প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৭

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৭
ইলমা বেহরোজ

ট্রেন চলছে তার সর্বোচ্চ গতিতে।কামরার বাতি নিভানো।চলন্ত ট্রেনের আওয়াজ চারিদিকে।জানালা দিয়ে সাঁ সাঁ করে ঢুকছে বাতাস।তিতলি চোখ বন্ধ করে বাতাস উপভোগ করছে।নিঝুমের চোখ স্থির হয়ে আছে তিতলির উপর।চোখ বন্ধ করে রেখেছে তিতলি, ঠোঁটে হাসি।হাসির তেজে গাল দু’টো ফুলে রয়েছে।বাঁকা সবগুলা চুল উড়ছে।সিনেমার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এই দৃশ্য!প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করতে গিয়ে নিঝুমের মনে হলো একটা কথা।মোহনা প্রেম করেনা।কিন্তু,ও সবাইকে বলতো প্রেম করে।এমনকি,এখনও বলে।ও চায়না কেউ ও’কে প্রপোজ করুক।ও চায় ওর স্বামী আগে প্রপোজ করুক।এটা নিয়ে মোহনার সাথে কথাও হয়েছিলো!আচ্ছা,এমনটা কি তিতলির বেলা হতে পারে?আসলে,অর্নব-টর্নব সব ভুয়া!নিঝুমের মুখে খুশির বিজলি চমকায়! তিতলির মুখ থেকে কথা বের করতে নিঞ্জা টেকনিক ব্যবহার করে।
চড়া গলায় তিতলিকে ডাকলো,

— “তিতলি?”
তিতলি খানিকটা চমকায়।ঘুরে তাকায়।তারপর ঢোক গিলে বলে,
— “জ্বি?”
— “মিথ্যে কেন বললে আমায়? এতো সাহস কীভাবে হলো?”
তিতলি ভয় পেয়ে যায়। এমন রাগে কথা বলছেন কেন উনি?তিতলির চুপসে যাওয়া মুখ দেখে নিঝুমের দম ফেটে হাসি আসে।কিন্তু,হাসি বের করলে তো চলবেনা! নিঝুম গলাটা আরো ভারী করে বললো,
— “তোমার গ্রামে অর্নব নামে তো কেউ নেই!আর তোমার গ্রাম থেকে কেউ কখনো আমেরিকা যায়নি।তোমার আব্বুই বললেন!তুমি মিথ্যে কেন বললে?”
তিতলি ভারি অবাক চোখে তাকায়।অস্পষ্ট ভাবে বলে,
— “আপনি কি বলেছেন বাবাকে?”
— “কি আর?বলেছি আপনার মেয়ে নাকি অর্নব নামে একটা ছেলেকে ভালবাসে।এখন,সে আমেরিকা থাকে।আগে গ্রামে থাকতো।খোঁজ নিয়ে মেয়ের বিয়ে দেন।”
তিতলির মুখটা ‘হা’ হয়ে যায়।আর্তনাদ করে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “কি করলেন আপনি? আব্বু এখন আমাকে কি ভাবছে আল্লাহ মাবূদ জানেন!আমিতো অর্নব নামে কোনো মানুষই দেখিনি জীবনে।”
নিঝুমের সন্দেহটাই ঠিক।নিঝুম কয়েক সেকেন্ড তিতলির চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকে।তারপর,মাথা চুলকিয়ে হাসে।তাঁর তিতলি কাওকে ভালবাসেনা! খুশি যেনো উপচে পড়ছে।বুকে প্রশান্তভাব চলে এসেছে!নিঝুম কিছু বলার পূর্বে তিতলি আক্ষেপ করে বললো,
— “কেনো এমন করলেন।দূর,আমারই দোষ কেন মিথ্যে বললাম!”
— “বেশ হয়েছে।মিথ্যে বললে এমনই হয়।” নিঝুমের বিদ্রুপ।
তিতলির চোখে জল টলমল করছে।তা দেখে নিঝুমের বুক ব্যাথিত হয়।গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে নিঝুম বললো,
— “তিতলি,আমি তোমার আব্বুকে কিছু বলিনি।নিঞ্জা টেকনিক বুঝো? সেই টেকনিক ছিলো এইটা! আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম,তোমার বিএফ হতেই পারেনা!”

কালো ফ্রেমে বানানো চশমার আড়ালে নিঝুমের দুষ্টু চোখগুলো স্পষ্ট ভেসে উঠে।তিতলির চোখ দু’টো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো।রাগে ফেটে উঠে সে।দাঁত কটমট করে।মনে মনে, হাজারটা গালি দেয় নিঝুমকে।নিঝুম চোখের চশমাটা খুলে শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
— “মনে মনে গালি দিতে হবেনা।সামনে আছি মুখ ফুটেই দাও।”
তিতলি ভড়কে যায়।নিজেকে স্বাভাবিক করে থমথমে গলায় বলে,
— “আমি কাওকে গালি দেইনা।”
— “ভালো।ভালো।”

তিতলি আড়চোখে নিঝুমকে দেখে। শার্ট খুলছে।নিঝুম শার্ট খুলে তিতলির দিকে তাকাতেই তিতলি চোখ সরিয়ে নেয়।নিঝুম ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকায়।তারপর, উঠে দাঁড়ায়।প্রেমে পড়ে যেন সে কিশোরে ফিরে এসেছে।সারাক্ষণ মাথায় দুষ্টুমি! নিঝুম তিতলির দিকে এক পা এক পা করে এগুতে থাকে।তিতলি, ব্যাপারটা উপেক্ষা করতে পারেনি।ভীতু চোখে নিঝুমের দিকে তাকায়।নিঝুম ইচ্ছে করে, ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলে।তিতলির বুকে ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে।হেঁচকি উঠে!হুট করেই যেন মনে হচ্ছে,নিঝুমের চরিত্রে দোষ আছে।সারাদিন কেমন গা ঘেঁষে ঘেঁষে ছিল!নিঝুম তিতলির কাছে এসে দাঁত বের করে হাসে।তারপর,শার্ট টা জানালায় রাখে।বলে,

— “এক পাশ ভিজে গেছে।বাতাসে শুকিয়ে যাবে। একটু ধরে রেখো যেনো উড়ে না যায়।আর, তোমার ব্যাগে পানির বোতল আছে।বের করে পানি খাও।”
তারপর নিজ বার্থে এসে বসে।তিতলি জোরে নিঃশ্বাস ফেলে।সে কি ভেবেছিলো আল্লাহ!
— “তোমার কাছে পাওয়ার ব্যাংক হবে?”
— “হুম হবে।”
তিতলি ব্যাগের চেইন খুলে পাওয়ার ব্যাংক বের করে নিঝুমকে দেয়।নিঝুম পাওয়ার ব্যাংকের সাথে ফোন যুক্ত করে।এরপর তিতলিকে বলে,
— “এতো বড় ব্যাগ নিয়ে আসছো বাড়ি থেকে।আর বইতে তো আমাকেই হচ্ছে।”
— “আমি কি আপনাকে বলেছি আমার ব্যাগের ভার নিতে?আপনিই তো ইচ্ছে করে….”
— “ব্যাগে কি আছে?”
— “শুধু কাপড়।”
— “খাবার-টাবার নেই নাকি? আমি খাবনা।এমনি জিজ্ঞাসা করছি।সত্যিটা বলে দাও।”
— “দূর,আপনি কেমন জানি করেন।”

নিঝুম সবকটি দাঁত বের করে হাসে।গালে হয় গর্ত!এরপর তিতলির সম্মুখ বরাবর এসে বসে।ফোনে মনোযোগ দেয়।তিতলি অনেকক্ষণ বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে থাকে।একসময় বিরক্তি লেগে যায়।নিঝুমের সাথে কথা বলতে নিঝুমের দিকে তাকায়।দেখে,নিঝুম শুয়ে আছে।ঘুমিয়েও গেছে!
গভীর রাত।মানুষের কোনো সাড়া-শব্দ নেই।বাতাস আর ট্রেনের শব্দ ছাড়া।সাথে,একটা বাচ্চার কান্নাও শুনা যাচ্ছে।পাশের কোনো কামরা থেকে আসছে ।
তিতলি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিঝুমের বুকে-বাহুতে!দেখতে সুপুরুষ, সুদর্শন, দীর্ঘ গড়ন।লাবণ্যময় মুখমণ্ডল।তিতলি চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে,

— “এর আগে দু’বার পাগলামি করেছি।আর না।”
তিতলি না চাইতেও আবার তাকায় নিঝুমের বস্ত্রহীন বুকে।জোরে শ্বাস নিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।কিন্তু আবারো…কি যে হচ্ছে!তিতলি নিজের উপর বিরক্ত হয়ে উঠে।ব্যাগ থেকে একটা বড় ওড়না বের করে। হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে নিঝুমের কাছে।তারপর, নিঝুমের বস্ত্রহীন গা ঢেকে দেয়।তিতলির চুড়ির টুংটাং আওয়াজে নিঝুমের ঘুম ছুটে যায়।তড়িঘড়ি করে উঠে বসে।তিতলি চমকে উঠে।আমতা আমতা করে বলে,
— “খুব বাতাস তো ভাবলাম আপ…আপনার বুঝি ঠান্ডা লাগছে।”
নিঝুমের মোটেও ঠান্ডা লাগছিলো না।তিতলির ওড়না গায়ে দেওয়ার আশায় তিতলিকে সমর্থন করে,
— “হুম।ঠান্ডা টা বেশিই লাগছে।”
তিতলি ওড়না দিয়ে বার্থে এসে বসে।নিঝুম প্রশ্ন করে,

— “ঘুম পাচ্ছেনা?”
— “না!”
— “সারাদিন ঘুমালে এমনই হবে।”
তিতলি নিশ্চুপ।নিঝুম বলে,
— “একটা বালিশ হবে?”
তিতলি অবাক হবার ভান করে বলে,
— “বালিশ কই পাবো?”
— “হুম তাইতো।”
নিঝুম থামে।তারপর আবার বললো,
— “বালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারিনা বুঝলে।”
তিতলির যেন মায়া হলো।মুখ ফসকে বলে ফেলে,
— “আপনি আমার কোলে মাথা রাখতে পারেন।”

নিঝুমতো এরকম কিছুই চাইছিলো।কিছু না ভেবে সে দ্রুত চলে আসে তিতলির পাশে।তারপর তিতলির কোলে মাথা রেখে দু’হাতে তিতলির কোমর জড়িয়ে ধরে।কোলে নাক ডুবিয়ে চোখ বুজে।তিতলি শিউরে উঠে।চোখ দু’টো ছোট হয়ে আসে।ওর পা দু’টো থরথর করে কাঁপছে। কোলে মাথা রাখতে বলেছিল সে।জড়িয়ে ধরতে নয়!কপাল ঘামা শুরু করে।অনেকক্ষণ কাটে পিনপতন নীরবতায়।নিঝুম তিতলির উষ্ণতায় পরম আবেশে চোখ বুজে আছে অনেকক্ষণ।ঘুম পাচ্ছেনা কেন জানি।নিঝুম হালকা হালকা নড়ছিলো।তিতলির মনে হলো নিঝুমের অশান্তি হচ্ছে হয়তো।তাই সে ডান হাত তুলে নেয় নিঝুমের মাথায়।তারপর আস্তে আস্তে বিলি কেটে দেয়।নিঝুমের হঠাৎ করেই বুকটা ভার হয়ে আসে।তিতলিকে খুব বলতে ইচ্ছে হয়,আমি তোমায় খুব ভালবাসি তিতলি।তোমার হাতের নরম স্পর্শে সারাজীবন চুলে বিলি কেটে দেবে?তুমি কি আমার হবে? কিন্তু পারেনি।জিভটা যেনো খুব ভারী।
তিতলি ভাবছে,সারাদিন ধরে যেসব কান্ড হচ্ছে সবকিছু যেনো ইঙ্গিত করছে নিঝুম তাকে ভালবাসে।আচ্ছা,আদৌ কি তা সম্ভব? নিশা যে আছে।কিন্তু একটা মেয়ে হয়ে কোনো ছেলের দৃষ্টি বুঝবে না এ তো হয় না!নিঝুম মুখ তুলে তাকায় তিতলির দিকে।বলে,

— “তিতলি?”
— “হুম?
গাঢ় স্বর তিতলির।
— “কিছুনা।”
বলে নিঝুম চোখ বুজে।তিতলি পাল্টা প্রশ্ন করে না।মিনিট খানেক পর বলে,
— “আপনি সবসময় কবিতা লিখেন?”
নিঝুম চোখ বন্ধ রেখেই জবাব দেয়,
— “যখন ইচ্ছে হয়।”
— “কবে থেকে লিখেন?”
— “বিশ বছর থেকে।”
— “খুব ভালো ছন্দ মিলান।”
নিঝুম হাসে।তিতলি ইতস্তত করতে করতে বলে,

— “এখন একটা শোনাবেন?”
নিঝুম চোখ খুলে।প্রশ্ন করে,
— “আগের নাকি এখন ভেবে বলব?”
তিতলি ঠোঁট কামড়ে ভাবে কি বলবে।এরপর বলে,
— “সময় দিলাম।ভেবে বলুন।”
নিঝুম তিন মিনিট পর বলে,
— “ছন্দ মিলানো যাচ্ছে না।”
— “আচ্ছা।”
— “আচ্ছা,যতটুকু পারি বলছি।”
তিতলি মাথা কাত করে।নিঝুম বলে,

” প্রেয়সী?
তুমি কি জানো?
তুমি নিঃসঙ্গ আকাশের একটি চাঁদ।
তুমি কারো হাজার বছরের আরাধনার রাজরাজেশ্বরী
তুমি কারোর সত্তায় করো অমরত্ব বাস
তুমি কি জানো?
কেউ একজন চোখ বুজে দেখে তোমার অধরের সূক্ষ তিল,তোমার মায়াময় হাসি।
কেউ একজন ভুল করে বারে বার কবিতার বদলে লিখে তোমার নাম। ”
তিতলি বুকে তোলপাড় হচ্ছে।মনে হচ্ছে প্রতিটি শব্দ যেন তাকে নিয়েই বলা।তাঁর অধরেও যে আছে একটা কালো সুক্ষ তিল!নিঝুম বলছে,
তুমি কি জানো?
আমি……”

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৬

নিঝুম বাকিটা বলে না।থেমে যায়।চোখ খুলে।তিতলি বাকিটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে।
নিঝুম গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে উঠে বসে।ওর কিছু ভালো লাগছেনা।কাছে থেকেও যেন অনেক দূরে মনে হচ্ছে তিতলিকে।মনে হচ্ছে, দুজনের মাঝে বিশাল বড় এক দেয়াল।যে দেয়াল টপকানোর সাহস দুজনের কেউ করতে পারছেনা।মনের কথা বলতে না পারার যন্ত্রনা খুবই ভয়ংকর।প্রেম ভীষন এক মানসিক ব্যাধি।দুজন মানুষ দুজনকে ভালবাসে।দুজনেরই মনে হয় অপর জন তাকে ভালবাসে কিন্তু নিশ্চিত নয়।আর এই নিশ্চিত-অনিশ্চিতের খেলায় দুজনেই আক্রান্ত প্রেমের মানসিক ব্যাধিতে।
আচমকা নিঝুম কামরা থেকে বের হয়ে যাওয়াতে তিতলি বড্ড আহত হয়।নিঝুম কামরার বাইরে এসে কয়েকটা কামরার সমন্বয়ে গঠিত দরজার মুখে দাঁড়ায়।এখানে প্রচুর বাতাস।নিঝুম ইচ্ছে করেই বের হয়ে আসে।সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলোনা কিছুতে।আজ প্রতিটি ক্ষণ নিঝুম হৃদয়ে যে পরম সত্য অনুভব করছে তা হলো, তিতলি শুধু তাঁর।আর সে শুধু তিতলির।

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৮