প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩১

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩১
ইলমা বেহরোজ

ড্রয়িংরুমে সবাই বসে আছে।নির্জন রাগী স্বরে নিঝুমকে বলে,
— “তোর কি রাগ নাই? তুই ওই নষ্টারে এক থাপ্পড়ে কেমনে ছেড়ে দিলি? আমি হলে খুন করতাম।”
— “মেয়ে মানুষকে আমি মারিনা।তারপরও রাগ সামলাতে পারিনি একটা থাপ্পড় দিয়েছি।এইযে একটা দিতে পেরেছি এতেই সবুর কর।”
নিঝুমের স্বর যথেষ্ট ঠান্ডা।নির্জন নিঝুমের এই ঠান্ডা স্বভাবটা নিতে পারে না। অভিমানী কণ্ঠে বলে,

— “তোর সাথে যদি আর কথা বলি!তারপর বলিস।”
নিঝুম হেসে নির্জনের পাশ ঘেঁষে বসে।তারপর বললো,
— “আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারলে থাক।”
নির্জন শীতল দৃষ্টিতে চোখ মেলে নিঝুমের পানে তাকায়।তারপর চোখ সরিয়ে নেয়।নিঝুম নির্জনের কাঁধে হাত রাখে।অভিজ্ঞ গলায় বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “নিশা কার মেয়ে জানিসই!এইযে দু’ভাই মেরেছি।এইটা নিয়েই দেখিস কাহিনি হবে।যদি আরো কিছু আমি বা তুই করতি।তাহলে কি হতো ভেবে দেখেছিস? আর যেভাবে রাগে লাফাচ্ছিলি! তুই তো ওরে মেরেই ফেলতি।তখন তোর জেলে যেতে হতো।তারপর রোহির কি হতো?”
জবাবের আশায় নির্জনের মুখের দিকে তাকায় নিঝুম।নির্জন যেন বুঝতে পেরেছে।সোফা থেকে উঠে ডাইনিং টেবিল থেকে পানি ভর্তি গ্লাস নিয়ে এক নিঃশ্বাসে পানি শেষ করে।এরপর দুই তলায় উঠে যায়।আঞ্জুমান রয়ে সয়ে বলেন,

— “কি খারাপ মেয়ে!এমন মেয়েও দুনিয়াতে আছে?আমার ছেলেটা কেমনে যে এমন একটা মেয়ের সাথে এতো দিন সম্পর্কে ছিল।নির্জন না তুই আহাম্মক!”
নিঝুম ভারী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
— “আহাম্মক কি আমাকে বললা?”
— “হুম তোরেই বলছি।তুই আহাম্মক না সাথে হাঁদারাম ।গবেটও তুই।”
নিঝুম ‘থ’ মেরে যায়।আহ্লাদ করে বলে,
— “আম্মু আমি কিন্তু বিয়ে করবো না।”
— “করিস না বিয়ে।আমার কি?”

কথাটি বলে তিতলির দিকে তাকায় আঞ্জুমান।তারপর আবার ছেলের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টা করে বলেন,
— “দেখবো,কতদিন বিয়ে না করে থাকতে পারোস।”
নিঝুম মায়ের রসিকতা বুঝতে পেরে হেসে ফেলে।তিতলি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।এদিক-ওদিক তাকায়।দৃষ্টি অস্থির রাখে।

নিঝুম সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছে।তিতলি সোফার চেয়ে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে।মোহনা অনেকবার বলছে পাশে এসে বসতে কিন্তু বসছে না।নিঝুম আশেপাশে থাকলে সে আর তার থাকে না।আর সেখানে এতো পাশাপাশি বসা অসম্ভব!নিঝুম আড্ডার ফাঁকে হুট করে একবার, তিতলির চোখে চোখ রাখে।তিতলি তখন হা করে তাকিয়ে ছিলো নিঝুমের দিকে।নিঝুম তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়।তিতলি চমকায় সেই সাথে লজ্জায় লাল হয়।চোখ সরিয়ে নেয়। ডান হাত ঘাড়ে রেখে এদিক-ওদিক তাকায়।তিতলির পাগলামি দেখে নিঝুমের হাসি দীর্ঘ হয়।সামনে বসে থাকা ভাই, ভাবী,বোন নিঝুমের সেই হাসি খেয়াল করে।নিঝুমের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকায়।দেখে,তিতলি লজ্জায় হাঁসফাঁস করছে।তিতলি নিঝুমকে আবার দেখতে চোখ তুলে।ওমা!দেখে,কয়েকটা চোখ তার দিকে তাক করা।তিতলির জান যায় যায় অবস্থা।মাহফুজ হোহো করে হেসে উঠে।নিঝুমকে উদ্দেশ্য করে সুরেলা গলায় বলে,

— “ওহ আচ্ছা,এই ব্যাপার?”
উপস্থিত সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে।নিঝুম থমকায়।এতক্ষণ সে হা করে তিতলির দিকে তাকিয়ে ছিলো।খেয়ালই করেনি,কখন এরা তাকিয়েছে!লজ্জায় সে ও নতজানু করে।এক হাতে মাথা চুলকায় সেই সাথে গালে গর্ত ফুটানো হাসি!

বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় নির্জনের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।নির্জনকে গোসল করানোর জন্য আলাদা স্টেজ বাঁধা হয়েছে।নির্জন গায়ে হলুদ করতে চায়নি।মায়ের জোরাজুরিতে হচ্ছে।নির্জনকে জোর করে লুঙ্গি পরানো হয়েছে।তবে,লুঙ্গি পড়ার আগে শর্ত দিয়েছিলো,নিঝুম লুঙ্গি পরলে তবে সে পরবো নয়তো পরবে না।’

এই খবর শুনে নিঝুম দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলো।তবুও সে লুঙ্গি পরবে না।অবশেষে,সবার টানাটানিতে বাধ্য হয়ে লুঙ্গি পরে।বন্ধুরাও লুঙ্গি পরেছে সেই সাথে স্যান্ডো গেঞ্জি।মৌনতা কই থেকে এতোগুলি কালা চশমা নিয়ে আসে।সব ভাইদের হাতে তুলে দেয়। সবগুলো ছেলে কালা চশমা পরে,কালা চশমা,লুঙ্গি ডান্স ,নাগিন ডান্সে মেতে উঠে ।তবে,নিঝুম নাচেনি।নিজের চশমা পরে স্টেজের পাশের রাজকীয় চেয়ারে বসে আছে।মহিলারা হলুদ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ।নির্জনকে গোসল করানোর জন্য।কিন্তু,নির্জন নিজের বিয়েতেই সবার চেয়ে বেশি উড়াধুড়া নেচেই যাচ্ছে।থামার লক্ষণই নেই!আশ্চর্য!প্রেমের বিয়ে বোধহয় এমনি।

এর মধ্যে মেয়েরা আসে।হলুদ শাড়ি পরে।আসে ফটোগ্রাফার।তিতলি সবার শেষে আসে শাড়ি পরে।নিঝুমের চোখ আটকে যায় তিতলির চুলের বেণুনিতে!তিতলির চোখে,তিতলির ঘাড়ে,তিতলির ঠোঁটে, পুরোটা তিতলিতেই আটকে যায় সে।তিতলি ছাদে এসেই চারপাশে খুঁজতে থাকে নিঝুমকে।একসময় দেখতে পায়।নিঝুমের ফর্সা মোটাসোটা বাহু সবার আগে চোখে ভাসে।দুজনের চোখাচোখি হতেই নিঝুম চোখ টিপে।তিতলি দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়।মুচকি হাসে।
ফটোগ্রাফার সবার ছবি তুলছে।নিঝুম চেয়ার থেকে উঠে আসে।দুজন ফটোগ্রাফারকে তিতলিকে ইশারা করে ফিসফিসিয়ে বলে দেয়,

— “ওইযে কর্ণারে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।ওই মেয়েটার একটা ছবিও যেন আপনাদের ক্যামেরাতে না দেখি।”
কথা শেষে নিঝুম চেয়ারে এসে বসে।একটা ভাগ্নেকে ডেকে বলে,
— “আমার রুমে যা!বিছানার উপর একটা ক্যামেরা পাবি।দ্রুত নিয়ে আসবি।”
— “আচ্ছা চাচ্চু।”
বলেই ছেলেটি দৌড়ে চলে যায়।

নির্জনকে চেপে ধরে আনে নিঝুম গোসলের জন্য।ফুফুরা,ভাবীরা চেপে ধরে হলুদ মাখিয়ে দেয়।যেই না পানি ঢালতে যাবে।নির্জন হলুদের বাটি থেকে হলুদ পুরোটা নিয়ে লাফিয়ে উঠে।সামনে যাকেই পাচ্ছে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে।বিয়ের খুশিতে পাগল হয়ে গেছে সে।গোসল করানোটা আর সম্পন্ন হয়নি।সেখানে উপস্থিত সবগুলো ছেলে নিজেদের কাছে লুকিয়ে রাখা রঙ বের করে পুরো জায়গাটা রংমহল বানিয়ে দিচ্ছে।আর সবাই রঙ খেলা শুরু করছে নিঝুমকে দিয়ে।নিঝুমের চশমা ভেঙ্গে গেছে ওদের ঠেলাঠেলিতে।আর চেহারা-শরীরের তো নাজেহাল অবস্থা।মেয়েদেরও একই অবস্থা।শুধু তিতলি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে।আর প্রাণখোলে হাসছে।একটা ছেলে তিতলিকে রঙ লাগানোর জন্য এগোতেই নিঝুম খপ করে ধরে ফেলে।মানা করে রঙ না লাগানোর জন্য।

নিঝুমের নাকে-কানেও রঙ ঢুকিয়ে দিয়েছে অরুণ।শান্তদের উপর এভাবেই অত্যাচার চলে আজীবন!এর মাঝে ঘটে এক কান্ড, নির্জনের বেস্ট ফ্রেন্ডের লুঙ্গি হুট করে খুলে যায়!মেয়েরা চিৎকার করে উঠে।তিতলি চোখ ঢাকে হাত দিয়ে।নিঝুম-নির্জন সহ আশেপাশের সবাই হাসিতে মাখামাখি!

স্পীকারের অতিরিক্ত আওয়াজে তিতলির মাথা ধরে আসে।মেয়েরা ছেলেদের জন্য কিছুই করতে পারছে না।চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।তিতলি ছাদ থেকে এসব পাগলামি দেখবে ভেবে বাসায় ঢুকে।নিঝুম তিতলিকে বাসার ভেতর যেতে দেখে নিজেও পিছনে আসে।তিতলি আর এক পা বাড়ালেই ছাদে উঠে যেত তার আগেই নিঝুমের ডাক,

— “তিতলি!”
তিতলি নিঝুমের দিকে তাকায়।দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জবাব দেয়,
— “জ্বি?”
নিঝুম তিতলির সামনে এসে দাঁড়ায়।ফিসফিস করে বলে,
— “সুন্দর!”
থেমে আবার বলে,
— “পরী মনে হচ্ছে।”
তিতলি লজ্জায় কুঁকড়ে যায়।নতজানু হয়ে পেছনের দেয়াল খামচে ধরার বৃথা চেষ্টা করে।নিঝুম তিতলির আরো কাছে এসে, থুতনি এক আঙ্গুলে তুলে ধরে। গভীর কণ্ঠে বললো,
— “এতো লজ্জা কেনো পাও? এইটুকুন মেয়ের এইটুকুনই লজ্জা থাকা উচিৎ?”
তিতলি নিশ্চুপ।ওর হাত-পা কাঁপছে থরথর করে।ঘামছে প্রচুর।নিঝুম তার থুতনি থেকে আঙ্গুল সরিয়ে নেয়।অনেকক্ষণ একা একা হাসে।তারপর আস্তে করে বলে,

— “আমার বয়স কত জানো?”
তিতলি মাথা নাড়ায়।সে জানে।নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “কত?”
— “সাতাশ-আটাশ।”
তিতলির গলা কাঁপছে।ঠোঁটে-মুখে লাজুকতা।নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “তোমার চেয়ে কত বছর বড়?”
— “দশ।”
— “আমি কিন্তু তোমার চেয়ে……. ”
নিঝুমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তিতলি আগে-বাগে বলে দেয়,
— “আমার আম্মু-আব্বুর বয়সের পার্থক্য ১৬ বছর।আর প্রেম করেই বিয়ে হয়েছিলো।”
নিঝুম হো হো করে হেসে উঠে।তিতলি জিভ কামড়ে চোখ খিঁচে ফেলে।নিঝুম তিতলির লজ্জার সুযোগ নিয়ে বলে,

— “মানে বলছো?আমরাও প্রেম করে বিয়ে করতে পারি তাইতো?”
— “না-না মানে!”
তিতলি তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেলে।তার নিজেরও খুব হাসি পাচ্ছে লজ্জায়।লোকটা অনেক দুষ্টু।নিঝুম অনেকক্ষণ..অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে তিতলির দিকে।তিতলি নতজানু হয়েই আছে।নিঝুম বিড়বিড় করে,
— “লাজুকলতা।”

তিতলি চোখ তুলে নিঝুমের দিকে তাকায়।একদম সম্মুখে দু’টি নেশাতর চোখ।বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ শুরু হয়।তিতলি চলে যেতে চাইলে নিঝুম তিতলির চুলের বেণীতে ধরে ফেলে।বেণীতে টান দিয়ে আবার জায়গায় নিয়ে আসে।দুজনের চোখ এক হয়! তিতলির মুখের একদম কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে গভীর ভালবাসা মাখিয়ে নিঝুম বলে,
” আমি ভয়ংকর প্রেমে পড়েছি তোমার।
এমন প্রেমে আমি কখনো পড়িনি।
বিশ্বাস করো….

এমন করে কেউ আমাকে মাতাল করেনি।
এমন করে কারোর চাহনিতে আমি হুঁশ হারাইনি।
এমন করে কারোর মায়ায় আচ্ছন্ন হয়নি।
এমন করে ছটফট করে মরিনি।
মেরেছো আমায়! মেরেছো তুমি!
ভালবাসার বানে মেরেছো।
আঠারো বছরের যত প্রেম তোমার মনের মন্দিরে জমিয়েছো, তার সবটুকু আমার চাই।না,না তার চেয়েও বেশি চাই।
আমার কিন্তু অল্পতে হবেনা,অতল সমুদ্র সমান প্রেম চাই।যে প্রেম ফুরিয়ে যাবেনা।
যে প্রেম কখনো মন থেকে সরবেনা
যে প্রেম কখনো হারাবেনা।
যে প্রেমের নেশা কখনো আমায় ছাড়বেনা
যে প্রেমের নেশা কাটানোর নয়।
আমি কোনো যুবক নই
আমি আঠাশ বয়সী পুরুষ
আমার এক পৃথিবী সমান মায়া চাই
নেশা চাই

তুমি যেখানেই ভালবাসা ঢালবে সেখান থেকেই কুড়িয়ে নিবো।
আমি শুধু তোমার ভালবাসা চাই,তোমার প্রেম চাই,তোমার রাগ-অভিমানের কারণ হতে চাই।
আমিও আমার আঠাশ বছরে সঞ্চরিত সবটুকু প্রেম তোমায় দিতে চাই। ”
নিঝুম থামে।দেখে তিতলি চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে।নিঝুম বলে,
— “তুমিকি শুনতে পাচ্ছো?লাজুকলতা! ”
তিতলি চোখ বুজেই মাথা নাড়ায়।সে শুনতে পাচ্ছে।
নিঝুম আবার বলতে চায়,

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ২৯

— “আমি তোমার…….”
তিতলি আটকিয়ে দেয়।নিঝুমের চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলে,
— “আপনি ভয়ংকর কবি!আপনি ভয়ংকর প্রেমিক।এভাবে আর বলবেন না।এভাবে নিঃশ্বাস নিবেন না।আমি মরে যাবো।হয়তো মরেও গেছি।আমার খুব মাথা ঘুরাচ্ছে!”

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩২