প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৮

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৮
ইলমা বেহরোজ

ড্রয়িংরুম জুড়ে ব্ল্যাক লেদার সোফা।সেখানেই সবাই বসেছে।কিছুক্ষণের মধ্যে রোহিকে নিয়ে আসা হয়।পুরো নাম রোহিতা শিকদার।তিতলি রোহিকে দেখার জন্য ঘুরে তাকায়।রোহি গোলাপি কাতান শাড়ি পরেছে।চুলে কালার করা আর স্ট্রেইট।কিছু চুল কপালে ছড়ানো।ভারী মিষ্টি দেখতে।লম্বায় ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি হবে।রোহিকে তিতলির পাশে বসানো হয়।রোহির ঠোঁটে হাসি লেগে আছে!
নিঝুম আর নির্জন পাশাপাশি বসে।নির্জন যেন হুট করেই লজ্জা পাচ্ছে খুব।লাল হয়ে যাচ্ছে মেয়েদের মতোন।নিঝুম হেসে নির্জনকে গুঁতো দেয়।তারপর ফিসফিসিয়ে বললো,

— “কি রে? দেখ তোর হবু বউকে।এমন মাথা নামিয়ে রাখছিস কেন?”
নির্জন ঠোঁট টিপে হাসি আটকাচ্ছে।লজ্জায় ফিক করে হেসে দিবে,এমন যা তা অবস্থা নির্জনের।জুহি সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,
— “নির্জন ভাই এমন ভাবে মাথা নত করে রাখছে মনে হচ্ছে তো তাঁকে দেখতে আসছে সবাই।”
জুহির কথা শুনে সবাই হাসিতে মেতে উঠে।নির্জন আরো লাল হয়ে যায়।আঞ্জুমান বলেন,
— “বিয়ের জন্য লাফাইছিস।এখন এমন সং ধরছস কেন?নিঝুম আব্বা তুমি তিতলির পাশে এসে বসো।রোহি আম্মারে নির্জনের পাশে বসাও।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘তিতলির পাশে বসো’ কথাটি দু’টো নর-নারীর কানে যেতেই দুজনের হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠে।দুজন দুজনের দিকে তাকায়!নিঝুমের চোখে তিতলির কান্নামাখা লাল চোখ জোড়া স্পষ্ট হয়।লালচে দু’টি চোখ।তিতলি কি কেঁদেছে? কেনো কেঁদেছে? ওইভাবে কথা বলাতে কি কেঁদেছে? নিঝুম তিতলির পাশে এসে বসতেই তিতলি চেপে বসে।নিঝুম মনে মনে শতবার সরি বলছে তিতলিকে।অথচ ইগোর জন্য পারছেনা মুখ ফুটে বলতে।ইগো দূরত্ব বাড়াচ্ছে। তিতলির হুট করে যেন কি হয়,নিঝুমের পাশ থেকে উঠে যায়।মৌনতার মাথার কাছে দাঁড়ায়।নিঝুম থমকায়,আহত হয়,কষ্টও পায়।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে ভেবে নেয়,একা পেলে সরি বলে দেবো।

বিয়ের কথা পাকা হয়।রোহির ভাই বিশ দিন পর কানাডা চলে যাবে।তাই পনেরো দিন পরেই বিয়ের তারিখ পড়ে।আঞ্জুমান আজই এনগেজমেন্ট শেষ করবেন ভেবেই এসেছেন।তাই আংটি পরানো পর্বও শেষ করা হয়।খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শুরু হবে কিছুক্ষণ পর।সবাই যার যার মতো আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।রোহি সবার আড়ালে নির্জনকে টেনে নিজের রুমে নিয়ে যায়।
তিতলির বুকটা ভার হয়ে আছে খুব।ছাদে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।একটা আট বছরী বাচ্চা ছেলে ছোটাছুটি করছিল।তিতলি ডাকে,

— “এই,এই বাবু শুনো?”
ছেলেটি এগিয়ে আসে।তিতলি ইতস্তত করে বলে,
— ” ছাদের সিঁড়িটা কোন দিকে বলতে পারবে?”
ছেলেটি তিতলির আঙ্গুলে ধরে ছাদের সিঁড়ি অব্দি নিয়ে আসে।তিতলি ধন্যবাদ দেওয়ার পূর্বেই ছেলেটি ছুটে চলে যায়।তিতলি ছাদে চলে আসে।পিছু পিছু আরেকজন আসে ছাদে।তিতলি খেয়াল করেনি।
তিতলি ছাদের রেলিং ধরে কয়েকবার প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়।পাশে এসে দাঁড়ায় নিঝুম।নিঝুমকে দেখে তিতলি অবাক হয়।কিন্তু তা প্রকাশ করলো না।চোখ সরিয়ে নেয়।নিঝুম,তিতলি দুজনই দূর আকাশে অনেক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে।নিঝুম তিতলির দিকে ফিরে দেখে,তিতলি অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।সে হঠাৎ হাত দিয়ে তুড়ি বাজিয়ে তিতলির মনোযোগ আনে।তিতলি তাকাতেই অপরাধী কণ্ঠে বলে,

— “সরি তিতলি।”
তিতলি চমকায়,অবাক হয়।তাঁর হৃদপিন্ডের গতি বাড়লো!সে অন্যদিকে ফিরে নিজের হাতে নিজে চিমটি দেয়।না ঠিকই শুনছে!স্বপ্ন,কল্পনা,ভাবনা কিছু নয়,সব বাস্তব।তিতলি টলমল মন নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।নিঝুম আবার মাথা নত করে অপরাধী হয়ে বললো,
— “সরি,তুমি বাচ্চা মেয়ে!তোমাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলা উচিৎ ছিল।ওভাবে বলা ঠিক হয় নি।”
তিতলি ফিক করে হেসে উঠে খুশিতে।নিঝুম কপাল কুঁচকে তাকায়।সে বুঝে উঠতে পারলোনা হাসির কারণ। বললো,
— “হাসছো যে?”
— “এমনি।”
তিতলি দু’হাতে মুখ চেপে ধরে আবার ফিক করে হাসে।নিঝুম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে নাকি?নিঝুম ইনোসেন্ট মুখ করে বললো,

— “এমনভাবে হাসছো মনে হচ্ছে অদৃশ্য কেউ কাতুকুতু দিচ্ছে।”
বলেই নিঝুম হাসলো।তিতলি কয়েক মুহূর্ত নিঝুমের হাসি দেখে।এই হাসিই তো তাঁর উপর বান মেরেছে!নিঝুম হাসি থামিয়ে বললো,
— “চোখ থেকে বর্ষাকাল সরিয়ে দাও।”
তিতলি হাসে।তাঁরচিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো,
— “আপনার সাথে যতক্ষন থাকি গ্রীষ্ম-বর্ষা সব ঋতুকে বসন্তকাল, বসন্তকাল মনে হয়!হৃদয়ে কুহু কুহু করে ডাকে কোকিল!আর মনের বাগানটায় ফুটে নানা রংবেরঙের ফুল।আপনি আমার কি যেন!”
কিন্তু তিতলি মুখ ফুটে বলতে পারলোনা।অনেকসময় অনেক কিছু বলা যায় না।যারা বলতে পারে তারাই তো সুখী!তিতলি নিঝুমের দিকে তাকিয়ে চওড়া হাসি দিয়ে বিগলিত হয়ে বললো,

— “জানেন,আমি যাকে ভালবাসি সে আমার কাছে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ পুরুষ।”
কথাটি শুনে নিজের অজান্তেই কোনো কারণে নিঝুমের হৃদপিণ্ডে তীব্র ব্যাথাতুর ছিদ্র হয়।নির্বিকার গলায় বললো,
— “ভালোই তো।”
নিঝুম অনুভব করে তাঁর মস্তিষ্ক ঠান্ডা নেই,রাগ হচ্ছে খুব।তিতলিকে অনেকগুলো কথা শোনাতে ইচ্ছে হচ্ছে।

অপেক্ষায় কেটে যায় সপ্তাহখানেকেরও বেশি দিন।নিঝুমের হাতে চলে আসে কয়টা অপারেশনের দায়িত্ব। সকাল থেকে রাত অব্দি মেডিকেল থাকে।তিতলি সারাদিন অপেক্ষা করে।নিঝুম যখন বাড়িতে ঢুকে তখন এক পলক দেখতে পায়।আগের মতো নিঝুমের রুমে যেতে পারেনা।বাড়ি ভর্তি মানুষ।ওরা কি ভাববে!নিঝুমকে মিস করতে গিয়ে অনেকবার লুকিয়ে কেঁদেছে।অবশেষে, যখন আর পাঁচ দিন বাকি বিয়ের।তখন নিঝুম ছুটি নেয় দশ দিনের।সবচেয়ে খুশি তিতলি হয়।খুশির ধাক্কায় আল্লাহকে শুকরিয়া জানিয়ে দু’রাকাত নফল নামায পড়েও নেয়!সেদিন দুপুর তিনটা কি চারটা হবে।বাড়ির সবাই একসাথে শপিং করতে আসে।তিতলির শাড়ি নিঝুমের পছন্দে কেনা হয়।তিতলির প্রতি নিঝুমের এতো আকর্ষণ দেখে বাড়ির সবারই মোটামুটি ধারণা হয়ে যায়, এদের মধ্যে কিছু একটা আছে। তিব্বিয়ার মতে,ইটিশপিটিশ আছে।নিঝুম তিতলির জন্য পায়েল কিনে।কিন্তু দেওয়া হয় না।কেনো কিনে সে জানে না।শপিং শেষে যখন সবাই শপিং মল থেকে বের হবে তখন কই থেকে একটা মেয়ে দৌড়ে এসে নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে।হাউমাউ করে কান্না শুরু করে।নিঝুম আরেকটু হলে পড়ে যেতো!সবাই বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল!হা হয়ে তাকায়।

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৭

বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছে না কেউ!আর….আর তিতলির বুক পুড়ছে অসহনীয় যন্ত্রণায়।মুহূর্তে বুকের মধ্যিখানে কেউ যেন আগুন জ্বালিয়ে দিল।চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।ঠোঁট কেঁপে উঠে।কান্না আটকে মৌনতাকে জিজ্ঞাসা করলো,
— “আপু মেয়েটা কে?”
মৌনতা ফিসফিসিয়ে বললো,
— “নিশা আপু !ভাইয়ার এক্স!”
তিতলির সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে। হাসফাঁস করতে থাকে।জোরে জোরে বার কয়েক নিঃশ্বাস ফেলে।
নিঝুম তাৎক্ষণিক তিতলির দিকে তাকায়।তিতলি চোখ সরিয়ে ঢোক গিলে।তাঁর দৃষ্টি অস্থির।নিঃশ্বাস বিষাক্ত।মনে হচ্ছে,নিঃশ্বাস নেওয়ার বদলে সে বিষ টেনে নিচ্ছে নিজের ভেতর!

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৯