প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৯

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৯
ইলমা বেহরোজ

নিস্তব্ধতায় কেটে যায় পনেরো মিনিট।আচমকা তিতলি লজ্জায় উঠে পড়ে।ব্যস্ত পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেলে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।নিঝুম শান্তভাবে ব্যাপারটা দেখে।তিতলি চলে যেতেই ঠোঁট কামড়ে হাসে।তিতলি যে জায়গাটায় ছিল সেখানে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে।তিতলি রুমে এসে ফ্লোরে বসে ধপ করে।কি যে হচ্ছে!তারপরই সটান হয়ে শুয়ে পড়ে ফ্লোরে।চোখ রাখে শূন্যে।অনুভূতি গুলো গভীরভাবে ভেবে অনুভব করছে আবারো।একটু পর উঠে দাঁড়ায়।রুমে পায়চারি করতে থাকে।ঠোঁটে হাসি।ইচ্ছে হচ্ছে তাঁর খুশির ঠেলার দেয়ালে মাথা ঠুকে রক্তাক্ত হয়ে যেতে।মানুষ কষ্টে এমন ভাবে আর সে খুশিতে।তিতলি দু’হাতে মুখ ঢেকে ফিক করে হেসে উঠে।পরেই আফসোস করে উঠে, দূর কেন চলে আসলাম।দরজা খুলে দেখে কেউ উঠেছে নাকি।না চাইতেও ছাদের দিকে চলে আসে।আবার নিজের রুমে ফেরত আসে।বিছানাউ উপুড় হয়ে শুয়ে চোখ বুজে।

ঘন্টাখানিক যাবৎ তিতলি রুমে ভূতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।ছটফট করছে।দুপুরে কিছু খেলোনা।হুট করে বিছানায় শুয়ে পড়ে,বালিশে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
দু’ঘন্টা ধরে নিশা আর নিঝুম একসাথে।তিতলি কোনোমতেই নিশার সাথে নিঝুমকে দেখার ক্ষমতা পাচ্ছেনা।নিশাতো নিঝুমের প্রথম ভালবাসা।সে শুনেছে, প্রথম ভালবাসা কেউ ভুলতে পারেনা।নিশার জিম্মায় না নিঝুম চলে যায়! নিঝুমের প্রথম প্রেম নিশা হওয়াতে তিতলির ভয় হচ্ছে খুব।সে জানে নিঝুম তাকে ভালবাসে।তবুও…তখন তার কি হবে? তিতলি বুকটা হাহাকার করে উঠে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিঝুম বারান্দায় গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে নিশা।নিঝুমের চোখ মুখ শক্ত।এতক্ষণ ধরে তাকে আটকিয়ে রেখেছে।কি বলবে, সরাসরি বলছেও না।নিশা কথা বলার সাহস পাচ্ছেনা।এই নিঝুম যেন তার প্রথম দেখা! নিঝুমই শুরু করে,
— “কি জন্য এখানে এনেছো?বাড়ির সবাই কি ভাবছে?”
খিটখিট করে বলে উঠলো সে।নিঝুমের ব্যবহার দেখে নিশার চোখ কপালে উঠলো।বললো,
— “একি ব্যবহার তোমার নিঝুম!”
নিঝুম বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়।সে চাচ্ছেনা রাগারাগি করার।কিন্তু হয়ে যাচ্ছে।কখনোই এমন রাগী প্রকাশভঙ্গি ছিল না তাঁর।অথচ, নিশাকে সহ্য করা যাচ্ছেনা।নিঝুম একটু নিভলো।বললো,

— “সরি!বলো কেনো এখানে ডেকেছো?”
— “গতকাল সারাদিন কল দিলাম ধরলেনা যে?”
— “এটা বলতে ডেকেছো?”
— “আরো আছে।আগে এটা বলো।”
— “ফোন সাইলেন্ট ছিল।”
— “তোমার মনে হয় নি?আমি কল দিতে পারি?”
— “না।”

নিঝুম জবাব দিল কটমট করে। নিশার চোখে মুখে অপমানিত ভাব ফুটে উঠে।তার নিজেরও রাগ হচ্ছে।কিন্তু নিঝুমকে হাতে রাখতে হলে রাগারাগি ঠিক হবেনা।
— “তুমি কি আমার উপর বিরক্ত?”
— “অবশ্যই!সেটা তুমি বুঝতে পারছোনা? আমি তোমাকে নিতে পারছিনা।”
সে মতামত জানালো দৃঢ় ভাবে।
— “সেদিন যে, মেনে নিলে?”
— “সরাসরি বলিনি।যা ইঙ্গিত দিয়েছি।ভুল করেছি।'”

নিঝুম চোখ সরিয়ে বাইরে তাকায়।নিশা ডান পাশের সোফায় বসে পড়ে।তারপর, হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।নিঝুমের মায়া হলো।সে কখনো তার শত্রুর সাথেও এমন ব্যবহার করেনি।নিশা এখন হয়তো সত্যিই ভালবাসে।আর ভালবাসার মানুষের বাজে ব্যবহার কেউই নিতে পারেনা।নিঝুম নিজেকে ঠান্ডা করে নিশার কাছে এগিয়ে আসে।তারপর বললো,

— “সরি নিশা! আমার হুটহাট কেনো এতো রাগ হচ্ছে আমি সত্যি বুঝতে পারছিনা।তোমাকে এতোটা হার্ট করতে চাইনি।কিন্তু আমার কাছে ফিরে না আসলেই বোধহয় ভালো হতো।আমাকে তুমি পাবেনা কখনো।এটা সম্ভব না।আমার কোনো টান নেই তোমার প্রতি।কোনো ভালো লাগা নেই।যেটা এখন হচ্ছে,সেটা সম্ভবত করুণা।আমার কথাগুলো সহজ ভাবে নিলে তোমারই লাভ!এভাবে আমার আশায় থেকোনা।ভালবাসলেই সবাইকে পাওয়া যায়না।যারা পায় তারা ভাগ্যবান।”
নিঝুমের অকপট স্বীকারোক্তিতে নিশা ভারি আশ্চর্য হয়।কি বলছে?কোনো টান নেই? ভালো লাগা নেই?দু’বছর আগে এই ছেলেই কত পাগল ছিলো তাঁর জন্য!নিশা দুর্বোধ হাসলো।বললো,

— “এটা বুঝি আমার শাস্তি?”
নিঝুম ভারি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
— “কিসের শাস্তি?”
— “তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার।”
নিঝুম তাচ্ছিল্য হেসে বাম পাশের সোফায় গিয়ে বসে।তারপর নিশার চোখে চোখ রেখে,বললো,
— “তুমি বরং তাই ভেবে নাও।”
নিশা নিষ্পলকভাবে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে থাকে।এ কোন নিঝুম?নিঝুম চোখ সরিয়ে নেয়।নিশা আরো অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে।তারপর প্রশ্ন করে,
— “কাওকে ভালবাসো?”
— “হ্যাঁ বাসি।খুব ভালবাসি।”
নিঝুমের কন্ঠে স্নিগ্ধতা।তাচ্ছিল্য কণ্ঠে নিশা বললো,
— “এই মেয়ে কখনো ছেড়ে গেলে।দু’বছর পর আবার ভুলে যাবে তাইতো?”
নিঝুমের যদিও রাগ হয়।তবুও কষ্টে রাগটা চেপে সহজ গলায় বললো,
— “সে তোমার মতো না নিশা।সে ভুলার মতো না।সে নেশার চেয়েও নেশাতর।যে নেশা ছাড়ানো অসম্ভব।আর আমি সেই নেশায় আসক্ত।”

— “এতোই গুণ তার? দেখাবে না?”
— “অন্যদিন।”
— “আজ নয় কেনো?”
নিঝুম নিশ্চুপ।
— “আমি তোমায় ভালবাসি নিঝুম।”
নিশা উঠে এসে নিঝুমের পা জড়িয়ে ধরে।ভারী করুণ ভাবে বললো,
— “প্লীজ আমায় কুড়িয়ে নাও।আমি তোমায় খুব ভালবাসি।তুমিও আমার নেশা।কীভাবে ভুলবো তোমায়।নিঝুম সদয় হও আমার প্রতি।প্লীজ।’

নিশার এমন কান্ডে নিঝুম সচকিত।নিশাকে ছাড়াতে গিয়েও পারছেনা।জাপটে পা ধরে রেখেছে।নিঝুম কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা।তিতলিকে ছাড়ার কথাতো ভাবতেই পারবেনা।তার উপর এই মেয়েকে বোঝানোর কোনো যুক্তি পাচ্ছেনা।সে তো ভালবেসেই ফিরে এসেছে।নিঝুম পড়ে মহা চিন্তায়।নিশাকে ছাড়ানোর জন্য আশ্বাস দিলো,
— “ছাড়ো পা।যা তোমার পাওনা তা সৎ হলে তুমি অবশ্যই পাবে।”
নিশা নিঝুমের কথাতে চুপ হয়ে যায়।তার চাওয়া তো সৎ নয়!তাঁর মানে কি নিঝুম তাঁর কব্জায় আসবে না?নিশা নিঝুমের পা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।চোখের জল মুছে বলে,

— “নিঝুম আমার তোমাকেই চাই।”
নিঝুম আদেশ স্বরে বলে,
— “নিশা।নিচে যাও,সবাই আনন্দ করছে।তুমিও করো গিয়ে।আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”
নিশা কিছু একটা বলতে গিয়েও চেপে যায়।
তিতলির দম বন্ধ হয়ে আসছিলো রুমে।আর থাকতে পারেনি সে।ওড়নাটা শরীরে ভালো করে টেনে নেয়।তারপর নিঝুমের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়।নক না করে নিঝুমের রুমে ঢুকার সাহস পাচ্ছেনা।আচ্ছা, ভালবাসি বলাটাই কি সব?তিতলি সাত পাঁচ ভেবে, নক না করেই রুমে ঢুকে পড়ে।তখনি নিশাও রুম থেকে বের হচ্ছিলো।দুজন মুখোমুখি হয়!

— “কোথায় যাচ্ছো?”
নিশার এমন চড়া গলা শুনে তিতলি চমকায়।
— “নিঝুম ভা..ভা..ভা…ইয়া।”
— “ভাইয়া বলতে গিয়ে তোতলাচ্ছো কেনো?”
নিশার কণ্ঠে বিরক্তি।তিতলি নিশ্চুপ।নিশার হুংকার,
— “এখন ও কারো সাথে দেখা করবেনা।একা থাকবে।যাও তুমি।”
নিশার কথায় তিতলি ব্যাথিত হয়।চোখের কোণে জল জমে।
— “কি হলো? দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
নিশার চড়া গলা শুনে নিঝুম এগিয়ে আসে।তিতলিকে দেখে অবাক হয়।কাছে এসে বলে,
— “কি হয়েছে?”
নিশা আদুরে কণ্ঠে বলে,
— “বেবি তুমি একা থাকতে চাও বললে না? তাই আমি ও কে বলছিলাম এখন যাতে তোমাকে বিরক্ত না করে।”
— “আমি আসি।”

তিতলি কাঁপা গলায় কথাটি বলে চলে যেতে নেয়।তখনি নিঝুমের ডাক,
— “পাকনামি করতে কে বলেছে তিতলি? আমি বলেছি চলে যেতে?”
তিতলি ঘুরে দাঁড়ায়।শান্ত স্বরে বলে,
— “উনি যে বললেন?”
— “রুমটা আমার না ওর?”
তিতলি নিশ্চুপ।নিশা বলে,
— “তুমি না একা থাকতে চেয়েছো।এই তুমি যাও তো।”
নিঝুম কঠিন স্বরে নিশাকে বলে,
— “তুমি কার সাথে কী আচরণ করছো বুঝতে পারছো না।যাও, নিচে যাও।”

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৮

নিশা তিতলির উপর রাগান্বিত হয় বড্ড।সেই সাথে অবাকও!গটগট আওয়াজ করে বের হয়ে যায় রুম থেকে।একবার পিছন ফিরে তাকায়।নিঝুম নিশার সেই দৃষ্টি দেখে চিন্তায় পড়ে যায়।এই দৃষ্টিতে ভালবাসা থাকতে পারে না।কি উদ্দেশ্য নিশার?
তিতলি মাথানত করে দাঁড়িয়ে আছে।সে কাঁদছে।সেটা নিঝুম বুঝতে পারে।আর এটাও বুঝে, কেনো কাঁদছে।কিছু না বলে পাঁজাকোলা করে নেয়।ব্যালকনির সোফায় এনে বসিয়ে দেয়।তিতলির সামনের সোফায় সে বসে।তিতলি নতজানু হয়ে ফোঁপাচ্ছে।নিঝুম হেসে তিতলিকে বলে,

— “এরকমভাবেই জেলাস হয়ে আজীবন কেঁদো।”
নিঝুমের কথা শুনে তিতলি নিঝুমের দিকে তাকায়।এরপর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে।নিঝুম অবাক হয়ে যায়।তিতলির সামনে হাটুগেড়ে বসে বলে,
— “কাঁদতে বলছি বলে জোরে কাঁদবে নাকি।কেউ শুনলে কি ভাববে?”
তিতলি আওয়াজ কমিয়ে হেঁচকি তুলা কান্নায় ভেঙে পড়ে।নিঝুম দু’হাতে তিতলিকে জড়িয়ে ধরে।কিছু বলতে যাবে তখনি সেন্টার টেবিলে থাকা ফোন থেকে টুংটাং আওয়াজ আসে।নিঝুম ঘুরে তাকায়।নিশার ফোন!

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩০