প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৫

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৫
ইলমা বেহরোজ

— “ও ভাই?”
সিএনজি ড্রাইভারের গলা উঁচু ডাকে তিতলি নিঝুম দুজনই যেন চমকে উঠে। তিতলি তো পুরোই ‘থ’ বনে গেছে।আবারো সে নিঝুমের আলিঙ্গনে আবদ্ধ! নিঝুম অবাক চাহনি নিয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকায়, বলে,
— “কি হইছে ভাই?”
— “আইয়া পড়ছি,যেহানে কইছিলেন।এহন কোন দিক দিয়া যামু?”
নিঝুম তিতলিকে ছেড়ে দেয়।তিতলি গুটিসুটি হয়ে কোণায় বসে।বাইরে একবার তাকিয়ে কাঁপা গলায় বললো,
— “ডান দিকের রাস্তাটা দিয়ে যান।”

তারপর আবার সিএনজি চলতে শুরু করে।নিঝুমের মনটা বড্ড ফুরফুরে। কতক্ষণ আগে কি মরা কান্নাটা কেঁদেছে! এতোটা অবুঝের কাজ করেছে সে? ভাবতেই পারছে না। এখন আফসোস হচ্ছে। ঠান্ডা মাথায় না ভেবে,আমেরিকা শব্দটার জন্য এভাবে লাফানো উচিৎ হয়নি। এতো ভাবা উচিৎ হয়নি।তিতলি হয়তো আমেরিকা যাওয়ার আগে থেকে ছেলেটাকে ভালবাসে। তখন জানতোই না ছেলেটা আমেরিকা যাবে।থাক গে, চলে গেছে তো গেছে।এখন তিতলি আমার! তিতলি ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাচ্ছে। সে ভাবছে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “আমি কি ঘুমের ঘোরে উনার বুকে চলে যাই? উনি আরো কত কি ভাবছেন আল্লাহ মাবূদ জানেন!
— “থামান!থামান!”
তিতলি কথায় সিএনজি থামে।তিতলি হালকা হেসে নিঝুমকে ইশারায় একটা বাড়ি দেখিয়ে বললো,
— “ওইযে,আমার বাড়ি!”
নিঝুম বাড়িটার দিকে তাকায়।একটা কালো গেইট দেখা যাচ্ছে।বাড়িটা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না গাছের জন্য।বাড়িটাকে গাছ আড়াল করে রেখেছে।নিঝুম ভাড়া মিটিয়ে তিতলিকে নিয়ে এগিয়ে আসে। গেইটের কাছে এসে তিতলি নিঝুমকে ফেলে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে।নিঝুম খানিকটা অবাক হয় তিতলির দৌড় দেখে।তারপর হেসে নিজেও ঢুকে।
তিতলি গেইটের ভেতরে ঢুকেই বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে,

— “বাবা,বাবা।কইইই তুমি।”
নিঝুম বাড়িটা দেখে।অনেক বড় উঠান সামনে।উঠানে অনেক গাছ-গাছালি।পাকা বাড়ি।তবে,বাড়ির এক পাশের ছাদ টিনের।সব মিলিয়ে অনেক সুন্দর।
গ্রামের একটি আভিজাত্যপূর্ণ বাড়ি।ঢিলা ফতুয়া আর পায়জামা পরা একজন ভদ্রলোক বেরিয়ে আসেন।সাদা দাঁড়ি।মাথায় টুপি,চোখে চশমা।তিতলি দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ে উনার বুকে।নিঝুম ভালো করে খেয়াল করে বুঝতে পারে উনি তিতলির আব্বু।শাহেদ মাহমুদউল্লাহ।মাস্টার, মাস্টার ছাপ আছে মুখে।আবারতো হবু শ্বশুর হয়।যখনি নিঝুমের মনে হলো, উনি তাঁর হবু শ্বশুর।দ্রুত এসে সালাম করে।পটাতে তো হবে নাকি?
কারো স্পর্শ পায়ে পেয়ে শাহেদ এক হাতে তিতলিকে জড়িয়ে ধরে। অন্য হাতে চোখের চশমাটা ঠিক করেন।তারপর,নিঝুমের মুখের দিকে তাকান।কিন্তু চিনতে পারছেন না।নিঝুম বুঝতে পেরে বললো,

— “আমি, আমি নিঝুম!”
শাহেদ মনে করার চেষ্টা করেন।তারপর, মনে হতেই মুখে হাসি ফুটে।তিতলিকে ছেড়ে দু’হাতে নিঝুমের দু’গালে হাত রেখে বলেন,
— “তু-তুই আমার নিঝুম?”
নিঝুম হেসে মাথা নাড়ায়। শাহেদ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। সেই ছোটবেলা দেখেছিলো ছেলেটাকে। ক্লাসে একমাত্র নিঝুমই মনোযোগ সহকারে পড়তো।সব কথা শুনতো।খুবই ভদ্র ছিল। আর ছুটি শেষে উনার সাথে অনেকক্ষণ থাকতো। তারপর একদিন চলে গেলো অনেক দূরে!তিনি জড়িয়ে ধরেন নিঝুমকে।কেঁদে দেন।ভেজা গলায় অভিযোগ করেন,
— “ভুলেই তো গেছিলি।এতোদিনে আবার মনে পড়লো না?”
নিঝুম এক হাতে কানের লতি ধরে বললো,

— “ভেরি, ভেরি দুঃখিত।”
শাহেদ হাসেন।ক্লাসে যেদিন দুষ্টুমি করতো নিঝুম তিনি শাস্তি দেওয়ার জন্য দাঁড় করালে নিঝুম ঠিক এভাবেই বলতো, ভেরি, ভেরি দুঃখিত।শাহেদ জিজ্ঞাসা করেন,
— “কি করছিস এখন?”
— “আপনার কি হার্টে সমস্যা আছে?”
শাহেদ কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করেন,
— “কেনো?”
— “আমি ঠিক করে দিতাম আর কি।”
নিঝুমের ঠোঁটে চাপা হাসি।শাহেদ সেকেন্ড কয়েক ভাবেন নিঝুমের কথার মানে।এরপর হেসে বলেন,
— “তুই ডাক্তার?হার্টের?”
নিঝুম মাথা নাড়ায়।শাহেদ ভারি হবাক হবার ভান করে বলেন,
— “আলহামদুলিল্লাহ!জানতাম,বড় কিছু হবি তুই।আর বাঁদরটার কি অবস্থা?”
— “নির্জনও ডাক্তার।”
— “সত্যি নাকি? ওর তো পড়ায় মনই ছিলোনা।”
— “তারপর হয়েছে।আসলে,বাবার মার খেয়ে ইচ্ছে হয়েছে পড়ার!”

নিঝুমের সাথে শাহেদ, তিতলিও হাসে।তিতলি হা করে নিঝুমের হাসি গিলছে।কথা বলার ভঙ্গি মুখস্থ করে নিচ্ছে।তখনি গেইট খোলার আওয়াজ হয়। তিনজন তাকায়।একজন মহিলা,আর একটা মেয়ে এসে ঢুকে।ওরা দুজনও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।তিতলির মনটা তেতো হয়ে আসে সৎ মা’কে দেখে।তিতলির আব্বুও ভ্রু কুঁচকে ফেলেন।তিনি প্রতিটি সেকেন্ডে আক্ষেপ করে যাচ্ছেন,কেনো রাগের বশে দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘরে কালসাপ আনলেন।তিথিয়া দৌড়ে এসে তিতলিকে জড়িয়ে ধরে।বললো,

— “কেমন আছিস? তোকে খুব মিস করেছি।”
— “আমিও আপু।”
তিতলির সৎ মা প্রশ্ন করেন,
— “ছেলেটা কে?”
শাহেদ বলেন,
— “ও নিঝুম।আলতাফের ছেলে।”
— “ওহ।”
তিনি কথা শেষ করে ঘরে ঢুকেন। উপস্থিত সবাই এতে বিরক্ত হয়। নিঝুম ভাবে,নূন্যতম ভদ্রতাও নেই মহিলার ভেতর। তিতলি ঠিকই বলেছে। এতোটা দিন এই মহিলার সাথে কাটালো কেমনে?
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চারজন উঠোনে বসেছে চেয়ার নিয়ে।নিঝুমের হাতে পেয়ারার ঝুড়ি।
তিতলি বাবা আর বোনের সাথে খোশ গল্পে মেতে উঠেছে। নিঝুম তিতলির হাসি হাসি মুখ দেখছে আর পেয়ারা খাচ্ছে।একসময় তিথিয়া তিতলিকে নিয়ে বাড়ির পিছনের দিকে চলে যায়।ওরা যেতেই শাহেদ খপ করে নিঝুমের দু’হাত চেপে ধরেন।শাহেদের হঠাৎ আক্রমণে নিঝুম থমকায়।প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায়। শাহেদ ভেজা কণ্ঠে বলে,

— “আমার মেয়েটারে তোদের হাতে দিয়েছি।একটু দেখে রাখিস বাপ।ওর যে আর কেউ নেই।মেয়েটা আমার একা বড় হইছে।নিজের মতো জগত বানিয়ে।”
নিঝুম স্বান্তনা দিয়ে আদুরে গলায় বলে,
— “আপনি চিন্তা করবেন না।তিতলি আমাদের কাছে খুব ভালো থাকবে।”
শাহেদ একটু চিন্তামুক্ত হলেন।নিঝুমের হাত দুটি ছেড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।নিঝুম আচমকা প্রশ্ন করলো,
— “তিতলি ছোট।মানে আপনি যখন দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তখন ওর আম্মু জীবিত ছিলেন।তাহলে, কেনো বিয়ে করলেন? ব্যাক্তিগত প্রশ্ন জানি!কিন্তু অনেকদিন ধরে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে মনে।আর আপনার সাথে আমার সম্পর্কটা ছোট থেকেই খুব ভালো।তাই প্রশ্নটা আম্মু, আব্বুকে না করে আপনাকেই করলাম।”
শাহেদ থমকান।হাঁসফাঁস করতে থাকেন।নিঝুম পরিস্থিতি অস্বাভাবিক দেখে বলে,
— “বলতে কোনো বাধা থাকলে বলতে হবে না চাচ্চু।”
শাহেদ নির্লিপ্ত চোখে তাকান।বলেন,
— “বলবো।অনেকদিন কাউকে বলা হয় না।”
নিঝুম কৌতূহল নিয়ে তাকায়।শাহেদ বলেন,

— “তিতলির আম্মু ছিলো আমার প্রেমিকা।ভালবেসে বিয়ে করি।বিয়ের কয়েক বছর পার হয়ে যায় বাচ্চা হয়না।সমাজ,পরিবার নানা নিন্দা কথা বলতে থাকে।আর তিতলির আম্মুও আমাকে কথা শুনাতো।কেনো করছিনা আরেকটা বিয়ে।প্রত্যেকদিন বাসায় এসে তিতলির আম্মুর বিয়ে করো, বিয়ে করো কথাটা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা শুরু হয়ে যেতো।আবার,আমার মা-বাবাও তাই বলতেন।একদিন এ নিয়ে খুব ঝগড়া হয় তিতলির মায়ের সাথে। কি করে নিজের স্বামীকে আরেকটা বিয়ের চাপ দিতে পারে কোনো নারী?বের হয়ে যাই বাড়ি থেকে।রাগের বশে করে ফেলি দ্বিতীয় বিয়ে।”
শাহেদ সেকেন্ড দুয়েক নিশ্চুপ থাকেন।তারপর আবার বলেন,

— “আমি তিতলির মা’কে ডাকতাম সোনা বউ বলে।সেটা তো তুই জানিস।তোর সামনেই ডেকেছি।ও লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো।আমাকে একদম সহ্য করতে পারতোনা অন্য নারীর সাথে।আমি দেখতাম,বুঝতাম।কিন্তু কিছু করার ছিলনা।যতটা পারি আমি আমার ওর পাশে থাকতাম।বিয়ের ছয় মাস পরই তিথিয়া পেটে আসে।তিথিয়ার যখন ১ বছর তখন তিতলি আসে পেটে।কিন্তু, তিতলির মুখটা দেখতে পারেনি ওর মা।তার আগেই…।”
শাহেদ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।নিঝুমের চোখ দু’টো জ্বলছে।কি বলে স্বান্তনা দিবে তার যোগ্য ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা সে।’আসি’ বলে সরে যায় সে সেখান থেকে।শাহেদ অনেকক্ষণ কাঁদেন।তিনি মাঝে মাঝেই এমন হাউমাউ করে কাঁদেন।যখনি মনে হয় তিতলির মায়ের কথা। খুব ভালবাসতেন মানুষটাকে।হূর পরী ছিল মানুষটা। নিঝুম আবার ঘুরে আসে।ডাকে,

— “চাচ্চু?”
শাহেদ চোখ তুলে তাকান।নিঝুম থমথমে গলায় বললো,
— “কাঁদবেন না প্লীজ।”
শাহেদ চেয়ার ছেড়ে নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন।নিঝুম কি বলবে, কি করবে বুঝতে পারছেনা।তবে,বুঝতে পারছে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে।ভালবাসা হারানোর কষ্টটা কতটা গভীর নিজ চোখে দেখে উপলব্ধি করতে পারছে।বুঝতে পারছে,সত্যিই নিশাকে সে কখনো ভালোই বাসেনি।ভালবাসা হারায়না কখনো। আত্মার সাথে মিশে থাকে।ভালবাসা চিরস্থায়ী! ক্ষণিকের জন্য নয়।

দুজনই ক্লান্ত খুব।গোসল করলে শরীরে প্রশান্তি আসতে পারে।তিতলির কাপড় আছে,কিন্তু নিঝুমের তো নেই।এখন কীভাবে গোসল করবে! তার সমাধান দেন শাহেদ।লুঙ্গি একটা হাতে নিয়ে বলেন,
— “এইটা পরে গোসল করে নে।”
নিঝুম কখনো লুঙ্গি পরেনি।চা,বাগানে পরতে হয়েছিল।তার মতে,লুঙ্গি একটা অশ্লীল অবাধ্য কাপড়।রাতে পরে ঘুমালে সকালে লুঙ্গি জায়গায় থাকেনা।কই জানি হানিমুন করতে চলে যায়!তাই শাহেদের কথা শুনে একটু ইতস্তত হয় নিঝুম।তারপর হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে লুঙ্গি নেয়।তিতলি নিঝুমকে গোসলখানায় নিয়ে আসে।নিঝুম ভ্রু হালকা কুঞ্চিত করে বলে,

— “গ্রামে এসেছি।পুকুরে গোসল না করলে কি চলে?পুকুর বা নদী নাই?”
— “হুম আছে।নদী একটু দূরে।তবে,১২ টা সিঁড়ি বেয়ে একটা পুকুর আছে আমার।পুকুরটার একটা নাম ও আছে।রূপরাঙা।”
— “তোমার?” অবাক হবার ভান করে বললো নিঝুম।
— “হুম আমার।আমার জন্য বাবা করেছেন।”
নিঝুম ঢং ধরে বলে,
— “ওহ তাই।তো,আপনার পুকুরে কি আমি গোসল করতে পারি? অনুমতি দিবেন? আর একটু দেখিয়ে দিবেন?”
নিঝুমের কথা বলার প্রকাশভঙ্গি দেখে তিতলি ফিক করে হেসে উঠে।তিতলির হাসি দেখে নিঝুমের ঠোঁটেও হাসি ফুটে। তিতলি নিঝুমকে নিয়ে আসে বাড়ির পিছনে।নিঝুম মুগ্ধ হয় চারপাশ দেখে।ছোট ফুলের বাগান।তার সামনে পুকুর।পুকুরের চারপাশে বড় বড় গাছ।আর পুকুরটা ঘিরে রাউন্ড দেয়াল।

— “তোমারও ফুলের বাগান আছে?”
তিতলি হেসে বলে,
— “হুম।আর এখানে যত ফুল, সব আমি লাগিয়েছি।আপনার ছাদ প্রথম দিন দেখে আমি এতো খুশি হয়েছিলাম।”
— “দেখেই বুঝা যাচ্ছে।এই সাজানো বাগানটা কার হাতে সাজানো!”
তিতলি মুচকি হাসে।
মৃদু বাতাস বইছে।দুজন মানুষের শরীর, মন এক ভালোলাগার পরশে তলিয়ে যাচ্ছে।আজও বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।আকাশ কালো।নিঝুম হুট করেই আবদার করে,
— “তিতলি গান ধরো।”
তিতলি কপাল কুঁচকে তাকায়।

— “মামার বাড়ি আবদার? যখন, তখন গান গাইতে বলবেন?”
— “খুব কি বড় আবদার?”
তিতলি হাসে।পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক দৃষ্টি নিয়ে।দু’তিনটা পাখি উড়ছে।গাছে বসেছে।ফুলের গাছগুলোও বাতাসে মৃদু নড়ছে।সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গান ধরে,
যাও পাখি বল, হাওয়া ছল ছল
আবছায়া জানলার কাঁচ
আমি কি আমাকে, হারিয়েছি বাঁকে
রুপকথা আনাচে -কানাচ
আঙুলের কোলে জ্বলে জোনাকি
জলে হারিয়েছি কান শোনা কি?
জানলায় গল্পেরা কথা মেঘ
যাও মেঘ চোখে রেখো এ আবেগ
যাও পাখি বল, হাওয়া ছল ছল
আবছায়া জানলার কাঁচ
আমি কি আমাকে হারিয়েছি বাঁকে
রুপকথা আনাচে -কানাচ ……

নিঝুম প্রকৃতি থেকে চোখ সরিয়ে তিতলির দিকে তাকায়।চুল হাত খোঁপা করা।লাল রঙের বাঁকা কয়টা চুল মুখের উপর ছড়িয়ে আছে।মৃদু বাতাসে মৃদু দুলছে।তিতলির নিচের ঠোঁটের তুলনায় উপরের ঠোঁট ফুলে থাকে।গোলাপি আভা ঠোঁটে।সেই ঠোঁট নাড়িয়ে বিভোর হয়ে গান গাইছে।তিতলি গান শেষ করে তাকায়।চোখভর্তি তাঁর কাজল।নিঝুম বিভ্রম নিয়ে বলি,
— “এদিকে আসো।”

তিতলি ভড়কে যায়।নিঝুম বলে,
— “কবিতা শুনাবো এদিকে আসো।”
তিতলি বাক-বাকুম হয়ে কাছে এসে দাঁড়ায়।নিঝুম একটু ঝুঁকে কণ্ঠে মাদকতা নিয়ে বলে,
” শুনছো কেশবতী?
শুনছো বুকের ধুকধুকানি?
প্রেমে পড়ার ছটফটানি?
প্রথম প্রেমের আগুন শিখায়
মরছি পুড়ে যেথায়-সেথায়। ”
তিতলি অবাক হয়ে তাকায়।নিঝুমের উত্তাপ নিঃশ্বাস ওর কপালে এসে ঠেকছে।নিঝুম বলছে,
” কাজল চোখের মায়াবিনী,
দেখছো? কেমন করে আকুল হয়ে,
দহন জ্বালে কাতর আমি। ”
তিতলি চোখ নামিয়ে ফেলে।হাত পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে।বুক উত্তাল ঢেউ বইছে।নিঝুম বলেই যাচ্ছে,
” তুমিবিহীন ঝাপসা শহর
অনুভূতি শীতল ভীষণ
শুনছো লাজুকলতা? শুনছো তুমি? ”

তিতলি গুটিগুটি পায়ে দাঁড়ায়।শরীর কাঁটা কাঁটা হয়ে যায়। কি হয়েছে উনার? কণ্ঠ এমন কেনো?
নিঝুম তিতলির দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে।তিতলিকে তাঁর সাদা কবুতরের বাচ্চা মনে হচ্ছে।তার উপর পরেছে কালো জামা।এতোটা গভীর ভাবে সে কখনো কাওকে দেখেনি।এই প্রথম তিতলিকে!আর মনে,উঁকি দিচ্ছে অন্যায় বাসনা।
আচ্ছা,সাদা-সুন্দরী মেয়েদের কালো জামা পরে ছেলেদের সামনা আসা অন্যায় তা কি জানেনা তিতলি? নিঝুমের ঘোর লেগে আসে।যেনো সে এই মুহূর্তে অন্য কোনো জগতে চলে এসেছে।

তিতলি চোখ তুলে তাকায়।নিঝুম নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার উপর। কয়েকটা মুহূর্ত পার হয়ে গেছে।মানুষটা নড়ছেই না।ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।তিতলির সারামুখে লজ্জা এসে ভীর জমায়।মাথা নত করে।লজ্জায় হাসি ফুটে উঠছে বার বার ঠোঁটে।ঠোঁটের হাসি হাসি ভাবটা আটকানো যাচ্ছেনা।কি এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে!তিতলির হাঁসফাঁস লেগে যাচ্ছে।মানুষটাকে কি জিনে ধরেছে?তিতলি মাথা নত করে পাশ কেটে চলে যেতে নিলে নিঝুম তিতলির হাতে ধরে টেনে সামনে নিয়ে আসে।তিতলি হতভম্ব হয়ে যায়।স্তব্ধ হয়ে যায়।সচকিত হয়ে যায়। নিঝুম লুঙ্গিটা কাঁধে রেখে অন্য হাতে তিতলির খোঁপা খুলে চুল মুক্ত করে দেয়।তিতলি হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। বুকে ধরাস ধরাস কিছু একটা পড়ছে! নিঝুমের কি হলো,তা তিতলির ছোট মাথায় ঢুকছেনা।কিন্তু চোখগুলোতে যেনো কি একটা!

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৪

— “কি?” তিতলির গাঢ় নিবিড় গলা।
নিঝুম তিতলির কথা শুনে তিতলির হাত ছেড়ে দেয়।নিজেকে স্বাভাবিক করতে তিতলির সামনের জায়গাটুকুতে কয়বার পায়চারি করে।তারপর জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলল,
— “কিছুনা।”
তারপর আবার উত্তেজিত হয়ে বললো,
— “এই তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? আর বেশিক্ষণ থাকলে কিছু একটা হয়ে যাবে।”
তিতলি ভড়কে যায়।থমথমে গলায় বলে,
— “কি,কি হবে?”
— “আমি কামড়ে দেবো তোমাকে।”
তিতলি আর্তনাদ করে উঠে,
— “কিহ।”
নিঝুম গটগট করে পুকুরের পানিতে নেমে আসে।

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৬