প্রণয়ের বিরহ পর্ব ২৫

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ২৫
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

সকালে ঘুম থেকে উঠেই একবার বাগানে হাঁটাহাঁটি করা পূর্বের বহুদিনের পুরনো অভ্যাস।অভ্যাস মতো আজকেও বাগানে হাঁটতে এসে একটা জিনিস দেখে চমকে উঠলো।তার প্রাণ প্রিয় জুলিয়েট রোজের গাছটা কে যেন কেটে রেখেছে গোড়া থেকে। মাথায় রক্ত উঠে গেল পূর্বের, চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো। আফসানা চৌধুরী কেবল মাত্র ঘুম থেকে উঠেছেন, তখনই ছেলের এমন চেঁচামেচি শুনে ফ্রেশ হওয়া বাদ দিয়ে দৌড়ে বাগানে এলেন।

‘ কি হয়েছে পূর্ব, চেঁচামেচি করছিস কেন?'(আফসানা চৌধুরী)
‘ আমার গাছটা কে কেটে রেখেছে মা? তাড়াতাড়ি বলো কে কেটেছে, আজ আমি তার হাত কাটবো।কার এতো সাহস আমার জুলিয়েট রোজের গায়ে হাত লাগায়?’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাগে গজগজ করতে করতে বলল পূর্ব।শরীর কাঁপছে রাগের পরিমাণ সহ্য করতে না পেরে। আফসানা চমকে উঠলেন গাছ কাটা গেছে শুনে। আস্তে আস্তে গাছটার কাছে গিয়ে দেখলেন গোড়া থেকে আলগা হয়ে গেছে একেবারেই। দেখে মনে হচ্ছে খুব সম্ভবত কালকে গাছটা কাটা হয়েছে।গোড়ার কাছে চুলের একটা পিন পড়ে থাকতে দেখে গলা উঁচিয়ে কাকে যেন ডাকলেন তিনি।

‘ আয়রা একটু বাগানে আয় তো মা!’
প্রায় সাথে সাথেই একটা অল্প বয়সী মেয়ে লাফাতে লাফাতে বাগানে দৌড়ে এলো।শর্ট জিন্স আর টপস্ পড়া মেয়েটার রূপ যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে।এক রাশ খোলা চুল পিঠে পড়েছে, মুখের সামনে কিছু চুল চলে এসেছিল।আয়রা ওগুলো হাত দিয়ে সরাতে সরাতে বললো,

‘ ডেকেছো কেন খালামণি?'(আয়রা)
‘ তুই কি এই এই যে গাছটা দেখতে পাচ্ছিস এটা কেটেছিস?’
ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন আফসানা চৌধুরী। মনে প্রাণে চাইছেন আয়রা যেন অস্বীকার করে ব্যাপারটা। নাহলে পূর্ব ওর কি অবস্থা করবে তা আল্লাহ মালুম!

‘ হ্যা এই উদ্ভট মার্কা গাছটা কেটে দিয়েছি আমিই।ওই একটা কথা শোনোনি “যে জিনিস যত বেশি সুন্দর আর প্রিয় সে জিনিস তত বেশি নিজের থেকে দূরে রাখতে হয়।” তো আমি ভাবলাম এতো সুন্দর গাছ বাগানে রেখে কাজ নেই,তাই কাল সন্ধ্যায় অনেক কষ্ট করে কেটেছি।কি ভালো কাজ করিনি ব,,,,,,,,’

‘ শাট আপ!’
আয়রার সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার আগেই চেঁচিয়ে উঠলো পূর্ব।রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না আর,ঠা’স করে একটা চ’ড় বসিয়ে দিল আয়রার গালে।

‘ তোমার সাহস হয় কি করে আমার বাগানে হাত দেওয়ার, নিজের বাপের তৈরি বাগান পেয়েছো নাকি তুমি হ্যা? কোনোদিন তো এই বাড়িতে দেখিও নি তোমাকে,উড়ে এসে জুড়ে বসেছো আবার মুখে কথার খই ফোটাচ্ছো?এই তোমার লজ্জা করলো না উইদাউট পারমিশন কারো বাগানের কোন গাছে হাত লাগাতে;হ্যা?’

রাগে গজগজ করতে করতে বলল পূর্ব।চোখে পানি চলে এসেছে গাছের শোকে। এতো আদরের গাছটা তার। নিজের জীবনের থেকেও বেশি প্রিয় এই গাছটা আর এটাই কিনা এই মেয়েটা! হনহন করে বাগান থেকে বেরিয়ে গেল পূর্ব। পূর্ব চলে যাওয়ার পর আফসানা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে আয়রা ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদতে শুরু করলো।

চ’ড় টা যদিও হজম করে নিয়েছে কিন্তু ওর এই কাট কাট কথা হজম করতে পারলো না আয়রা। হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো। আফসানা চৌধুরী কিছু বললেন না কাউকেই, আয়রার এই কাজে তিনি নিজেও যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে গেছেন।না জানি পূর্ব এখন কি তান্ডব চালায় এই মেয়েটার উপর, কিছু না জেনে কেন পাকনামি করতে গেল কে জানে?

আমার ওমন চিৎকারে মা দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বসার রুমে এলো। বিস্ফোরিত চোখে আমি তখনও ঘরের দিকে তাকিয়ে আছি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার, এটা কি সত্যি দেখছি আমি নাকি কোনো দুঃস্বপ্ন? কাঁধে হালকা ঝাঁকি দিলো মা।

‘ কি হয়েছে তাসু, এভাবে চিৎকার করে উঠলি কেন? পায়ে কি খুব বেশি ব্যথা করছে তোর, একটু অপেক্ষা কর মা।গরম পানি বসিয়েছি চুলায়। পানি গরম হলেই সেক দিয়ে দিবো পায়ে তাহলেই আর ব্যথা থাকবে না।'(মা)
আমি মায়ের কথা কানে নিলাম না। ঘরের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এরপর আস্তে করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলাম ,

‘ মা আমার ঘরে ওটা কে রয়েছে সত্যি করে বলো! আমি কি এইমাত্র ভুল কিছু দেখলাম চোখ দিয়ে নাকি সত্যিই?'(আমি)
‘ কেন রে তাসু, তুই কি আমাদের আসিফ কে ভুলে গেলি নাকি? কয়েকদিন হলো বেড়াতে এসেছে আমাদের বাসায়,তোরা কেউ নেই বাসায় তাই ওকে তোর রুমে থাকতে বলেছি। এখন তুই এসেছিস ওকে অন্য রুমে চলে যেতে বলবো, চিন্তা করতে হবে না এতো।’

এটুকু বলেই মা তাড়া দেখিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। আমি থম ধরে বসে রইলাম সোফায়, পায়ের ব্যথা ভুলে গেছি কিছুক্ষণের জন্য।আসিফ!!! বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা পুরোনো ক্ষত টা জেগে উঠলো আবার।কত শত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই নামটার সাথে। বুকের বাম সাইডে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত করতে পারছি এখন, শরীর অবশ হয়ে আসছে এই নামটা শুনে।আস্তে করে সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে অতীতের মাঝে ডুব দিলাম,,

স্কুল জীবনের প্রথম ভালোবাসা ছিল আসিফ।ক্লাস সেভেনে উঠেছি তখন আর আসিফ এসএসসি পরীক্ষার্থী। একদিন সন্ধ্যায় সৎ মায়ের বংশের বড় বোন জামিয়া খালা আর তার পরিবারের সবাই বেড়াতে এলেন আমাদের বাসায়। জামিয়া খালার বড় ছেলে আসিফ রহমান আর ছোট ছেলে জয় রহমান।জয় আমার ব্যাচমেট ছিল তাই ওর সাথে খুব সহজেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো আমাদের।রোজ একসাথে পড়তে বসি তাহমিমা,আমি, জয় ।

একদিন আসিফ এলো আমাদের সাথে বই পড়তে, তাহমিমা ছোট ও খুব ফ্রি হয়ে গিয়েছিল আসিফের সাথে কিন্তু আমি পারছিলাম না। প্রথমদিন থেকেই কেমন জানি লজ্জা মিশ্রিত ভয় লাগছিল তাকে। আমার এই ভয় লজ্জা দূর করলো আসিফ নিজেই, প্রচুর হাসাহাসি করলো আমাদের সাথে। জোকস্ বললো অনেক,পড়া নিয়ে মজার মজার সব বুদ্ধি দিল।ম্যাথ ধাঁধা দিল একটা।

ধাঁধা টা এই যে ৯ এমন একটা সংখ্যা যেটার সাথে কোন সংখ্যা গুন করলে গুনফলের সংখ্যা গুলো আবার যোগ করলে ৯ ই হবে। অবাক হয়েছিলাম ধাঁধা টা শুনে, পরীক্ষা করে দেখলাম সত্যিই তাই হলো। জিজ্ঞেস করলাম কোথা থেকে শুনেছে,বললো আসিফের প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ স্যার এর একটা বই পড়ে জেনেছে এটি।আরো অনেক কিছু জানলাম ওর থেকে।

ও বলে চলেছে আর আমি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে সবকিছু শুনেছি। ভালোলাগা টা তখন থেকেই শুরু হলো।জামিয়া খালা রা আমাদের বাসায় দশ দিন ছিলেন।এর মধ্যেই আসিফের সাথে সেরকম একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল আমার। শুধু ভালো লেগেছিল নাকি ভালোবাসতাম তা জানি না কিন্তু যেদিন ওরা চলে গেল সেদিন বিছানায় মুখ গুজে কেঁদেছিলাম খুব।

মা তো প্রায় সারাদিনই আমাকে দিয়ে কাজ করাতো কিন্তু আসিফের চোখে যখনই পড়েছে আমি কাজ করছি তখনই মা’কে এটা ওটার আল দিয়ে আমাকে কাজ থেকে বাঁচিয়ে দিত।দিন দুয়েক মন ভার করে পড়ে রইলাম। স্কুল এ যাওয়ার ইচ্ছা করতো না, কোন কাজ দিলে মন দিয়ে করতে পারতাম না। ফলস্বরূপ মা’র খেয়েছি।

এভাবেই আস্তে আস্তে তিন বছর কেটে গেল।টেন এ উঠলাম আমি। এর মধ্যে আসিফের আর একবার ও দেখা পাইনি কিন্তু তাই বলে অনুভুতি গুলো মরে যায় নি। বরং দিন দিন বেড়েই চললো একতরফা ভালোবাসা। তাহমিমা সেভেন এ পড়ে, ঠিক আমার সেই বয়সে এসে ও আমার সবকিছু বুঝতে পারলো।মন খারাপের সঙ্গী হলো ওই। একদিন সকালে কোচিং এ যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছি হঠাৎ মাঝ রাস্তায় কে যেন “স্নিগ্ধ পরী” বলে ডেকে উঠলো।

বহু প্রতীক্ষিত সেই কন্ঠস্বর চিনতে আমার এতটুকু ও অসুবিধা হয়নি, বুঝতে পেরেছিলাম আমার আসিফ আমাকে ডেকেছে। পিছন ফিরতেই এক বড় চমক পেলাম।আসিফ কতগুলো লাল গোলাপ নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আছে আমার সামনে।এক মুহূর্তও দেরি না করে সাথে সাথেই ফুলগুলো নিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম।কত অপেক্ষা করেছি তার জন্য। অবশেষে আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছিল। প্রেমের সম্পর্ক তার সাথে সেখান থেকেই শুরু।

আমি ভেবেছিলাম আসিফ ও বুঝি আমাকে ভালোবাসে ঠিক আমার মতই কিন্তু নাহ।দুই মাস পর হুট করেই কিছু না বলে ও আমেরিকা চলে যায় পড়াশোনার জন্য। জামিয়া খালার স্বামী আমেরিকার একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে, পুরো পরিবার টা তখন আমেরিকা সেটেল হয়ে গেল। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। পরপর দুই সপ্তাহ যখন ওর কোন খোঁজ পেলাম না তখন সবকিছু ভুলে মা’কে জিজ্ঞেস করি ওদের কথা তখন মা আমাকে বলে ওরা আমেরিকা চলে গেছে।

খবরটা শুনে পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম, এতো ভালোবাসতাম আসিফ কে যে ওকে ছাড়া কিছু ভাবতেও কষ্ট হত কিন্তু ও আমাকে না জানিয়ে এভাবে চলে যেতে পারে এটা কল্পনাতীত ছিল।এর বছর দুয়েক পর খবর এলো আসিফের নাকি অন্য একটা মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে।আর তার সাথে আসিফের ছোট থেকেই সম্পর্ক ছিল, ছোট থেকেই নাকি ওদের বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল।এসব শুনে শুধু কাদতাম মা’কে লুকিয়ে।

তামু সব বুঝতে পারতো কিন্তু ওর ও কিছু করার ছিল না। শান্তনা দিত, মোটিভেট করতো যতটা পারতো।সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পুরো চার বছর লেগেছে আমার।ধীরে ধীরে তার সমস্ত স্মৃতি পুড়িয়ে দিয়েছি, তার প্রতি যেই নিষ্পাপ অনুভূতি গুলো ছিল সেগুলো নিজের হাতে গলা টিপে হ’ত্যা করেছি।সব ছেড়েছুড়ে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী হয়েছিলাম আর তার পর এলো এই পূর্ব।সেও আমাকে ঠকালো আসিফের মতো।

দু’বার ভালোবেসে ভুল করলাম আমি। সেটাও সামলে নিতে পারতাম কিন্তু আবার কেন পুরোনো ঘা তাজা করতে ফিরে এলো আসিফ? একবার আমাকে ভেঙে দিয়ে শান্তি হয়নি কি তার, আবার এসেছে অব্যক্ত অনুভূতি গুলো জাগাতে? হঠাৎ মাথায় কারো হাতের স্পর্শে চোখ খুলে তড়াৎ করে উঠে বসলাম।দেখি মা গরম পানির ব্যাগ হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। অতীত ভাবতে ভাবতেই কখন চোখে পানি চলে এসেছে কে জানে, তাড়াতাড়ি করে চোখের পানি মুছে নিতে মা জিজ্ঞেস করল,

‘ কাদছিস কেন তাসু?'(মা)
‘ ওই এমনিতেই ব্যথায় চোখে পানি চলে এসেছে।দাও ব্যাগটা আমি সেক নিয়ে নিচ্ছি।'(আমি)
‘ পারবি তুই, তাহলে নে। আমি তোর জন্য রান্না বসিয়েছি এইমাত্র। তুই তো মুরগির মাংস খুব পছন্দ করিস, আমি তোর জন্য সেটাই রান্না করতে বসালাম। তুই সেক নে, আমি দেখে আসি তরকারি টা,পুড়ে না যায় আবার!’

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২৪

হাতে গরম পানির ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে মা চলে গেল। আমি মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো আবারই সেদিকে কোনো খেয়াল নেই আমার। আমি শুধু ভাবছি আমার ভাগ্যের কথা। মায়ের এতো ভালোবাসা ও আমার কপালে ছিল বুঝি?

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২৬