প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৭

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৭
ইলমা বেহরোজ

নিঝুম সদর দরজা থেকে আড়চোখে তিতলিকে দেখছে।নির্জন আর দু’বোন সোফার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।তাঁরা তৈরি।এখন শুধু বেরোবে।নির্জন নিজ হাতের নখ কামড়ে মৌনতাকে বললো,
— “কিরে আম্মু আর ফুফিরা কই?’
মৌনতা ব্যাঙ্গ করে বললো,
— “এহ!তর সইছেনা আর।আসছে, আসছে সময় হলেই আসবে।তোমার অপেক্ষা করতে কষ্ট হলে একা চলে যাও।”
নির্জন ধমকিয়ে বলে,

— “তুই সবসময় বড় ভাইয়ের সাথে ইচ্ছে করে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে চাস কেন?”
— “আমাকে কিছু জিগাও কেন?জিগাবানা।”
মৌনতা কথা শেষ করে ঠোঁট বাঁকায়।
নির্জন তেড়ে আসে মৌনতাকে মারতে।মৌনতা দ্রুত তিতলির পিছনে চলে আসে।নির্জন,মৌনতা তিতলিকে ঘিরে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু করে।তিতলি গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকে।আর নিঝুমের চোখ তিতলির শাড়িতে।কি পাতলা একটা শাড়ি পরেছে!নূন্যতম কমনসেন্স নেই মেয়েটার।এতো মানুষের ভীরে যাবে এমন রূপে?রাগে নিঝুমের কপাল ইষৎ কুঁচকানো!মেজাজ যাচ্ছে খিঁচড়ে!
তিতলি দেখে নিঝুম চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে।সে এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাবে,কার উপর চোখ গরম করছে?কিন্তু কেউ নেই।নির্জন, মৌনতা আর সে ছাড়া।তিতলি এগিয়ে আসে নিঝুমের দিকে।তিতলিকে আসতে দেখে নিঝুম চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকায়।তিতলি পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ আওয়াজ করে কাশে।নিঝুম অন্যদিকে মুখ রেখেই গম্ভীরভাবে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “কিছু বলবে?”
তিতলি নিঝুমের ভারী কণ্ঠ শুনে কথা হারিয়ে ফেলে।
— “না তেমন কিছুনা।”
নিঝুম নিশ্চুপ!তিতলিও নিশ্চুপ।নিশ্চুপতাকে ভেঙ্গে তিতলি আমতা আমতা করে বললো,
— “আসলে বলতে চাচ্ছিলাম,আপনি কি কারো উপর রেগে আছেন? মানে,কেমন দেখাচ্ছে যেন আপনাকে।”
নিঝুম প্রবল আক্রোশ নিয়ে তিতলির চোখের দিকে তাকায়।তিতলির বুক ধ্বক করে উঠে।কি রাগী চোখ দু’টো!নিঝুম রাগতে পারে তিতলি ভাবেনি।নিঝুম চোখ সরিয়ে নেয়।তিতলি কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। ঢোক গিলে প্রশ্ন করে,
— “আমি কোনো দোষ করেছি?”
নিঝুম শান্তভাবে কঠিন করে বলে,

— “জর্জেট শাড়ি পরে বাইরে যাওয়া মেয়ে মানুষকে অন্তত আমি ভালোর তালিকায় রাখতে পারি না।”
কথা শেষ করে নিঝুম বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যায়।তিতলির চোখ থেকে টুপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।ভাবে,একটাবার অন্তত মানা করতে পারতেন।এভাবে না বলে।তিতলি ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে কাঁদতে থাকে।মোহনার ডাক শুনে চমকে উঠে।তাড়াতাড়ি করে চোখের জল মুছে।ঘুরে তাকায়।এরপর জোরপূর্বক হেসে জবাব দেয়,
— “জ্বি আপু?”
— “চলো আমরা বের হয়ে যাই।তুমি, আমি,মৌ,ভাইয়ারা,মাহফুজ ভাইয়া,আর ভাবি একটা গাড়ি দিয়ে যাবো।আর ওরা একটু পরই চলে আসবে।”
তিতলি বিপন্ন গলায় বললো,

— “আমি না যাই আপু?প্লীজ?”
মোহনা চমকে গিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো,
— “এ কি কথা!যাবেনা মানে!কেনো?”
ইতস্তত হয়ে তিতলি বললো,
— “আসলে,আপু দুইটা শাড়ি এনেছি শুধু!গতকাল একটা পরছি।আজ এটা পরেছি।কিন্তু এই শাড়িটা….!আর তো শাড়ি নেই আমার।”
মোহনা তিতলিকে খেয়াল করে দেখে।খুবই পাতলা শাড়ি।যদিও অতোটা বোঝা যাচ্ছে না শরীর।তবুও দৃষ্টিকটু।মোহনা তিতলির গালে হাত রেখে বলে,

— “এটা কোনো ব্যাপার!আমার রুমে এসো আলমারি খুলে যে শাড়ি ভালো লাগে সেটা পরবে।আসো।”
— “কিন্তু ব্লাউজ? আমিতো তোমাদের চেয়ে মোটা।”
— “তুমি মোটা না!আমরা দুবোন অতিরিক্ত চিকন।কত্ত কিউট তুমি জানো?”
তিতলি হালকা হাসলো।
— “আসো,আসো।”
তিতলিকে হাতে ধরে টেনে উপরে নিয়ে যায় মোহনা।
রুমে এসে মোহনা আলমারি খুলে কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি বের করে।সোনালি রঙের পাড়।সেই সাথে ব্লাউজ বের করে কলাপাতা রঙের।শাড়ি – ব্লাউজ তিতলির হাতে তুলে দিয়ে মোহনা বললো,
— “একমাত্র এই শাড়ির ব্লাউজটাই আমার হয়না।চিকন করাবো,করাবো করে আর করা হয়নি।পরে ফেলো দ্রুত।”
ইচ্ছে নেই তবুও সবার কথা ভেবে তিতলি শাড়ি পরে নেয়।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে মৌনতাও চলে এসেছে ততক্ষণে।মৌনতা তিতলিকে দেখেই বললো,

— “কি সুন্দর লাগছে তিতলিকে।”
মোহনা এগিয়ে আসে।চোখ থেকে কাজল নিয়ে তিতলির কানের নিচে লাগিয়ে দেয় আর বলে,
— “কারো নজর না লাগুক!”
তিতলির খোঁপা খুলে চুল ছড়িয়ে দেয় মৌনতা।চুল আছড়ে দিতে দিতে বলে,
— “এমন চুল কেউ খোঁপা করে লুকিয়ে রাখে?”
তিতলি চোখ নামিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
— “গরম লাগে তাই।”
মোহনা কাজল নিয়ে আসে।তিতলির থুতনিতে ধরে মুখটা উপরে তুলে বললো,
— “গভীর এই চোখ গুলোতে সবসময় কাজল দিবে।”
মৌনতা আক্ষেপ করে বলে,
— “আমার চেয়ে বয়সে ছোট একটা পুতুল ভাবি যদি হতো।সারাদিন সাজাতাম।”
মোহনা তিতলিকে কাজল পরিয়ে বললো,

— “নির্জন ভাইয়ার বউকে সাজাইস।”
মৌনতা চোখ-মুখ খিঁচে বলে,
— “এহ,রোহি আপু তো চিকন আর আমাদের চেয়ে লম্বা!বয়সেও বড়।কোন দিক দিয়া তোর পুতুল মনে হয়?”
মোহনা হেসে বললো,
— “আর যা ই বলিস!রোহিতা আপু খুব ভালো আর সুন্দরী।”
— “ভালো সেটা তো জানি।তবে পুতুলের মতো না।কঙ্কালের হাড্ডি।নিঝুম ভাইয়ার জন্য তিতলির মতো একটা পুতুল পেলেই হবে।এ জীবনে আর চাওয়ার কিছু নাই।”
‘এ জীবনে আর চাওয়ার কিছু নাই” লাইনটুকু মৌনতা সুর তুলে বলে।তিতলি মোহনার কথা শুনে লজ্জায় কুঁকড়ে যায়।মনে মনে ভাবে,
— “আমিও তাই চাই।তবে,আমার মতো না।আমিই হতে চাই!তাহলে এ জীবনে আমারো আর চাওয়ার কিছু থাকবে না।”
রুম থেকে বেরোবার পূর্বে মোহনা মৌনতাকে চোখ টিপে।দুজনই মৃদু হাসে।তিনজন নিচে নেমে আসে।আঞ্জুমান ক্রোধিত কণ্ঠে বলেন,

— “এতোক্ষণ লাগে সাজতে?কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।”
— “আমরা সাজিনি।তিতলিকে সাজিয়েছি।আর, মিথ্যে কথা!আমরা অনেক্ষণ ওয়েট করছি তোমাদের জন্য।তোমরা না।”
মৌনতা কলকল করে উঠে।
তিব্বিয়ার ছেলে মাহফুজের বউ তিতলির কাছে এসে হেসে অনেকটা জোরেই বললো,
— “মেয়েটা তো একদম ফুটফুটে।কে ও?”
আঞ্জুমান উত্তরে বলেন,
— “আমার ভাইয়ের মেয়ে।”
তিব্বিয়া কটু করে বললেন,
— “আঞ্জু তোমার ভাই আছে নাকি?কই জীবনেও তো দেখলামনা।সামনে আসলে খরচ হবে তাই আসেনি নাকি।”
আঞ্জুমান চোখ গরম করে তাকান।বলেন,
— “আপন ভাই কি ভাই শুধু হয়?আমার মামাতো-খালাতো ভাই থাকতে পারেনা?”
ঝগড়া বেড়ে যাওয়ার আগে আলতাফ চৌধুরী সবাইকে তাড়া দেন বের হতে।তাৎক্ষণিক তর্ক থেমে যায়।

নিঝুম, নির্জন কখন থেকে গাড়িতে বসে আছে।নিঝুম ড্রাইভিং সিটে।সে আজ গাড়ি চালাবে।নির্জন তার পাশে।দুজন খোশ-গল্পে মেতে আছে।যদিও নিঝুমের মনের মণিকোঠায় কিছু একটা খোঁচাচ্ছে।
— “আমরা এসে গেছি।”
মৌনতার গলার স্বর শুনে দু’ভাই বাইরে তাকায়।
নিঝুমের চোখ সবার আগে কলাপাতা রঙের শাড়ি পরা মেয়েটার দিকে পড়ে।।সূর্য কিরণ দিচ্ছে ঠিক তিতলির মুখ বরাবর।তিতলি চোখ খিঁচে হেঁটে আসছে।কোঁকড়া চুল চিকচিক করছে রোদে।চুলের রংটা যেন লাল।মুখে হালকা সাজ।নিঝুম মুগ্ধতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল।এতো মুগ্ধ সে কবে হয়েছিল ঠিক মনে নেই।নাকি হয়ই নি?

নির্জন তিতলিকে দেখে নিঝুমের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।নিঝুম চশমা পড়েনি।তাই নিঝুমের চোখ দু’টির মুগ্ধতা স্পষ্ট।নির্জন মৃদু হাসে।তিতলির দিকে আবার তাকায়।ভাবে,ভাই তাহলে সত্যিই প্রেমে পড়েছে!তিতলি গাড়ির কাছে আসতেই নির্জন গাড়ি থেকে নেমে পড়ে দ্রুত।নিঝুমের হুঁশ ফিরে।নির্জন জোর করে তিতলিকে নিঝুমের পাশে বসিয়ে দেয়।তিতলি,নিঝুম দুজনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।পিছনের সিটে মৌনতা,মোহনা,নির্জন,মাহফুজ আর তার বউ বসে।নিঝুম গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।পেছনের ওরা আড্ডায় মেতে উঠে।
মোহনা মাহফুজের বউ জুহিকে প্রশ্ন করে

— “ভাবী,আব্রাহাম আর আরতিনা কোথায়?”
জুহি বললো,
— “ওরা ওদের দাদির কাছে।পেছনের গাড়িতে।”
মৌনতা মুখ ভার করে বলে,
— “জানেন,ভাবি ছোট ফুফির ছেলের বউটাকে আমার একটু ও ভালো লাগেনা।ভালো হইছে ওরা আমাদের সাথে যাচ্ছেনা।”
পিছনের সিটের তিনটা মেয়ের মধ্যে চলতে থাকে কুটনামি।ছেলে দুজন ফোনে ব্যস্ত।সামনের সিটে বসে থাকা দু’জন মানুষ তাকিয়ে আছে দূর রাস্তায়।অথচ মন পাশের জনের কাছে।ওরা শুধু নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে।কারো মুখে কোনো কথা নেই।সেকেন্ডে সেকেন্ডে হার্ট বিট মিস করছে।যখন কারো প্রতি ভালবাসা আসে।কিন্ত মুখ ফুটে হয়না বলা।তখন,মানুষটা পাশে থাকলে বুকে চলে হাতুড়ি পেটা।চলে ধুকধুকানি।তাঁদের বেলাও তাই হচ্ছে।আগে ভালবাসতো একজন এখন দুজন দুজনকে বাসে।কিন্তু কেউ জানেনা কারো কথা।নিঝুম তো বুঝে উঠতেই পারছেনা,ওর সাথে কি হচ্ছে? তিতলির ব্যাপারে এতো নাক গলাচ্ছে কেনো?
তিতলির এতক্ষণ ধরে থম মেরে থাকা গুমোট মনে নিঝুমের কাছাকাছি এসে ভাললাগার পরশ লাগতে লাগলো।

সবাই নামার পর,তিতলি আর নিঝুম নামে।ততক্ষণে সবাই গেইটের ভেতর চলে গেছে।তিতলি শাড়ির আঁচলটা টেনে ঠিক করে।বাড়ির ভেতর যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।তখন নিঝুম ডেকে উঠে,
— “তিতলি?”
তিতলি মলিন মুখে ঘুরে দাঁড়ায়,মাথা নত করে।সে অভিমান করেছে,বড্ড কঠিন অভিমান!থমথমে গলায় নিঝুম বললো,
— “তুমি কি খুব কষ্ট পেয়েছো?”
তিতলির গলা কাঁপছে।অভিমানে কান্না গলায় এসে থেমেছে।চোখে জলের ভীর।নিঝুম আরো কাছে আসে।তিতলির থুতনিতে ধরে মুখ তুলে কোমলভাবে বললো,

— “তাকাও।”
জলে চিকচিক করা চোখে নিঝুমের পানে তাকায় তিতলি।নিঝুমের মুখটা চুপসে যায়।অপরাধী ভাব নিয়ে বললো,
— “সরি তিতলি,আমি খুব সরি।আর এভাবে বলবনা!”
তিতলি মৃদু করে হাসে।দু’হাতে জড়িয়ে ধরে নিঝুমকে।চোখ বুজে।গাড়ির হর্নের আওয়াজে তিতলি চমকে উঠে।চোখ খুলে।ঘুমিয়ে পড়েছিল সে!
স্বপ্ন দেখেছে এতক্ষণ।দিবা স্বপ্ন!সামনে তাকিয়ে দেখে একটা এক তলা সাদা বাড়ি।আর নিঝুম তাঁর পাশেই বসে আছে।তিতলি দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তবুও মন বলছে,বলতেও তো পারে।মোহনা তিতলিকে নামতে বললে তিতলি বললো,

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৬

— “তোমরা যাও, আমি আসছি।”
সবাই নেমে পড়ে।বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে।তিতলি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।কিন্তু একি!নেই নিঝুম। তিতলি গেইটের দিকে তাকায়।দেখে,নিঝুম ওদের সাথেই চলে যাচ্ছে।তিতলির খুব কান্না পায়।খুব বেশি।সে কি শুধু স্বপ্ন দেখে যাবে সারাজীবন?কিছু কি পূরণ হবার নয়? কেনো এতো ভাবে সে?যদি পূরণই না হবে!ডুকরে কান্না আসছে তাঁর।তিতলি দু’হাতে মুখ চেপে কয়েক সেকেন্ড কাঁদে।এরপর দ্রুত চোখের জল মুছে গাড়ি থেকে নামে।পিছনের সিটে তখনো নির্জন ছিল সে খেয়াল করেনি।

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৮