প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৬

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৬
ইলমা বেহরোজ

নিঝুম পুরো বাড়ির এদিক-ওদিক ঘুরে দেখতে থাকে।তিতলির সৎ মা রোমেনা কিছুতেই তিতলি আর নিঝুমের উপস্থিতি যে নিতে পারছেন না তা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।নিঝুম তিতলির রুমটা খুঁজে খুঁজে বের করে।তিতলি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজেকে দেখছিল।আর মিটমিট করে হাসছিল নিঝুমের কথা ভেবে।কিছুক্ষণ আগের মুহূর্তটা ভাবাচ্ছে খুব।তাঁর মনে হচ্ছে, কবিতাটা নিঝুম ওর উদ্দেশ্যেই বলেছে। পর পরই আবার প্রতিবাদ করে উঠে নিজেকে, আমার জন্য কেন বলতে যাবেন।দূর।
তিতলি চিরুনি হাতে নেয়।তখন মনে হয়, দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে।তিতলি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।নিঝুম হাসে।তিতলি উঠে দাঁড়ায়।বলে,

— “কিছু দরকার?”
নিঝুম তিতলির রুম দেখতে দেখতে বলে,
— “দরকার তো কত কিছুই।”
— “কি?”
নিঝুম তিতলির বিছানার উপর বসে।বলে,
— “কিছুই না।”
— “মাত্র বললেন,কি জানি দরকার।”
— “ভুলে গেছি।”
তিতলি ভারী অবাক হয়।বলে,
— “কি বলছেন?আগা-মাথা নাই।”
নিঝুম প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে।স্ক্রিনে মনোযোগ দিয়ে বলে,
— “কি করছিলে কর।তুমি আমার রুমে গিয়ে বসে থাকতে।এখন আমি তোমার রুমে বসে থাকবো।”
তিতলি হেসে ফেলে।চেয়ারে বসে চুল আছড়াতে থাকে।নিঝুম বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “এতো লম্বা ঘন চুল সামলাও কীভাবে?”
— “গরমকালে গরমটা বেশি লাগে।আর আছড়াতে কষ্ট।এইটুকুই।”
নিঝুম ফোন বিছানার উপর রেখে উঠে আসে তিতলির দিকে।বলে,
— “দাও তো চিরুনি। দেখি আছড়াতে পারি নাকি।”
তিতলি হকচকিয়ে গেল।
— “কার চুল আছড়াবেন?”
— “অবশ্যই তোমার চুল।”

তিতলি ভেতরে ভেতরে শিহরিত হয়।নিঝুম তিতলির অনুমতি ছাড়াই চিরুনিটা ছিনিয়ে নেয়।তিতলি নির্বাক।নিঝুম তিতলির চুল আছড়াতে থাকে।তিতলি চুপসে যায়।মানা করার সাহস পাচ্ছে না।নিঝুম আয়নার দিকে তাকায়।তিতলি চোখ বুজে রেখেছে।নিঝুমের মন আকস্মিক ভেবে নেয়, তিতলি তাঁকে অন্য চোখে দেখে!তখনি কারো পায়ের শব্দ আসে কানে।তিতলি চট করে দূরে সরে দাঁড়ায়।রোমেনা আসে।চোখে – মুখে বিরক্তি নিয়ে বলে,
— “কিছু দরকার মেহমানের?”
নিঝুম হেসে জবাব দেয়,

— “জ্বি না।”
রোমেনা যেতেই নিঝুম তিতলির দিকে এগিয়ে আসে।চুল আছড়িয়ে দিতে।তিতলি তাঁর আগে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যায়।নিঝুম হতবাক।আয়নার দিকে তাকায়।চিরুনিটা দিয়ে নিজের চুল আছড়ায়।এরপর কি মনে করে, চিরুনিটা গেস্টরুমে নিয়ে আসে।ব্যাগপ্যাকে রেখে দেয়।এরপর নিজে নিজে বিড়বিড় করে,
— “আমি কি চুরি করলাম?”
এরপর নিজেই হেসে উঠলো।

শাহেদের মনটা বড্ড খারাপ।ভেবেছিলেন মেয়ে থাকতে এসেছে।কিন্তু না, চলে যাবে।রেখে দিতেন একদিন।কিন্তু নির্জনের বিয়ে শুনে ছেড়ে দেন।নিঝুম জোর করেছিলো শাহেদকে সাথে নিতে কিন্তু তিনি আসেন নি।বাড়ির গেইট থেকে বের হয়ে হাঁটা শুরু করে ওরা।এদিকটায় গাড়ি পাওয়া যায়না।বাজারে গিয়ে নিতে হবে।নিঝুম খেয়াল করে তিতলি মুখ ওড়না দিয়ে ঘুরে হাঁটছে। নিঝুম জিজ্ঞাসা করে,

— “তিতলি,কোনো সমস্যা? মুখ ঘুরলে কেনো?”
তিতলি ছোট করে বলে,
— “এমনি।”
— “মুখ থেকে হাত সরাও।”

ধমকের স্বরে বললো নিঝুম।তিতলি ধমক শুনে বাধ্য হয়ে মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়।তবে মাথা নত করে রাখে।নিঝুম তিতলির এমন চুপসে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পারলো না।সন্ধ্যার আযান পড়ছে।রাখালরা গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছে।অনেকে নিজ কাজ থেকে বাড়ি ফিরছে।তেমনি পথচারী দুজন গলার জোর বাড়িয়েই একজন আরেকজনকে বলতে শোনা যায়,
— “তিতলি না মাইয়াডা?সাথে পোলাডা কেডা?”
অপর জন জবাব দেয়,

— “হইবো হইতো অন্য আরেকটা নাগর।নইলে আগের নাগরই।যার লগে পলাইছিলো।”
কথাগুলো নিঝুম-তিতলি দুজনেরই কানে আসে।নিঝুমের মেজাজ মুহূর্তে পাল্টে যায়।ঘুরে দাঁড়ায় কথা শুনাতে।তিতলি খপ করে নিঝুমের হাতে ধরে ফেলে।চোখের ইশারায় ‘না’ করে।নিঝুম চোখ গরম করে তাকায়।দুজন পথচারী জহুরি চোখে দেখছিল।নিঝুমকে এভাবে তাকাতে দেখে ভয় পেয়ে যায়।নিঝুমের মধ্যে একটা সাহেব,সাহেব ভাব যা আছে। যা গ্রামের দুজন পথচারীকে ভয় পেতে বাধ্য করে।দ্রুত জায়গা ত্যাগ করে।নিঝুম তিতলিকে রাগ নিয়ে বলে,

— “এসব সহ্য করো কেন?”
— “আর কি করব? ”
— “শাহেদ চাচ্চু কিছু বলেন না?”
— “বাবার সামনে কেউ কিছু বললে অনেক অশান্তি হয়।”
— “তুমি এমন বিড়াল হয়ে কেন থাকো?”

তিতলি নিশ্চুপ। নিঝুম আর কিছু বলে নি। বাজারে এসে সিএনজি নেয়।কুমিল্লা ট্রেন ষ্টেশন যেতে।
রাত ১০ টা।জলপ্রাতের মতো বৃষ্টি হচ্ছে।প্লাটফর্মের মাঝ বরাবর তাঁরা দুজন দাঁড়িয়ে আছে।সন্ধ্যা সাত টায় ষ্টেশনে চলে আসে।এসে শুনে, ট্রেন ছাড়বে রাত ১১ টায়।এই তিন ঘন্টা এদিক-ওদিক ঘুরে কাটিয়েছে।কিন্তু হঠাৎ করে প্রবল বৃষ্টি।শিলা পড়া বৃষ্টি!দৌড়ে এসে দুজন প্লাটফর্মে দাঁড়ায়।বাতাস বইছে প্রবল।তিতলি রীতিমতো শীতের প্রকোপে কাঁপছে। নিঝুম ভ্রু-জোড়া হালকা কুঁচকে তিতলির খোঁপা খুলে দেয়।বলে,
— “এতো ঘন চুল থাকতে শীতে কাঁপতে হয়?ছেড়ে দিলেই পিঠ গরম হয়ে যায়।”
উত্তরে তিতলি কিছু বলেনি।নিঝুমের নিজেরও শীত করছে!হাত ঘষছে অনেকক্ষণ ধরে।তিতলির দিকে তাকায়,দেখে তিতলি খুব কাঁপছে।সে তিতলির পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়।নিঝুমের হাতের ছোঁয়া পেয়ে তিতলি কেঁপে উঠে।নিঝুম এক হাত তিতলির হাতের বাহুতে রেখে,টেনে নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসে।তিতলি স্তম্ভিত!ঢোক গিলে মিনমিনে গলায় বললো,

— “কি?”
— “কিছুনা।আমারো ঠান্ডা লাগছে অনেকক্ষণ যাবৎ, তোমারও তাই। ভাবলাম,জড়িয়ে ধরলে দুজনেরই ঠান্ডা কমবে!”
নিঝুমের শান্ত গলা।যেন সে নিজের বউকে জড়িয়ে ধরেছে।কন্ঠে প্রবল আত্মভাব।তিতলি নিঝুমের মুখ দেখতে পাচ্ছেনা।তাঁর মাথা নিঝুমের বাম বুকে।সে খুশিতে ডগমগ!শীতের উছিলায় নিঝুমের বুকে জায়গা পেলো।এ যেন মেঘ না চাইতেই জল!কিন্তু তারপরই, মনটা মলিন হয়ে আসে।তিতলি ভাবে,
উনার সাথে তো প্রেম নেই? উনি আমার স্বামীও না।আর উনিতো আমাকে ভালোও বাসেন না।তাহলে, জড়িয়ে ধরলেন কেনো?শীত লাগলে কি সব মেয়েদেরই এমনে বুকে টেনে নেন?

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৫

তিতলি নিঝুমের থেকে ছুটে যেতে চাইলে নিঝুম যেন আরো গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে।তিতলি বুঝতে পারছে না মানুষটা কিসের এতো অধিকার দেখাচ্ছে?নিঝুম মিটমিট করে হাসছে।তিতলি কে জ্বালাতে এতো বেশি আনন্দ পাচ্ছে সে।
ট্রেন ছেড়ে দিবে কিছুক্ষণের মধ্যেই!দুজন নিজেদের কামরায় এসে অবস্থান নেয়।কামরার দু’পাশে লম্বা দু’টো বার্থ।একটা বার্থ একদম জানালার পাশে।আরেকটা,জানালার চেয়ে একটু পিছিয়ে।তিতলি,আগে-আগে দৌড়ে গিয়ে জানালার সামনে বসে পড়ে।ঝাপটা হাওয়ার তোড়ে নিশ্বাস আটকে যাবার উপক্রম হলো তাঁর।নিঝুম,হালকা হেসে দরজা লাগিয়ে অপর সাইটের বার্থের একদম কর্ণারে বসে।জানালা থেকে অনেক দূরে।নিঝুম,ব্যাগপ্যাক থেকে সেন্টার ফ্রুট বের করে।দু’টো এগিয়ে দেয় তিতলির হাতে।তিতলি খুশি হয়ে বলে,

— “থ্যাংকু।”
উত্তরে নিঝুম হাসে।তিতলি নিঝুমের দিকে চোখ রেখেই সেন্টার ফ্রুট মুখে পুরে।নিঝুমের ঠোঁটে সবসময় সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে ফুটে থাকে হাসি।চারিদিক তখন আলোড়িত হয় যেন।আর তিতলির হৃদয় হয় খান-খান!নিঝুম তাকাতেই তিতলি চোখ সরিয়ে নেয়।নিঝুমের খটকা লাগে।তিতলি কেনো তাকে লুকিয়ে দেখে?

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৭