প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৪

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৪
ইলমা বেহরোজ

বাসে উঠার দীর্ঘ দু’ঘন্টা পর তিতলির ঘুম ভাঙ্গে। নড়তে গিয়ে নিজেকে বন্দি মনে হলো তাঁর।চোখ মেলে ভালো ভাবে তাকায়।দু’টো হাত আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে তাকে।আর তার মাথা কারো বুকে!বুকের মালিকের মুখ দেখার জন্য অবাক চাহনি নিয়ে মুখ তুলে উপরে তাকায় তিতলি।মুখখানি দেখে চমকায় সে।নিঝুম!সিটে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।দু’হাতে তিতলিকে আঁকড়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে।তিতলি হকচকিয়ে গেল!

মুহূর্তে তার পুরো শরীর বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে আসে।হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে বাড়লো।বাড়লো গতি নিঃশ্বাসের।এতোটা কাছাকাছি দুজন মিশে আছে।যা তিতলির ভাবনার বাইরে ছিল!তিতলির শরীর রীতিমতো কাঁপতে থাকে।তিতলির কাঁপুনি আর নিঃশ্বাসের গতিতে নিঝুমের ঘুম ছুটে যায়।চোখ খুলে তাকায়।চশমা নাকের ডগায় চলে এসেছে।নিঝুম এক হাত তিতলির থেকে সরিয়ে চশমা ঠিক করতে ওপরে তুলতেই তিতলি চট করে বুক থেকে সরে যায়।তিতলির এভাবে সরে যাওয়াতে নিঝুমের মনে হলো, এতক্ষণ তিতলি তার বুকে ছিলো।নিঝুমের কোনো ভাবান্তর হলোনা।সে স্বাভাবিক ভাবে পকেট থেকে ফোন বের করে। ফেসবুকে লগ ইন করে।তিতলি জানালা ঘেঁষে বসেছে।ওর বুক এখনও ধড়ফড়, ধড়ফড় করছে।নিঝুমের দিকে ফিরেই তাকাচ্ছেনা।তাঁর মনে এখনও রাতের ঘটনাটা বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে।এই বুঝি নিঝুম তাকে খারাপ মেয়ে পদবি দিলো!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিঝুম দেখাচ্ছে সে ফোনে মগ্ন।আসলে সে আড়চোখে দেখছে তিতলিকে।বুক ঢিপঢিপ করছে।ইচ্ছে হচ্ছে, কোনো এক অধিকার খাটিয়ে তিতলিকে আরো একবার বুকে জড়িয়ে ধরতে।মুচকি হাসে নিঝুম।ফোনটা প্যান্টের পকেটে রেখে ঘুমের ভান ধরে।সে অপেক্ষা করছে কখন বাস ঝাঁকুনি দিবে আর সাথে সাথে সে ইচ্ছে করে তিতলির কাঁধে এসে পড়বে।কিন্তু না,অনেকক্ষণ পার হয়ে যায়।গাড়ি মোড় পাল্টাচ্ছে না।ঝাঁকুনিও দিচ্ছে না।নিঝুমের মেজাজ বিগড়ে যায়!বিড়বিড় করে,এতক্ষণ ঝাঁকিয়ে নাড়ি-ভুঁড়ি বের করে দিছে আর এখন….. আনরোমান্টিক বাস একটা!ধ্যাত।”

নিঝুমের ফোন বেজে উঠে।ফোনের স্ক্রিনে নিশার নাম্বার।নিঝুমের ভ্রু হালকা কুঞ্চিত হয়।কল কেটে দিতে গিয়েও কাটেনি।তিতলি যে, তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে।সে ইচ্ছে করে কল রিসিভ করে।ফুরফুরে মন নিয়ে নিশার সাথে পকপক করতে থাকে।তিতলি মাথায় ওড়নাটা টেনে নেয় ভালো করে যেনো মুখ দেখা না যায়।তারপর, জানালার বাইরে চোখ মেলে তাকায়।নিঝুম এতো আনন্দ সহিত কথা বলছে নিশার সাথে!তিতলির বড্ড খারাপ লাগছে।চোখ বার বার ভিজে উঠছে।আর সে বাম হাতের তালু দিয়ে বার বার চোখের পানি মুছে যাচ্ছে।ঠোঁটের সাথে গলা কাঁপছে।না আসলেই বোধহয় ভালো হতো।দু’হাত জানালার স্টিলের বর্ডারের উপর তার উপর থুতনি রেখে অনবরত চোখের জল ফেলতে থাকে সে।চাইলেও পারছেনা জলের ধারা কমাতে।

অনেকক্ষণ হয়ে গেলো তিতলি এদিকে তাকাচ্ছেনা।নিঝুম নিশাকে কিছু না বলেই হুট করে কল কেটে দেয়।তার বয়েই গেছে, নিশার সাথে কথা বলতে।যার জন্য এতো কিছু সেই তো তাকাচ্ছে না।তিতলির কি একটুও দূর্বলতা নেই তাঁর প্রতি?থাকলে তো জেলাস ফিল করতো!নিঝুম ডাকে,
— “এক্সকিউজমি?”
তিতলি ভারি অবাক হলো।চোখের জল মুছে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় নিঝুমের পানে।থমথমে গলায় বললো,
— “আ-আমাকে বলছেন?”
নিঝুম এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললো,
— “তো কাকে বলবো আর?আমি কি এখানে আর কাউকে চিনি?”
— “কিন্তু আমার নাম তো জানেন।এমন ভাব মেরে ডাকার কি হলো?”
— “ইচ্ছে হলো।”
ছোট করে তিতলি বললো,

— “ওহ।’
— “এসবের মানে কি?”
তিতলি অবাক হবার ভান করে বললো,
— “বুঝিনি ঠিক!'”
— “আই মিন হোয়াট ইজ ইউর প্রবলেম?”
— “কই সমস্যা?”
— “এইযে সেই শুরু থেকে চুপ করে বাইরে তাকিয়ে আছো।কথা-বার্তা নেই।তুমি তো এই ধাঁচের মেয়ে না।”
তিতলি মাথা নত করে।কেমনে সে বলবে, রাতের কান্ডের জন্য আমি খুবই দুঃখিত!এজন্যই এতো চুপ থাকা।নিঝুম তিতলিকে চুপ দেখে হাসে।ওর অকারণেই হাসি পাচ্ছে।কিসব ভাবছে, কিসব বলছে কিছুই জানেনা।তবে এইটুকু বুঝেছে,বুকে সেই ছটফটে ভাবটা আর নেই।নেই কোনো অশান্তি! আচমকা নিঝুম প্রশ্ন করে,

— “তোমার বয়ফ্রেন্ডের নাম কি?”
তিতলি আরো নিভে যায়।এখন কার নাম বলবে সে?আমতা আমতা করে সে বললো,
— “কে,কেনো?”
নিঝুম চশমাটা ঠিক করে সামনে তাকিয়ে বললো,
— “না এমনি।”
মনে হলো কথাটা হেসে বলেছে নিঝুম।তিতলি তাই মুখ তুলে তাকায়।নিঝুমের মুখটা উজ্জ্বল। চোখেমুখে হাসি।দেখতে চমৎকার লাগছে।তিতলি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে।নিঝুম ঘুরে তাকাতেই তিতলি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।নিঝুম দাঁত দেখিয়ে হাসে।তিতলি টোলটা দেখে। ভাবে,গার্লফ্রেন্ডের সাথে ফোনে কথা বলে মানুষটা কতো হ্যাপি!
এরপর তিতলি হালকা কেশে গলা স্বাভাবিক করে। তারপর বললো,

— “আমার বয়ফ্রেন্ড নেই আগেই বলেছি।কিন্তু একজনকে খুব ভালোবাসি।তার নাম অর্নব।”
নিঝুমের মুখের হাসির রেখাটা কমে আসতে থাকে।সে নিষ্পলক চাহনি নিয়ে তাকায়। বলে,
— “অর্নব!”
— “হুম।”
— “থাকে কই?”
— “আমেরিকা।”
— “পরিচয় কীভাবে?”
— “আগে আমাদের গ্রামেই ছিলো।ছয় মাস আগে আমেরিকা চলে গেছে।”
— “ওহ।”

নিঝুমের মেজাজ খিঁচড়ে যায় আমেরিকা নামটা শুনে।মনে মনে কটমট করে ভাবে,প্রত্যেকটা মেয়ে লোভী!আমেরিকান ছেলে দেখলেই এরা লাফায়।তিতলিকে তবুও অন্যরকম ভেবেছি।এরা কি ভাবে? আমেরিকান ছেলেদেরই টাকা আছে? আমাদের নেই!অবশ্যই আছে, নিশা,তিতলি এদের মতো মেয়েদের হাজারবার কিনে বেঁচা যাবে আমার টাকায়।অহংকার করার মতো আমার অনেক কিছুই আছে। নিঝুমের কপালের রগ দপদপ করতে থাকে।
এতোগুলা মিথ্যে বলে তিতলি হাঁপিয়ে উঠেছে।কিভাবে পারলো এতোগুলা মিথ্যে বলতে?তিতলি নিজেও বুঝে উঠতে পারছেনা।তবে, এইটুকু বুঝেছে নিঝুম এতক্ষণ ঘেঁষে বসে ছিলো।হুট করেই দূরে সরে গেছে!

বাস থেকে নেমে সিএনজি নেয় ওরা।পিছনের সিটের দু’প্রান্তে দুজন বসে।দুজনই নিশ্চুপ।নিঝুম সবেমাত্র বুঝেছে,তিতলিকে সে ভালবাসে এর মধ্যেই তিতলিকে লোভী হিসেবে জানলো।তিতলি আমেরিকান ছেলে ভালবাসে!ঠিক নিশার মতো।নিঝুমের মনে পড়ে যায়।দু’বছর আট মাস আগে নিশার কয়টা কথা।নিশা বলেছিল,
— ” দেখ নিঝুম,তুমি ডাক্তারি পাশ কবে করবে তা আল্লাহ মাবূদ জানেন।এখন তুমি বেকার বুঝছো।আমি এখন যাকে ভালবাসি সে আমেরিকায় থাকে।বিয়ের জন্য দেশে এসেছে।তুমি জানো তাঁর কত টাকা?আমেরিকান ছেলে মানেই স্বর্গ।আর মেয়েরা স্বর্গ চায়।যার জন্য আমেরিকান ছেলে পারফেক্ট।”

কতোটা নিচু মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিল নিশা।নিঝুমের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই ভালো ছিল।তবুও এমনটা করলো।তখন আর মাত্র কিছুদিন বাকি ছিল ডাক্তারি পাশ করার।নিশা সেই সময়টুকু দেয় নি।অবশ্য ভালোই হলো।নিশা মরীচিকা ছিল।নিঝুমের দৃষ্টি অস্থির।ঠোঁট ভেঙ্গে সে কাঁদছে।বুকটা হাহাকার করছে।কয়েকটা মুহূর্ত আগে বুকটা প্রশান্তিতে ভরপুর ছিলো।পুরোনো ঘা তে যেনো আবার ঘা পড়লো।নিশার সাথে তিতলিকে মেলাতে গিয়ে তার বুক ব্যাথায় বিষে যাচ্ছে!ভেতরে তুমুল ঝড় বইছে।

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৩

কুমিল্লা থেকে সিএনজি করে তিতলির গ্রামে যেতে দু’ ঘন্টা লাগে।পনেরো মিনিট পার হতে না হতেই তিতলি আবারো ঘুমিয়ে পড়ে।তিতলি কিছুতেই গাড়িতে সজাগ থাকতে পারে না।নিঝুম চোখের পানি মুছতে গিয়ে তিতলিকে খেয়াল করে।সিএনজি ঝাঁকি দিলেই বাইরে পড়ে যাবে মেয়েটা।নিঝুম দ্রুত তিতলির কাছে এসে বসে।মনের রাগ,অভিমান সাইডে রেখে তিতলির কোমর ধরে টেনে কাছে নিয়ে আসে।শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।তারপর,তিতলির মুখ থেকে চুলগুলো সরিয়ে দেয়।নিঝুমের চোখের সম্মূখে তিতলির মায়াবী মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ভাসে।নিঝুমের যেন হঠাৎ করে মনে হলো নিশার ধারে কাছেও না এই মেয়ে।এই মুখের মেয়ে লোভী হতেই পারেনা।কি পাগল সে।চট করে তো সে কারো প্রতি কোনো মনোভাব আনে না।চট করে কান্না তো দূরের কথা।মুহূর্তে কি সস্তা ভাবনা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।কি অদ্ভুত? সে অনুতপ্ত হয়ে পড়ে।নিঝুমের মনটা হুট করেই যেমন বিষে গিয়েছিল তেমন হুট করেই ভালো হয়ে যায়।সে আরো শক্ত করে কাছে টেনে ধরে তিতলিকে।ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে।তিতলি ঘুমের মাঝে ঠোঁট নাড়াচ্ছে!ছোট বাচ্চারা যেমন ঘুমের মধ্যে ঠোঁট নাড়ায়।কিছু খাওয়ার মতো করে।ঠিক যেন তেমন।নিঝুম ফিক করে হেসে ফেলে।হেসে বিড়বিড় করে,

— “আমেরিকান ছেলে পছন্দ করো আর লন্ডনি ছেলেই পছন্দ করো।নির্জনের বিয়েটা যেতে দাও। তারপর এই ডাক্তারকেই পছন্দ করতে হবে।আর হ্যাঁ বিয়েও।কোনো ছাড়াছাড়ি নাই।”

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৫