প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪০

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪০
ইলমা বেহরোজ
— “শাহেদ? আছিস কই ব্যাঠা।” আলতাফ চৌধুরীর হুংকার। বাড়ির ভেতর থেকে শাহেদ আগে আগে বেরিয়ে আসেন।পিছনে তিথিয়া আর তার মা।চৌধুরী বাড়ির সবাইকে দেখে রীতিমতো অবাক হোন তিনি।মেয়ে কোনো ভুল করলো নাকি?খুব সাবধানে জিজ্ঞাসা করেন,
— “কিছু কি হয়েছে?” শাহেদের চোখেমুখে আতংক।
আলতাফ চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে, বলেন,
— “মেয়ের খবর রাখিস?”
শাহেদের মুখটা চুপসে যায়।স্ত্রীর দিকে তাকান।স্ত্রী ভেংচি দিয়ে অন্য দিকে তাকান।উনার প্রকাশভঙ্গী বলছে,দেখো,দেখো।তোমার আদরের মেয়ে কোন কু-কাজ করেছে।জানতাম এমনি হবে।
শাহেদকে চুপ থাকতে দেখে আলতাফ চৌধুরী হেসে এগিয়ে আসেন।বুকে বুক মিলান।শাহেদ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।তিনি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকান।আলতাফ চৌধুরী বলেন,
— “মেয়ের বয়স তো আজ উনিশ হতে যাচ্ছে। বিয়ে কি দিবিনা?”
শাহেদ হাসেন।বলেন,
— “ভালো ছেলে পেলে তো দিবোই।”
— “আমার নিঝুম কি ভালোনা?”
শাহেদ,তার স্ত্রী, তিথিয়া যেন বুঝতে পারলোনা।ভারী অবাক চোখে তাকায়।আলতাফ চৌধুরী বলেন,
— “আমার ছেলে কি তিতলির জন্য উপযুক্ত নয়?”
শাহেদের বিস্ময় কাটছেইনা।গোল সোনালি ফ্রেমের আড়ালে চোখ দুটি গোল হয়ে তাকিয়ে আছে।তিনি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!নিঝুম একজন সফল ডাক্তার।কত জ্ঞানী।তাঁর সাথে তিতলি?আঞ্জুমান এগিয়ে আসেন।চোখ থেকে সানগ্লাস টা খুলে বলেন,
— “ভাই সাহেব।আপনার মেয়ে ভালো থাকবে আমাদের কাছে।”
শাহেদ চোখের চশমাটা হাতে ধরে নাকের ডগা থেকে টেনে এনে, চোখে পরেন।তারপর বলেন,
— “নিঝুম-তিতলির মতামত কি?”
সবাই হেসে উঠে।যেন তিনি কৌতুক শোনালেন।আলতাফ চৌধুরী শাহেদের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
— “লাইলি-মজনুর কাহিনি জানিস তো?”
 শাহেদ বিব্রতবোধ করেন। আমতা আমতা করে বলেন,
— “জানি।”
— “নিঝুম-তিতলিও সেই পর্যায়ে চলে গেছে।”
আলতাফের মুখে হাসি।শাহেদ কতক্ষণ হা হয়ে থাকেন।তারপর চোখের চশমাটা ঠিক করতে করতে  হাসেন।আলতাফ হেসে জড়িয়ে ধরেন।বলেন,
— “তুই তো আমার হবু বেয়াইসাব হয়ে গেলি রে।”
শাহেদ সোজা হয়ে দাঁড়ান।প্রশ্ন করেন,
— “বিয়ের তারিখও কি ঠিক?”
আলতাফ আঞ্জুমানের দিকে তাকায়।তারপর বললো,
— “সেটা স্বয়ং বর আগেই ঠিক করে নিয়েছে।আগামী বুধবার।”
— “আর সাত দিন?” আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করেন।
— “হু।” হতাশা নিয়ে বলেন আলতাফ।আবারো বলেন,
— “ভাবিস না।সাত দিনেই ধুমধাম বিয়ে আয়োজন করে ফেলবো।”
— “সেটা তো ব্যপার না।আমারো প্রচুর অর্থ জমা আছে, মেয়েদের বিয়ের জন্য।রাজ আয়োজন করা যাবে।তবুও…।’ শাহেদ থামেন।তারপরই হেসে বলেন,
— “সমস্যা নাই।তো এই কথাই রইলো?”
— “সে কি আর বলতে? বরের আদেশ বলে কথা!”
সবাই হেসে উঠে।হাসি নেই তিতলির সৎ মায়ের ঠোঁটে।বুক জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে তাঁর।বড় মেয়ের বিয়ের আগে সতিনের ছোট মেয়ের বিয়ে!শাহেদ বলে,
— “কি কারবার!এতো দূর থেকে এসেই বিয়ের আলাপ শুরু।তোরা তো বাড়িতেই ঢুকস নাই।”
রাত ৮ টা ২৩।তিতলি বুঝতে পারছে না ওরা যাচ্ছে কোথায়।জিজ্ঞাসা করলে নিঝুম বলে,
— “এইতো ঘুরছি।”
কিন্তু তিতলির মনে হচ্ছে তাঁরা সিলেটের বাইরে কোথাও যাচ্ছে।কিন্তু কোথায়?
— “এইযে?” তিতলি হাতের চুড়ি গুলোতে টুংটাং আওয়াজ তুলে বললো।নিঝুম বললো,
— “হুম?”
— “যাচ্ছিটা কই? বলবেন প্লীজ?”
— ‘ঘুরছি।”
— “আমরা সিলেটের বাইরে চলে আসছি।এখন ঢাকাতে আছি।তাইনা?” সরু চোখে তাকিয়ে বললো তিতলি।
নিঝুম তিতলির দিকে তাকিয়ে হাসে।মোহনীয় সেই হাসি।তিতলি বললো,
— “ছেলেদের হাসি এতো সুন্দর হতে নেই।”
— “আমার হাসি সুন্দর?”
— “তো কাকে বলছি?”
— “ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান প্রশংসার জন্য।”
তিতলি ভেংচি কেটে বললো,
— “আপনি কেনো আমাকে ভালবাসেন?”
— “সব কেনোর উত্তর হয়না তিতলি।”
— “আচ্ছা,এটা বলুন আমার প্রতি দূর্বল হলেন কবে?” ভারী উৎসাহ নিয়ে বললো তিতলি।
— “চা-বাগানে হয়তো।”
তিতলি দূর রাস্তায় তাকায়।তারপর আবার বললো,
— “নিশার চেয়েও বেশি ভালবাসেন আমায়?”
— “তোমার কি মনে হয়?”
— “বেশি।”
— “তাহলে প্রশ্ন কেনো?”
— “এমনি।”
— “আমি নিশাকে ভালোই বাসিনি।”
— “হুম।”
— “নিশার সাথে যখন আমার একটা সম্পর্ক ছিল তখন আমি ডাক্তারি পড়ছি।বইয়ের মাঝে ডুবে থেকে সময় যেতো।রাতে ঘুমাবার আগে ফোনে কথা হতো।নিশার অভিযোগ শুনতাম।অন্যদের বিএফ ঘুরতে নিয়ে যায়,রুম ডেট করে,পার্টি করে কত কি করে আমি কেনো করি না।এমন হাজারটা অভিযোগ।কখনো কানে তুলিনি।সপ্তাহে একদিন ঘুরতে নিয়ে যেতাম।”
— “পানসে সম্পর্ক ছিল?”
— “হুম।”
— “কিন্তু আমার বেলা…”
কথা কেড়ে নিয়ে নিঝুম হেসে বললো,
— “হস্পিটেলেও যেতে ইচ্ছে হয়না।ইচ্ছে হয় সারাক্ষণ ঘেঁষে থাকি।”
তিতলি হেসে মাথা নত করে।নিঝুম আবার বললো,
— “নিশা আমাকে বলতো, আমি নিরামিষ,তেঁতো। আনরোমান্টিক!আরো কত শত নিক-নেম ছিল আমার।” নিঝুমের ঠোঁটে হাসি।তারপর আবার তিতলিকে জিজ্ঞেস করে,
— “তুমি কি বলবে?”
তিতলি নিঝুমের দিকে একবার তাকায়।তারপর বাইরে তাকায়।তারপর আবার নিঝুমের দিকে তাকায়।চোখে চোখ রেখে ক্ষীণ স্বরে বললো,
— “‘আপনি প্রেমিক! ভয়ংকর প্রেমিক!”
নিঝুম নিচের ঠোঁট কামড়ে সামনে তাকিয়ে হাসে।তিতলি কাচের জানালার বাইরে চোখ রাখে।হাসে সে, অনেকক্ষণ হাসে।
রাত ১২ টা প্রায়।রিদি আর তার বাবা নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরেছে সকালেই।রিদি সেই দুপুর থেকে দরজা লাগিয়ে রেখেছে।খাচ্ছেনা কিছু! আরমান অনেকবার ডেকেছেন কিন্তু রিদির এক কথা সে খুলবে না দরজা।রিদির বাথরুমের সাথে আরমান চৌধুরীর রুমের বারান্দা লাগানো।মেয়ে খায়নি তাই আরমান চৌধুরীর চোখে ঘুম নেই।সিগারেট নিয়ে বারান্দায় এসে বসেন।আচমকা উনার মনে হলো,পানির শব্দ!সাথে কেউ কাঁদছে। চিৎকার করে কাঁদছে।আরমান চৌধুরীর বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো।তাঁর মেয়ে যে কাঁদছে।আরমান চৌধুরী সিগারেট ফেলে দৌড়ে মেয়ের রুমের সামনে আসেন।গলার আওয়াজ লম্বা করে ডাকেন,
— “রিদি….মামনি দরজা খোল।একটাবার সামনে আয়।এভাবে কাঁদিস না।নিঝুমকে এনে দেব আমি।”
ভেতর থেকে সাড়া নেই।অনেকক্ষণ ডেকেও যখন সাড়া পাওয়া গেলো না মেয়ের।তিনি ড্রয়িংরুমে চলে আসেন।ভাবেন,নিঝুম নিশাকে ভালবাসতো।নিশা চলে যাওয়াতে তিতলিকে ভালবেসেছে।তিতলি যদি চলে যায়,আমার মেয়ে যদি তখন পাশে পাশে থাকে তাহলে নিঝুম রিদিকে ভালবাসবে!কিন্তু তিতলি দূরে যাবে কীভাবে?আরমান ভাবনায় পড়ে যান।সিগারেট জ্বালান।একটার পর একটা সিগারেট ফুরিয়ে আসে। তবুও উনার চিন্তার শেষ নেই।আচমকা মুখে হাসি ফুটে উঠে। বিড়বিড় করেন,আলতাফ ভাই ক্ষমা করিস আমায়।মেয়ের সুখের জন্য তোর দূর্বলতায় হাত বাড়াতে হচ্ছে আমায়।
তিতলি ঘুমাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে।আর ত্রিশ মিনিট তাহলেই পৌঁছে যাবে তিতলির বাড়ি।কিন্তু ১-২ ঘন্টা ধরে নিঝুমের বুকে জ্বালাপোড়া অনুভূতি হচ্ছে খুব।কারণ ছাড়া।বার বার তিতলির দিকে তাকাচ্ছে।কান্না পাচ্ছে খুব।তার তো কান্না পায়না অকারণে!  এমনকি কারণেও কান্না পায়না।আজ তবে কেনো?
তিতলির এক পাশের বাঁকা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।ড্রাইভ করার পাশাপাশি তাই দেখছে নিঝুম।বুকের যন্ত্রণাটা বেড়েই চলেছে।চোখ জোড়াতেও জ্বালা শুরু হয়েছে।নাকটা লাল হয়ে আসছে।অদৃশ্য কোনো কষ্টে সে মুখর হয়ে আছে।কিন্তু কিসের এতো বেদনা? আর চোখগুলো বার বার তিতলির দিকেই কেনো যাচ্ছে? কেনো ইচ্ছে হচ্ছে তিতলিকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে পিষে ফেলতে।চোখ দুটো তার লাল হয়ে এসেছে।নিঝুম জোরে নিঃশ্বাস নেয়।বুকের ভারটা কমাতে।তিতলি জেগে উঠে।নিঝুম দ্রুত সানগ্লাস পরে নেয়।তিতলি চোখ কচলে তাকায়।অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
— “রাতের বেলা সানগ্লাস কেনো?”
— “এমনি!” হালকা করে বললো নিঝুম।
— “খুলুন।”
— “না। থাকুক প্লিজ।”
তিতলি হাত বাড়িয়ে সানগ্লাস নিয়ে নেয়।তারপর হেসে বললো,
— “ঢং!”
নিঝুম তাকাচ্ছে না অনেকক্ষণ।তিতলি তাকায় নিঝুমের দিকে।অন্ধকারের জন্য দেখা যাচ্ছে না ভালো করে।এক পাশ শুধু দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। আচমকা, সামনের একটা গাড়ির আলো নিঝুমের চোখেমুখে এসে পড়ে।তখনি তিতলি দেখতে পায়,নিঝুমের নাক, চোখ লাল।মুখটা ফ্যাকাসে। তিতলির বুক ধ্বক করে উঠে। আতংকিত  কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,
— “কি হইছে আপনার? এমন দেখাচ্ছে কেনো?”
নিঝুম আর নিজের ইচ্ছে দমিয়ে  রাখতে পারেনি।দম বন্ধ কষ্টে তলিয়ে যাচ্ছে সে।কি জন্য এমন হচ্ছে?গাড়ি থামায় এক পাশ করে।তারপরই চোখের পলকে তিতলিকে এক টানে কাছে এনে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।তিতলি কেঁপে উঠে,হকচকিয়ে গেল হঠাৎ নিঝুমের আক্রমণে।ব্যাথা পাচ্ছে পিঠে।এতো জোরে ধরেছে নিঝুম।তবে সে  লক্ষ্য করে, নিঝুম নিঃশ্বাস নিচ্ছে ঘন ঘন।বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে তাঁর। যেনো ঝড় বইছে বুকে।নিঝুম ফিসফিসিয়ে বলল,
— “জানিনা।আমি জানিনা।তিতলি আমি তোমাকে সত্যি অনেক ভালবাসি।পাগলের মতো ভালবাসি।”

1 COMMENT

Comments are closed.