প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪২

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪২
ইলমা বেহরোজ
গায়ে হলুদের দিনটা কাটে আনন্দে।পাড়া-প্রতিবেশী মহিলারা সারাদিন তিতলিকে লজ্জা দিয়ে গেল।সবার মুখে বাসর রাতের কথা।যত অশ্লীল কথা-বার্তা আছে সবই আজ শুনেছে সে।তবে,ভেতরটা সুখে টুইটুম্বুর ছিল।আর একটা রাত তারপরই চিরদিনের জন্য সে নিঝুমের।যখনি ভাবে তখনি শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে।রুমের দরজা বন্ধ করে নেচেছে খুশিতে।জানালা দিয়ে তা দেখেছে শাহেদ।কি খুশি তিনি,মেয়েটার সুখ দেখে।বিগত ৫-৬ টা দিন খুব দম বন্ধ অনুভূতিতে কাটে।তবে,দিন শেষে ফোনালাপ হয় রাতভর।কিন্তু তৃপ্তি ছিল না।বেশিক্ষণ দুজন চুপ থাকতো।একজন আরেকজনের গভীর নিঃশ্বাস শুনতো।
নিঝুম সারাদিন নিজ আসনে বসে ছিল।সবার নাচ গান দেখেছে।আর ভেবেছে, কতরূপে, কতভাবে তিতলিকে ভালবাসা যায়।তিতলির সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো ভেবে বার বার হেসে উঠছিল সে।উপস্থিত সবাই সেটা লক্ষ্য করেছে।নির্জনতো বলেই ফেললো,
— “বাজান দেখি হেব্বি খুশি?”
— “আমি তোর বাজান লাগিনি?”
— “কথার কথা মিয়া।”
এর মাঝে নিঝুমের ফ্রেন্ড অরুন আসে।নিঝুমের পিঠ চাপড়ে বললো,
— “তো চৌধুরী সাহেব?মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত ?”
নিঝুম চোখের চশমাটা ঠিক করে বললো,
— “মাঠে কেন?”
— “আরে বাবারে!চৌধুরী মিয়া দেখি ভাজা মাছ উল্টে দিতেও চিনেনা ভাব নিচ্ছে।”
নিঝুম গলা খ্যাঁক করে উঠে।তারপর বললো,
— “অশ্লীল কথা ছাড়ো মিয়া।তোর না বাচ্চা হবে?এসব বলিস না।তাহলে, দেখবি তোর ছেলেও তোর মতো লুইচ্ছা হইছে।”
অরুন ভারি অবাক হয়ে বললো,
— “কি কস ব্যাটা? বাচ্চা কি আমার পেটে নাকি? বউয়ের পেটে!”
— “তোর পেট দেখে যা মনে হলো তাই বললাম।” নিঝুম এদিকওদিক তাকিয়ে উঠে পড়ে।নির্জন জোরে হেসে উঠে অরুণকে বললো,
— “শালা পেট টা কমা।”
রাত নয়টায় বরের বাড়ি থেকে কনের যাবতীয় শাড়ি-গহনা চলে আসে।রাত দুটোতে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা-ফূর্তি শেষ করে নিঝুম,তিতলি নিজেদের রুমে আসে।তিতলি নিঝুমের দেওয়া লাল বেনারসিটা বুকের সাথে চেপে ধরে চোখ বুজে থাকে অনেকক্ষণ।চারপাশ রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে তার।অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি।তবে,তার মাঝে চাপা হয়ে আছে আরেকটা অনুভূতি!ফোনটা বেজে উঠলো।তিতলি শাড়িটা কাঁধে নিয়ে ফোন হাতে নেয়।নিঝুমের কল!ঠোঁটে হাসি ফুটে।রিসিভ করে,
— “হ্যালো?” তিতলির গলা।
ওপাশ থেকে ভেসে আসে উল্লাসধ্বনি,
— “আমার বউ!আমার বউ! আমার বউ! আমার বউ! আমার বউ!আমার ব….”
— ” আল্লাহ!থামেন।”
— “কেন? শুনতে ভালো লাগছে না?”
— “তা নয়।আপনি তো দম ও নিচ্ছিলেন না।”
— “দম নিতেও চাই না।সারাদিন-রাত জপবো আমার বউ তুমি।”
তিতলি কলকল ধ্বনিতে হেসে উঠে।নিঝুমও হাসে।বললো,
— “স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে অবশেষে।”
— “হ্যাঁ! কত লালিত স্বপ্ন বুকে বাসা বেঁধেছে।’
— “শুনি একটু?”
— “বিয়ের রাতে বলবো।”
— “উহু! বিয়ের রাতে কোনো কথা নেই।শুধু প্রেম!”
তিতলি হাসে।নিঝুম বললো,
— “বলো?”
— “কি বলবো?”
— “বুকের জমা লালিত স্বপ্ন।”
— “ওইতো ভেবেছি,সবসময় শাড়ি পরবো।কোমরে আঁচল গুঁজে রান্না করবো আপনার জন্য।হসপিটাল যাওয়ার আগে শার্ট, জুতো, টাই পরানোর দায়িত্ব আমি নিবো।তিনবেলা খাইয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার হবে।বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় ধোঁয়া উঠানো চা কাপ নিয়ে দুজন পাশাপাশি বসে গল্পে মাতবো।ছুটির দিনে বৃষ্টি হলে ছাদে দুজন ভিজবো।আরো আছে….’
— “আমার সাথে থেকে দেখছি রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছো।”
— “আপনি রোমান্টিক নাকি?”
— “তো?”
— “লম্পট।”
— “সেটা তো তোমার জন্য।”
তিতলি নিশ্চুপ।নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “আচ্ছা বিয়ের পর যা-ই  করি হালাল তাইনা?”
— “মানে?”
— “ওইতো ছুঁয়ে-টুঁয়ে দেওয়া।” নিঝুমের কণ্ঠে ফাজলামো।
— “ছিঃ!আর হালাল।”
— “ইশ! মিস করবো।”
— “কি?”
— “তোমার বকাটা।”
— “কোনটা?”
— “চরিত্রহীন বলে বকে দেওয়াটা।”
তিতলি জোরে হেসে উঠে।নিঝুম বললো,
— “প্রেমের পর কয়েকদিন তুমি সম্বোধন করছিলে মাঝে মাঝে।তারপর আবার সেই আপনি! এবার কি তুমি বলবেন ম্যাম?”
— “ট্রাই করবো।”
— “উহু বলতেই হবে।বউ রূপে আপনার মুখে তুমিটাই শুনতে চাই ম্যাডাম।”
— “ম্যাডাম, ম্যাডাম করছেন কেনো?”
— “অভ্যাস করছি।”
— “কি?”
— “বিয়ের পর সব মেয়েই ম্যাডামের রূপ নেয়।তার চেয়েও বাঘিনী রূপ নেয় অনেকে।”
— “মজা করছেন? আমি ওরকম না হ্যাঁ। যথেস্ট ঠান্ডা মেয়ে।”
— “দেখা যাবে।”
— “হুহ।”
বেশ ক্ষণ পিনপতন নীরবতা।
— “এই লাজুকলতা?” জড়ানো গলা নিঝুমের।
— “আপনার এই ডাকটা ভয়ংকর।”
— “ভালবাসি।”
— “জানি।”
— “পৃথিবীর যে সুখটা তুমি চাও।তাই তোমার পায়ে ছড়িয়ে দেব।”
— “আপনার ভালবাসার চেয়ে সুখ আর আছে নাকি?”
— “যদি নাইবা থাকে।তাহলে,আমি ছাড়া কখনো দূরে থেকো না।”
— “সুখ কে ছাড়তে চায়?”
— “কথা বলার ধরন পাল্টে  গেছে তোমার।”
— “কেমন?”
— “আবেগী বানিয়ে দিতে পারো খুব সহজে।”
তিতলি নিশ্চুপ।হালকা হাসে।নিঝুম বললো,
— “তিতলি?”
— “হুম?”
— “বুকটা শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে ইদানীং।” ধরা গলা নিঝুমের।
— “আমারো।”
— “হাঁসফাঁস লাগে বড্ড।’
— “আমারো।”
— “কবে তোমার কাছে পৌঁছাবো।”
— “কালই।”
— “এখন চলে আসি প্লীজ?”
— “এই না।মানুষ কি বলবে।সেদিনও আপনি চলে আসতে চাইলেন।আরেকটু ধৈর্য ধরুন।”
— “সোমবার তো রেল ষ্টেশনে চলেই আসছিলাম।তোমার রিকুয়েস্টের জন্যই আবার ফিরে আসা।”
— “আর কয়টা ঘন্টা।”
—- “পাল্টে যাবে আমাদের সম্পর্ক।”
তিতলি হাসে।বললো,
— “অনেক রাত হয়েছে ঘুমান।”
— “তুমিও ঘুমাও।”
— “ঘুমাচ্ছি।”
— “এই শুনো?”
— “হুম বলুন?”
— “ভালবাসি!”
— “ভালবাসি।”
— “ফোনটা রাখতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।”
— ”আমারো।”
— “টুকটুকি?”
— “হুম?”
— “জানিনা কি বলবো।কল কাটতে পারছিনা।তুমি কাটো।”
— “আচ্ছা কাটছি।”
— “এই শুনো।”
— “আবার কি?”
—- “খুব ভালবাসি।”
তিতলি আওয়াজ করে হাসে।বললো,
— “আমিও আপনাকে খুব খুব খুব ভালবাসি।এবার ঘুমান।গুড নাইট।”
— “গুড নাইট।”
নিঝুম পুরো রুমটায় একবার চোখ বুলায়।এই সাত দিনে সে রুমটা নতুনরূপে সাজিয়েছে।গোল খাট,সাদা চাদর,সাদা পর্দা।আলমারিও চেঞ্জ করেছে।সাদা আলমারি এনেছে রুমে।সোফা-সেট চেঞ্জ করেছে।সাদা সোফা এনেছে।পুরো রুমটা সাদাময়।কাল থেকে এই রুমটা আরেকজনেরও! তিতলির আর তাঁর! দুজনের ভালবাসার ঘর।হৃদয়ের সবটুকু প্রেম এই রুমকে সাক্ষী করেই সে তিতলিকে দিবে।তিতলি কল কেটে ফোন আলমারির উপর রেখে শুয়ে পডে।আড়ষ্টতা এসে ভর করেছে।উঠে বসে।জানালার সামনে টুল নিয়ে বসে।বাইরে শন শন বাতাস বইছে। বাতাসে তিতলি সামনের কয়টা চুল উঁড়ছে।মুখটা শুষ্ক।উঠে দাঁড়ায়।এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার বসে।আবার উঠে দাঁড়ায়।পায়চারি করে রুমে অনেকক্ষণ।
সকাল সাতটায় রওনা দিয়েছে বরযাত্রী।পৌঁছাতে দুপুর।কিন্তু তার আগেই আলতাফ চৌধুরী প্লেনে করে সকাল ৯ টা ত্রিশ মিনিটে তিতলির বাড়ি এসে উপস্থিত।শাহেদ অবাক হোন।বরের আগে বরের বাপের আগমন!কোনো জরুরি দরকার হলেতো ফোনে বলতো তারপর আসতো। হুট করে কেন তার আগমন?