প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৪
ইলমা বেহরোজ

দু’দিন পর ভর্তি এক্সাম অথচ তিতলির মন বসে না পড়ায়।এমনটা কখনো হয়নি।জ্বর,মাথা ব্যাথাসহ কত রকম রোগে ভুগেছে। কিন্তু কখনো পড়া থেকে মন উঠেনি।প্রেম রোগ বোধহয় এমনই।মনটা চুরি হয়েই গেলো।ডাক্তার মানুষকে সুস্থ করে আর এই ডাক্তার অসুস্থ বানিয়ে দিলো!তিতলি রুমে অনেক্ষণ পায়চারি করে।মনে হাজারটা ভাবনা।উসখুস লাগছে।মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব!সাংঘাতিক অস্বস্তি মনে,শরীরে।মাথার কাপড়টা টেনে রুম থেকে বের হয় তিতলি।সিঁড়ি তিনটা উঠে আর এগোয়নি।বেশ খানিকক্ষণ ছাদের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।এরপর নেমে আসে।হালকা হলুদ আলোয় পুরো বাড়িটাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে।সবার ঘরের দরজা বন্ধ।রাত একটা বাজে, হয়তো ঘুমাচ্ছে সবাই।শুধু তিতলির ঘুমটাই হারাম হয়ে গেলো।

— “তিতলি নাকি?”
মৌনতার ডাক শুনে কেঁপে উঠে তিতলি।ফিরে তাকায়।মৌনতাকে দেখে মৃদু হাসে।তবে চিনতে পারেনি এটা মোহনা নাকি মৌনতা। তাই শুধু আপু বলে সম্বোধন করে।
— “হ্যাঁ আপু আমি।ঘুম আসছিলো না তাই হাঁটছিলাম।”
— “তুমি তো ১০ টায় ডিনার করে রুমে আসছিলে।তিন ঘন্টা শুয়ে থেকেও ঘুমে ধরেনি!আল্লাহ!”
— “না আপু।আসলে দু’দিন পর এক্সামতো।পড়ছিলাম।”
— “বাব্বাহ!একদম আমার ভাইদের মতো দেখি।শুধু পড়া আর পড়া।’
উত্তরে তিতলি হাসলো সাথে মৌনতাও।
— “আচ্ছা, যাও ঘুমাও।গুড নাইট।”
— “গুড নাইট।”
তিতলি রুমে এসে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে।চোখের পর্দায় ভেসে উঠে নিঝুমের হাসি।সে চট করে চোখ খুলে।স্বস্তি পাচ্ছেনা একটুও।প্রেমে শান্তি থাকলেও স্বস্তি নেই! এ যেনো এক টক-জ্বাল-মিষ্টির মিশ্রণে তৈরি অনুভূতি।একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে তিতলি আবার চোখ বুজে।দুপুরে যতক্ষণ নিঝুমের রুমে ছিল তার প্রতিটা সেকেন্ড আবার রিপিট করে কল্পনায় টেনে আনে।তিতলির মুখে লাজুকতা।সে ছোট থেকেই প্রচণ্ড লাজুক।প্রেমে পড়ে যেনো লাজুকতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।সারাক্ষন মুখে ফুটে থাকে লজ্জা।লজ্জাবতীরা যখন প্রেমে পড়ে তখন খুব বেশিই মুগ্ধকর দেখায়। তিতলির বেলায় তার ব্যাতিক্রম হচ্ছেনা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সকাল।তিতলিকে নিচে নামতে দেখে আঞ্জুমান হাত বাড়িয়ে খাবার টেবিলে ডাকেন।
— “তিতলি আসো।”
তিতলি অনেকটা অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
— “ফুফি আম্মা আপুরা, ভাইয়ারা কই?এখনও উঠেনি?”
— “কয়টা বাজে দেখেছো ?৯টা ২০ বাজে। এখন কি ওরা বাসায় থাকবে ?”
— “ইয়া আল্লাহ! এতো বেলা!”
— “সকালে ডাকতে নিছিলাম তোমাকে কিন্তু মৌন বলল অনেক রাত অব্দি পড়ছো।তাই আর ডাকিনি।”
— ”সরি ফুফি আম্মা এতো বেলা হয়ে গেল….”
মিসেস আঞ্জুমান বাধা দিয়ে বললো,
— “এসবের জন্য সরি বলতে হবেনা।”
— “আপুরা ভার্সিটিতে?আর ভাইয়ারা হসপিটালে না?”
— “হুম সবাই বাইরে।নিঝুম এখনো বের হয়নি।রেডি হতে গেছে।চলে যাবে এখনি।এতো কথা না বলে জলদি খাও।অনেক বেলা হইছে।শরীর খারাপ করবে।”

— ” আন্টি একটা কথা বলি?”
— “হুম বলো।”
— “আপনি আমাকে তুমি করে না বলে তুই বলতে পারেন।ভালো লাগবে অনেক।”
মিসেস আঞ্জুমানের খুশিতে গদগদ হয়ে বলেন,
— “আমারো তুমি তুমি বলতে কেমন লাগছিলো রে মা।বাঁচালি!কি সুন্দর করে ফুফি আম্মা ডাকিস। আর আমাকে তুমি করে সম্বোধন করতে হয়।ভালো লাগছিল না।”
উত্তরে তিতলি মিষ্টি হাসলো।বললো,
— “বাবা বলেছে আপনাকে ফুফি আম্মা ডাকতে।”
— “তাই।কিন্তু মাঝে মাঝে তো আন্টি ডাকতেছিস।”
তিতলি অপরাধীর মতো হেসে বলে,
— “আসলে সবাইকে আন্টি ডাকি তো তাই।চলে আসে মুখে অটোমেটিক। ”
— “কয়দিন ডাকলেই অভ্যাস হয়ে যাবে।”

কিছুক্ষণ পর নিঝুম নেমে আসে।আঞ্জুমান রান্নাঘর থেকে হাত মুছে ছেলেকে আদর করতে এগিয়ে আসেন।তিতলি নিঝুমটা যে কে এখনো দেখেনি তাই পিছনে ফিরে দেখার জন্য।নিঝুমকে দেখে তিতলি বিস্ফোরিত হয়।মাথা ঘুরিয়ে নেয়।চোখ মার্বেলের মতো গোল হয়ে যায়।এখুনি চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে এমন অবস্থা।সে বিড়বিড় করে,
— “নিঝুম এটা?তাহলে নির্জন কে? কারে দেখলাম? নির্জন কে? আর নিঝুমই কে?”
হিঁচকি উঠার আগে সামনে রাখা পানি খেয়ে ঢোক গিলে তিতলি।নিজেকে সামলায়।নিজের সাথে নিজে কথা বলে,
— “তিতলি এতো উত্তেজিত হোস না।ফুফি আম্মাকে জিজ্ঞাসা করে তোর প্রশ্নের উত্তর বের করে দেব।শান্ত হ,কুল কুল!”
তিতলি আবার ঘুরে তাকায়।নিঝুম হাসছে গালে টোল!খাবার রেখে এক হাতে মাথা ভর দিয়ে নিষ্পলকভাবে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।ঠোঁটে তার ভালবাসার হাসি।চোখের দৃষ্টিতে নিঝুমের জন্য অজস্র ভালবাসা।
জিন্সের সাথে ইন করা ব্ল্যাক শার্ট,হাতে এপ্রোন।বডি সুগঠিত,সবল।চুল গুলো ছোট তবে খাড়া খাড়া।চোখে চশমা।গোল ফ্রেমের।তিতলি বেহায়ার মতো হা করে তাকিয়ে থাকে।এক সেকেন্ডের জন্যও চোখের পলক পড়েনা।ফলে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

— “তিতলি?”
আঞ্জুমানের ডাকে তিতলি হকচকিয়ে উঠে।হুঁশ আসে।খেয়াল করে নিঝুম নেই।আঞ্জুমান আবারো প্রশ্ন করেন,
— “তিতলি শরীর খারাপ?”
— ” ভাবছি।”
— “কি ভাবছিস?”
তিতলি খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে টান টান হয়ে বসে।এরপর বললো,
— “গতকাল বললেন উনার নাম নির্জন আজ বলছেন নিঝুম।কিন্তু শুনছি আপনার দু’ছেলের নাম নিঝুম আর নির্জন।আমার নিজেরে পাগল পাগল মনে হচ্ছে ফুফি আম্মা।”
কথার মাঝে সেখানে টুনি উপস্থিত হয়।মিসেস আঞ্জুমান আর টুনি একসাথে হেসে উঠে।তিতলি নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে থাকে।প্রশ্ন জাগে মনে, এরা হাসছে কেনো?হাসার মতো কি বললো? টুনি টেবিল মুছতে মুছতে বলে,
— “আফামণি হেগোরাও জমজ!”
তিতলির চোখগুলো আরো বড় আকার ধারণ করে।কন্ঠে আকাশচুম্বী বিস্ময়তা নিয়ে প্রশ্ন করে,

— “মানে?”
— “নিঝুম ভাইজান আর নির্জন ভাইজান জমজ।”
তিতলির দু’ঠোঁট নিজেদের শক্তিতে আলাদা হয়ে যায়।আঞ্জুমান হাসেন।তিতলির হিঁচকি উঠে।আঞ্জুমান হাসি থামিয়ে পানি এগিয়ে দেন।তিতলি পানি খেয়ে শান্ত হয়।অনেকটা জোরেই হাঁফ ছেড়ে বললো,
— “এ কি জমজের কারখানায় এসেছি!যেদিকে তাকাই সব দুটো।”
আঞ্জুমান, টুনি আবারো হাসে।তিতলি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “এখানে কি ফুফি আম্মাও দুইটা আছে? টুনিও কি দুইটা?
টুনি হা হয়ে ভ্রু-জোড়া কুঁচকে ফেলে।আঞ্জুমানকে বলে,
— “খালাম্মা, আফারে ভূতে ধরছে।দেখেন কেমনে তাকাইছে।”
— “তোর সবকিছুতে ভূত না টানলে হয় না?”
— “শরি খালাম্মা।”

— “শরি না সরি হবে।না মা, আর জমজ নেই এখানে।খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।আর আমার ছেলে মেয়েরা জমজ।মেয়েগুলার মধ্যে যার চুল লম্বা সে মৌনতা আরেকজন মোহনা।আর ছেলেদের মধ্যে যার গালে টোল পড়ে,দেখতে স্বাস্থ্যবান,আর ঠান্ডা স্বভাবের তার নাম নিঝুম আর ফাজিলটা নির্জন।মনে থাকবে?”
তিতলি বাধ্যর মতো মাথা ঝাঁকায়।টুনি ফোড়ন কাটে,
— “খালাম্মা নিঝুম ভাই প্রাকৃতিক বটকা না হে তো বিয়াম কইরা বটকা হইছে।”
— ” কি ভাষা!বটকা কি?ওর কি ভূরি আছে?যে বটকা বলবি!”
টুনি মাথা নামিয়ে বলে,
— “শরি। ”
— “বটকা যদি আরেকদিন শুনি তোর চাকরি ক্যান্সেল।” মিসেস আঞ্জুমান হনহন করে রুমে চলে যান।টুনি মুখ বাঁকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলে,
— “মাইনষের বাড়িত বান্দিগিরি করি এইডা নাকি চাকরি!”

তিতলি রুমে এসেই সানজুকে কল করে।সানজুকে মনের সব কথা না বললে শান্তি লাগে না।সানজু কল রিসিভ করতেই তিতলি বলে,
— “সানজু মিস্টেক হয়ে গেছে একটা?”
— “মারাত্মক কিছু?”
— “তেমন না।”
— “তো?”
— “উনার নাম নির্জন না নিঝুম।”
সানজু সেকেন্ড কয়েক থ মেরে বসে থাকে।এরপর হো হো করে হেসে উঠে।তিতলির মেজাজ খিঁচড়ে গেল।হাসতে হাসতে সানজু বললো,

— “যার প্রেমে পড়লি তার নাম কেমনে ভুল বললি!”
কথা শেষ করে সানজু আবার হাসে।তিতলির প্রচন্ড রাগ উঠে।
— “আমি কেমনে জানবো।নিঝুম, নির্জন জমজ দুই ভাই।দুজনেই দেখতে একরকম।”
— “কিহ?একরকম দেখতে!কার প্রেমে পড়েছিস জানিস তো?”
— “হ জানি।উনার গালে টোল পড়ে।”
— “তাহলে টোলই প্রেমের কারণ?”
— “কি জানি।”
— “এই আমি না ভাবছি ভুলে ভুলে বাসর ঘরে যদি আরেকটা ভাই ঢুকে পড়ে তো তুইতো ওইটার সাথে বাসর করে ফেলবি!কি সাংঘাতিক দোস্ত!”
— “ছিঃ তোর এই ফিউচার গণনা আমার ভাল্লাগেনা।”
— “আচ্ছা মা মাফ কর।সরি আমি!”
— “ঢং।”
— “প্রপোজ করবি কবে?”
— “খাইয়া আমার আর কাম নাই?জীবনে বলবনা।
মাত্র দু’দিন হলো আসছি।”
— “তাইলে যখন অন্য মেয়ে চুরি করে নিয়া যাবে তখন বুঝবি।”
— “এতোদিনে হয়তো নিয়েও নিছে।”
— “এসব ভেবেও ভালবাসতে গেলি?এক পাক্ষিক ভালবেসে যাবি নাকি?”
তিতলি কন্ঠে অসহায়ত্ব নিয়ে বলে,
— “নির্জন ভাইয়া প্রেম করে গতকাল শুনছি।নিঝুম ভাইয়াকে নির্জন ভাবতাম।মানে ভাবতাম নিঝুম ভাই প্রেম করে।তবুও তো মনকে আটকাতে পারিনি।”
— “মরবি তুই মরবি!”
তিতলি লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে!

দুপুরের নামাযের পর ড্রয়িং রুমে বসে সবাই। নিঝুম, নির্জনের জন্য অপেক্ষা করে।তারা আসলে একসাথে দুপুরের খাবার খাবে। মোহনা তিতলিকে প্রশ্ন করে,
— “তিতলি গান গাইতে পারো?”
তিতলি বিনয়ের সাথে বলে,
— “একটু আধটু পারি।”
মৌনতা উচ্ছাসিত কন্ঠে বললো,
— “সিরিয়েসলি!আমার লাইভ গান শুনতে এতো ভালো লাগে। প্লীজ একটা গাও।”
তিতলি একবার নাচক করলেও পরে রাজি হয়ে যায়।মৌসুমি ভৌমিকের সেদিন গানটির সুর তুলে।মুগ্ধ হয়ে উপস্থিত সবাই শুনে।তিতলির অনেক প্রশংসা করে।তখন আগমন ঘটে নিঝুম-নির্জনের।টুনি বলে উঠে,
— “ভাইজানরা আইয়া পড়ছে।”

বাকিরা মেইন ডোরের দিকে তাকায়।এক জোড়া একরকম মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।তবে কেন জানি এখন নিঝুমকে চিনতে একটুও অসুবিধে হচ্ছেনা তিতলির।নিঝুমের চোখের দিকে তাকায় সে।চোখাচোখি হয় দুজনের।তিতলির ভেতরটা শিরশির করে কেঁপে উঠে।মানুষটার দৃষ্টিতে সাংঘাতিক কিছু আছে!লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয়।নিঝুম – নির্জন হালকা পাতলা কথা বলে পা বাড়ায় উপরে যেতে।আঞ্জুমান রান্নাঘরে ঢুকেন।মৌনতা তিতলির কাছে আবদার করে রোমান্টিক একটা গান গাইতে।বলার সাথে সাথে তিতলি সুর তুলে।

” তুমি আমার এমনি একজন
যারে এক জনমে ভালোবেসে
ভরবে না এ মন
এক জনমের ভালোবাসা
এক জনমের কাছে আসা
একটু চোখের পলক পড়তে
লাগে যতক্ষণ….. ”

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৩

গানের সুর গলায় চোখের দৃষ্টি নিঝুমে।নিঝুম এক পা এক পা করে সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ পার হচ্ছে তা তিতলির কাছে গানের সুরের মতো মনে হচ্ছে।এইযে, এখুনি হাতের ঘড়ি টা খুললো তাতেও ছন্দের গতি।নিঝুম হুট করে সিঁড়িতে থমকে দাঁড়ায়।মনে হচ্ছে কেউ একজন তাকিয়ে আছে তার দিকে।গভীর দৃষ্টি নিয়ে।পিছন ফিরে তাকায়।সাথে সাথে তিতলি চোখ সরিয়ে ফেলে।সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে লজ্জার আভা।তখন কন্ঠে লাইন দু’টি –
” ভালবাসা সাগর তুমি
বুকে অথৈ জল ”

প্রজাপতি আমরা দুজন পর্ব ৫