প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪১

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪১
ইলমা বেহরোজ
বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিতলি!নিঝুমের আচমকা মনে হলো, আজ তো তিতলির জন্মদিন।ওর সামনে এতো ইমোশনাল হওয়াটা ঠিক হচ্ছে না।চট করে সে নিজেকে সামলিয়ে নেয়।ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,
— “ভালবাসি খুব তোমায়।”
তিতলি কয়েক সেকেন্ড নিঝুমের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।তারপর বললো,
— “আমিও বাসি।খুব।”
নিঝুম হেসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।তিতলি বাইরে তাকায়।চারপাশটা তার চেনা মনে হচ্ছে।বিভ্রম নিয়ে প্রশ্ন করে,
— “আমরা কি কুমিল্লায়?”
নিঝুম উত্তরে হাসে।তিতলি হা হয়ে যায়।ভারী অবাক হয়ে বললো,
— “সত্যিই? আমরা কুমিল্লায়? ইয়া আল্লাহ!”
তিতলির কথা বলার ভঙ্গি দেখে নিঝুম ঠোঁট কামড়ে হাসে।তিতলি আবারো বললো,
— “বাবা জানে?আমরা যে যাচ্ছি?” একটু থেমে করুণ গলায় বললো,
— “রাত কয়টা বাজে? ১ টা নাকি ২ টা? এতো রাতে দুজনকে একসাথে দেখলে পাড়ার লোক কি ভাববে?”
নিঝুম ইষৎ ভ্রু কুঁচকে ফেলে। বললো,
— “পাড়া-পড়শী পাত্তা দেইনা আমি।”
নিঝুমের উত্তরে তিতলি সন্তুষ্ট হয়নি।কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠে।
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামায়।ফোন বের করে নির্জনকে টেক্সট করে সে।নির্জন জানায়।সব রেডি।এক ঘন্টা যাবৎ অপেক্ষা করছে তাঁরা।মৌনতা,মোহনা ঘুমিয়ে যাচ্ছে বার বার। তিতলি ফোনে উঁকি দেয়।নিঝুম ফোন চট করে পকেটে রেখে দেয়।তিতলি সন্দিহান চোখে তাকায়।নিঝুম গাড়ির দরজা খুলে বের হয়। বললো,
— “গাড়িতেই থাকবে নাকি নামবে?”
তিতলি বাধ্য মতো নেমে পড়ে।গেইটের সামনে এসে তিতলি গেইটে যখন আওয়াজ করতে যাবে।নিঝুম আটকায়।তারপর আস্তে করে ধাক্কা দিতেই খুলে যায়।তিতলি চমকায়!এতো রাতে গেইট খোলা তো কখনোই থাকেনা।ভাবনায় ডুবে সে!কি যেন একটা ব্যাপার আছে মনে হচ্ছে।
— “জন্মদিন!  হ্যাঁ জন্মদিন আজ!”
তিতলি আপন মনে বলে উঠে।তার মানে কোনো সারপ্রাইজ আছে?সারপ্রাইজ পাওয়ার কয়েক মুহূর্ত আগেই তার মনে পড়ে গেলো আজ তার জন্মদিন। খুশিতে সে গদগদ। নিঝুমের ডাকে ভাবনার সুতো কাটে।
— “তিতলি?”
— “হে?”
— “তোমার বাগানে চলো।”
— “হুম চলুন।”
তিতলি আগে আগে হাঁটা শুরু করে।নিঝুম চিন্তায় পড়ে যায়।মেয়েটা জিজ্ঞাসা করেনি কেনো? বলার সাথে সাথেই বাগানে চলে যাচ্ছে।বুঝে গেলো নাকি?
তিতলি বাগানে এসে থামে।চারিদিকে ঘুটঘুটে আঁধার।নিঝুম বাগানে এসে ফোন বের করে।নির্জনকে টেক্সট দিতে টাইপিং করা শুরু করে তখনই বিকট শব্দ হয়।তিতলি কান চেপে ধরে।আকাশে আলোয় আলোয় ভেসে উঠে,
“শুভ জন্মদিন টুকটুকি।”
তারপরই আবার নিভে যায়।তিন সেকেন্ড পর তিতলির চেয়ে অনেকটা দূরে সাদা রঙের বাতি জ্বলে উঠে অনেকগুলো। খেয়াল করে দেখে বাতিগুলো একটা বাক্য গঠন করেছে। বাক্যটা,
” Will You marrY me ? “
তিতলির হাত পা কাঁপতে থাকে খুশিতে।কাঁপা শরীরে ঘুরে দাঁড়ায়।নিঝুমের ঠোঁটে হাসি।চোখে চশমা।দু’হাত পকেটে রাখা। হাসির দমকে ঠোঁট কাঁপছে।হাসি আটকাতে বার বার ঠোঁট কামড়ে ধরছে ।তিতলি উত্তর দেওয়ার যোগ্য শব্দ পাচ্ছে না।সে ভাবতে পারছেনা উত্তরে হ্যাঁ বললেই নিঝুম ভয়ংকর প্রেমিক থেকে ভয়ংকর স্বামী হয়ে উঠবে!নিঝুম পকেট থেকে দু’হাত বের করে।হাত বাড়ায়।ইশারা করে বুকে আসতে।কিন্তু তিতলি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।নিঝুম এগিয়ে আসে।দু’হাতে আঁকড়ে ধরে তিতলিকে।অনেকক্ষণ পার হয় তিতলির সাড়া নেই।শরীর নিস্তেজ।নিঝুম দাঁত খুলে হেসে উঠে।মেয়েটা আর এই জগতে নেই খুশিতে!
— “এইখানেই থাকবি?নাকি রুমে যাবি?”
নির্জনের গলার স্বর শুনে নিঝুম তাকায়।হেসে তিতলিকে কোলে তুলে নেয়।নির্জনকে প্রশ্ন করে,
— “আব্বু, আম্মু,শাহেদ চাচ্চু কোথায়?”
— “ড্রয়িং রুমে।”
— “ওদের ড্রয়িং রুমটা কর্ণারে না?”
— “সমস্যা নাই।কয়দিন পর তোদের বিয়ে।লজ্জা কিসের?”
— “তবুও বড়রা না? তুই আগে আগে যা। সামনে যে রুম পাবো তিতলিকে রেখে দেব।”
নির্জন ফোন টিপতে টিপতে সামনে এগোয়।নিঝুম পিছন পিছন।
পা টিপে সদর দরজা দিয়ে ঢুকে।ড্রয়িং রুম দেখা যাচ্ছে।কিন্তু সবাই ব্যাস্ত।সামনে একটা রুম পেয়ে চট করে ঢুকে পড়ে।রুমে তিতলির সৎমা ছিল।নিঝুম খেয়াল করেনি।তিতলিকে শুইয়ে দিয়ে কপালে চুমু এঁকে যখনি বের হতে নিবে খেয়াল হয় রুমে আরেকজনও ছিল।নিঝুম অস্বস্তিতে পড়ে।কিছু না বলে বের হয়ে যায়।ড্রয়িং রুমে আসতেই শাহেদ বলে উঠেন,
— “আমার পছন্দের ছেলে আমার মেয়ের জামাই হবে!একজন বাবার কাছে এর চেয়ে খুশি আর কি হতে পারে?”
নিঝুম হেসে সালাম দেয়।আলতাফ চৌধুরীর পাশে বসে।মৌনতা বললো,
— “মাইয়া কি অজ্ঞান?”
নিঝুম হেসে মাথা নাড়ায়।আলতাফ বললেন,
— “পানি দে মুখে।তারপর নিয়ে আয়।আংটি পরানোর পর্ব শেষ করে ফেলি।কালতো ভোরে রওনা দেব নাকি।”
নিঝুম উঠে রান্নাঘরে চলে আসে।এক গ্লাস পানি নেয়।তিতলি যে রুমে সে রুমের দিকে যায়।
ড্রয়িংরুমে।মোহনার স্বরে আক্ষেপ ঝড়ে পড়ে,
— “দূর।এভাবে এনগেজমেন্ট হয়ে যাবে!পার্টি নাই।নাচ-গান নাই।”
আলতাফ সোফায় হেলান দিয়ে বলেন,
— “তোর ভাই বিয়ে ঠিক করেছে সাত দিন পরই।গায়ে-হলুদ,বিয়ে,বৌ-ভাত কত কিছুর আয়োজন করতে হবে।সুযোগটা কই?আলাদা আয়োজন করে আংটি পরানোর?”
মোহনা চুপ হয়ে যায়।
কিছুকক্ষণ পর নিঝুম আগে আগে তিতলি পিছন পিছন হেঁটে আসে।তিতলির মাথায় ঘোমটা।লজ্জায় কান দিয়ে যেনো ধোঁয়া বের হচ্ছে।তিতলি বাবার পাশে বসে।নিঝুম আলতাফের পাশে বসে।নির্জন একটার পর একটা ক্লিক করেই যাচ্ছে।আঞ্জুমান আংটি নিয়ে এগিয়ে আসেন৷তিতলিকে পরাতে।তখনি নিঝুম বললো,
— “আমার বিয়ে? আমি আংটি পরাবোনা?”
উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠে।তিতলির মুখে লাল আভা বৃদ্ধি পায়।নিঝুম হকচকিয়ে গেল। আঞ্জুমান আংটি নিঝুমের হাতে দেন।আর বলেন,
— “যা পরা।”
নিঝুম পরাতে আসে।শাহেদ চিন্তায় পড়েন।নিঝুমকেও তো আংটি পরাতে হবে।কিন্তু হুট করে সব হয়ে গেলো।তিনি তো নিঝুমের জন্য আলাদা আংটি গড়ার সুযোগই পান নি।’আসছি’ বলে তিনি নিজের রুমে আসেন।স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
— “আলমারির চাবিটা দাও।”
— “কি দরকার।”
— “আংটি টা লাগবে!”
রোমেনার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো।বললো,
— “ওই হীরার আংটি টা?”
শাহেদ কড়া গলায় বলেন,
— “চাবি দিতে বলছি?”
— “ওই আংটি দিয়া কি করবা তুমি?”
— “নিঝুমকে পরাবো।”
— “এতো দামী…”
শাহেদ কথা কেড়ে নিয়ে বলেন,
— “আংটি তো তোমার না রোমেনা।জেসমিনের (প্রথম স্ত্রী)দেওয়া আংটি।তার মেয়ের জামাইকে তার দেওয়া আংটি পরাবো।সেখানে তোমার কথা বলার অধিকার নেই।”
রোমেনা মুখ ঘুরিয়ে ফেললো।শাহেদ রোমেনার আঁচল থেকে চাবি খুলে নেন।আলমারি খুলে আংটি হাতে নিতেই আবদুল মিয়ার শরীর শিউরে উঠে! জেসমিন ছোট থেকে একটা ব্যাংকে টাকা জমাতো।যখন তাঁদের প্রেম হয় শাহেদ ছিলেন বেকার।এমতাবস্থায়ই জেসমিন পালিয়ে আসে তার সংসারে।সাথে নিয়ে আসে সারাজীবনের সঞ্চরিত টাকায় এই উপহার।যা পরিয়ে দেয় বিয়ের রাতে!
অতীতের সব মুহূর্ত যেন পলকে চোখে ভেসে উঠে।আবেগী হয়ে উঠেন এই বয়সে এসে।কথা ছিল বৃদ্ধকালেও একজন আরেকজনের পাশে থাকবে।কিন্তু নেই! নেই সে! থাকবেই কেমনে?সে যখন ছিল তখনি তো ঘরে নিয়ে আসা হয় সতিন!
ভোর পাঁচটা ত্রিশ তখন।ছয়টার মধ্যে বের হতে হবে।ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে সিলেট যাবার প্ল্যান করেছেন আলতাফ।নির্জন নিঝুমের কাছে আবদার করেছে গাড়িটা দিতে।রোহিকে নিয়ে লং ড্রাইভে বের হবে আট টায়।নিঝুম সায় দেয়।সবই ঠিক ঠাক ছিল।হুট করে যেন বিস্ফারণ হয়।মৌনতা যখনি বললো,
— “তিতলি সাত দিন পর দেখা হচ্ছে আবার।”
নিঝুমের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে।রাগ উঠে যায় হুট করে।মৌনতাকে ধমকে বললো,
— “সাত দিন পর মানে?”
— “এমা!ভাইয়া তিতলিকে এখনও নিয়ে যাবা নাকি?”
— “তো কি রেখে যাবো?”
— “এভাবে কথা বলছো কেন?”
আঞ্জুমান এগিয়ে আসেন।বলে,
— “কি আব্বা? চেঁচাচ্ছিস কেন?”
— “আম্মু?তিতলিকে নাকি রেখে যাওয়া হবে?”
আঞ্জুমান হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
— “সাত দিন পর বিয়ে।এখন নিয়ে যাওয়াটা ভালো দেখায় না বাপ।”
নিঝুম কিছু বলতে যাবে তখন আটকায় তিতলি।বললো,
— “সাত দিনই তো। ব্যাপারনা।দেখতে দেখতে কেটে যাবে।” মৌনতা, আঞ্জুমান সরে যায়।নিঝুম তিতলির দিকে এগোয়। বললো,
— “কেমনে থাকবো? সাত দিন না দেখে?”
তিতলি নিঝুমের দু’হাত মুঠো করে ধরে বললো,
— “এইটুকু তো সহ্য করতেই হবে।কষ্ট ছাড়া কি কেষ্ট মিলে?সাত দিন পর থেকে আর আলাদা হবো না।”
নিঝুমের গলা কাঁপতে থাকে।মাথা নিচু করে নিঃশ্বাস নেয় কয়েকবার।তারপর চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
— “খুব মিস করবো।খুব।”
— “আমিও।”
নিঝুম নিশ্চুপ।তার হাঁসফাঁস লাগছে।বাতাসটাও তেতো লাগছে।খুবই তিক্ত চারপাশ।তিতলির ও জানি কেমন অনুভূতি হচ্ছে।বুকটা ভারী খুব।সে আবেদনময়ী গলায় বললো,
— “অনেক শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরবেন আমায়?”
নিঝুম শুনামাত্রই জাপটে ধরে তিতলিকে।খুব শক্ত করে।শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে।তিতলি ফোঁপাতে থাকে।বুকে যেন রক্তকরণ হচ্ছে!খামচে ধরে রেখেছে নিঝুমের পিঠ।ছেড়ে দিলেই যেন হারিয়ে যাবে।নিঝুম কাঁদতে গিয়েও কাঁদতে পারছে না।
— “নিঝুম?” আঞ্জুমানের ডাক।
মায়ের ডাক শুনে নিঝুম তিতলিকে ছেড়ে দেয়।
— “জলদি আয় আব্বা।৮ টার মধ্যে তো পৌঁছাতে হবে।” আঞ্জুমানের উচ্চ গলা।
নিঝুম তিতলির কপালে চুমু এঁকে বললো,
— “আসি?’
তিতলি খামচে ধরে নিঝুমের শার্ট।ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছে তার।নিঝুম বললো,
— “তাহলে সাথে চলো?”
তিতলি চট করে চোখের জল মুছে বললো,
— “আপনি যান।সাবধানে যাবেন।”
নিঝুম তিতলির দু’গালে হাত রেখে বললো,
— “নিজের খেয়াল রেখো।”
— “রাখবো।আপনিও।”
— “কইরে নিঝুম?” আলতাফ চৌধুরীর গলা।
নিঝুম তিতলিকে ছেড়ে গেইট থেকে বেরিয়ে পড়ে।তিতলি পিছন থেকে চিৎকার করে বললো,
— “আমি আপনায় খুব ভালবাসি ডাক্তার।”
নিঝুমের কানে কথাটা আসতেই পায়ের নিচের মাটি শিরশির করে উঠে।মাথা নিচু করে গেইটের বাইরে থেকে উঁকি দেয়।তিতলি হেসে ফেলে।নিঝুম হাতে নেড়ে ‘বিদায়’ জানায়।তারপর গাড়িতে এসে বসে পড়ে।গাড়ি স্টার্ট দেয়।তিতলি দৌড়ে আসে গেইটের বাইরে।গাড়ি যতক্ষন দেখা যায়,তাকিয়ে থাকে।চোখের সামনে উধাও হয়ে যায় গাড়ি।তিতলির বুকটা হাহাকার করে উঠলো।নিস্তেজ শরীর ঠেলে নিয়ে আসে পুকুরঘাটে।সিঁড়িতে বসে।বুক ফেটে কান্না আসছে। মন ভরে কাঁদার জন্য পুকুরে নেমে পড়ে।স্মৃতিচারণ করতে থাকে।৮-৯ মাস পূর্বে এই পুকুরেই তো নিঝুম গোসল করেছিল?বড্ড আপন মনে হয় এই জল।আঁকড়ে ধরার বৃথা চেষ্টা করে তিতলি।কিন্তু পারছে না!মন কেমন করছে যেন।তিতলি ঝিম মেরে জলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
— “এই ভোরবেলা জলে নামলি কেন?”
শাহেদের কণ্ঠে তিতলি কেঁপে উঠে ফিরে তাকায়।তাঁর কিছু ভালো লাগছে না।সব শূন্য লাগছে।শাহেদের জবাব দিল না।ঘাড় ঘুরিয়ে জলে ডুব দিল।