প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৫

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৫
ইলমা বেহরোজ

হঠাৎ গুমরে উঠলো কালো মেঘ।সঙ্গে কলার থোড়ের মতো সাদা বিদ্যুতের ঝলকানি।নির্জন এই জলবনে আটকে রাখার ফন্দি আঁটছে যেন প্রকৃতি!
নিঝুম মাঝিকে তাড়া দিয়ে বলে,
— “ফিরে চলুন।”
তেড়ছাভাবে পথ ধরে মাঝি খুব দ্রুত ফিরে আসে।আরো আগেই ফেরা হতো।তিতলি ইনিয়েবিনিয়ে অতিরিক্ত সময় জলবনে কাটিয়েছে।ওরা পাঁচ মিনিট হেঁটে একটা রেস্টুরেন্টে উঠে।ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে অনেকখানি ভিজেছে দুজন।মিনিট ত্রিশেকের মধ্যে সন্ধ্যা হবে।রেস্টুরেন্টে কোনো কেবিন নেই।খুবই সাধারণ।খোলা-মেলা।তবুও অনেক রুচিশীল মানুষেরা অমৃত পানের মতো খাবার খাচ্ছে।নিঝুম একটা টেবিল বুক করে বসে পড়ে।খাবার অর্ডার করে।নির্জনের কল আসতেই সাথে সাথে রিসিভ করে।নির্জন বললো,

— “কই আছিস?”
নিঝুম একবার তিতলির দিয়ে তাকায়।এরপর বললো,
— “রাতারগুল আছি।”
— “অনেক দূরে তো।সন্ধ্যে হচ্ছে আবার আকাশ ভালো না।থেকে যাবি?ভেজাল তো ঘন্টাখানেক আগেই শেষ হলো।”
— “থাকতে তো হবেই।কিন্তু…হোটেলে উঠতে.. ”
নিঝুমকে দ্বিধাগ্রস্থ হতে দেখা যায়।নির্জন বললো,
— “দশ মিনিট অপেক্ষা কর।”
খাবার চলে আসে।তিতলি উঠে ওয়াশরুমে যায়।হাত মুখ ধুতে।ফিরে এসে দেখে একটা মেয়ে নিঝুমের পাশে এসে সবেমাত্র দাঁড়িয়েছে।তিতলি ভ্রু’জোড়া কুঁচকে আরেকটু এগিয়ে আসে।মেয়েটির পায়ে হাই নেক কেডস,পরনে জিন্স, শার্ট।হেসে নিঝুমকে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “ডক্টর আহনাফ রাইট? ”
নিঝুম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।মেয়েটি হেসে হাত বাড়িয়ে বলে,
— ” আমি মেঘা।”
নিঝুম সৌজন্যতার খাতিরে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে বললো,
— “সরি!চিনতে পারিনি।”
মেয়েটি তিতলির চেয়ারে বসে ছেলে পটানো টাইপ হাসি হেসে বললো,
— “আপনি আমাকে চিনবেন না।তবে,আমার আব্বুকে চিনবেন বোধহয়।”
— “নাম কী?”
— “মাহবুব আলম।”
নিঝুম চিনে ফেলার মতো ভঙ্গি করে বললো,
— “আল হামরা যে বিজনেস রয়েছে মাহবুব আলম।উনার কথা বলছেন?”
মেঘা হেসে বললো,

— “ঠিক ধরেছেন।”
— “এখন কেমন আছেন উনি?”
— “খুব ভালো।সারাক্ষণ আপনার কথা জপ করে।আমরা তো ভেবেই নিয়েছিলাম আব্বু আর বাঁচবেন না।আমার দাদি তো রীতিমতো ফেরেস্তার সাথে আপনার তুলনা করেন।যদিও এটা ঠিক না।”
মেঘার হাসি দেখে তিতলির গা জ্বালা করে উঠে।দপদপ করে হেঁটে এসে মেঘাকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
— “এটা আমার সিট।উঠুন।”
মেঘা আকস্মিক এমন ব্যবহারে থতমত খেয়ে যায়।
তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়।তিতলি কপাল কুঁচকে রেখে দপ করে চেয়ারে বসে।নিঝুম পরিস্থিতি সামলাতে মেঘাকে বললো,

— “আপনি আমার পাশের চেয়ারে বসতে পারেন।”
মেঘা কিছু বলার পূর্বে তিতলি চোখ-মুখ কঠিন করে বলে,
— “এখন আমরা খাবো।আড্ডা দেব না।”
মেঘা তিতলির এহেন ব্যবহারে পুরোই নার্ভাসনেস হয়ে পড়ে।সেই সাথে অপমানিত অনুভব করে।মেঘা ডক্টর আহনাফের ছবি দেখেই প্রেমে পড়েছিল।হুট করে দেখা হওয়াতে বুঝে গেল তাঁর জায়গা বুকিং!ডক্টর আহনাফ বিবাহিত!মেঘা জোরপূর্বক হেসে নিঝুমকে বললো,
— “ডক্টর আহনাফ।আসি তাহলে।”
নিঝুম কথা বলার আগে তিতলি মুখে ঝামটা মেরে বলে,
— “হুম আসুন।”
মেঘা চলে যেতেই নিঝুম দু’হাতে মুখ ঢেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।এরপর তিতলিকে বললো,
— “এটা কেমন ব্যবহার তিতলি?”
তিতলি জবাব না দিয়ে নিজ ধ্যানে খেতে থাকে।নিঝুম আর প্রশ্ন করেনি।বিরক্তি নিয়ে খাওয়া শেষ করে।নির্জন টেক্সট পাঠায়।যে রেস্টুরেন্টে ওরা আছে নাম জানার জন্য।নিঝুম নাম সেন্ড করে।দুই মিনিট শেষে নির্জন কল করে।
— “একজন তোদের নিতে আসবে।জায়গা থেকে নড়িস না।”
— “কে?”
— “তোরা যেখানে আছিস সেখান থেকে খুব কাছেই রোহির মামার বাড়ি।বাড়িতে মামা-মামি ছাড়া কেউ নেই।হোটেলে যখন থাকতে পারবিনা বাড়িতে গিয়েই থাক।”

— “আমি কারো বাড়িতে থাকতে পারবনা।”
— “তাহলে হোটেলে উঠ।”
নিঝুম তিতলির দিকে তাকায়।তিতলিকে নিয়ে হোটেলে এক রাত কাটানো মানে তিতলির চরিত্রে সমাজের আরেকটা দাগ বসানো।নিঝুম নির্জনকে বলে,
— “আচ্ছা,বাড়িতেই।”
দশ মিনিটের মাথায় একজন ভদ্রলোক এসে নিঝুমকে বলে,
— “আপনে নিঝুম নি?”
নিঝুম হেসে বললো,
— “জ্বি।আমার কথাই বলেছে।”
— “থুকাইতে গিয়া অয়রান অই গেছি।আউক্কা।আমার লগে আউক্কা।”
তিতলি ভদ্রলোকের ভাষা শুনে নিঝুমকে বলে,
— “সিলেটি ভাষায় কথা বলছেন?”
নিঝুম ফিসফিস করে বলে,
— “হুম।রোহি ছাড়া রোহির বংশের কেউ শুদ্ধ ভাষা পারে না।”

তিতলি কিটকিট করে হেসে উঠলো।নিঝুম চোখ পাকাতেই তিতলি হাসি আটকায়।সিনএনজি দশ মিনিট পর একটা এক তলা পাকা বাড়ির সামনে এসে থামে।ভদ্রলোক আগে আগে নেমে গেইট খুলে
দেন।নিঝুম,তিতলি বাড়িতে ঢুকতেই একজন অতি সুন্দরী মধ্যবয়সী মহিলা এগিয়ে আসেন।ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হচ্ছে এনারা অতিথি পেয়ে খুব খুশি।নিঝুম-তিতলিকে একটা রুম দেখিয়ে দেওয়া হয়।ভদ্রলোক একটা শার্ট আর শাড়ি নিয়ে আসেন।নিঝুম-তিতলিকে দিয়ে বলেন,
— “কাপড় গুন্তা তো ভিজি গেছে।ঔ লউক্কা কাপড়।পাল্টাই লাউক্কা।হেছে ঠান্ডা লাগি যাইব।”
কথা শেষ করে তিনি বেরিয়ে যান।নিঝুম শার্ট চেঞ্জ করে তিতলিকে বলে,
— “উনাদের বোধহয় আমাদের সম্পর্কের কথা বলা হয়নি।আমি বলে আসছি।তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।”
নিঝুম বেরিয়ে যেতেই তিতলি শাড়ি চেঞ্জ করে নেয়।
খোঁপা খুলে চুল ছেড়ে দেয়।আলনার উপর রাখা নিঝুমের শার্ট চোখে পড়তেই মৃদু করে হাসে।শার্টটি বুকে জড়িয়ে গুনগুনিয়ে উঠে,

” কি দিয়া মন কাড়িলা ও বন্ধুরে
অন্তরে পিরিতের আগুন ধরাইলা।”
নিঝুম দরজার সামনে এসেই তিতলির কণ্ঠে দু’লাইন গান শুনে।রুমে ঢুকে তিতলির উদ্দেশ্যে বলে,
— ” বাড়ির সামনে পুকুর আছে ডুব দেও গিয়ে।আগুন নিভে যাবে।”
নিঝুমের কণ্ঠস্বর শুনে তিতলি চমকে উঠে!তার বুকে তো নিঝুমের শার্ট।পেছন থেকে চুলের জন্য বোঝা যাচ্ছে না তিতলি কিছু একটা জড়িয়ে ধরে আছে।কিন্তু ঘুরলেই দেখতে পাবে!তিতলির পা দু’টো স্থির থেকেই কাঁপাকাঁপি শুরু করে।মানুষের বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার ভয়েও বোধহয় এমন কাঁপা-কাঁপি হয় না।নিঝুম জহুরি চোখে তিতলিকে আগাগোড়া দেখে নেয়।তেমন কিছু তো চোখে পড়েনি তাহলে তাকাচ্ছেনা কেনো?কথাও বলছেনা।নিঝুম বললো,
— “স্ট্যাচু হয়ে আছো কেনো?কি সমস্যা?”

তিতলির ইচ্ছে হচ্ছে দৌড়ে বাথরুমে ডুকে যেতে।সামনে একমাত্র বাথরুমের দরজা আছে।কিন্তু পা দু’টো তব্ধা হয়ে আছে।সে জোরে নিশ্বাস ফেলে।এরপর চোখের পলকে দৌড়ে বাথরুমে ডুকে পড়ে।
নিঝুম নির্বাক!বাকরুদ্ধ!বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!অপলকভাবে বাথরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।এক মিনিট পার করে তিতলি গুটিগুটি পায়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসে।মাথা নত।নিঝুম ভারী গলায় বললো,
— “সমস্যা কি?মাথার তাঁর কি এক-দুটো ছেঁড়া আছে?”
তিতলি নিশ্চুপ।কোনো জবাব নেই।নিঝুম দ্বিতীয়বার আর প্রশ্ন করেনি।শান্তভাবে বললো,
— “পাশের রুমটা আমার।আমি রুমে যাচ্ছি।আর ভদ্রমহিলা তোমাকে যেতে বলেছেন।”
তিতলি মাথা কাত করে।নিঝুম আলনায় শার্ট খুঁজে, পায়না।তিতলিকে প্রশ্ন করে,

— “তিতলি শার্ট কই?”
তিতলি আমতাআমতা করে বলে,
— “বা…বাথরুমে রেখেছি।ধোয়ার জন্য।সারারাতে শুকিয়ে যাবে।”
নিঝুম বাথরুমে যেতে যেতে বললো,
— “আমি পারবো।”
শার্ট হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে।বেরিয়েই নিঝুম হাসতে থাকে।নিঃশব্দ হাসি।হাসির দমকে চোখের চশমা দুলে দুলে নাকের ডগায় চলে আসছে আর নিঝুম তা বার বার ঠিক করছে।তিতলির মতো মেয়ে সে দু’টো দেখেনি।কখন কি করে নিজে বুঝে না।তিতলি রুম থেকে বের হয়ে দেখে নিঝুম হাসছে।
নিঝুমকে একা একা হাসতে দেখে অবাক হয়।সাথে মুগ্ধ হয়।গালের মনকাড়া গর্ত দেখে।তিতলিও হাসে।

ঘুমাতে ঘুমাতে রাত বারোটা বেজে যায়।নিঝুম দরজা খুলে ঘুমায়।তিতলিকে বলে ভয় পেলে তাকে ডাকতে।দুজন বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।রাত দু’টোর দিকে তিতলি স্বপ্ন দেখে ঘামতে থাকে।সর্বাঙ্গ যন্ত্রনায় মুছড়াতে থাকে।কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে।স্বপ্নে দেখছে –

” নিঝুম তিতলিকে পাঁজাকোলে নিয়ে একটা ফুলের বাগানে হাঁটছে।দুজন দুজনের চোখ দিয়ে আদান – প্রদান করছে হাজার কথা!হাজার প্রেমের সংলাপ!শরীরের প্রতিটা লোমকূপ অনুভূতিতে তলিয়ে যাচ্ছে ভালবাসার সমুদ্রে!হুট করে কোথেকে একটা মেয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়।নিঝুমের মুখটা চুপসে যায়।তিতলিকে নামিয়ে দেয়।মেয়েটা নিঝুমের হাতে শক্ত করে ধরে নিয়ে চলে যেতে থাকে।তিতলি চিৎকার করে কেঁদে নিঝুমকে ডাকতে থাকে।কিন্তু, তাকাচ্ছেনা নিঝুম! চলে যাচ্ছে মেয়েটির সাথে! ”
তিতলি ধড়পড়িয়ে উঠে ঘুম থেকে।চোখে জল।শরীরে ঘাম।হাঁপাচ্ছে সে।বুক ওঠানামা করছে হাঁপড়ের মতো।তিতলি চারিদিকে তাকিয়ে নিঝুমকে খুঁজতে থাকে।নেই রুমে।তিতলি শাড়ির আঁচল কোনোমতে জড়িয়ে নিঝুমের রুমে আসে।ড্রিম লাইটের আলোয় নিঝুমকে দেখতে পায়।নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মানুষটা!কেউ নিয়ে যায়নি।কাঁপা পায়ে নিঝুমের পাশে এসে দাঁড়ায়।মুখপানে চেয়ে থাকে অনেক্ষণ!

স্বপ্নের ঘোর যেন কাটছে না।গলা অব্দি এসে আটকে আছে কান্নারা।স্বপ্নটা একদম বাস্তব মনে হচ্ছিলো।অনুভব হচ্ছিলো ভীষণভাবে।তিতলি দপ করে নিঝুমের পায়ের কাছে বসে।মনে জাগে অন্যায় ইচ্ছে!কষ্ট মনে নিয়ে আসে অনুভূতিদের মেলা।নিয়ে আসে হাজারো আকাঙ্ক্ষা।তিতলির বেলাও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।ওর প্রবল ইচ্ছে জাগে একবার নিঝুমের পা স্পর্শ করতে ভিন্নভাবে।কিন্তু যদি জেগে উঠে?কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে!কলঙ্কের কথা ভাবতে গিয়ে তিতলি মুখ ফিরিয়ে নেয়।কিন্তু মন যে অনেক আগে থেকেই অবাধ্যের চরম শিখরে পৌঁছে আছে।

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৪

তিতলি ঘুরে তাকায়।চোখ বন্ধ করে নিঝুমের পায়ে চুমু এঁকে দেয়।কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে বুঝতে সে কি করেছে।যখন বুঝতে পারে হন্তদন্ত হয়ে রুমে চলে আসে।দ্রুত বিছানায় উঠে।’দ’ স্টাইলে মাথা নিচু করে বসে।শরীর কাঁপছে তাঁর তরতর করে।এমন দুঃসাহসিক কাজ তাঁর জীবনে সে দুটো করেনি।তিতলির হেঁচকি উঠে।হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস নেয়।তন্দ্রা একদমই নেই চোখে।বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।চোখ মেলে তাকায় আকাশপানে।বৃষ্টি হয়েছে পুরো সন্ধ্যা তাঁর কোনো চিহ্ন অব্দি নেই।ইয়া বড় চাঁদ আকাশে।চাঁদটা যেন তাঁর জন্যই আজ আকাশে উঁকি দিয়েছে।চাঁদে চেয়ে থাকতে পারছেনা তিতলি।তার মনে হচ্ছে চাঁদও তাঁকে,বেশরম, বেহায়া মেয়ে বলছে।তিতলি চাঁদের থেকে মুখ লুকাতে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে।বুকে পাড় ভাঙ্গা উত্তাল ঢেউ।

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ১৬