প্রণয়ের বিরহ পর্ব ২৪

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ২৪
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

‘ ত তুই এসব কি বলছিস পূর্ব? তাহমিমা বেঁচে আছে মানে!ওকে তো আমি সেদিন নিজের হাতে,,, তাহলে ও বেঁচে থাকতে পারে কি করে?’
শুকনো ঢোক গিলে বললো তূর্য। পূর্ব তূর্যের অবস্থা দেখে হো হো করে হেসে উঠলো, চেয়ারে হেলান দিয়ে কতক্ষণ হেসে নিল। এরপর চোখ ছোট ছোট করে তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,,
‘ হ্যা।ওই দেখ,তোর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে হাতে সাড়াশি নিয়ে,দেখ দেখ ও কিন্তু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বেঁচে আছে হা হা হা!’

আবার হেসে উঠলো পূর্ব।ভালোই মজা লাগছে তূর্য কে ভয় পেতে দেখে।ও জানে তূর্য কে তাহমিমার কথা বললে ও মেয়েদের থেকেও বেশি ভয় পাবে। ভালোবাসার মানুষ কে খু*ন করেছে কি-না! তূর্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এক সেকেন্ডের জন্য মনে হয়েছিল পূর্ব বুঝি সত্যিই বলছে তাহমিমা বেঁচে আছে, কিন্তু এটা অসম্ভব ব্যাপার। সেদিন এক্সি’ডে’ন্ট এর পর হসপিটালে যখন নিয়ে যাওয়া হলো তখন আই সি ইউ তে ঢুকে গলা টিপে ধরেছিল নিজেই। মুখের উপর কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল কিন্তু শরীরের গঠন দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে ওটাই তাহমিমা। পাঁচ মিনিট ধরে থাকার পর যখন নিশ্চিত হলো ও আর নেই তখন গিয়ে নিজের বেডে শুয়ে পড়েছিল। এরপর সবকিছু তো পূর্ব ই করল। আনমনে বললো,,

‘ ড. শাওনের কোন খোঁজ পেলি পূর্ব?’
‘ নাহ।ওই বুড়ো টা কোথায় লুকিয়েছে কে জানে, এখনও ওর খোঁজে শহরে লোক সেট করা আছে।ওকে দেখতে পেলে সাথে সাথেই আমাকে ইনফর্ম করবে।'(পূর্ব)

ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে তূর্য বললো – ‘ওহ।’
‘ বাই দা ওয়ে তূর্য, তুই কেন এসেছিস সেটা তো বললি না। এটা তো তোর বাসায় গিয়ে ঘুমানোর টাইম তাহলে তুই অফিসে বসে কি করছিস বলতো?'(বেশ সন্দেহের গলায় বলল পূর্ব)
‘ ভালো লাগছিল না তাই তোর সাথে আড্ডা দিতে এসেছি।চল এখন বাড়িতে যেতে হবে, একসাথে ই যাই না হয়।আর অফিসে তো তোর এখন কোন কাজ ও নেই!'(তূর্য)
তূর্যের প্রপোজাল শুনে পূর্ব কিছুক্ষণ ভাবলো। সত্যিই এখন হাতে কোন কাজ নেই,সব কাজ কর্মচারী রাই করছে।ডেস্ক থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো – ‘চল।’

সন্ধ্যা ছয়টা বাজছে কিন্তু স্নিগ্ধার ঘরের দরজা এখনও ভিতর থেকে বন্ধ দেখে চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে আম্মার। নিজের ঘরে ব্যস্ত পায়ে পায়চারি করতে লাগলেন তিনি।এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো দিপ্তী,ওকে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিলেন স্নিগ্ধার ঘরে।

‘ কি হয়েছে বল, ভিতর থেকে কোন সাড়া পেয়েছিস? এতো কোন আনন্দে মজে গেছে ওই মা* যে তিন ঘণ্টা পার করে ফেলেছে। আগে তো যেতেই চাইছিল না,কি দেখে এলি বল;'(আম্মা)
একনাগাড়ে বলে দিপ্তীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন আম্মা।দিপ্তী কিছুক্ষণ সময় নিল কথা বলার জন্য। দৌড়ে দৌড়ে এসেছে তাই হাঁপিয়ে উঠেছে খুব। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,,
‘ আমাকে কিছু বলার সময় তো দেন আম্মা! সর্বনাশ হয়ে গেছে আম্মা!’ (দিপ্তী)
‘ কি সর্বনাশ হয়েছে, সরাসরি বলছিস না কেন?'(দিপ্তীর কথার মাঝখানে বলে উঠলেন আম্মা)

‘ ওই বাবুকে খু*ন করে স্নিগ্ধ মেয়েটা পালিয়েছে তা-ও বাড়ির পিছন দিয়ে।ওই যে ওর ঘরের জানালা টা আছে না, সেটা ভেঙে পালিয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি ওর ঘরে চলুন আমার সাথে।’

ব্যস্ত গলায় বলল দিপ্তী। আম্মা শুনে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে রইলেন, একবার শুধু বললেন ‘ও এটা করতে পেরেছে?’ পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি দিপ্তী কে নিয়ে ওর ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।এক তলার এই মাথায় আম্মার ঘর আর আরেক মাথায় স্নিগ্ধা কে থাকতে দেওয়া হয়েছে। মাঝখানে সবকটা ঘরই মেকআপ।এই বাড়ির এতো এতো মেয়েরা সবাই উপচে পড়েছে স্নিগ্ধার ঘরে।ভিড় ঠেলে ঘরে ঢুকলেন আম্মা।

ঢুকেই চিৎকার করে উঠলেন ভয়ে।কি বিচ্ছিরি ভাবে মাথাটা থেঁতলে গেছে দেখে শরীর কেঁপে উঠে বারবার।ঘরময় রক্ত ছড়িয়ে আছে, কিছু রক্ত শুকিয়ে ও গেছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই এই কান্ড টা ঘটে গেছে।খাটে ধপ করে বসে পড়লেন আম্মা।সবাই চুপ হয়ে আম্মাকে দেখছে।জানে আম্মা এখন স্নিগ্ধা কে যেখানেই পাবে সেখানেই মে’রে রেখে আসতে বলবেন।চাপা উৎকণ্ঠা নিয়ে সবাই আম্মার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতে লাগলো। আম্মা কিছুক্ষণ লা*শ টা দেখে জানালার দিকে তাকালেন। কাঁচের জানালা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে,পাশেই রড টা রাখা। রড টা হাতে তুলে নিয়ে রক্তের গন্ধ নিলেন আম্মা। এরপর ধীরে ধীরে বললেন,,

‘ তোরা কয়েকজন মিলে বাগানে একটা গর্ত খুঁড়ে ফেল।এই বাবু কে মাটি চাপা দিতে হবে তো নাহলে এটার দুর্গন্ধে টেকা দায় হয়ে পড়বে।দিপ্তী, তুই আর শাহারা মিলে ঘরটা ধুয়ে ফেল।এই ঘরে কাল থেকে নতুন কোন মা* উঠবে।’
আম্মার কথা শুনে সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। আম্মার আজ হয়েছে কি? তিনি স্নিগ্ধা কে না খুঁজতে বলে এই ঘটনা চাপা দেওয়ার কথা বলছেন কেন! সবাইকে নিজের জায়গায় অনড় থাকতে দেখে ধ’ম’ক দিলেন আম্মা।
‘ তোরা কি আমার মুখ দেখবি নাকি কাজ করবি?’

সবাই তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়লো। আম্মা ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এসে দরজাটা এটে দিলেন।বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর হবে আম্মার।বেশ পড়াশোনা জানেন তিনি। ছোট্ট ট্রাংক খুলতেই একটা লাল মলাটের ডায়েরি বেরিয়ে এলো। একটা কলম তুলে নিয়ে ডায়েরির একটা পেইজে লেখতে শুরু করলেন।
১২ ই সেপ্টেম্বর ২০১৯

জানিস মা আমি খুব খারাপ একটা মহিলা। টাকার জন্য কতগুলো মেয়ের ইজ্জত বিক্রি করি আবার ওদের দেশের বাইরেও পাঠিয়ে দেই। খুব খারাপ রে আমি।এই যে দেখ আমি যেখানে থাকি সেখানে সবাই আমাকে আম্মা বলে ডাকে। মায়ের মতো দেখে আমাকে, ওদের মাঝে মেয়ের রূপ দেখতে পাই আমি। কিন্তু আমার না মন ভরে না রে মা, এতো মানুষের গলায় আম্মা ডাক শুনি তারপরও আমার তৃষ্ণা শেষ হয়না।

আমার বড় ইচ্ছে করে তোর গলায় একটা বার মা ডাক শুনতে! কেন চলে গেলি তুই আমাকে ছেড়ে?জানিস মা, আমি না তোর মতো দেখতে একটা মেয়েকে পেয়েছিলাম কিছুদিন আগে।আজ মেয়েটার একটা বাবুর সাথে সময় কাটানোর ছিল কিন্তু মেয়েটা তা না করে বাবুকে মে’রে পালিয়েছে।এই নিষিদ্ধ পল্লী থেকে কেউ একবার বেরিয়ে গেলে আমি তাকে বাঁচিয়ে রাখি না কিন্তু আমি তার সাথে কিছুই করতে পারছি না কেন বলতো মা?

তাকে খুজার চেষ্টা না করে আমি প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করছি কেন, তার প্রতি হঠাৎ করেই আমার খুব টান হচ্ছে রে। জানি না কেন জানি তার মাঝে আমি হুবহু তোকে দেখতে পাই,সেই ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করা,সেই তোর মতো জেদি আর একরোখা মেয়েটা। আচ্ছা আমি কী তোকে খুব মনে করি বলেই এমন হচ্ছে নাকি অন্য কিছু? মাতৃত্বের টান কেন হচ্ছে ওর প্রতি? জানি না আমি কিন্তু আমি ওকে দুহাতে আগলে রাখবো এখন।যেখানেই যাক ও আমি কাউকে বলবো না ওর পালিয়ে যাওয়ার কথা। এমনকি পূর্ব সাহেব কেউ।ও ভালো থাকুক এখান থেকে চলে গিয়ে, আমার মনে হচ্ছে এই নিষিদ্ধ পল্লী ওর জন্য ঠিক নয়। বাইরের পরিবেশ ওর জন্য ভালো!

লেখা শেষ করে ডায়েরি টা বন্ধ করলেন আম্মা।চোখ থেকে নিজের অজান্তেই দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো ডায়েরির উপর। এতক্ষণ তিনি তার একমাত্র মৃ’ত মেয়ে তাসু কে উদ্দেশ্য করে লিখছিলেন। পুরো ডায়েরি জুরে তাসু কে উদ্দেশ্য করেই লেখা।যখন মেয়ে ছোট তখন ওর বাবার সাথে ঝামেলা হয় আর ডিভোর্স হয়ে যায়।

পরে পেটের দায়ে এই নিষিদ্ধ পল্লীতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।যখন একটু টাকা এল হাতে তখন মেয়েকে নিজের কাছে আনতে ওর বাপের কাছে গিয়েছিলেন কিন্তু তখন শোনেন তার মেয়ে নাকি মা’রা গেছে। প্রাক্তন স্বামী আবার দ্বিতীয় বিয়ে করেছে দেখে খুব অবাক হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কিছু না বলে বাড়ির বাইরে থেকেই চলে আসেন।

এরপর থেকে এই পল্লিতে ই তার জীবন আটকে আছে।এখানে সব জায়গায় তার আধিপত্য বিস্তার হয়েছে। বাইরে থেকে খুব কঠোর আম্মা,কেউ ভুল করলে তার শাস্তি হয় মৃ’ত্যু। কিন্তু ভিতরে ভিতরে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যান আম্মা যখন তার মেয়ের কথা মনে হয়। এই মেয়েটার প্রতি এই অদ্ভুত টানের কারণ তিনি জানেন না আর জানতেও চান না। ভালো থাকুক মেয়েটা!

সকাল দশটার দিকে একটা বাড়ির সামনে এসে বসে পড়লাম।আর এক পা চলার শক্তি নেই আমার।কাল বিকাল থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে আমার। বাড়ির দরজার সামনে বসে থেকেই চিৎকার করে ডাকলাম,

‘ মা!’
প্রায় সাথে সাথেই একটা মহিলা বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখে তিনি ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন প্রথমে কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে আমাকে হুট করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি ও জড়িয়ে ধরলাম তাকে।এই মহিলা আমার সৎ মা। নিজের বাড়িতেই এসেছি আমি।

‘ কেমন আছিস তুই মা? কোথায় চলে গিয়েছিলি আমাকে না বলে,তামু তো আমাকে ছেড়ে চলে গেল এখন তুই ও কি আমাকে ছেড়ে যেতে চাস বল? এই তিন তিনটা মাস কোথায় ছিলি তুই?'(মা)
‘ মা, আমাকে একটু ধরে ধরে ঘরে নিয়ে যাবে? আমার পা আর চলছে না, খুব কষ্ট হচ্ছে আমার!'(আমি)

মা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নিয়ে আমাকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে এলেন। বসার রুমে সোফায় বসিয়ে দিলেন আমাকে। এরপর কোথায় যেন তাড়াতাড়ি চলে গেলেন,বলে গেলেন আমি যেন বিশ্রাম নেই বসে বসে। তিনি এক্ষুনি আসছেন।পা ব্যথায় ককিয়ে উঠছি বারবার, সোফায় পা তুলে বসে আরাম করে বসলাম একটু।

এই কয়দিনে অনেক বেশি ধকল গেছে আমার উপর দিয়ে। বাসায় থেকে নিজেকে সুস্থ করে এরপর পূর্বের বিরুদ্ধে মাঠে নামতে হবে। অনেক পরিবর্তন হয়েছে আমাদের বাড়িটা। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই একটা ঘরে চোখ আটকে গেল আমার। চমকে উঠলাম ঘরের দিকে তাকিয়ে,গলা ফাটিয়ে মা’কে ডেকে উঠলাম ঘরের ভিতরের দৃশ্য টা দেখে। এটা কি ছিল ঘরে!

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২৩

(আসসালামুয়ালাইকুম।পাঠক আপনাদের কাছে আমার একটা চাওয়া আছে, সেটা কি পূরণ করবেন আপনারা?আর চাওয়া টা হচ্ছে গঠন মূলক মন্তব্য করবেন আজকে।নাইস নেক্সট অসাধারণ এগুলো বাদ দিয়ে দুই লাইনের একটা উৎসাহ মূলক মন্তব্য করুন সবাই।এটাই আমার চাওয়া; বেশি হয়ে গেল কি চাওয়া টা!)

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২৫