প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩৭

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩৭
ইলমা বেহরোজ
দুই ভাই বাড়ি ফিরছে।নিঝুম ড্রাইভ করছে।নিঝুমের মুখে হাসি লেগে আছে অনেকক্ষণ যাবৎ।মনে হচ্ছে খোশ মেজাজে আছে।নির্জন প্রশ্ন করে,
— “কিরে ভাই?”
— “আজ জুন মাসের ৬ তারিখ না?”
নিঝুমের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা।
— “হ।কেন?” নির্জন ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করছে।কিন্তু ঠাওর করতে পারছেনা।
— “তিতলি একসাথে দুইটা সারপ্রাইজ পেয়ে কেমন রিয়েক্ট করবে তাই ভাবছি।নির্ঘাত সেন্সলেস হবে।”
— “খুইল্লা বল ব্যাঠা।” নির্জনের কুঁচকানো ভ্রু।
— “কি খুলুম?” নিঝুমের ভারী ইনোসেন্ট গলা।
নির্জন ফোঁস ফোঁস করে উঠে।গর্জে উঠে বললো,
— “প্যান্ট খোল।তার ভিতরে কিছু থাকলে ওইটাও খোল।'”
— “ছিঃ নির্জন।ছেলেদের সিক্রেট দেখতে চাস!তোর বউ জানে তুই যে গে এর লিস্টে নাম লিখাচ্ছিস?” নিঝুমের কন্ঠে রসিকতা।নির্জন রেগে নিঝুমের বাহুতে ঘুষি দিতে থাকে।গাড়ি এদিক-ওদিক হয়ে যায়।নিঝুম দ্রুত গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে ধরে টেনে আনে।গাড়ি থেমে যায়।তির্যকভাবে তাকায় নির্জনের দিকে।নির্জন সোজা হয়ে বসে।মিনমিনিয়ে বললো,
— “সরি।”
নিঝুম গাড়ি স্টার্ট দেয়।চোখ দূরে রাস্তায় রেখে বললো,
— “দুদিন পর তিতলির জন্মদিন।ফ্যামিলি পার্টির আয়োজন করবো ভাবছি।সেটা অবশ্যই তিতলির অজান্তে।আর আব্বুর সাথে আজ কথা বলবো।জন্মদিনের উইশের পরপরই বিয়ের প্রপোজালটা সেরে ফেলার চিন্তা করতেছি।”
নির্জনের চোখ দু’টো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো।তারপরই বললো,
— “তিতলি অজ্ঞান হবে নয়তো হেঁচকি উঠবে দেখিস।”
নিঝুম জোরে হেসে বললো,
— “দুটোই হবে।এটাই তিতলি।”
নির্জনও তাল মিলিয়ে হাসতে থাকে।হাসির মাঝে নিঝুমের মুখের দিকে তাকায়।নিঝুম সেটা খেয়াল করে বললো,
— “দেখ ভাই।তোর বিয়ে হইছে অনেকদিন।আট মাস প্রায়।আমার বিয়ে হবে।এভাবে তাকাইস না।অন্য কোনো ছেলে খুঁজে নে। নিজের ভাইয়ের এতো বড় ক্ষতি করিস না।” নিঝুমের চোখেমুখে দুষ্টুমি।
——–‘নিঝুম!আমি কিন্তু তোকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে ফেলে দেবো।আমি তোর দিকে তাকাইছি এর কারণ আছে।”
নিঝুম ভারী অবাক হবার ভান করে বললো,
— “কি কারণ? “
— “বলবোনা।”
— “তুই কিন্তু মেয়েদের মতো রিয়েক্ট করছিস।”
— “মেয়ে আর গে দের সাথেই মিলিয়ে গেলি সারাজীবন। সালমান খানের সাথে একদিন মিলালে কি এমন হতো?’ নির্জনের কণ্ঠে অভিযোগ।
নিঝুম বলে,
— “তুই সালমান খানের চেয়েও সুন্দর।”
— “ইনডিরেক্টলি নিজের প্রশংসা করলি।”
উত্তরে নিঝুম হাসে।নির্জন খুব রাগী!তবে বড্ড নরম মনের মানুষ।কখনো দুজনের মধ্যে ঝগড়া বাঁধেনি।যতই রাগী হউক নির্জন।নিঝুম সামলিয়ে নিয়েছে।যখন নিঝুম-নির্জন মেডিকেলে প্রথম পা রাখে।নির্জন সিনিয়র দের সাথে প্রথম দিনই মারামারি শুরু করে।নিঝুম যদি সেদিন ঠান্ডা মাথায় সব না সামলাতো নির্জনকে পঙ্গু হয়ে হস্পিটাল ভর্তি থাকতে হতো।খুনসুটি করে করে বাড়ি ফেরে দুজন।তিতলির ভার্সিটিতে গিয়েছিল নিঝুম।শুনে,তিতলি নাকি অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে।বাড়িতে ঢুকেই তারা থমকে দাঁড়ায়। ড্রয়িংরুমে সবাই বসে আছে।সবার মুখ শুকনো।
— “কিছু কি হয়েছে?” নিঝুমের প্রশ্ন।
নির্জন চোখের ইশারায় রোহিকে প্রশ্ন করে।রোহি চোখের ইশারায় জবাব দেয়,উপরে আসো।সে উপরে উঠে যায়।নির্জন নিঝুমের পাশ কাটিয়ে উপরে উঠতে পা বাড়ায়। নিঝুম তিতলিকে খুঁজতে থাকে।নেই এখানে!রুমে হয়তো।তার মা-বোনেরা মুভি বা সিরিয়াল দেখেও এভাবে শুকনো মুখে বসে থাকে।তাই আর পাত্তা দেয়নি।উপরে উঠে আসে।তবে মনটা খচখচ করছে।আব্বুর মুখটা ওমন কেন?কেমন থমথমে পরিবেশ।ঝড় উঠার পর বা আগের অবস্থা যেমন তেমন। এপ্রোন হাতেই আবার নিচে নেমে আসে।বললো,
— “আম্মু কিছু কি হয়েছে?”
— “না।কি হবে।” থমথমে গলায় বললেন আঞ্জুমান।
— “এমন দেখাচ্ছে যে সবাইকে?” নিঝুমের সরু চোখ।
ততক্ষণে নির্জনও নেমে এসেছে।রোহির মুখে সব শুনে শার্ট চেঞ্জও করেনি।আঞ্জুমান কিছু বলার আগে নির্জন বলে উঠে,
— “আরে ভাই!আগে ফ্রেশ হ।তারপর ফ্যামিলি ক্যাচাল শুনিস।”
নির্জনের কথায় পাত্তা না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে নিঝুম,
— “আম্মু তিতলি কই?”
— “নাই।”
আঞ্জুমান মাথা নিচু করে বলে।তারপরই আর্তনাদ করে উঠে,
— “আব্বা!আমি দেখি নাই। ও কখন বের হইয়া গেছে।নয়তো আটকাইতাম।”
নিঝুম যেনো কিছু বুঝে উঠতে পারলো না।ভ্রু-জোড়া বাঁকিয়ে বললো,
— “হেয়ালি না করে বুঝিয়ে বলো।”
রিদি আসে।নিঝুমের শেষ প্রশ্ন শুনে বললো,
— “আজ তিতলি আগে আগে ভার্সিটি থেকে চলে এসেছে।বাবা বলছিলো,তিতলি নির্লজ্জ অন্যের বাড়িতে থাকে।ঘষাঘষি করে তোর সাথে।এসব তিতলি শুনে নিয়েছে হয়তো।তাই ব্যাগ হাতে….”
রিদির গলা কাঁপছিলো খুব।এই তিন-চার দিনে সে এটুকু বুঝেছে,নিঝুম পাগলের মতো তিতলিকে ভালবাসে।আর শান্ত মানুষরা যখন রাগে তখন চারপাশ লন্ড-ভন্ড করে দেয়।নিঝুমের রাগ করাটা স্বাভাবিক।রিদির কথা শুনে নিঝুম স্তব্ধ হয়ে গেল।মা’কে জিজ্ঞাসা করে,
— “রিদি যা বলছে সত্যি?”
আঞ্জুমান মাথা নাড়ায়।নিঝুমের মাথার রগ দপদপ করতে থাকে।কি করতে জানি ইচ্ছে হচ্ছে।চাপা স্বরে শুধু বলে,
— “তিতলির বয়স কম।ও ম্যাচিউর না অতো।কোথায় গেছে,কি করছে…আমাকে তখনি কল করো নি কেন কেউ?”
নিঝুম দ্রুত পা ফেলে সোফায় বসে পড়ে।সে রাগতে চায়না।সে রাগেনা কখনো।তিতলির বেলায় সব উল্টো হচ্ছে।এপ্রোন ছুঁড়ে ফেলে সে।কাউকে কিছু না বলে ক্ষুব্ধ চেহেরায় বেরিয়ে যায়।
ভাবতে থাকে তিতলি কই যেতে পারে।যদি গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছে থাকে।তাহলে রেল স্টেশনে যাবে।কিন্তু ট্রেন হয় ভোরে নয় সন্ধ্যায় ছাড়ে।তাহলে কি স্টেশনে বসে বসে কাঁদছে?নিঝুম দ্রুত গাড়ি নিয়ে ত্রিশ মিনিটের মাথায় স্টেশন চলে আসে।পুরো প্লাটফর্ম ঘুরে বেরায় তিতলির খুঁজে।আশেপাশের সব দোকান দেখে।কোথাও নেই! মনের মাঝে অনেক ভয় এসে ধাক্কাতে থাকে।কোনো বখাটে ছেলেদের হাতে পড়েনি তো?
নিঝুমের বুকে ভয়ের হাতুড়ি পেটা চলতে থাকে।বুক ধুকধুক আওয়াজ তুলছে।সন্ধ্যা অব্দি পাগলের মতো প্লাটফর্মের এমাথা-ওমাথা ছুটে।তারপর গাড়িতে এসে বসে ঝিম মেরে।মাথায় কোন কিছু আসছে না।আচ্ছা বাসে গ্রামে চলে যায় নি তো?তারপরই মনে পড়ে, তিতলিকে কল দিচ্ছি না কেন? ফোন হাতে নেয়।ফোন সুইচড অফ!বিপদ যখন আসে চারিদিক থেকেই আসে।নিঝুম গাড়ি স্টার্ট দেয়।মনে পড়ে তখন,তিতলি কোনো ফ্রেন্ডের বাসায় তো যেতে পারে।ফ্রেন্ড কথাটা মাথায় আসতেই,আগে শান্তার কথা মনে পড়ে।তিতলিকে নিয়ে শান্তার হোস্টেলে গিয়েছিল সে।অবশ্য উপরে উঠেনি। তবে,তিতলির মুখে শুনেছিল শান্তা ২য় তলায় ইউনিট-৩০ এ থাকে।নিঝুমের মুখে হাসি ফুটে উঠে।গাড়ি ঘোরায়।আল্লাহকে ডাকতে থাকে।যেন,শান্তার কাছেই তিতলিকে পাওয়া যায়।
তিতলি দ ভঙ্গিতে বসে আছে।শান্তা রুম গুছিয়ে নিচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে সে বকবক করেই যাচ্ছে।তিতলি উত্তর দিচ্ছে না।
— “কিরে হারামি?এমন কইরা রাখছস কেন মুখ?”
— “ভাল্লাগতাছে না।”
— “আমি আগেই জানতাম।সন্ধ্যা পার হলেই,আপনি দেবদাস হয়ে যাবেন।”
— “উনার ফোন অফ বলছে বার বার।টেনশন হবে না?”
—- “বাসার অন্য কাওকে কল দে।”
—- “সেই সাহস নাই।আপুরা,আন্টি,আংকেল,রোহি ভাবি কত আদর করতেন আমাকে।আর রাগের বশে কিছু না বলে চলে আসলাম।”
— “কল কইরা সরি বল।”
— “আগে উনার সাথে কথা হউক তারপর…”
শান্তা আর কিছু বলেনি।হুট করে তিতলি ঢোক গিলতে থাকে।কাঁপা গলায় ডাকে শান্তাকে।
— “ওই শান্তা।”
— “কি?”
— “উনি মনে হয় আমারে খুঁজতাছে।”
— “হ।আমারো তাই মনে হয়।”
— “যদি একবার আমারে পায়।খুন করে ফেলবো।”
তিতলির মুখে কান্না কান্না ভাব চলে আসে।তারপরই আবার নিজেকে সাহস দেয়।
— “না এ হতে পারে না।উনিতো খুবই শান্ত।”
কিন্তু মন মানছে না।ভয় লাগছে।হেঁচকি উঠে পড়ে তাঁর।শান্তা তিতলির হেঁচকির সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।প্রথম দিন তো ভয়ই পেয়েছিল।পানি এনে এগিয়ে দেয়।বলে,
— “ল পানি খা।হিচকি রানি।”
নিঝুম দারোয়ান,সহ হোস্টেলের কর্মকর্তা কাউকে পাত্তা না দিয়ে ২য় তলায় চলে আসে।ইউনিট-৩০এর দরজায় কড়াঘাত করে। একটা মেয়ে দরজা খুলে।নিঝুম সাথে সাথে প্রশ্ন করে,
— “এখানে শান্তা আছে?”
— “জ্বি না।পাঁচ তলায় ৬৫ নাম্বার ইউনিটে পাবেন।”
নিঝুম দ্রুত পাঁচ তলায় চলে আসে।পিছন পিছন দারোয়ান সহ আরো দুজন পুরুষ। আর একজন ফর্সা মোটা মহিলা আসেন।এভাবে একটা ছেলে মেয়েদের হোস্টেল দৌড়ে বেড়াচ্ছে।ব্যাপারটা বিপজ্জনক!দরজায় কড়াঘাতের আওয়াজ শুনে তিতলির মুখের ভেতর থেকে সব পানি বেরিয়ে পড়ে।শান্তা বললো,
— “ডরাস কেন।যা দরজা খোল।”
— “আমি যামু না।”
— “কেন?”
— “যদি উনি হয়।মেরে ফেলবো।রাগে না বলে বাড়ি থেকে…”
শান্তা অনেকটা জোরে হেসে বললো,
— “নিঝুম ভাই না অনেক শান্ত কইলি।”
— “হ।তবুও ভয় লাগতাছে কেন জানি।”
দরজায় করাঘাত বেড়েই চলেছে।শান্তা তিতলিকে ঠেলে পাঠায়।তিতলি কাঁপা পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।বিসমিল্লাহ বলে দরজা খুলতেই দেখে নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে।তিতলি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে।অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম প্রায়।নিঝুম তিতলিকে দেখে যেন কলিজায় পানি পেলো। দু’হাতে তিতলিকে বুকে টেনে আনে।জোরে চেপে ধরে।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জোরে।জান যায় অবস্থা হয়েছিল তার।তিতলি বাকরুদ্ধ!উনি মারলোনা কেন?তারপরই আবার নিজেকে ধমকে বললো,
— “হে রে তিতলি?মার খাস নাই বলে কি তোর আফসোস হচ্ছে?”