প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩৮

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩৮
ইলমা বেহরোজ
নিঝুম ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরে।নিঝুমকে দেখেই আঞ্জুমান দৌড়ে আসেন।কণ্ঠে উৎকণ্ঠা,
— “মেয়েটাকে পেয়েছিস আব্বা?”
— “পাইছি।আসেনি।” কণ্ঠে হতাশা।
— “কই আছে?”
— “হোস্টেলে।”
— “যার জায়গা যেখানে।সে সেখানেই গেল অবশেষে!”
আরমান চৌধুরীর বিদ্রুপে কুঞ্চিত ভ্রু কুঁচকায় নিঝুম।কপট রাগ নিয়ে বললো,
— “চাচ্চু,বয়সে বড় আছেন অনেক।আমার বাবার ও বড়।বড়দের মতো থাকবেন।যেনো ভাতিজার সামনে অপমানিত না হতে হয় প্লীজ।”
আরমান চৌধুরীর মুখটা থমথমে হয়ে উঠে।অপমান বোধ করেন।কয়টা কথা শুনানোর জন্য উদ্বাহী হোন কেবলি,তখন রিদি চোখের ইশারায় অনুরোধ করে চুপ থাকতে।আরমান চৌধুরী পুরোটা কথা হজম করে নেন।উঠে দাঁড়ান চলে যেতে।
— “আব্বু?১৬ তারিখ বিয়ে করবো তিতলিকে।আপনি রাজি?রাজি না থাকলেও করবো।”
নিঝুমের কণ্ঠে অভিমান,জেদ,রাগ।আরমান থমকে দাঁড়ান।আলতাফ ছেলের কথা শুনে মুচকি হাসেন।এমন রাগ করে কখনো কিছু বলেনি নিঝুম।আর কথার কি ঢং? রাজি না থাকলেও করবে বিয়ে।আগেই বলে দিচ্ছে!ভাবা যায়?আলতাফ হেসে ছেলের পিঠ চাপড়ে বলেন,
— “তোর আগে থেকেই রাজি।”
নিঝুম হেসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।উপস্থিত সবার মুখে হাসি।রিদি আর আরমান চৌধুরী ছাড়া!রিদি চোখের জল আড়ালে মুছে হেসে দু’কদম এগিয়ে এসে বললো
— “কনগ্রাচুলেশন ব্র!”
নিঝুম রিদির মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
— “থ্যাংকিউ সিস্টার।”
রিদি হেসে উঠে।
— “তিতলি আসলো না কেনো?” বললেন আঞ্জুমান।
— “আম্মু অনেকবার বলছি।কিন্তু আসেনি।আমিও আর জোর করিনি।থাকুক আর ৬-৭ টা দিন বন্ধু-বান্ধবদের সাথে।তারপর তো এই বাড়িতেই থাকতে হবে।”
নিঝুমের কথায় সন্তুষ্ট হলেন না আঞ্জুমান।মুখ ভার করে ফেলেন।নিঝুম মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো,
— “কাল আসবে দেখা করতে।”
— “সত্যি?” আঞ্জুমানের কণ্ঠে আনন্দ।
— “হুম সত্যি।”
তিতলি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।শান্তা খাবার বেড়ে তিতলির দিকে তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ।তিতলির খেয়ালই নেই।শান্তা ডাকে,
— “কিরে বাল?খাবি কখন?”
— “খামু।তুই খা।”
— “কি ভাবস?”
— “ভাবতেছি,উনি কি পাগলামোটাই না করলেন।”
— “হ।তো?”
— “উনার পরিচয় কোনো সাধারণ পাব্লিক হলেতো,আজ পুঁতেই ফেলতো হোস্টেলের লোকগুলা।ভাগ্যিস, ম্যানেজার চিনেন।”
— “শুধু কি ছাড়ছে?কফি -টফিও খাওয়াই দিছে।”
— “হোস্টেল এতো কড়া হয়!বাপরে।”
—- “হইছে আর ক্যাচাল পারিস না।খেতে আয়।”
পরদিন।নিঝুম হসপিটাল থেকে আসার পথে তিতলিকে বাড়ি নিয়ে আসে।সবাই খুব খুশি হয়।তিতলি সবাইকে সরি বলে।বিকেলের দিকে নিঝুম তিতলিকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসে।কিন্তু আসার পর থেকে মনটা ছটফট করতে থাকে।তিতলিকে না দেখলে রাত যেনো ঘুমটাও হয়না।ভেতরটা শূন্য লাগে।ইচ্ছে হয় এখনি তিতলিকে বিয়ে করে নিজের করে নিক!কিন্তু সবকিছুরই তো সময় আছে! সে উপন্যাস পড়া শুরু করে ব্যাস্ত হওয়ার জন্য।কিন্তু না মন তো আর বসেনা।আর ঔদিকে, তিতলি বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে।বইটা যে উল্টা সেটারও খেয়াল নেই।প্রথম দেখার পর থেকে দুজন একসাথে কাটিয়েছে প্রতিটা সময়।ঘুমাবার পূর্বে একজন আরেকজনকে দেখেছে।জড়িয়ে ধরেছে।আর এখন সেই বিকেল বেলা দেখা হয়েছে।এখন রাত ১০ টা ৩০ মিনিট!আবেগ গুলো জল হয়ে চোখে জমা হচ্ছে।শান্তা বই থেকে চোখ তুলে তাকায়! দেখলো তিতলি গালে হাত দিয়ে গাঁট হয়ে  বসে আছে।বইয়ের দিকে মন নেই।চোখগুলো ঝাপসা! শান্তা এক আঙ্গুলে গুঁতো দেয় তিতলিকে।তিতলি হকচকিয়ে উঠলো।
— “কিতা ভাবস?কান্দস নাকি?”
তিতলি চোখ বুজতেই দু’চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।জবাবে সে চুপ।শান্তা ঘাবড়ে যায়।বই বন্ধ করে উঠে আসে।তিতলির দু’কাঁধে হাত রেখে বললো,
— “কি হইছে?”
তিতলির কান্নার বেগ বেড়ে যায়।সে খুব মিস করছে নিঝুমকে।খুব!শান্তা হালকা আন্দাজ করতে পারে।বললো,
— “নিঝুম ভাইরে মনে পড়তাছে?”
তিতলি মাথা নাড়ায়।
— “কল দে।আসতে ক।নয়তো তুই যা।”
— “থাক।রাত হইছে অনেক।কালই দেখা হবে।”
— “তাইলে কান্দিস না।”
— “আচ্ছা।”
— “ফোনে কথা বল, মনে শান্তি পাবি।”
— “থাক।”
— “কিসের থাক? কথা বল।”
শান্তা বিছানার উপর থেকে ফোন নিয়ে আসে।তিতলির দিকে এগিয়ে দেয়।আদেশ স্বরে বলে,
— “এখনি কথা বল।”
— “প্লীজ শান্তা।”
— “কেনো চাচ্ছিস না?’
— “অভিমান হচ্ছে খুব।”
— “কিসের?”
— “উনি তো মিস করছেন না।করলে কল দিতেন।”
— “ওরে!এই ব্যাপার।”
তিতলি আওয়াজ করে হেঁটে বিছানার উপর বসে।তারপর শুয়ে পড়ে।জোরে আওয়াজ করে বললো,
— “বাতিটা নিভা।আমি ঘুমাবো।”
শান্তা ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করে।তারপর বাতি নিভিয়ে জানালার পাশে গিয়ে বসলো।শান্তার রাত জাগার অভ্যেস আছে।তার রাতের আকাশ খুব ভালো লাগে।যদি আকাশে একটা থালার মতো চাঁদ থাকে।আজ সত্যিই আকাশটা অসাধারণ।চাঁদটা অনেক বড়।ঘড়ির কাঁটায় ১২ টা হয়ে এসেছে।নিঝুমের চোখে ঘুম নেই।পায়চারি করে অনেকক্ষণ রুমে।তিতলিকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে।সোফায় বসে আনমনা হয়ে।চোখ রাখা শূন্যে। মন বলছে, হোস্টেলে যাবে।
কিন্তু এতে যে তিতলির বদনাম।আবার মিস করতে গিয়েও পাগল হয়ে যাচ্ছে।গতকাল রাতে তো দেখে এসেছিল।তাই ঘুমাতে পেরেছিল।কিন্তু আজ!কেনো এতো ছটফটানি তিতলিকে ছাড়া।নিঝুম হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে আবেগে।যতই বুঝদার মানুষই হউক না কেন! একটা সময় জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে মানুষ প্রবল কিছু ইচ্ছের টানে।নিঝুম ফোন হাতে নেয় অনেকবার। কিন্তু কলে কি হবে?ভয়েস শুনবে শুধু।ভিডিও কল?না সেটাও মন মানে না।নিঝুম গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।পথে অনেকবার মনে হয়েছিল ফিরে যাই।কিন্তু পারেনি সে।হোস্টেলের সামনে এসে গাড়ি থামায়।গেইট দিয়ে যখনি ঢুকতে যাবে একজন দারোয়ান পথ আটকায়।
— “কই যাবেন?”
— “পাঁচ তলায়।৬৫ নাম্বার ইউনিটে!”
— “কে থাকে আপনার?”
নিঝুম বউ বলতে গিয়েও বলেনি।বললো,
— “না থাক।দেখা করবো না।”
নিঝুম দূরে এসে দাঁড়ায়।কতক্ষণ গাড়ির মধ্যে বসে থাকে ঝিম মেরে।জানালা দিয়ে মাথা বের করে বিল্ডিংটা দেখে নেয় আগা-মাথা।একটা বুদ্ধি মাথায় আসে।তিতলি পাঁচ তলায় আছে।বিল্ডিংটাও পাঁচ তলা।ছাদে গিয়ে তারপর তিতলিকে কল দিয়ে ছাদেই তো ডাকা যায়? কিন্তু এটা পাগলামি না?করা কি ঠিক হবে? হুম ঠিকই! তিতলিকে একবার দেখতে সব করা যাবে।নিঝুম দ্রুত গাড়িটা ঘুরিয়ে নেয়।হোস্টেলের পিছন দিকে আসে।আশ্চর্য!এখানেও গার্ড। পিছন দিকের পাইপ বেয়ে ছাদে উঠার প্ল্যান করেছিল সে।কিন্তু এদের জ্বালায় কেমনে কি?
নিঝুম হতাশ হয়ে সামনে তাকায়।চোখ পড়ে পাশের বিল্ডিংয়ের পিছনের গেইটে।গেইট খোলা! নিঝুম উপরে তাকায়।বিল্ডিংটা ছয় তলার।হোস্টেলের সাথে অনেকটা মিশে খাড়া হয়ে আছে।গাড়ি এক সাইট করে।নিঝুম বুকে ফুঁ দিয়ে পাশের বিল্ডিংয়েই ঢুকলো।সৌভাগ্যক্রমে, ভেতরের গেইট ও খোলা।এই বিল্ডিংয়ের কোন ফ্ল্যাটে কোন হাবলা থাকে আল্লাহ জানে।গেইট খুলে রেখেছে! যা ই হোক!নিঝুমের জন্য ভালোই।সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে আসে।পা পেলে সাবধানে।ছাদের দরজায় এসে সে থমকে দাঁড়ায়।ছাদেরও দরজা খোলা!নিঝুমের মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে আসে,
— “ও মাই গড!এতো কেয়ারলেস। “
ছাদে উঁকি দেয় সে।কেউ নেই।তাহলে ছাদের দরজা খোলা কেন? নিঝুম দু’কদম এগিয়ে আসতেই দেখতে পেলো একটা ছেলে আর মেয়ে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে লিপ্ত। নিঝুম চোখ সরিয়ে নেয়।সেই দুজনও নিঝুমকে দেখতে পায়।ছেলেটা নিজেকে ঠিক করে দ্রুত পালায়।মেয়েটা কাচুমাচু হয়ে দু’কদম এগিয়ে এসে বললো,
— “ভাইয়া প্লীজ।নালিশ করবেন না বাসায়।”
নিঝুম যেনো পুরোই হা!ছেলেটা পালালো।আর এই মেয়ে কিসব বলছে?হুট করে মেয়েটা নিঝুমের পায়ে ধরে ফেলে।আর্তনাদ করে বললো,
— “ভাইয়া প্লীজ।আর এমনটা হবে না।জানিনা আপনি কয় তলায় কোন ফ্ল্যাটে থাকেন।কিন্তু প্লীজ এসব নিয়ে বিল্ডিংয়ের কারো সাথে কথা বলবেন না।”
নিঝুম এবার যেন সব বুঝলো।মেয়েটা এই বিল্ডিংয়েরই কোনো ফ্ল্যাটের।বয়ফ্রেন্ডকে ছাদে নিয়ে এসেছে আতংক নিয়ে।তাই গেইট লাগাতে মনে নেই।নিঝুম মনে মনে পিশাচীক হাসিতে ফেটে পড়ে।তারপর অনেকটা ভাব নিয়ে বললো,
— “ওকে।ওকে।যাও।আর যেনো এমন না হয়।”
— “আচ্ছা ভাইয়া।”
মেয়েটা দ্রুত জায়গা ত্যাগ করে।নিঝুম আকাশের দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
— “সবই আল্লাহর ইচ্ছে।”
কয়েক সেকেন্ড হাসে সে।তারপর জীবনের বাজি রেখে ছয় তলা বিল্ডিং থেকে লাফ দিয়ে পাঁচ তলা বিল্ডিংয়ের ছাদে পা রাখে।পা ফসকে যদি পড়তো একবার জীবনের বাতি নিভে যেতো।নিঝুম তিতলিকে কল করে।ধরলো শান্তা।
— “হ্যালো?”
—- “কে?”
শান্তা নাম্বারটা দেখে।নিকনেম, ডাক্তারমশাই।তারপর বললো,
— “জিজু আমি শান্তা।দাঁড়ান।তিতলিকে ডেকে দিচ্ছি।”
শান্তা তিতলিকে ঝাঁকিয়ে  ডাকতে থাকে।তিতলি ঘুমে কাতুর!জড়ানো গলায় বললো,
— “ঘুমাতে দে।”
— “আরে তোর জামাই কল দিসে।”
— “আমার বিয়া হয় নাই।রং নাম্বার।”
— “আরে বাল।চোখ তো খুলবি।”
তিতলি চোখ খুলে।শান্তা ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো,
— “তোর বয়ফ্রেন্ড কল দিসে!নে?”
তিতলির মুখের রঙ পাল্টে যায়।দ্রুত ফোন কেড়ে নেয়।
— ”হ্যালো?”
— “ছাদে আসো জলদি।”
— “মানে? কোন ছাদে?”
— “তোমার মাথার উপরে যে ছাদ।সেখানে!”
— “হোস্টেলের ছাদ?”
— “হুম।”
— “আপনি আসছেন?”
— “হুম।”
— “কেন?’
— “আগে আসো।”
তিতলি ফোন কেটে ওড়না হাতে নেয়।মুখে তাঁর আতংক!বিস্ময়!উত্তেজনা। শান্তা প্রশ্ন করে,
— “কি হইছে?”
— “উনি ছাদে অপেক্ষা করছে।”
শান্তার চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। বললো,
— “সর্বনাশ!একবার কেউ দেখলে ভেজাল হবে।তোর হোস্টেলে থাকাটাই রিস্ক হয়ে যাবে।”
— “সেটাই তো।কিন্তু অপেক্ষা করছেন যে।”
— “আচ্ছা যা।দরজার সামনে আমি দাঁড়িয়ে থাকবো।কেউ আসলে বলবো তোদের।মটরের পিছনে লুকিয়ে পড়বি।”
— “আচ্ছা।”
দুজন সাবধানে বেরিয়ে পড়ে।শান্তা ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিতলিকে ইশারা করে যেতে।তিতলি কয়েক কদম এগিয়ে আসতেই আচমকা কেউ আক্রমণ করে।নিঝুম! দৌড়ে এসে জাপটে ধরেছে তিতলিকে।শক্ত করে।তিতলি বুঝতে পেরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।নিঝুম ফিসফিসিয়ে বললো,
— “মিস ইউ টুকটুকি।”
— “আমিও আপনাকে খুব মিস করেছি।খুব।”
— “বিকেল থেকে এতটুকু সময় এতো যুগ মনে হয়েছে।”
— “আমারো।”
দুজন দুজনের বুকের ধুকধুকানি শুনে অনেকক্ষণ।তারপর হুট করেই নিঝুম ঠোঁটচুমু করে বসে।তিতলি মাথা নিচু করে মিনমিনে গলায় বললো,
— “হুট-হাট চুমু খাবেন না।সামলাতে পারিনা।”
— “আমি আছি সামলাতে।”
তিতলি নিঝুমের চোখে চোখ রাখে।তারপরই কঠোর গলায় বললো,
— “এতো রাতে ছাদে কি?আসলেনই বা কীভাবে?”
নিঝুম গর্ব করে বললো,
— “ওইতো পাশের বিল্ডিং থেকে লাফ দিয়ে।”
তিতলি চমকায়।থমথমে গলায় বললো,
— “কি বলছেন?”
তিতলির প্রকাশভঙ্গী দেখে নিঝুম নিশ্চুপ।তিতলি আবার বললো,,
— “যদি পা ফসকে যেতো কি হতো? ভেবে দেখেছেন?”
— “ওসব ভাবার সময়টা কই? আমার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছিলো তোমাকে দেখতে না পেয়ে।”
— “একদম ঠিক করেন নি আপনি।”
— “তোমাকে দেখতে আমি এমন বেঠিক কাজ আরো করতে রাজি।”
তিতলি গাল ফুলিয়ে চলে যেতে নিলে নিঝুম টেনে আরো কাছে নিয়ে আসে।বলে,
— “যাকে দেখতে এসেছি সে চলে গেলে কেমনে হবে?”
— “চলে যাবো আমি।”
— “বাবা! তোমার রাগ আছে?”
— “হুম আছে তো।”
— “আচ্ছা, আর এভাবে আসব না।”
— “সত্যি?”
— “হুম সত্যি।” নিঝুম মৃদু হেসে বললো।
তিতলি নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে পরম আবেশে।ভেতর থেকে শান্তার তাড়া,
— “আরে ভাই জলদি কর।কেউ আসবো।’
তিতলি মাথা তুলে তাকায়।নিঝুমকে বললো,
— “এখন যাবেন কীভাবে?”
— “পাইপ বেয়ে নিচে নেমে যাবো।”
— “প্লীজ না, পা ফসকে গেলে।”
— “আর কি করার?”
— “কেন আসতে গেলেন?”
— “আরে কিছু হবে না।”
নিঝুম তিতলির কপালে চুম্বন করে ছাদের কর্ণারে এসে দাঁড়ায়।এই ছাদের রেলিং নেই!বিপজ্জনক ছাদ! নিঝুম নামতে যাবে।তখনি তিতলি ধরে ফেলে শার্টের কলারে।আকুতি করে বললো,
— “প্লীজ।এভাবে না।
নিঝুম তিতলির গালে দু’হাত রেখে বললো,
— “কিছু হবেনা পাগলি।”
তিতলি তবুও মানেনি।জাপটে জড়িয়ে ধরে নিঝুমকে।সে কিছুতেই পাইপ বেয়ে নিচে নামতে দিবে না।নিঝুমকে জড়িয়ে আনতে গিয়ে তিতলির পা ফসকে যায়।নিঝুম দ্রুত তিতলির হাত টেনে ধরে।টান মেরে ছাদে দূরে ফেলে।কিন্তু সে নিজেকে সামলাতে পারেনি।পা ছাদ থেকে ছুটে যায়।তিতলি ছাদের মেঝেতে পড়ে দ্রুত পিছন ফিরে তাকায়।চিৎকার করে উঠে,
— “ডাক্তার।”
তিতলির চিৎকারে শান্তা দৌড়ে আসে।তিতলি উন্মাদের মতো উঠে দাঁড়ায়।দৌড়ে আসে।নিচে উঁকি দেয়।দেখে, নিঝুম তিন তলার বারান্দার রেলিং ধরে ঝুলে আছে।কপালে আঘাত পেয়েছে।রক্ত ঝড়ছে।আবারো চিৎকার করে ডাকে তিতলি,
— “ডাক্তার।”
নিঝুম ঝুলন্ত অবস্থায় তিতলিকে আওয়াজ করতে মানা করে।তারপর ধীরে ধীরে ঝুলে পাইপ পর্যন্ত আসে।পাইপ আঁকড়ে ধরে নিচে নেমে যায়।উপরে তাকায়।তিতলি মুখে ওড়না চেপে কাঁদছে।ইশারায় তিতলিকে কান্না বন্ধ করতে বলে।তারপর আড়াল হয়ে যায়।পিছনের গেইটে এসে দেখে গার্ড নেই।বাথরুমে গেছে হয়তো।কপালে হাত চেপে ধরে, দ্রুত জায়গা ত্যাগ করে।গাড়িতে এসে হেলান দিয়ে বসে।প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে।রড জাতীত কিছু দ্বারা আঘাত লেগেছে কপালে।পরনের শার্ট খুলে মাথায় চেপে ধরে।গাড়ি স্টার্ট দেয়।
— “আর কত কাঁদবি?এবারতো চুপ কর?জিজুর ব্যাপারটা জাস্ট মেরাক্কেল ছিল।ভাইয়া বেঁচে গেছে।আল্লাহর কাছে শুকরিয়ানা আদায় কর কান্না থামিয়ে।”
— “কেমনে বলছিস চুপ করতে? উনার কপাল থেকে রক্ত আসছিল।আমি যাবো উনার কাছে।”
— “এতো রাতে একা কেমনে যাবি?”
— “হেঁটে যাবো।”
— “চিনিস?রাস্তাঘাট?”
শান্তার জবাব না দিয়ে তিতলি দ্রুত বেরিয়ে পড়ে।গেইটে এসে হয় ভেজাল!দারোয়ান কোনোভাবেই বের হতে দিবে না।তিতলি জোর করে ঠেলে বেরিয়ে আসে।পিছন পিছন শান্তা।তবে,শান্তা বের হতে পারলো না।তাকে নিয়ম ভাঙ্গা যাবে না।আর যে থাকার জায়গা নেই তাঁর।ফোঁপাতে ফোঁপাতে অনেকটা রাস্তা হেঁটে আসে তিতলি।একটা সিএনজি পেয়ে যায়।হাতের ইশারায় থামতে বলে।সিএনজি থামতেই তিতলি উঠে বসে।ড্রাইভার প্রশ্ন করে,
— “কই যাবেন?”
— “উপশহর।বি ব্লক যান।”
— “না এহন ওইদিক দিয়া যামুনা।”
— “প্লীজ ভাই। যান।আল্লাহর দোহাই লাগে।”
তিতলির কান্নামাখা মুখ দেখে ড্রাইভারের মায়া হয়।যেতে রাজি হন।রাস্তা খালি হওয়াতে পঁচিশ মিনিটে চলে আসে।তিতলি একশো টাকার নোট ড্রাউভারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দৌড়ে গেইটের সামনে আসে।ড্রাইভার পিছন ডাকে বাকি টাকা নেওয়ার জন্য।কিন্তু তিতলির সেখানে ভ্রুক্ষেপ নেই।বাড়ির দারোয়ান তিতলিকে দেখে বললো,
— “আফামনি আপনে?”
— “তাড়াতাড়ি গেইট খুলেন।”
দারোয়ান গেইট খুলতেই তিতলি ধড়মড় করে ঢুকে।বড় বড় পা ফেলে সদর দরজায় আসে।কলিং বেল চাপতে থাকে জোরে জোরে।নিঝুমকে ঘিরে সবার ভীর ছিলো।কলিং বেলের এতো আওয়াজে সবাই সচকিত হয়।নির্জন দ্রুত হেঁটে এসে দরজা খুলে।দেখতে পায়,তিতলিকে!মুখের কি বিধ্বস্ত অবস্থা।দরজা খুলতেই তিতলি আর নিঝুমের চোখাচোখি হয়।তিতলি দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিঝুমের বুকে।ততক্ষণে নিঝুম দাঁড়িয়ে পড়েছে।মাথায় ব্যান্ডেজ!তিতলি বুকে মাথা রেখে ফোঁপাতে থাকে।বলে,
— “আপনি ঠিক আছেন তো?”
নিঝুম তিতলির মাথা হাত বুলিয়ে বললো,
— “এইযে ঠিক আছি।ব্লাড আসাও বন্ধ হয়েছে।নির্জন ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে।”
তিতলি চোখ তুলে তাকায়।নিঝুম মৃদু হাসে।তিতলি আবারো কান্না করে বুকে মাথা রাখে।তিতলির খেয়ালই নেই আশেপাশে পরিবারের সব সদস্য রয়েছে।রোহি চোখের ইশারায় নির্জনকে উপরে চলে যেতে বলে।দুজন একইসাথে উপরে উঠে যায়।তাদের দেখাদেখি বাকিরাও।সেই মুহূর্তেই তিতলির খেয়াল হয়,পরিবারের অনেকে ছিল।এখন তারা লজ্জায় চলে যাচ্ছে।দ্রুত নিঝুমের থেকে সরে দাঁড়ায়। নিঝুম তিতলির পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
— “ইশ!কেঁদে কি অবস্থা।কিছু হয়নি।জাস্ট এইটুকু ব্লাড এসেছে।আর কাঁদতে হবে না।”
— “আমি সরি!”
— “সরি? কেনো?”
— “আমি টানাটানি করলাম বলেই তো এরকম একটা ঘটনা ঘটলো।”
— “মোটেও না।”
— “হুম তাই।”
অনেক জোরাজুরি করার পর নিঝুম শুয়েছে।তিতলি পানি খাইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নিঝুমের।কিছুতেই নিঝুম ঘুমাচ্ছে না।শুধু অশ্লীল কথাবার্তা বলছে।ডাক্তাররা অশ্লীল কেমনে হয়?
তিতলি প্রশ্ন করেই ফেলে,
— “ডাক্তাররা অশ্লীল কেমনে হয়?”
ভারি অবাক হয়ে নিঝুম উত্তর দিলো,
— “এমা! ডাক্তাররাই তো অশ্লীল হবে।যা করে সবই খোলামেলা।”
— “ছিঃ।আপনি অসুস্থ হয়ে অসভ্য হয়ে গেছেন।ফুফি আম্মা বলেছেন দ্রুত ঘুমাতে।ঘুমান।এরপর আমি ঘুমাতে যাব।”
তিতলি বই হাতে নিয়ে উঠে আসে।বারান্দার সামনে দরজায় হেলান দিয়ে বসে।নিঝুম বলে,
— “দূরে গেছো কেন?”
— “আপনি মানুষটা বহুত সেয়ানা।তাই।”
নিঝুম হাতে ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে হেসে বললো,
— “কয়েকটা লাইন মনে পড়েছে।কার লিখা মনে নেই ঠিক।মুখস্থ আছে।বলবো?”
— “অশ্লীল না হলে বলুন।”
নিঝুম হাসে।নিশ্চুপ হাসি।তারপর বললো,
— “বাতিটা নিভাও।আমার চোখে ধরছে।”
তিতলি উঠে গিয়ে বাতি নিভিয়ে আসে।নিঝুম তিতলির দিকে তাকায়।তারপর বললো,
” তুমি যে আমার শুক্লা তিথি ফুটন্ত চাঁপা,
রোদেলা বিকেলবেলা হাতের মাঝে হাত রেখে পথ চলা,
আমি ক্লান্তিহীন ভাবে তোমায় ভালবেসে জড়িয়ে ধরা,
তোমার ঠোঁটেঠোঁট রেখে তৃপ্তির  চোখে তোমার ঠোঁটে  চুম্বন করা,?
হাজারো দ্বিধা দ্বন্দ্বের নক্সা বোনা বেগুনি সন্ধ্যা,
তোমার ঠোঁটেঠোঁট রেখে শিরা উপশিরা বেপরোয়া হওয়া। “
তিতলি হেসে উল্টো হয়ে বসে। নিঝুমের দিকে পিঠ করে।এরপর বললো,
— “আপনার চরিত্র ভালো না।”
— “সব বউই চায়।তার জামাইটা তার জন্য চরিত্রহীন  হউক।”
— “আমি চাইনা।”
— “উপরে উপরে।”
— “মোটেওনা।ভেতরেও।”
— “আমি বাচ্চা না।”
তিতলি আর কথা বাড়ায়নি।পুরো পিঠ জুড়ে ঘন চুল তাঁর।এক হাতে সরিয়ে আনে এক পাশে।পিঠ খালি হয়।জামার যে চেইন খোলা তা হয়তো তিতলির খেয়ালে নেই।নিঝুম দেখতে পায়।চোখ সরিয়ে নিয়েও আবার তাকায়।সত্যি শিরা-উপশিরায় অদ্ভুত অনুভূতি চেয়ে যাচ্ছে।একি! ভয়ংকর কান্ড!
নিঝুম হালকা কেশে বলে উঠে,
— “চেইন লাগাও জামার।”
তিতলি চমকে উঠে।দ্রুত ঘুরে বসে।পিঠে হাত দেয়।সত্যি তো!নিঝুমের দিকে তাকায়।মানুষটা দুষ্টু করে হাসছে।তিতলিকে লজ্জা দিতে আবার নিঝুম বললো,
— “তুমি কি ইচ্ছে করে সব খুলে-টুলে আসো আমার সামনে?লাভ নেই গো।বিয়ের আগে কিচ্ছু হচ্ছেনা।’
তিতলি রেগে গিয়ে বললো,
— “মোটেও না।এটা বেখেয়ালি হয়েছে।”
নিঝুম বিদ্রুপ করে বললো,
— “বুঝি!বুঝি!”
তিতলি কড়া গলায় বললো,
— “দেখুন বেশি হচ্ছে।আমি কিন্তু কামড়ে দেব।”
— “এটাই পারো।আর কি পারো?কখনো নিজের ইচ্ছায় একটু চুমু খেয়েছো?”
— “কত্তবার দিয়েছি চুমু।”
— “ঠোঁটে?”
তিতলি থমকায়।তারপর বললো,
— “সে তো লজ্জায় দেইনা।কিন্তু এর মানে নয় যে, আমি পারিনা।”
—- “তো প্রমাণ দেও পারো যে।”
তিতলি নিঝুমের দিকে তাকায়।রাগে নাকের পাটা ফুলছে তাঁর।নিঝুম চেপে হাসে।তারপর আবার উৎসাহ দিল,
— “কি হলো? আসো? সাহস থাকলে?”
তিতলি চুল হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে আবার পিঠে নিয়ে আসে।বই রেখে এগিয়ে আসে।নিঝুম ছাদের দিকে চোখ রেখে গুনগুন করে।তিতলি নিঝুমের পাশে বসলো।তারপর টুক করে নিঝুমের ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললো,
— “এইযে দিলাম।”
নিঝুমের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।এমন ভাব নিয়ে বললো,
— “এটা কোনো চুমু হলো?”
তিতলি ভ্রু কুঁচকায়।প্রশ্ন করে,
— “তাহলে কেমনে?”
— “ওইযে শুক্রবারে দিয়েছিলাম।”
তিতলি ঢোক গিলে।তারপর বললো,
— “না পারবনা।”
নিঝুম শুয়ে থেকেই আঙ্গুলে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
— “জানতাম!কামড়াকামড়ি ছাড়া তোমার পক্ষে আর কিছু সম্ভব না।”
— “সম্ভব।”
— “তো করে দেখাও।”
তিতলি এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা ভাবে।তারপর নিঝুমের দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে মাথা নামিয়ে আনে।তখনি নিঝুম টেনে পাশে শুইয়ে দেয় তিতলিকে।তিতলির মুখের উপর ঝুঁকে বললো,
— “আচ্ছা ভালবাসার তুষারের ঝড় আছে?'”
— “জানিনা।”
তিতলির মিনমিনে গলা।নিঝুম নিঃশ্বাস ফেলে তিতলির মুখে।তারপর ফিসফিসিয়ে বললো,
— “হঠাৎ করে যেন ভালবাসার তুষারের ঝড়ে আমি হোঁচট খেয়ে পড়েছি।যত দূর চোখ যায়, যতদূর যায়না, চোখ ধাঁধানো তুমি আর তুমি।”
তিতলি চোখ বুজে।আবার নিভু নিভু করে খুলে বললো,
—- “আপনি যখন নিজের বানানো কিছু কথা আমায় শুনান,আমার যেনো কি হয় জানেন?ভয়ংকর কাঁপন ধরে।আপনার কণ্ঠ,নিঃশ্বাসে তখন কি যেনো মিশানো থাকে।”
নিঝুম হেসে পাশে শুয়ে পড়ে।বলে,
— “আচ্ছা,চুমুটা দিয়ে দাও।”
তিতলি উঠে দাঁড়ায়।রুম থেকে বের হতে হতে বলে,
— “ঘুমাতে যাচ্ছি।আপনিও ঘুমান।অসুস্থতা আপনাকে চরিত্রহীন ডাবল স্কয়ার বানিয়ে দিয়েছে।”
নিঝুম ঠোঁট কামড়ে হেসে তিতলির যাওয়া দেখে।