প্রণয়ের বিরহ পর্ব ২৩

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ২৩
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

‘ এই মেয়েটাকে এক রাতের জন্য চাই।কত দাম এই মেয়েটার?’
সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো এক পঞ্চাশোর্ধ লোক।তার সামনেই হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে আম্মা,যার কাছে এসে মেয়ে চাইতে হয়। আম্মার হাতে ও সিগারেট। হাতের সিগারেট টা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঠিক হয়ে বসলেন আম্মা। এরপর পাশের যে মেয়েটি বসে আছে তার গাল টেনে দিয়ে বললেন,,

‘ এর রেট ও নিজেই ঠিক করবে,বড় দেমাগি বেটি এইটা।যা খুশি দিতে পারেন বাবু কিন্তু কম দামের বেটি এটা নয়!’
গাল ছেড়ে দিলেন আম্মা। ছাড়া পেয়ে আরেক দফায় কেঁপে উঠলাম আমি। বুড়ো লোকটার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে দেখলাম বারকয়েক। বাবার বয়সী লোকটা,পান খেয়ে ঠোঁট দাঁত সব কালো করে ফেলেছে।কালো দাঁতের ফাঁক দিয়ে বিশ্রীভাবে সিগারেট টানছে আর খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। শাড়ির আঁচল টা টেনে ঠিক করে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম অমনি খপ করে হাতটা ধরে ফেললেন আম্মা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ যাস কই মা*? এই বাবু রে তো খুশি করতে হবে, নাহলে তোর রোজগার আসবে কোত্থেকে।যা বাবু রে নিয়ে যা মা*!’
এতক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদলে ও এবার শব্দ করেই কেঁদে উঠলাম।বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে কাঁদার সুযোগ পেলাম না। লোকটি চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে চললো একতলার সর্বশেষ ঘর টির দিকে। ঘরে এনে বিছানায় ছুড়ে মারলো একরকম।

বাবার বয়সী মানুষটি দরজা বন্ধ করে নিজেকে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম পুরুষ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য তৈরি করছে যখন তখনই আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। উঠে বসলাম বিছানায়। এই ঘরেই আমি থাকি গত কয়েক দিন ধরে।খাটের নিচে একটা শক্ত লোহার রড রাখা হয়েছে, কুকুর বিড়াল ঘরে এলে যাতে তাড়ানো যায় সেজন্য।খাট থেকে নেমে সেই রড টা তুলে নিয়ে পিছনে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। ছুড়ে ফেলেছিল বিধায় শরীরের উপর আঁচলটা ঠিক নেই।খালি গায়ে লোকটা এসে শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত লাগানোর জন্য হাত বাড়ালো আমার দিকে..…………..

নিথর দেহটার পাশে বসে হাঁপাতে লাগলাম।কি বিচ্ছিরি ভাবে মাথাটা থেঁতলে গেছে দেখে নিজেই শিউরে উঠছি বারবার। আমাকে ছোঁয়ার ও সুযোগ দেই নি একে। আচমকা রড পিছন থেকে বের করে এনে মাথার মাঝ বরাবর মে’রে’ছি। এতো জোরে আঘাত পেয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করার সময় পায়নি লোকটা,প্রান পাখি উড়ে গেছে প্রায় সাথে সাথেই।রড টা ফেলে দিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসে রইলাম।হাত পা এগুনোর জন্য বিন্দুমাত্র শক্তি ও নেই শরীরে।

পূর্বের কথা ভেবে হু হু করে কেঁদে উঠলাম আমি। পূর্ব কি করে পারলো আমার সাথে এমনটা করতে? আমি তো ওর স্ত্রী ছিলাম, একসাথে জীবন কাটানোর কথা দিয়েছিল তো ও আমাকে, তাহলে? নিজের স্ত্রী কে অন্যের ভোগসামগ্রী করে রাখলো। সেদিন রাতে জ্ঞান হারানোর পর পূর্ব আমাকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল। প্রয়োজনীয় সব চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলে আমাকে।ঝাড়া দুই মাস হসপিটালে পড়ে ছিলাম।

তখন পুরোটা সময় আমার পাশে ছিল পূর্ব। আমার প্রতি এতো কেয়ার নিতে দেখে ভেবেছিলাম পূর্ব বুঝি শুধরে নিয়েছে নিজেকে,সব অন্যায় কাজ ছেড়ে দিয়েছে। মনের মধ্যে ও আর তূর্যের প্রতি যেই ঘৃণা টা ছিল সেটা ওর এই ভালোবাসাময় ব্যবহারে উবে গিয়েছিল কর্পূরের মতো। কিন্তু ও শুধরায়নি।যখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলাম তখনই ও ওর আরেক দফায় হিংস্র রূপটা দেখালো আমাকে।

শাওন স্যারের কাছে শুনেছিলাম পূর্ব আর তূর্যের পাপের ব্যবসা এই নিষিদ্ধ পল্লী।আর এখানে যেই মেয়েগুলো অভাবের তাড়নায় টাকার লোভে আসে তাদের অনেককেই বিদেশে ও পাচার করা হয়।যেদিন হসপিটাল থেকে আমাকে রিলিজ করে সেদিন ও আমাকে নিয়ে এই নিষিদ্ধ পল্লীতে আসে। এখানকার রক্ষা আম্মা,শাহেলী তার কাছে আমাকে রেখে চলে যায়।শাহেলী আম্মা আমাকে দেখে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন।একে তো খুব বেশি বয়সী না আমি তার উপর গায়ের রং ও ভালো,ব্যাস আর কি লাগে?

পূর্ব কে বারংবার ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় করে। বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম পূর্বের ব্যবহারে, এতো ভালোবাসা দেখিয়ে শেষে এমন করবে সত্যিই ভাবতে পারিনি। আমার ভুল ছিল ওকে দ্বিতীয়বার ভরসা করা টা! ঘৃণা হচ্ছে এখন নিজের উপর,আসলেই আমি বোকা। নাহলে ওর সম্পর্কে সবকিছু জানার পরও কি করে আমি, ছিঃ
মেঝের দিকে তাকালাম।রক্তের স্রোত দরজা ছুঁইছুঁই করছে, একবার বাইরে বেরিয়ে গেলেই সর্বনাশ।

তাড়াতাড়ি গিয়ে একটা কাপড় ফেলে দরজার নিচের ফাঁকা টা বন্ধ করে দিলাম।ঘর থেকে বের, হতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।একটাই জানালা আছে এই ঘরের। সেটা দিয়ে বের হলে এই এতো বড় বাড়ির পিছন দিকে চলে যেতে হবে।যা ভাবা সেই কাজ।রড টা দিয়ে কাঁচের জানালা ভেঙ্গে জানালা দিয়ে লাফ দিলাম বাইরে।এক তলা হলেও বেশ উঁচু জানালা হওয়ায় হুমড়ি খেয়ে পড়তে হলো মাটিতে। কাপড় ঝেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একবার তাকালাম এই বাড়ির দিকে। আশপাশে যতদূর চোখ যায় পুরোটাই নিষিদ্ধ পল্লী।

পুরো এলাকা জুড়ে এইসব কারবার চলে।আর এই বাড়িটার আম্মা হচ্ছে সবকিছুই ঠিকাদারি করে, মেইন পয়েন্ট এই বাড়িটা। এতদিন পালাতে সাহস করিনি, একবার এই বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে তার জীবনের উপর নেমে আসে অনিশ্চয়তার ছায়া।তাই সাহস করিনি কিন্তু আজ না পালালে ম’রা ছাড়া উপায় থাকবে না।পা চালালাম এবার।যত দ্রুত সম্ভব আমাকে পালাতে হবে, বাঁচতে হবে এদের থেকে!

কেবিনের এসির মিটার বাড়ানো হয়েছে। চারপাশে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব বিরাজ করছে।ইজি চেয়ারে বসে পেপারের টপ নিউজ পড়ছে পূর্ব। সামনে বসে তূর্য বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল । তূর্য গত দুই ঘণ্টা ধরে এখানে বসে আছে কিন্তু পূর্বের এতে কোন হেলদোল নেই,সে তার মত নিউজ পড়ে চলেছে।যেই ছেলে জীবনেও পেপার ছুঁয়ে দেখে না সেই ছেলে আজ দুই ঘণ্টা ধরে পেপার পড়ছে ব্যাপারটা তূর্য ঠিক হজম করতে পারলো না।যার পরনাই বিরক্ত হয়ে বাক্য ছুঁড়ল পূর্বের দিকে,,

‘ মহাশয়, আপনি কি পড়িতেছেন জানিতে পারি কি? আমি যে এখানে বসিয়া কঙ্কাল হইতেছি তাহা কি আপনার স্মরণে আছে?'(তূর্য)
পূর্ব যেন তূর্যের থেকে এক কাঠি উপরে বিরক্ত হয়ে গেছে। হাতের পেপার টা দলা পাকিয়ে ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
‘ শান্তিতে খবর টা পড়তে দিচ্ছিস না! কি হয়েছে বল।বউ পিটিয়েছে, নাকি খেতে দেয়নি সকালে?'(পূর্ব)

‘ আইছে আমার বউওয়ালা।তোর কি মতিভ্রম ঘটেছে নাকি পূর্ব?আমরা দুজনেই তো বিধবা।বউ বিরাগী, সংসার বিরাগী ভুলে গেছিস নাকি?বউ ছাড়া সিঙ্গেল জীবনযাপন করছি কতদিন ধরে আর তুই বলছিস বউ!!!!! ‘(তাচ্ছিল্য মেশানো গলায় বলল তূর্য)

‘ একটা পয়েন্ট ভুল বললি জানিস তো? আমি বিধবা,বিরাগী,সিঙ্গেল কোনোটাই না । আমার বউ আছে, সংসার ও আছে। শুধু কিছুদিনের জন্য বিরতি নিয়েছি, আমার বউয়ের বড় তেজ কি-না,তা না কমালে জীবন সুন্দর হবে না। তবে তূর্য, আমার না মাঝেমধ্যে তোর জন্য কষ্ট হয়রে, তোর ভাই বিবাহিত আর তুই এখনও সিঙ্গেল আছিস।অবশ্য সেটা থাকতি না যদি না সেদিন নিজের হাতে ওকে শেষ করতি ;'(পূর্ব)

পেপার ওয়েট টা ঘুরাতে লাগল পূর্ব।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে কিভাবে ঘুরছে এটা। সামনে বসা তূর্য সরু দৃষ্টিতে বাইরে দিকে তাকালো। পূর্বের কথায় অনেক কিছুই মনে পড়ছে তার,স্বার্থের জন্য তাহমিমা কে শেষ করতে হলো তাকে। ভালো সে সত্যিই বাসতো তাহমিমা কে কিন্তু ওর পাকনামি টা মেনে নেওয়া যাচ্ছিল না।ধরা পড়ে গেলে এত বছরের পুরনো ধারা অক্ষুণ্ন রাখা যেত না,বরঞ্চ জেলের ঘানি টানতে হতো।উদাস হয়ে বললো,

‘ ভাবীকে ওখানে রেখে এসেছিস তুই। পরে হাজার লোকের ছোঁয়া শরীরটা তুই এক্সেপ্ট করতে পারবি তো?'(তূর্য)
‘ কে বললো তোকে, স্নিগ্ধ কে হাজার লোক ছুঁবে? আমি ওকে চিনি, একটা লোকও ওকে স্পর্শ করতে পারবে না। সবকিছুর জন্য প্রস্তুত হতে হবে ওকে, অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হবে সেজন্যই তৈরি হওয়ার জন্য ওকে ওখানে ছেড়ে এসেছি আমি।'(পূর্ব)

‘ তুই এসব কি বলছিস পূর্ব? আমার তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না।এই বলছিস ওকে নিস্তেজ করতে চাস,এই বলছিস ওকে তৈরি করতে ছেড়েছিস! আমি না তোর কাজকর্ম, কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না।'(তূর্য)
‘ সময় হলেই বুঝতে পারবি সব। তবে তোকে একটা কথা জানাই, তোর আর এই উদাস হয়ে বসে থাকতে হবে না দোস্ত। তাহমিমা বেঁচে আছে!'(পূর্ব)

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২২

‘ কিহ!!!!!’
চমকে উঠে বিস্ফোরিত চোখে পূর্বের দিকে তাকালো তূর্য।কি বললো পূর্ব, তাহমিমা বেঁচে আছে?এটাই বললো কি ও নাকি ও কানে ভুল শুনলো, তাহমিমা কে তো ও নিজের হাতে শেষ করেছে তাহলে!!!!!

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২৪