প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩৩

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩৩
ইলমা বেহরোজ

অতীত।
নিঝুমকে দেখা হয় না আজ চারদিন।তিতলির জান যায় অবস্থা।নির্জনের বিয়ের পরের দিনই হসপিটাল থেকে কল আসে।আর সেদিন রাতেই নিঝুম ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে।সিলেটে বেশ নাম ডাক নিঝুমের।ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছে অপারেশনের জন্য।তিতলির সময় কাটে না।সারাক্ষণ বুকে শূন্যতা অনুভব হচ্ছে।নিজেকে একা মনে হচ্ছে।তাকে একাকীত্ব গ্রাস করেছে ভয়ংকর ভাবে।পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সাথেই কথা হয়।আড্ডা হয়।তবুও সবকিছু শূন্য।কেউ পাশে না থাকাকে একাকীত্ব বলেনা।একাকীত্ব বলে,যখন প্রিয় মানুষটি পাশে থাকে না,কাছে থাকে না।তিতলি প্রতিটি সেকেন্ডও যেন গুণে চলেছে।অনেকবার কল দিতে গিয়েও দেয় নি।সাহস পায় না।হাত-পা কাঁপে।

সন্ধ্যা রাত তখন।চৌধুরী পরিবারের সব সদস্য ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে।সন্ধ্যার ধোঁয়া উঠানো চা’র কাপ সবার হাতে।কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে চুমুক দিচ্ছে চা’র কাপে।শুধু তিতলির মুখেই কথা নেই,নেই কোনো হাসি।মলিন হয়ে আছে।চা ঠান্ডা হচ্ছে।সেখানে তার ভ্রুক্ষেপ নেই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “তিতলি?চা যে ঠান্ডা হচ্ছে।”
আঞ্জুমানের গলা শুনে তিতলি আমতা-আমতা করে বললো,
— “এ-এইতো খাচ্ছি।'”
বলেই ঠান্ডা হওয়া চা পুরোটা এক ঢোকে গিলে নেয়।তারপর,আঞ্জুমানের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসে।আঞ্জুমান বলেন,
— “ওমা! এক ঢোকে খেয়ে নিলি।এতো ঠান্ডা চা খেতে গেলি কেন?বলতি টুনি আরেক কাপ এনে দিতো।’

— “না, না ঠান্ডাই মজা।'”
তাড়াতাড়ি বললো তিতলি।আলতাফ চৌধুরী আদুরে কণ্ঠে বলেন,
— “তিতলি মা।কি হয়েছে? ইদানিং দেখছি খুব মন খারাপ করে থাকো।কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
তিতলি থমথম গলায় বললো,
— “না আংকেল।মানে,মাইগ্রেন সমস্যা একটু।”
রোহি হেসে খোঁচা মেরে বললো,
— “নিঝুম ভাই আসলে,মাইগ্রেন কেন আরো রোগ থাকলে সেগুলোও উড়ে যাবে।”
সবাই হো হো করে হেসে উঠে।আলতাফ চৌধুরী, আঞ্জুমান বয়সে বড় তাই উনারা নিজেদের সংযত রাখেন।তবে ঠোঁট টিপে হাসেন।তিতলির হেঁচকি উঠে। চোখ-মুখ লাল হয়ে আসে।আঞ্জুমান স্বাভাবিক কণ্ঠেই টুনিকে বলেন,

— “টুনি পানি দে।”
টুনি পানি এগিয়ে দিয়ে বলে,
— “এই লন আফা পানি।”
তিতলি গ্লাস হাতে তুলে নেয়।টুনি সবার উদ্দেশ্যে বললো,
— “জানেন আপনেরা,যতবারই নিঝুম ভাইজানের নাম উডে।এই আফার ডেহুর(হেঁচকি) উডে।”
বলেই ফিক করে হেসে দেয়।তিতলি লজ্জায় গ্লাস চেপে ধরে।বড় দের সামনে কিসব বলছে টুনি!
টুনি আবার শুরু করে,
— “আর হেদিন।নির্জন ভাইজানের বিয়ার দিন দেহি,নিঝুম ভাইজান তিতলি আফারে……..
তিতলি আঁতকে উঠে।টুনিকে কথার মাঝে বাধা দিয়ে থমথমে গলায় তিতলি বললো,
— “টুনি!”
টুনি তিতলির চোখের দিকে তাকাতেই তিতলি চোখের ইশারায় টুনিকে অনুরোধ করে না বলার জন্য।টুনি দমে যায়।রোহিতা জহুরি চোখে তিতলির ইশারা খেয়াল করে। এরপর আদেশস্বরে টুনিকে বলে,

— “এই টুনি, কি বলছিলা বলো।”
নির্জন ঠোঁট দিয়ে কিসের মতো ইশারা দেয় টুনিকে।প্রশ্ন করে ইশারায়, চুমু দিয়েছে নাকি।মৌনতা,মোহনা হা করে আছে শোনার জন্য।আঞ্জুমান আলতাফ চৌধুরীকে গুঁতো দিয়ে ইশারা করেন এখান থেকে উঠে যেতে।ছেলে-মেয়েগুলা পুরো বখে গেছে।মা-বাপের সামনে কি ফাতলামি শুরু করেছে।আঞ্জুমান মুখে তওবা তওবা করেন।তারপর উঠে যান স্বামীকে নিয়ে।টুনি আবার তিতলির দিকে তাকায়।তিতলি ইশারায় আবারো অনুরোধ করে না বলার জন্য।কিন্তু টুনি বলে দেয়,

— “দেহি,তিতলি আফার শাড়ির কুচি ঠিক কইরা দিতাছে।হেরপর(তারপর) খোঁপা বাইন্ধাও দিছে।হেরপর…”
তিতলি সোফা থেকে উঠে টুনির মুখ চেপে ধরে।তারপর সবার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি দেয়।টুনি জোরে ঝাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে দেয়।বলে,
— “আল্লাহগো আরেকটু হইলে মইরা যাইতাম।ভাই আমি কইমুনা।উফফ,দম বন্ধ হইয়া গেছে।”
টুনি জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।রোহি তিতলির কাঁধে হাত রাখে।তিতলি রোহিকে দেখে আবার হাসে।জোরপূর্বক হাসি।রোহি ডান ভ্রুটা নাচিয়ে বললো,
— “তলে তলে টেম্পু চলে এতদূর?”
— “দূর ভাবি।”
তিতলি তাড়াতাড়ি জায়গা ত্যাগ করে দৌড়ে।সবাই আবারো জোরে হেসে উঠে।

রাত তখন ১ টা,নিঝুম বাড়ি ফেরে।পুরোটা রাস্তা উত্তেজনায় কেটেছে।সারাকক্ষণ ঠোঁটে হাসি লেগেই ছিল।তিতলির সাথে কাটানো প্রত্যেকটা সময় ভেবেছে।সকালে রাস্তায় চুড়ির মেলা দেখে দুই ডজন কাচের নীল চুড়ি কিনে নিয়েছে।বাড়ি ফিরে আগে মায়ের রুমে আসে।তারপর,নিজ রুমে আসে।কাপড় চেঞ্জ করে তিতলির কাছে যাবে ভাবে।তিতলি গত তিন রাত নিঝুমের রুমে ঘুমিয়েছে।সবাই ঘুমিয়ে পড়লে,সে চুপিচুপি নিঝুমের রুমে চলে আসে।ভোরে ফজরের নামাযের জন্য উঠে।তখন নিজের রুমে ফিরে যায়।আজও চুপিচুপি নিঝুমের রুমের সামনে এসে থামে।শুনতে পায় রুমের ভেতর হালকা নড়াচড়ার আওয়াজ হচ্ছে।দরজা হালকা ধাক্কা দেয়। উঁকি দিয়ে নিঝুমকে দেখে চমকে যায়।আলমারি থেকে শার্ট বের করছে।পরনে থ্রী কোয়াটার প্যান্ট।তিতলির শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম খুশিতে।চট করে দরজা থেকে সরে যায়। খুশিতে তার চোখ জ্বলজ্বল করছে।নিঝুম এসেছে? সত্যি এসেছে? মনে হচ্ছে কত সহস্র‍ বছর বাদে দেখা মিলেছে প্রেমিকের।তিতলি চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে।চোখের তৃষ্ণা যেনো পুরোপুরি মিটেনি।তাই আরো একবার উঁকি দিতে নেয়।নিঝুম তখন বের হচ্ছিলো তিতলির রুমে যাওয়ার জন্য।তিতলি উঁকি দিতেই সে

তিতলির হাতে ধরে হেঁচকা টানে রুমের ভেতর নিয়ে আসে।তিতলির বুকে চারশো ভোল্ডের শক চলছে।মানুষটাকে একদম নিতে পারে না সে।নিঝুম দরজা লাগাতেই তিতলি ঢোক গিলে।বাতি নিভিয়ে ডিম লাইট জ্বালায় নিঝুম।নিভু নিভু আলোতে তিতলিকে দেখতে তার বড় ভালো লাগে।রহস্যময়ী মনে হয়।

— “কেমম আছেন?”
তিতলির কাঁপা গলা।নিঝুম উত্তর না দিয়ে তিতলির কাছে এসে দাঁড়ায়।তিতলি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।বার বার ওড়না টানছে।নিঝুম তিতলির কোমরে ধরে কাছে টেনে আনে।তিতলি বড্ড অবাক হয়।নিঝুমের চোখে চোখ রাখে।
— “খুব মনে পড়েছে তোমায়!”
নিঝুমের শীতল কণ্ঠ।তবে কণ্ঠে যেন এক গ্লাস নেশা মেশানো বা তার চেয়েও বেশি ছিল।
— “আমারো।”

তিতলি উত্তেজনায় ছোট করে উত্তর দেয়।নিঝুম আরেকটু জোরে চেপে ধরে।আরো কাছে টেনে আনে তিতলিকে।তারপর,জড়ানো গলায় বললো,
— “ভালবাসি তিতলি!”
সময় থেমে যায়।তিতলি পায়ের তলা শিরশির করে উঠে।বাতাসে প্রেম প্রেম সুবাস মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে।ভালবাসি কথাতে এতো নেশা থাকতে পারে?এতো জাদু থাকতে পারে?তিতলির বুকে উথাল-পাতাল ঢেউ শুরু হয়।ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে।চোখে জল এসে ভীর জমায়।দু’হাতে নিঝুমের শার্টের কলার ধরে ক্ষীণ আওয়াজ করে বলে,

— “আবার বলুন।”
— “ভালবাসি টুকটুকি।”
তিতলি চোখ বুজে জোরে নিঃশ্বাস নেয়।পৃথিবীটা ঘুরছে মনে হচ্ছে।আরেকটু শক্ত করে নিঝুমের শার্টের কলার খামচে ধরে কাছে এসে বলে,
— “প্লীজ আরেকবার বলুন।!
নিঝুম হালকা হেসে,তিতলির কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
— “ভালবাসি লাজুকতা।ভালবাসি।ভালবাসি।”
তিতলির শরীর অবশ হয়ে আসে।শরীরের হাড়ের জোর কমে আসে।নেতিয়ে পড়ে নিঝুমের বুকে।নিঝুম এতে একটুও অবাক হয়নি।হেসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তিতলিকে।

তিতলিকে পাঁজাকোলে নিয়ে নিঝুম সোফায় বসে আছে।অনেকক্ষণ পার হয়ে গেছে, সে তিতলির মুখে তাকিয়ে আছে।এই কিছু মুহূর্তে বুঝে গেছে তার মাদকে পরিণত হচ্ছে তিতলি।তিতলি যখন কাছে থাকে,অনেক নিষিদ্ধ ইচ্ছে এসে মস্তিষ্কে ভর করে।নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।আলতো করে তিতলির চুলে হাত বুলাতে থাকে।তিতলি জেগে উঠে।তার বড় দুটি আঁখি যেন ভালবাসায় নিভু নিভু হয়ে এসেছে।নিভু নিভু চোখে নিঝুমকে দেখে।নিঝুমের চোখে চশমা নেই।কয়টা চুল কপালে ছড়িয়ে আছে।গুড়ি গুড়ি দাঁড়ি।ঠোঁটে মুচকি হাসি।গালে টোল!মাথায় তাঁর পরশ! তিতলি আচমকা নিঝুমের গলা জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।ব্যাপারটা বুঝতে নিঝুমের কয়েক সেকেন্ড লাগে।সে বুঝতেই পারেনি কখন তিতলি জেগেছে।তারপর, হেসে সেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।তিতলি চোখ বুজে বিড়বিড় করে,

— “ভালবাসি আপনাকে।খুব ভালবাসি।সেই শুরু থেকে…সেই শুরু থেকে বুকে প্রেমের অসহনীয় যন্ত্রনা!ভাবিনি,কখনো ভাবিনি কখনো এই মানুষটা আমাকে ভালবাসবে।আমার হবে।আমায় বুকে জায়গা দিবে।তার অস্তিত্বে আমার অংশ এসে মিলবে।সত্যি ভাবিনি।”
একদমে বলে তিতলি থামে।তবে নিঝুমকে ছাড়েনি।নিঝুম হেসে বলে,
— “এমন পুতুলকে ভালো না বেসে কেমনে থাকি?”
তিতলি নিঝুমের গলা ছেড়ে নিঝুমের চোখের দিকে তাকায়।এরপর বুকে মাথা রেখে অভিমানি গলায় বললো,
— “নিশা যখন এসেছিলো,আমি কত কষ্ট পেয়েছি।কতো কেঁদেছি!আমার মরে যেতে ইছে হচ্ছিলো।”

নিঝুম তিতলির মাথায় হাত রেখে বললো,
— “নিশা আমার জীবনের একটা কালো পৃষ্ঠা।সেই পৃষ্ঠা ছিঁড়ে দিয়েছি।এখন শুধু ভালবাসার একেকটা পাতা হবে।মাঝে ঢুকবেনা কোনো তৃতীয় লোক।”
তিতলি ছলছল চোখে নিঝুমের চোখে চোখ রাখে।বলে,
— “সত্যি?”
নিঝুম তিতলির কপাল থেকে চুল সরিয়ে বলে,
— “সত্যি।”
তিতলি খুশিতে ডগমগ হয়ে নিঝুমের বুকে মাথা রাখে।পরক্ষণেই সরিয়ে নেয়।নিঝুম ভারী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে,

— “কি? ”
— “খেয়েছেন?”
নিঝুম তিতলিকে টেনে কাছে আনতে চায়।তিতলি হাত সরিয়ে দেয়।ধমকস্বরে বলে,
— “আগে বলুন, খেয়েছেন?”
নিঝুম হেসে ব্যালকনির ফ্লোরে বসে।দেয়ালে হেলান দিয়ে।বলে,
— “হুম খেয়েছি।বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।”
— “ফ্লোরে বসলেন কেনো?”
— “ইচ্ছে হলো।”
তিতলি নখ খুঁচাতে থাকে হাতের।কি বলবে খুঁজে পাচ্ছেনা।বুক যেন অনেক দিন পর শান্ত!চোখ তুলে দেখে,নিঝুম হা করে তাকিয়ে আছে।চোখে কি যেন!মন কেমন করা চাহনি।তিতলি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে।বলে,

— “আপনি এভাবে তাকাবেন না প্লীজ।আপনার তাকানো ভয়ংকর!”
নিঝুম হো হো করে হেসে উঠে।হাসতে হাসতে বললো,
— “আমার সবই তোমার ভয়ংকর লাগে!”
আবারো হাসতে থাকে।তিতলি নিঝুমের হাসি দেখে উঠে দাঁড়ায় চলে যেতে।তখনি নিঝুম সুরেলা গলায় বলে উঠে,
” নিভু নিভু আলোতে, ঝিরিঝিরি হাওয়াতে
তোর মনের চাওয়া-পাওয়া
বুঝা দেখি খুবি সোজা!”

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩২

তিতলির বুক ধ্বক করে উঠে।এতো চেষ্টা করেও মনের কথা লুকাতে পারেনি!বুঝে নিলো মানুষটা!এখন কি এসে চুমু দিবে?আমি কি মানা করবো? না পালাবো?কিন্তু চাওয়া যে…।নিঝুম তিতলিকে রেখে রুম থেকে চুড়িগুলো নিয়ে আসে।হাতে পরিয়ে দেয়।যদিও বড় হয়ে যায়।তারপর নিবিড় চুমু এঁকে দেয় তিতলির চুড়ি পরা হাতে!তিতলির রগে রগে কাঁপন শুরু হয়।নিঝুম তিতলি দিকে তাকায়।তিতলিও তাকায়।তিতলির ভীষণ লজ্জা করছে।মুখ লুকাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিঝুমের বুকে।দুজন দুজনকে গভীর আবেশে জড়িয়ে রাখে অনেকক্ষণ…অনেক মুহূর্ত!চোখে তাঁদের সুখের জল।মনে প্রাণে একটাই চাওয়া সারাজীবন দুজন দুজনার থাকুক।ভালবাসার পথচলা শুরু হলো এখান থেকেই।দুজনের মনের রঙিন প্রজাপতিরা এক হলো এখানেই!এই সময়ে! এই রাতে!এই প্রহরে!

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩৪