প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩৯

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩৯
ইলমা বেহরোজ
পাঁচ মিনিটের মাথায় তিতলি আবার আসে।এসে বলে,
— “আমার সুইমিংপুলে ডুব দিতে ইচ্ছে করছে ভীষণ।”
নিঝুম চোখ বুজেছিল।তিতলির কণ্ঠ শুনে তাকায়।বলে,
— “অদ্ভুত কথাবার্তা।কাল সকালে যত ইচ্ছে ডুব দিও।”
তিতলি হাত কচলাচ্ছে।তাঁর সত্যি হুট করে ইচ্ছে হচ্ছে সুইমিংপুলে গা ভাসিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে।নিঝুম বলে,
— “কি হইছে? এদিকে আসো।”
তিতলি বিছানার এক পাশে বসে।মুখ গুমোট করে।নিঝুম বলে,
— “তোমার বয়সী মেয়েদের এই এক সমস্যা। এদের মুড সুইং হয় বেশি।হুটহাট এটা-ওটা করতে ইচ্ছে করে।”
তিতলি মাথা নাড়ায়।নিঝুম বলে,
— “ঘুম পাচ্ছে না?”
তিতলি না করে।নিঝুম রুমের ছাদে চোখ নিবদ্ধ করে।তারপর হালকা আওয়াজ করে প্রশ্ন করলো,
— ” কিছুক্ষণ গল্প করো,তাহলে।”
— “কি নিয়ে গল্প করবো?”
নিঝুম ভাবে।কোনো টপিক পাচ্ছে না।তাই বলে,
— “বললে না, আমার কণ্ঠে কি যেন মেশানো থাকে।কি মেশানো থাকে?”
তিতলি মাথা কাত করে নিঝুমের চোখে চোখ রাখে।এরপর বললো,
— “মদ।”
নিঝুম হো হো করে হেসে উঠে।বসলো।তিতলির দিকে তাকিয়েববললো,
— “মদ টেস্ট করেছো কখনো?”
তিতলি ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
— “আমি ভালো মেয়ে।”
নিঝুম খুঁচিয়ে বললো,
— “তাহলে বুঝলে কেমনে আমার কণ্ঠে মদ মেশানো থাকে?”
তিতলি চোখ-মুখ কুঁচকার। তারপর আহ্লাদী স্বরে বললো,
— “দূর বুঝেন না আপনি।”
নিঝুম হাসিতে ফেটে পড়ে এবং আলমারির পাশে এসে দাঁড়ায়।তিতলি নিঝুমের হাসি দেখে জ্বলে উঠে।থ্রী-কোয়াটার প্যান্ট আর টি-শার্ট বের করে কাঁধে নেয় নিঝুম।তারপর তিতলির দিকে তাকায়।নিঝুম কিছু বলতে চায়, তার আগেই তিতলি বলে উঠলো,
— “মাথায় ব্যান্ডেজ করা তো।টি-শার্ট কেমনে পরবেন?শার্ট নিয়ে যান।”
নিঝুম আশ্চর্য হবার ভান করে বললো,
— “ওহ তাই তো।”
নিঝুম আকাশি রঙের একটা শার্ট বের করে।বিছানার দিকে তাকায়। তিতলি তাকিয়ে আছে।নিঝুম ঠোঁট কামড়ে আবারো হাসে।ওয়াশরুমে যেতে যেতে একটা কথা ছুঁড়ে দেয়।
— “বিয়ের আগে গলা বড় জামা পড়ে আমার সামনে আর এসোনা।এবারের মতো দিলাম ছেড়ে।”
শুনেই তিতলি হুড়মুড় করে ঠিক হয়ে বসে।ওড়না তাঁর এক কাঁধে।তাড়াতাড়ি করে মাথায় কাপড় দেয়।সেই সাথে শরীর ঘুরে ফেলে।তারপরই নিজে নিজে হাসে অনেকক্ষণ,অনেক মুহূর্ত!নিঝুম ওয়াশরুম থেকে বলে,
— “তিতলি একটা গান গাও তো।”
তিতলি না চাইতেও গান ধরে,
” সোনা বন্ধু তুই আমারে করলিরে দিওয়ানা
মনে তো মানেনা দিলে তো বুঝেনা।
সোনা বন্ধুর এমনি গুণ জল দিলে নিভেনা আগুন
ক্যামনে নিভাবো আগুন আমায় একটু বলনা
মনে তো মানেনা দিলে তো বুঝেনা। “
নিঝুম ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে।তিতলির দিকে তাকায়।মাথায় কাপড় দেওয়াতে একদম বউ বউ লাগছে তাকে!তিতলিও তাকায়৷ বাকি টুকু শেষ করে,
‘সোনা বন্ধুর মুখের হাসি, যেন পূর্ণিমা শশী
হাসিতে হইইলাম পাগল ঘরে থাকতে পারলাম না
মনে তো মানেনা দিলে তো বুঝেনা।
সোনা বন্ধুর প্রেমের তরী, চালাই তারা ক্যামন করি
তরীতে বইসা রইলাম মাঝির দ্যাখা পাইলাম না
মনে তো মানেনা দিলে তো বুঝেনা।’
যতক্ষন গান গায় সে ততক্ষণ একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থাকে।গান শেষ হয়,তবুও রেশ যেন রয়ে যায় মনে-প্রাণে, শরীরে-মস্তিষ্কে!মাথার কাপড়টুকু পড়ে যায়।তিতলি দাঁড়ায়।অদ্ভুত চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে নিঝুমের পানে।এগিয়ে আসে নিঝুমের দিকে।তিতলিকে এগুতে দেখে নিঝুম হকচকিয়ে গেল।সোজা হয়ে দাঁড়ায়।তিতলি এগুচ্ছে।চোখ জোড়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে।নিঝুম খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করলো।১৬-১৯ ছর বয়সী মেয়েরা আবেগী হয় বড্ড!এরা আবেগের সমুদ্রে সাতার কাটে।কোনো ক্লান্তি নেই তাতে।তিতলি নিঝুমের কাছে এসেই গলা জড়িয়ে ধরে দু’হাতে।নিঝুমের বুকে হাতুড়ি পেটা চলতে থাকে অনবরত।হুট করে তিতলি চুমু খেয়ে বসে।এতো রোমান্টিক, দুষ্টু নিঝুমেরও মুহূর্তে নিজেকে দূর্বল মনে হলো।তিতলি এমন পাগলামি এই প্রথম করলো!নিঝুম দু’হাতে তিতলিকে জড়িয়ে ধরার পূর্বেই তিতলি ছুটে পালিয়ে যায়।নিঝুম হতভম্ব।কি হলো বুঝলো না।যখন বুঝতে পারে মাথা চুলকিয়ে হাসলো।
— “নির্জন?” নিঝুম ডাকলো।
নির্জন বাইরে বের হতে যাচ্ছিলো।নিঝুমের ডাকে ফিরে তাকায়।নিঝুম বললো,
— “তিতলির হোস্টেল থেকে ওর যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসবি।”
— “ওকে।”
— “আর শোন?”
— “হুম?”
— “ওর ফ্রেন্ড পাবি একটা।নাম শান্তা।সুন্দর আছে।আলেহা ফুফির ছোট ছেলের সাথে যদি লাইন লাগাতে পারিস।দেখিস।” নিঝুমের ঠোঁটে হাসি।
নির্জন তীর্যকভাবে তাকায়।তারপর বললো,
— “কেন বলতো?”
— “তিতলি আর শান্তা ফ্রেন্ড।বেস্ট ফ্রেন্ড।”
— “এইবার বুঝছি।আচ্ছা দেখবনে।”
— “ওকে যা।”
— “বাই।”
নিঝুম  ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসে।তিতলি তখনি আসে।
— “শুনুন?”
নিঝুম তাকায়।তিতলি বললো,
— “হোস্টেলে দিয়ে আসুন।”
নিঝুম মুখ গম্ভীর করে বললো,
— “হোস্টেলে আর যাচ্ছো না।”
— “কিন্তু…”
— “তিতলি আমাকে রাগিয়ো না।”
তিতলি চুপ হয়ে যায়।তারপর আবার অনুরোধ করলো,
— “আচ্ছা কাপড়চোপড় নিয়ে আসি।শান্তার সাথে দেখা করে আসি?”
— “ওই হোস্টেলে যাওয়ার দরকার নেই।”
— “কেনো?”
— “তুমি হোস্টেলে গেলেই জবাবদিহি করতে হবে। আর আমি চাইনা তুমি কারো কাছে জবাবদিহি করো।”
— “করলে কি হবে?”
নিঝুম চোখ গরম করে তাকায়।
— “এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার? গার্ড, ম্যানেজার সবাই তোমাকে সামনে দাঁড় করিয়ে একটার পর একটা কৈফিয়ত চাইবে।গতকাল রাতের ব্যপারে! আর আমি সেটা হতে দিবো?” নিঝুমের গলায় তেজ।তিতলি ভয় পেয়ে চুপ হয়ে যায়।আঞ্জুমান এগিয়ে আসেন।বলেন,
— “আব্বা? বকছিস কেন?”
নিঝুম নিশ্চুপ। তিতলির নাকের পাটা লাল হয়ে যায়।নিঝুম তাকাচ্ছেই না তার দিকে।ছলছল চোখে আঞ্জুমানের দিকে তাকায়।আঞ্জুমান চোখের ইশারায় সান্ত্বনা দেন।নিঝুম উঠে আলতাফ চৌধুরীর রুমে যায়।তিতলি আহত হয়।কি এমন করলো যে, এমন করতে হলো?নিঝুম বাবার রুমের দরজায় এসে বললো,
— “আসব আব্বু?”
আলতাফ চৌধুরী বই পড়ছিলেন।চোখ তুলে তাকান।পা ভাঁজ করে বসতে বসতে বলেন,
— “আয়।আয়।”
নিঝুম বাবার পাশে বিছানায় গিয়ে বসে।চোখের চশমাটা ঠিক করে বললো,
— “আব্বু,কুমিল্লা চলেন?”
আলতাফ চৌধুরী সুক্ষ্ণভাবে তাকান।বলেন,
— “আজি বিয়ে করতি নি?”
বাবার কথা বলার ঢং দেখে নিঝুম হেসে ফেলে।বললো,
— “না আব্বু।”
— “তাহলে?”
— “আজ রাত ১২ টার পর তিতলির জন্মদিন।ভাবছিলাম,এখানেই পার্টি করবো। কিন্তু তিতলির পছন্দ না জন্মদিন নিয়ে পার্টি করা।তাই,শুধু একটা সারপ্রাইজ….”
— “থাক।বুঝছি।কখন রওয়া দিতে হবে?”
— “দু’ঘন্টা পরই ?”
— “কি বলস?এতো জলদি? আবার বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাবো।কোনো প্ল্যান…”
— “প্লীজ আব্বু।” নিঝুমের অনুরোধ।
— “আচ্ছা।তোর মা-বোনদের তো নিয়ে যেতে হবে।বলে দেখ,ওদের সাজগোজ দু’ঘন্টার মধ্যে শেষ হবে নাকি।”
— “ওদের বলে রাখছি।ওরা রেডি।”
অবাক চোখে তাকান আলতাফ চৌধুরী। আর্তনাদ করে বলেন,
— “সব রেডিই করেই বাপের কাছে আসছেন?”
নিঝুম লজ্জায় চোখ নামায়।আলতাফ চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
— “তো তিতলির সামনেই বিয়ে পাকা হবে নাকি? তাহলে সারপ্রাইজ কেমনে?”
— “না আব্বু।নির্জনকে ভোরেই সব বুঝিয়ে দিয়েছি।আপনি শুধু শাহেদ চাচ্চুকে রাজি করাবেন।আপনারা সব রেডি রাখবেন।আমি রাত ১২ টার পর তিতলিকে নিয়ে পৌঁছাবো।”
ছেলের পকপক দেখে আলতাফ চৌধুরী অবাক হন।কি ছেলে কি হলো?তারপরই বলেন,
— “বুঝছি।তিতলি জানবে না আমরা যে গেছি তাইতো?”
নিঝুম হেসে মাথা নাড়ায়।তারপর বললো,
— “আসি আব্বু।”
নিঝুম বের হয় আঞ্জুমান এসে ঢুকেন।স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
— “দেখছো কারবারটা? নিজের বিয়ে নিয়া কেমনে লাফাইতাছে।আর সব কিছু নিজেই ঠিক করতাছে।”
আলতাফ চৌধুরী হাসেন।আঞ্জুমান আবার বলেন,
— “আমার লাজুক ছেলেটার লজ্জা কই যে গেলো!”
সবাই রেডি।দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে।মৌনতা রুম থেকে নিঝুমকে কল দিয়ে বলে, তিতলিকে নিয়ে বের হয়ে যেতে নয়তো ওরা এখন বের হতে পারবে না।নিঝুম দ্রুত রেডি হয়।তিতলি নিঝুমের রুমেই ছিল।প্রশ্ন করে,
— “কই যাবেন?”
— “তোমাকে বলতে হবে?”
তিতলি মুখ ভার করে নখ খোঁচায়।নিঝুম একটা বোরকা হিজাব দিয়ে বললো,
— “তাড়াতাড়ি পরো।”
— “কই যাবো আমরা?”
— “পরতে বলছি পর।”
অগত্যা তিতলি বোরকা পরে নেয় চুপচাপ। নিঝুম তিতলির হাতে ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে।মুখে কোনো কথা নেই তাঁর।গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে।ড্রাইভিং সিটে বসে। পাশের সিটের দরজা খুলে দিয়ে বললো,
— “উঠে বসো।”
তিতলি উঠে বসে।নিঝুম দরজা লক করে গাড়ি স্টার্ট দেয়। তারপর বললো,
— “আমরা আজ গাড়ি দিয়ে ঘুরবো সারাদিন।”
তিতলি খুশি হয়নি।কারণ,নিঝুম তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে।তাই সে মুখ ভার করে রাখে।নিঝুম বললো,
— “সরি।”
তিতলি তাকায়।নিঝুমও তাকায়।আবার বললো,
— “সরি।”
তিতলি হেসে নিঝুমের এক হাতের বাহু চেপে ধরে।অভিমান স্বরে বললো,
— “আমি কষ্ট পেয়েছিলাম।’
— “জানি তো।”
তিতলি নিশ্চুপ। নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “আমাদের বিয়ের প্রথম রাত নিয়ে তোমার কোনো ইচ্ছে আছে?”
তিতলি যেন অবাক হলো খুব।নিঝুমের চোখের দিকে তাকায়।নিঝুম আবার বললো,
— “আছে?”
নিঝুম উৎসুকভাবে তাকায়।তিতলি বললো,
— “একটা মুভি দেখে একটা ইচ্ছে হয়েছিল।”
— “কি?”
তিতলি হেসে নিঝুমের কাঁধে মাথা রাখে তারপর বললো,
— “আমাদের বিয়ের প্রথম রাতের খাট হবে গোল।চাদর হবে সাদা।খাটকে ঘিরে সাদা পর্দা থাকবে।পুরো রুমের জানালা-দরজায় থাকবে সাদা পর্দা।ডিম-লাইট জ্বলবেনা।ঘরের এক কোণে জ্বলবে মোমবাতি।”
নিঝুম মুগ্ধতায় বললো,
— “বাব্বাহ।”
তিতলি হেসে আরো জোরে চেপে ধরে নিঝুমের বাহু।নিঝুম আবার প্রশ্ন করে,
— “বিয়ের দিন কি রঙের বেনারসি পরতে চাও?”
— “লাল টুকটুকে। আচ্ছা,আপনার ইচ্ছে কি প্রথম রাত নিয়ে?”
— “আমার?”
— “হুম আপনার!”
— “না বলা যাবে না।তুমি লজ্জা পাবে।”
— “পাবো না বলেন।”
— “না পাবে। লজ্জায় অজ্ঞান হয়ে যেতে পারো।”
তিতলি চুপ হয়ে যায়।তবে,একটু দূরে সরে বসে।নিঝুম হেসে বললো,
— “তিতলি জেদ করোনা।সত্যি তুমি লজ্জা পাবে।”
— “পেলে পাবো।”
— “আচ্ছা বলছি।”
তিতলি উৎসুক হয়ে তাকায়। নিঝুম এক পাশে গাড়ি থামায়। তারপর তিতলির চোখে চোখ রাখে। বললো,
— “সাদা রঙ পবিত্র।আর পবিত্র রঙ দ্বারা পবিত্র নারীদের মানায়।আমার চোখে পবিত্র নারী আমার তিতলি।আমি চাই,জীবনের শ্রেষ্ঠ রাতটাতে তুমি পবিত্রতার রানী হয়ে সামনে আসো।’
— “তারপর?”
নিঝুম হেসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।বলে,
— “বিয়ের দিন মেসেজ করে বলবো।”
— “দূর।”
নিঝুম হেসে উঠে বলে,
— “পাগলি।”