প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২০

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২০
ইলমা বেহরোজ

নিঝুম রুমে না ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুইমিংপুলে।মনে হচ্ছে পৃথিবীটা থেমে গেছে।নিশাকে কিছুতেই মানতে পারছে না।অথচ, সে কত অপেক্ষা করেছে নিশার ফিরে আসার।নিশা ফিরে আসাতে নিঃশ্বাস নেওয়াটাও কষ্টকর মনে হচ্ছে।নিঝুম নিজের মনের অনুভূতি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেনা।সুইমিংপুলের স্বচ্ছ পানি দেখে মনে পড়ে সেদিনের কথা, যেদিন তিতলি এই সুইমিংপুলে সাঁতার কেটেছিল নিশ্চিন্তে।আচ্ছা, নিশা কি তিতলিকে সুইমিংপুলে আসতে মানা করবে? ভাবতেই নিঝুমের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।নিজে নিজে রাগে বিড়বিড় করে,

— “না,কখনো না।এই,এই সুইমিংপুল তিতলির।”
নিজের কথা নিজের মগজে বারি খায়।নিঝুম খুব করে চমকায়।ভাবে,এই সুইমিংপুল তো আমার।তিতলির নয়।তিতলি কেনো চারিদিকে বিচরণ করছে? আচ্ছা,তিতলি কার জন্য এতো পাগল?কাকে ভালবাসে? নিঝুমের মনে হয় সে নিজের অস্তিত্ব থেকে সরে যাচ্ছে।গোলকধাঁধায় তলিয়ে যাচ্ছে।চারিদিকে শুধু প্রশ্ন!প্রশ্ন!আর প্রশ্ন!জবাব নেই।কোথাও কোনো উত্তর নেই।নিঝুম এক নিঃশ্বাসে কয়েকবার ডুব দেয়।হাঁপাতে থাকে।দ্রুত উঠে পড়ে।রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নির্জন তোয়ালে নিয়ে সামনে দাঁড়ায়।নিঝুম প্রথম অবাক হলেও পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “রুমে ছিলি?”
— “হুম।এসেছিলাম একটু।”
নিঝুম তোয়ালেটা নিয়ে মাথার চুল মুছতে থাকে।নির্জন রয়ে সয়ে প্রশ্ন করে,
— “নিশার ফিরে আসা তোকে খুশি করতে পারলো না?”
নিঝুম এক সেকেন্ডের জন্য থেমে যায়।এরপর আবার চুল মুছতে থাকে।নির্জন বলে,
— “তোর আয়না যে তাঁর কাছ থেকে নিজেকে লুকাচ্ছিস?”
নিঝুম থমকায়।নির্জনকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে পড়ে।নির্জন কয়েক মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।এরপর নিচে নেমে আসে।
নিঝুম ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে।তিতলি ডান পাশের সোফাটায় সবসময় এসে বসে।নিঝুম সোফাটার দিকে এক ধ্যাণে তাকিয়ে থাকে।কিছু ভাবে।কি ভাবে নিজেও জানে না।বার কয়েক রুমে পায়চারি করে।তিতলি ফেলুদা পড়া শুরু করেছিল।নিঝুম ফেলুদা বইটি হাতে নেয়।বইটির দিকে একধ্যাণে তাকিয়ে থাকে।আগেও পড়েছে তবুও আবার পড়ার জন্য বইটি খুলে।শুরু থেকে না পড়ে তিতলি যেখানে এসে থেমেছে সেখান থেকে পড়া শুরু করে!

কাঁদতে কাঁদতে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গিয়েছিল তিতলি।ঘুম ভাঙ্গে দরজার কড়াঘাতে।ধড়ফড় করে উঠে।ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলে।মোহনার চওড়া হাসি দেখে তিতলিও হাসে।তিতলি বুক পোড়া তীব্র দুঃখেও হাসতে কার্পণ্য করলো না।মোহনা ডান ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
— “রাত কয়টা বাজে খবর আছে?”
তিতলি হালকা গলায় জানতে চাইলো,
— “কয়টা? ”
— “১১ টা।”
তিতলি জিভ কাটে।তারপর বললো,
— “এতোটা বেজে গেছে!সবার খাওয়া তো শেষ ?”
— “না সবার শেষ না।অনেকে বাকি।চলো।”
তিতলি ইতস্ততভাবে বললো,
— “আপু,আসলে ইচ্ছে হচ্ছেনা খেতে।ক্ষুধাও নেই।”
মোহনা তিতলির হাতে ধরে বলে,
— “তা বললে তো হবেনা।আম্মু,ভাইয়ারা অপেক্ষা করছে।চলো।”
তিতলি আর না করতে পারলোনা।মোহনাকে বললো,
— “তুমি যাও।আমি আসছি।”
মোহনা হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
— “তিন মিনিটের মধ্যে আসো।”
— “আচ্ছা।”
মোহনা চলে যায়।তিতলি ওয়াশরুমে গিয়ে অনেক্ষণ মুখে পানি ঝাপটায়।কান্না ভাবটা মুখ থেকে সরাতে।চোখমুখ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।যেন সিডর গেল মাথার উপর দিয়ে।

তিতলি চেয়ারে এসে বসে।তাঁর সামনে এসে বসে নিঝুম।নিঝুম আসতেই তিতলির হৃৎপিন্ড চলাচল দ্রুত হতে থাকে।তিতলি মনে মনে নিজেকে নিজে ধমকায়,এখনো,এখনো কেনো এতো ফিলিংস তোর?কেন?শুনিস নি?মানুষটা ভালবাসে আরেকজনকে।খুব বেশি বাসে।খুব…..
নিঝুমের চোখ দুটো তিতলির মুখখানা বড্ড দেখতে চাইছে।কিন্তু কীসের আড়ষ্টতা যেনো ভর করেছে মগজে।পারছে না মাথা উঁচিয়ে সামনে বসে থাকা মেয়েটাকে দেখতে।বুকটা কেমন করছে। অশান্তিতে ভুগছে!

তিতলি আড়চোখে নিঝুমের দিকে তাকাচ্ছে নিজের অজান্তে।আটকাতে পারছে না নিজেকে।কিন্তু নিঝুম তাকাচ্ছেনা একবারও। মনেই হচ্ছেনা সে তিতলিকে চিনে।মনোযোগ সহকারে খাচ্ছে।তিতলির ঠোঁট দুটো কাঁপতে থাকে,কান্না আসছে খুব তাঁর।খুব কষ্ট হচ্ছে।
নিঝুম কেনো তাঁকেই ভালবাসলো না?যদি সে অন্য কারোরই হবে তবে তাঁর মাঝে এতো আকুলতা,এতো প্রেম,এতো আবেগ কেনো দিলো আল্লাহ?
নির্জন তিতলির দিকে তাকায়।সে আড়চোখে নিঝুম,তিতলিকে অনেক্ষণ যাবৎ দেখছে।তিতলির চোখ দুটো লাল!দেখেই মনে হচ্ছে কেঁদেছে খুব।নির্জন দ্রুত খাওয়া শেষ করে। এরপর সবাইকে শুনিয়ে বললো,

— “তিতলি,কাঁদছো নাকি?আর চোখ এতো লাল আর ফোলা কেনো?কেঁদেছো তাই না?”
নির্জনের কথা শুনে সবাই তিতলির মুখের দিকে তাকায়।তিতলি থমকায়!বিব্রতবোধ করে।নিঝুম এতক্ষণ অনেক কষ্টে গিলছিলো শুধু।তিতলি কেঁদেছে শুনে গলায় খাবার আটকে যায়।দ্রুত তিতলির ফ্যাকাসে মুখপানে চোখ নিবদ্ধ করে।
তিতলি আমতা-আমতা করে বললো,

— “ক-কই না তো!”
আঞ্জুমান তিতলিকে দেখে বলেন,
— “মিথ্যে কেন বলছিস তিতলি?তোকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে মরা কান্না কেঁদেছিস।আমি এতক্ষণ খেয়ালই করিনি!”
তিতলি বুঝে যায়, সে ধরা পড়ে গেছে।এখন আর অস্বীকার করে লাভ নেই।তাই অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে একটা মিথ্যে বলে দেয়,
— “আ-আসলে,বাবার কথা খুব মনে পড়ছিলো।”
তিতলির কথা শুনে আঞ্জুমান আবেগি হয়ে পড়েন।
— “বাবার কাছে যাবি মা?’
তিতলিকে উত্তরের সুযোগ না দিয়ে নিঝুম বলে উঠে,

— “রেডি থেকো কাল ভোরে তোমাকে নিয়ে যাবো।”
সবাই অবাক হয়ে তাকায়।নিঝুম বিব্রত বোধ করে।সে কথাটি মুখ ফসকে নিজের অজান্তেই বলেছে।তবে মনের ইচ্ছা এটা।মনের বিরুদ্ধে বলেনি।তিতলি নাকচ করার আগে আঞ্জুমান বলেন,
— “হুম আব্বা তাই যা।আমিও তাই বলতাম।কিন্তু জলদি ফিরিস দুজনেই।নির্জনের গায়ে হলুদ তিন দিন পর।”
নিঝুম চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।তারপর শান্ত স্বরে বললো,

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৯

— “ভোরে যাবো।পুরো বিকেল থেকে নাইট কোচে ফিরে আসবো।”
কথা শেষ করে সে জায়গা ত্যাগ করে।সেখানটায় নির্জন বোধহয় সবচেয়ে খুশি হয় নিঝুমের সিদ্ধান্তে!
তিতলি নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর সুযোগই পেলো না।তিতলি খাবার প্লেটে চোখ নিবদ্ধ করে ‘থ’ মেরে আছে।ও চাইছেনা আরো কিছু মুহূর্ত মানুষটার সাথে থাকতে।মায়া,ভালবাসা এতোটাই হয়ে গেছে যে,এখন এতো কষ্ট পেতে হচ্ছে।যাকে পাবে না, উল্টে মায়া বাড়বে, তার সাথে আরো কিছু মুহূর্ত থাকা বেমানান! তিতলি ভেবে নেয়,নিঝুমকে না করে দিবে।সে যাবেনা কাল!কিছুতেই যাবে না।

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২১