঝুম নিশার অকস্মাৎ আগমনে অসন্তুষ্ট!সে নিশাকে বুক থেকে সরাতে চাইলে নিশা আরো শক্ত করে আটকে ধরছে!নিঝুম থমথমে গলায় বললো,

— “নিশা তুমি?”
নিশা কান্নারত কণ্ঠে থেমে থেমে বললো,
— “নিঝুম,আই লাভ ইউ।আই লাভ ইউ সো মাচ! আমি তোমাকে ছাড়া ভালো নেই।আমাকে ক্ষমা করো।আমি ভুল করেছি।প্লীজ!”
নিঝুমের শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম।তিতলির দিকে তাকায়।তিতলি চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়।নিশা কেঁদেই চলেছে।অনেক মানুষ তাকিয়ে আছে।ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু। সবাই মজা নিচ্ছে।নিঝুম নিশাকে থামাতে নিশার মাথায় এক হাত রেখে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “শান্ত হও নিশু!মানুষ দেখছে।”
নিঝুমের মুখে নিজের ডাকনাম শুনে নিশা যেনো স্বস্তি পায়।কান্না থামিয়ে মুখ তুলে নিঝুমের চোখে তাকায়।তারপর হুট করে চুমো বসিয়ে দেয় তাঁর গালে।নিঝুম বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল।
তিতলি এই দৃশ্য একদমই সহ্য করতে পারেনি।আওয়াজ করে ডুকরে উঠে।মৌনতা তাকাতেই নিজেকে সামলে নেয়।এরপর মুখে ওড়নার আঁচল চেপে ধরে কান্না আটকানোর জন্য।বুকে হচ্ছে তীব্র যন্ত্রনার রক্তকরণ!তিতলি নিঝুমের দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে জল বিসর্জন দিতে থাকে।নিঝুম যদি তখন একবার তাকাতো দেখতে পেতো তাঁকে ভালবেসে একটা মানুষ প্রেমের অগ্নিশিখায় কেমন করে পুড়ছে!দেখতে পেতো তীব্র কস্টের অশ্রু!কিন্তু নিঝুম আর তাকালো না।তবে,নির্জন তাকায়।দেখতে পায় তিতলিকে কান্নারত অবস্থায়।নির্জনের বুকে চিনচিন ব্যাথা হয়।
নিশা শুরু থেকে বেশরম মেয়ে।মিসেস আঞ্জুমান ভ্রু-কুঁচকে ফেলেন!এগিয়ে আসেন নিশার দিকে।কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলেন,

— “এই মেয়ে কেনো এসেছো?কি চাও আর?”‘
নিশা নিঝুমকে ছেড়ে মিসেস আঞ্জুমানের দু’হাত মুঠোয় নিয়ে কেঁদে বললো,
— “প্লীজ আন্টি,আমাকে মাফ করে দেন।প্লীজ আন্টি।”
মিসেস আঞ্জুমান এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে নেন।বলেন,
— “পাব্লিক প্লেসে ড্রামা শুরু না করলে তোমার হতোনা?”
নিশা চারিদিকটা দেখে বললো,
— “সরি আন্টি।”
মিসেস আঞ্জুমান সবাইকে বলেন বাসায় ফিরতে।নিঝুম বলে,
— “তোমরা যাও!আমি একটু পর আসছি।”
আঞ্জুমান ছেলের দিকে চোখ গরম করে তাকান।বলেন,
— “কই যাবি?”
— “আসছি যাও।”
— “এই মেয়েকে আমি আর কখনো মানবোনা এইটুকু মনে রাখিস।”
কথা শেষ করে তিনি হনহনিয়ে হেঁটে জায়গা ত্যাগ করেন।আস্তে আস্তে সবাই এগোতে থাকে।কিন্তু, তিতলির পা যেনো চলছে না।কোনোমতে অবশ হয়ে যাওয়া শরীরটাকে নিয়ে দ্রুত জায়গা ত্যাগ করে।একবারো নিঝুমের দিকে ফিরে তাকায় না।

রেস্টুরেন্টে সামনা-সামনি তাঁরা দুজন বসে আছে!নিঝুম গুম মেরে মাথা নত করে আছে।নিশা আগে মুখ খুলে,
— “সরি!”
নিঝুম গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— “কেনো?”
— “জানো না?”
— “না!”
— “এদিকে তাকাও না!”
নিঝুম না তাকিয়েই বললো,
— “হুট করে আমার কথা কেনো মনে হলো? দু’বছর চার মাস আগে ঠেলে দূরে ফেলে এখন….”
নিঝুমের কথার মাঝে বাধা দিয়ে নিশা বললো,
— “প্লীজ!সরি আমি।আমি অনুতপ্ত।”
নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।বললো,
— “কি চাও?”
নিশার সহজ স্বীকারোক্তি,
— “তোমাকে!”
— “রিলেশনসিপ কন্টিনিউ করতে চাও? পরে আবার অন্য ছেলের হাত ধরে আমেরিকা যেতে চাও?আমাকে তুচ্ছ করে তাই তো?”

কথা বলার সময় নিঝুমের কপালের রগ দপদপ করে উঠে।নিশা নিঝুমের দু’হাত মুঠো করে ধরে।কোমল কন্ঠে বললো,
— “আমার ভুল হয়েছে।মানুষ বার বার একই ভুল করেনা নিঝুম।আমিও এমন ভুল করবনা।আরেকটা সুযোগ দাও না?”
নিশার স্পর্শ নিঝুমের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।আস্তে করে নিজের হাত সরিয়ে নেয়।তারপর রসহীন কণ্ঠে বললো,
— ” তাঁর কি হলো? যার জন্য আমার কান্না দেখেও তোমার মায়া হয়নি।চলে গিয়েছিলে!”
নিশা কপট রাগ নিয়ে বলে,
— “ওই খবিশের বাচ্চার কথা আর বইলো না।খবিশের বাচ্চারে ভালো ছেলে ভাবছিলাম।কিন্তু আমি ভুল।ও একটা লম্পট!”
নিঝুম তাচ্ছিল্য হাসলো।নিশা আবার বলে,

— “আমেরিকা যাওয়ার কয়দিন পরই বুঝতে পারি আমি একটা লম্পটের সাথে বাস করছি।দ্রুত ওরে আমি ছেড়ে দেই।এ’কদিন একা থেকেছি একটা ডিপার্টমেন্টে!একাকীত্ব আমাকে বুঝিয়েছে তোমার অভাব, তোমাকে কতটা ভালবাসি নিঝুম।”
নিঝুম নিশাকে বুঝতে নিশার চোখের দিকে তাকায়।কিন্তু, নিশার চোখ কথা বলেনা।তিতলির চোখের মতোন।নিশার চোখে গভীরতা নেই। তিতলির মতো।নিঝুম চোখ নামিয়ে নেয়।শান্তভাবে বললো,
— “যদি বলি,আমি তোমাকে আর ভালবাসিনা।তোমাকে আর নিজের জীবনে ফিরাতে চাইনা?”
নিশা আঁতকে উঠে।আর্তনাদ করে বলে,

— “মরেই যাবো তাহলে।”
নিঝুম গ্লাসে পানি ঢালে।এরপর ঢকঢক করে পান করে।শুকিয়ে যাওয়া গলাটা একটু যেন ভিজে উঠে।
নিশা প্রশ্ন করে,
— “কি হয়েছে নিঝুম?”
— “কিছুনা।”
নিশা নিঝুমকে পরখ করে নিয়ে বলে,
— “তোমাকে অচেনা,অচেনা লাগছে খুব।”
নিঝুম চোখ অস্থির রেখেই জবাব দেয়,
— “অনেকদিন পর দেখেছো,তাই হয়তো!
— “ভালবাসি!”
নিঝুম নিশ্চুপ। নিশা আকুল হয়ে প্রশ্ন করে,
— “ভালো বাসোনা আমায়?”
— “দেখো নিশা,আম্মু তোমাকে মেনে নিবেনা।আম্মু জীবনে প্রথম তোমার কাছে এতো অপমানিত হয়েছিল।উনি সেটা ভুলবেন না।”
নিশা দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নামাখা কণ্ঠে বলে,

— “এসব আর বলোনা।আমি অনুতপ্ত তার জন্য।”
নিঝুম নিশ্চুপ।নিশা প্রশ্ন করে,
— ” এই,এই নিঝুম আমাকে এক্সেপ্ট করবেনা?”
নিশা অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে নিঝুমের মুখপানে। উত্তর জানার জন্য।নিঝুম দু’হাতের উপর ভর করে মাথা নিচু করে ভাবে,তিতলি কাকে ভালবাসে?কে সেই ভাগ্যবান?বয়ফ্রেন্ডের কথা যখন বলে,কি সুখী মনে হয় তিতলিকে।খুব বেশি কি ভালবাসে? মনে তো হয় খুব বেশি বাসে।যার জন্য হুটহাট উদাসীন হয়ে পড়ে তাকে অবশ্যই কম ভালবাসবে না।
— “নিঝুম?”
নিশার ডাকে নিঝুম মাথা তুলে তাকায়।চোখে জল চিকচিক করছে।নিশা দেখেও পাত্তা দেয়নি।সে নিজেকে নিঝুমের সামনে উপস্থাপনা করতে ব্যস্ত!
— “নিঝুম দেখো আমি আর ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরিনা,ভ্রু প্লাক করিনা,চুলে কালার করিনা,চোখে লেন্স পরিনা,সব ন্যাচারাল।যেমনটা তুমি চাইতে!পাঁচ বছরের প্রেমে বার বার যা কিছু চাইতে আমার কাছে তার সব কিছু দিয়ে নিজেকে সাজিয়েছি।মানিয়ে নিয়েছি।শুধু তোমার জন্য!শুধু তোমার ভালবাসা পেতে!প্লীজ আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না।”
নিঝুম নিশার দিকে ভালোভাবে তাকায়।আলগা কণ্ঠে বলে,

— “হুম দেখতে পাচ্ছি।”
— “এতো উদাসীন কেমনে হলে নিঝুম?”
— “কই উদাসীন?”
— “কখন থেকে দেখছি উদাস হয়ে আছো!আমার উপর মনটা নেই।”
— “কীভাবে থাকবে মন?যেভাবে অপমান করে ছুঁড়ে ফেলেছিলে!”
নিঝুমের শীতল গলা।ঠোঁটে বাঁকা হাসি।নিশা ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদতে থাকে।বলে,
— “আই এম সরি কলিজা।আর হবেনা এমন!প্লীজ আবার আগের মতো করে নাও সব।আমি আমার সব ভুল শুধরে নিবো।”
নিঝুম উদাসীন ভাবেই জবাব দেয়,
— “আচ্ছা।”
নিশা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে।নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
— “সত্যি!সব আগের মতো হবে?থ্যাংকিউ,থ্যাংকিউ সো মাচ। ”
নিঝুমও তাল মিলিয়ে হাসে।তবে,হাসিটা ভেতর থেকে আসেনি।ইদানিং কেমন খালি খালি লাগে বুকটা!বিশেষ করে,চা-বাগান থেকে ফেরার পর থেকে!এইযে নিশা জড়িয়ে ধরেছে কোনো রকম অনুভূতি হচ্ছে না।মনে হচ্ছে ভেতরে প্রাণ নেই।নিস্তেজ মনে হচ্ছে নিজেকে।বার বার মনে হচ্ছে, তিতলি কোনো এক ভাগ্যবানকে ভালবাসে।কিন্তু এই ভাবনাটা কেনো তাঁর মাথায় ঘুর ঘুর করে খোঁচাচ্ছে তা নিঝুম জানে না।বুকে যে এক নাম না জানা যন্ত্রনার বাস শুরু হয়েছে।তা তাড়াবে কে?কেউ কি নেই?

সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে নিঝুম।তাঁর অপেক্ষায় দু’তলার পুরোটা জুড়ে পায়চারি করে তিতলি।অবশেষে যখন আসে উপর থেকে তিতলি বড় বড় চোখ জোড়া মেলে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে থাকে।নিঝুমকে দেখে প্রাণহীন মনে হচ্ছে।নিঝুম ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে ধপ করে।তিতলি সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। তিতলি নিঝুমের কাছে পৌঁছানোর আগে নিঝুমের বড় ফুফি নিঝুমের কাছে এসে প্রশ্ন করেন,
— “মেয়েটার সাথে কই ছিলি নিঝুম?ওই মেয়েটার সাথেই তো তোর বিয়ে ঠিক হইছিলো?পরে অন্য পোলার হাত ধরে বিদেশ গেলো তাই না?”
নিঝুম ক্লান্ত গলায় ছোট করে বললো,
— “হুম।”
বড় ফুফি নিঝুমের সামনের সোফায় বসে।ঠোঁট বাঁকিয়ে কণ্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বললেন,
— “কি বজ্জাত মেয়েরে বাপ!কোন পোলার লগে পালাইয়া এখন আবার তোর ঘাড়ে পড়তে চাইছে।দুশ্চরিতা মেয়ে এগুলারেই বলে।”
নিঝুম ভ্রু-জোড়া কুঁচকে আপন মনে কিছু একটা ভাবছে।তিব্বিয়া বলেন,

— “এই নস্টা মাইয়ারে আর জায়গা দিস না নিঝুম।তোর কপাল ছাই করতে আসছে এই মাইয়া।”
নিঝুম এবার বিরক্ত হয়।সে শত্রুকে নিয়েও নিন্দা পছন্দ করেনা।আর তাঁর এই বড় ফুফিকে ভীষণ অপছন্দ করে সে।সবসময় খুঁচিয়ে কথা বলবে।যত রকম নোংরা কথা আছে সব উনার মুখে।তিব্বিয়া আবার বলেন,
— “নিশার বাপ আলাউদ্দিন না?মেয়র যে।বাপ যেমন অসৎ,মাইয়াও তেমন হইছে।লম্পটের ঘরে লম্পট মাইয়া।'”
নিঝুমের বুক ভারী হয়ে আছে খুব।একা একা লাগছে।নিশার আগমনে তার খুশির হওয়ার কথা ছিলো।অথচ,রাগ হচ্ছে প্রচন্ড।কারো উপর রাগটা মিটাতে পারলে শান্তি লাগতো।আবার ফুফি কি প্যাচাল শুরু করেছে।ফুফিকে জব্দ করার মতো কথা খুঁজতে থাকে নিঝুম।পেয়েও যায়।রাগ নিয়ে বলে,
— “ফুফি নিশা ইজ মাই গার্লফ্রেন্ড!আমরা একজন আরেকজনকে ভালবাসি।আমাদের পাঁচ বছরের প্রেম ছিলো।আপনার কি মনে হয় দু’বছরের ব্যবধানে ভুলে যাবো সব?আর আমি নিশাকে এক্সেপ্ট করে নিয়েছি!নেক্সট টাইম এসব কথা বলবেননা দয়া করে।”

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৮

আক্রোশে চাপা গলায় বললো নিঝুম।তারপর দপ দপ করে পায়ে আওয়াজ করে সিঁড়ির কাছে এসে থমকে যায়।তিতলি!তিতলি কি শুনেছে রাগের কথা?শুনলেও বা কি?নিঝুমকে উঠতে দেখে তিতলি চট করে ঘুরে দাঁড়ায়।নিঝুম তিতলিকে কিছু একটা বলতে গিয়েও,থেমে যায়।দ্রুত জায়গা ত্যাগ করে নিজ রুমে চলে আসে।তিতলি রুমে এসে দরজা বন্ধ করে,বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।ক্ষীণ আশা জেগেছিলো মনে!কিন্তু একটু আগে নিঝুম কি বললো? সে ভালবাসে নিশাকে!নিঝুমের অকপট স্বীকারোক্তি তিতলির হৃদয়ে যে তুফান নিয়ে এসেছে, তা কি নিঝুম জানবে কোনোদিন? জানবে না।কখনো সে জানাবে না।কবর দিবে সে অনুভূতিকে।কঠিন কবর।তিতলি কান্নার আওয়াজ কমাতে বালিশে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে। কিন্তু কান্নার বেগ বেড়েই চলেছে।বালিশের এক কোণা কামড়ে ধরে সে কেঁদেই চলেছে তো, কেঁদেই চলেছে।থামার কোনো লক্ষন নেই!মনের আকাশে বজ্রপাত হচ্ছে সেই সাথে ঝড়।

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২০