প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৩

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৩
ইলমা বেহরোজ

বৃদ্ধ ভদ্রলোক থেমে থেমে প্রশ্ন করেন,
— “কত বছর হলো বিয়ের?”
নিঝুম কয়েক সেকেন্ড ভাবে।তারপর বৃদ্ধের দিকে তাকায়।উদাস গলায় বলে,
— “বিয়ে হয়নি।”
বৃদ্ধর মুখ দেখে বোঝা গেলো উনি একটুও অবাক হননি বরং হেসে জিজ্ঞাসা করেন,
— “গার্লফ্রেন্ড তাই তো?”
নিঝুম আরো মিইয়ে যায়।মাথা নত করে হাতের আঙ্গুলের নখ খোঁচায় আর বলে,
— “তা ও নয়।”
এবার বৃদ্ধ একটু ঘাবড়ান!তারপর আবার হাসেন।বলেন,
— “ভালবাসো কিন্তু বলতে পারছো না। তাই তো?”
নিঝুম যেন এবার তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।অভিজ্ঞ গলায় বললো,
— “ভালবাসা?ভালবাসা টা আসলে কি?ভালবাসা মানে,কয়েক বছর ভালো লাগবে।একবার দূরে গেলেই সব শেষ!সব অনুভূতি উধাও!হাস্যকর না?”

নিঝুমের কথা বলার ধরণ বৃদ্ধের ভালো লাগেনি। তিনি মুখ ঘুরিয়ে নেন।বাসের অনেক উৎসুক চোখ নিঝুমের দিকে তাকায়।নিঝুমের এতটুকুও অস্বস্তি হয় নি।বৃদ্ধের পাশের সিটে একজন ভূড়িওয়ালা লোক বসেছে।লোকটি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।বৃদ্ধ জানালার বাইরে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকেন।তারপর আবার নিঝুমের দিকে ফিরে বলেন,
— “দাদু ভাই?”
ডাকটি নিঝুমকে এক অন্যরকম অনুভূতির সাথে পরিচয় করায়।কি সুন্দর করে ডাকলো!নিঝুম তাকায়।বৃদ্ধ হালকা হাসেন।বলেন,
— “ভালোলাগা একটা অনুভূতি আর ভালবাসা আরেক অনুভূতি।অনেকে ভাললাগাকে ভালবাসার সাথে গুলিয়ে ফেলে।”
নিঝুম যেনো ভারি চমকালো। কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলো,
— “যেমন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বৃদ্ধ হাসেন।তারপর গলায় ঝুলানো ব্যাগটা থেকে একটা ছোট পানির বোতল বের করে এক ঢোক পানি খেয়ে গলা ভেজান।বোতলটা আবার জায়গায় রেখে,নিঝুমের দিকে তাকিয়ে হাসেন।বলেন,
— “ভালোলাগা হচ্ছে রাস্তায় চলার পথে কোনো ফুল মনে ধরল, তা ছিঁড়ে নিলে। শুকিয়ে গেল কিংবা আর ভালো লাগল না ফেলে দিলে। আর ভালোবাসা হলো সেই ফুলগাছকে পরিচর্যা করে তাতে ফুল ফোটালে, পাশে পাশে রাখলে। আর এই ভালোবাসাই হলো সম্পর্ক জিইয়ে রাখার প্রাণ, মূলমন্ত্র। ভালোলাগাতে বিশ্বাসের উপস্থিতির তেমন প্রয়োজন নেই কিন্তু ভালোবাসাতে একের বিশ্বাস অন্যের সবকিছু! ভালোলাগার আবেগ কিছুটা বায়বীয় ব্যাপার। ভালোলাগা এমন এক জিনিস যা একবার শুরু হলে সব কিছুই ভালো লাগতে থাকে। অনেকগুলো ভালোলাগা থেকে হয়ত কিছু চিরস্থায়ী হয় আর বাকি সবই আপেক্ষিক। তবে, ‬ভালোলাগা হচ্ছে ভালোবাসার প্রথম শর্ত, অনেকের অনেক কিছু আমাদের ভালো লাগে, কিন্তু তাই বলে আমরা সবাইকে ভালোবাসতে পারিনা।শুনছো?”

— “জ্বি।”
— ” ভালোবাসা অন্তর দিয়ে অনুভব করতে হয়। এক্ষেত্রে ভালোলাগা বা কোনো প্রকার ভাষার প্রয়োজন হয় না। ভালোবাসার বিশেষ কোন রং নেই।ভালোবাসা মানে কাউকে জয় করা নেওয়া নয়। ভালোলাগার জিনিসটাকে বা পছন্দকে হাসিল করে নেয়া নয় বরং নিজেই কারো জন্য হেরে যাওয়া। কারো অন্তরের সাথে নিজের অন্তরকে একাত্ব করে নেয়া। নিজের মনকে সঁপে দেয়া।এটা চোখের বা জ্ঞানের গভীরতা দিয়ে হয়না।হয় হৃদয় এর পবিত্রতা দিয়ে। এই ভালোবাসা কখনও কাঁদায়, কখন হাসায়, কেউ এর জন্য আত্মবিসর্জন দেয়। মানুষ কত ত্যাগ স্বীকার করে ভালোবাসার মানুষকে পাবার জন্য। আবার এই ভালবাসার জন্য মূল্যবান অনেক কিছুই হারায় যার জন্য বিন্দুমাত্র আফসোস ও কখনো হয় না। ”
বৃদ্ধ থামেন।হাঁপান।আরেক ঢোক পানি খান।এরপর আবার বলতে শুরু করেন,

— ” শুধু ভালোলাগা থাকলে এই জিনিসগুলো আসে না মন থেকে।ভালোবাসা বেঁচে বা টিকে থাকে পরস্পরের বিশ্বাসে।যে প্রেমে বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয় সেখানে হয়ত প্রেম থাকে না, থাকে সামাজিকতা রক্ষা। ভালোবাসা পবিত্র একটি অনুভূতি। ভালোলাগা থেকে স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভালোবাসা উচিত নয়। মনে রাখবে, ভালোলাগাতে প্রত্যাশা থাকে।তবে ভালোবাসার সাথে প্রত্যাশার কোনো সম্পর্ক নাই।ভালোবাসার পরিধি মহাবিশ্বের মতোই বিশাল।‘ভালোবাসা’ নামক বস্তুটিতে যতটা আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়, তা শুধু ‘ভালোলাগা’ থেকে মেলে না। খুব তুচ্ছ কারনে যে কারো প্রতি ভালো লাগা তৈরি হতে পারে। আবার ঠুনকো কারণেই সেই ভালোলাগার মৃত্যু হতে পারে। ভালোবাসার মৃত্যু হয় না, ঠিক যেমন একই কারণে আত্মার মৃত্যু নেই।( উপরোক্ত কিছু লাইন সংগ্রহীত)”
বৃদ্ধ থামেন।কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলেন,

— “ভাললাগাতে অনুভুতি আর মন থাকেনা কিন্তু ভালবাসাতে আবেগ অনুভুতি আর মনের বিষয় থাকে।ভাললাগাতে হারানোর কিছু নেই ভালবাসাতে হারানোর অনেক কিছু থাকে যা মেনে নিতে হয় ভালবাসা দিয়ে ।ভাললাগাতে প্রেম থাকেনা আর ভালবাসাতে প্রেম ছাড়া কল্পনা করা যায়না।ভালবাসায় মন-শরীর দুটোরই থাকে প্রবল টান।আর ভালোলাগাতে শুধু বাইরের সৌন্দর্যের শরীরটাই প্রবল টানে।একবার ছুঁয়ে দিলে, সেই আকর্ষণ ও শেষ!”
নিঝুম ঘোরে চলে যায়।জড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করলো,
— “ভালবাসার লক্ষন কি?”
বৃদ্ধ হাসেন।তারপর বলেন,

— “তার জন্য তোমার খুব চিন্তা হবে।তার সব কিছুতে তোমার অধিকার খাটাতে ইচ্ছে হবে।সেই মেয়েটার কান্না-হাসি সবকিছুতে একেকরকম মুগ্ধতা খুঁজে পাবে।যখন পাশে থাকবে চারিদিকটা আলোড়িত মনে হবে।তার,কোনো বিশেষ জায়গায় তোমার মন ডুববে না,তোমার মন ডুববে তার কাজল চোখে,তার খোলা চুলে,তার কথায়।তার ব্যবহৃত প্র‍ত্যেকটা জিনিস হবে মূল্যবান।চোখ বন্ধ করলে, যে মেয়েটা তোমার চোখে ভাসবে সে তোমার ভালবাসা।যে মেয়ে তোমার পাশে থাকলে, তোমার বুকে থাকলে, তোমার মনে প্রশান্তি আসবে, সে মেয়ে তোমার ভালবাসা।তার সাথে একবার খারাপ ব্যবহার করার পর,তোমার খুব অশান্তি হতে থাকে বুকে,সবকিছুতেই অশান্তি এসে বিরাজ করে, সে তোমার ভালবাসা।যার চোখের জল তোমার বুক ভারি করে, সে তোমার ভালবাসা।যার ঠোঁটের হাসির সাথে তোমার ঠোঁটের হাসির সংযোগ থাকবে, সে তোমার ভালবাসা।’

বৃদ্ধ লোকটি কথাগুলো চোখ বন্ধ করে বলেন।থেমে থেমে।হয়তো তিনি কল্পনায় তার মৃত প্রিয়তমাকে ভেবেছেন।তার কথা ভেবেই নিজের সব অনুভূতি বলেছেন।আশে-পাশের কয়টা সিটের মানুষ বৃদ্ধ লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে।নিঝুম এক হাতে কখন তিতলির কোমর জড়িয়ে ধরেছে নিজেও জানেনা।তিতলি তখনও গভীর ঘুমে বিভোর! গাড়িতে সে কখনো সজাগ থাকতে পারেনা।ঘুম পাবেই!নিঝুম মনোযোগী শ্রোতা হয়ে পুরোটা শুনলো।মাথা নত করে সেও চোখ বন্ধ করে রেখেছে।যেনো মুহূর্তটা সে অন্য এক জগতে কাটিয়ে এসেছে।বৃদ্ধ চোখ খুলে নিঝুমের দিকে তাকান।প্রশ্ন করেন,

— “কার মুখখানি তোমার চোখে?”
নিঝুম চোখ খুলে অস্পষ্ট কণ্ঠে বললো,
— “তিত-লি!”
বৃদ্ধ হাসেন।বলেন,
— “সেই তো তোমার ভালবাসা!”
নিঝুম চমকায়।খুব করে চমকায়।তিতলিকে সে ভালবাসে?নিঝুম চিন্তায় মগ্ন হয়।হারিয়ে যায়।কূল পাচ্ছে না।বৃদ্ধ আবার বলেন,

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২২

— “শুনো দাদু ভাই, তুমি যদি তাকে ভালবেসে থাকো তোমার মুখ থেকে আপনা-আপনিই ভালবাসার কথা বেরিয়ে আসবে।ভালবাসা আটকিয়ে রাখা যায়না, প্রকাশ পাবেই।আর যদি প্রথম প্রেম ভুলে অন্য কারোর প্রেমে পড়ো!প্রথম প্রেমের কথা একদমই ভুলে যাও।তার প্রতি সব অনুভূতি উধাও হয়ে যায়। ভাববে,আগেরজনকে তুমি ভালোই বাসোনি।সে তোমার ভালোলাগার একটা অভ্যেস ছিলো একসময় সেই অভ্যেস কেটে গেছে এইটুকুই।বেশিরভাগ মানুষ জীবনে একবার প্রথম ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে!”

নিঝুম জোরে নিঃশ্বাস ফেলে।কিছুকক্ষণ সবাই নিশ্চুপ।বাস থামে,আবার চলতে শুরু করে।বৃদ্ধ লোকটি কখন নেমে যায় নিঝুম খেয়ালই করেনি।বাসে থাকা যে মানুষগুলো বৃদ্ধের ভালবাসার ব্যাখ্যা শুনেছে। তারা সবাই ততক্ষণে বুঝে গেছে, এই বৃদ্ধ এককালে কোনো নারীর ভয়ংকর প্রেমিক ছিলেন।
বৃদ্ধ নিঝুমের বুকে ঝড় তুলে দিয়ে গেলেন।নিঝুমের মন হুট করেই কথা বলা শুরু করেছে।বলছে,সে ভালোবাসে তিতলিকে।হ্যাঁ বাসে!সে ভালবাসে।এবং তিতলিকেই।বাসে,খুব বেশি ভালবাসে।

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৪