প্রণয়ের বিরহ শেষ পর্ব 

প্রণয়ের বিরহ শেষ পর্ব 
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

রাত এগারোটার দিকে বাড়িতে ফিরলাম। শরীর টা দুর্বল লাগছে খুব। শাওন স্যার বাসার গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। গাড়িতে করে আসার সময় বারবার সাবধান করেছেন পূর্বের সম্পর্কে,ওর থেকে যেন নিরাপদ দূরত্বে থাকি সেটা বারবার বলে দিয়েছেন। আমি সেন্স লেস হওয়ার পর তিনি নাকি দাদী কে কল করে বলেছিলেন যে আমাকে বিষ দেওয়া হয়েছে,সেই বিষ টা আবার হসপিটালে পাঠানোর জন্য। অবাক হয়ে তাকালাম স্যারের দিকে।

‘ স্যার, আপনি দাদী কে এসব কল করে বলেছিলেন কেন? এবার যদি হিতে বিপরীত হয়ে যায় তাহলে কি হবে!'(আমি বেশ চিন্তিত কন্ঠে বললাম)
‘ ডোন্ট ওয়ারি তাসনিয়া। মহুয়া চৌধুরী আমাদের জন্য সেইফলি প্লেস। আমি এতসব প্লান করতে পেরেছি শুধুমাত্র উনার জন্যই,আজ তাহমিমা বেঁচে গেছে উনার জন্য। তুমি কিচ্ছু ভেবো না,ওই বাড়িতে তোমাকে সাহায্য করার জন্য তিনটি মানুষ আছে। একজন মহুয়া চৌধুরী, আরেকজন আনোয়ার চৌধুরী আর আরেকজন!'(এটুকু বলেই আনমনে হেসে উঠলেন শাওন স্যার)

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ আরেকজন কে স্যার?'(ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি)
‘ ও কেউ না। সময় এলেই সবকিছু নিজ থেকেই জানতে পারবে তুমি, আমার বলার প্রয়োজন হবে না আর।'(শাওন স্যার)
গাড়ি এসে থামলো চৌধুরী বাড়ির সামনে।গাড়ি থেকে নেমে শাওন স্যার কে বিদায় জানিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। বিদায় জানানোর সময় বারবার সতর্ক করে দিলাম স্যার কে,যেন ওই ভয়ানক তূর্যের থেকে সামলে রাখে নিজেকে। আমি নিজেকে পূর্বের হাত থেকে কতটুকু বাঁচাতে পারবো জানি না তবে স্যার যেন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখেন ওর হাত থেকে। ভিতরে ঢুকতে খালেক চাচা আমার কাছে দৌড়ে এলেন। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,,

‘ আপনি আইছেন আম্মাজান,দেহেন স্যারের কি অবস্থা অইছে! আপনার চিন্তায় স্যারের প্রেশার উঠছে আম্মাজান,কেউ কেউ কইতাছে স্যার নাকি বিষ খাইছে আপনার লাইগা। আপনি নাকি স্যারের উপর রাগ কইরা বাড়ি ছাইড়া গেছেন গা হের লাইগা স্যার বিষ খাইছে?’
প্রায় এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলেন খালেক চাচা। আমি বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। এইসব কি বলছেন উনি, পূর্ব বিষ খেয়েছেন মানে? উনি বিষ খেয়েছেন তা-ও আবার আমার জন্য,কানে কিছু ভুল শুনলাম না তো?

‘ কি বললেন চাঁচা? পূর্ব বি বিষ খেয়েছে আমার জন্য! না আপনি কি আমার সাথে এতো রাতে মজা করছেন চাচা,আর বাড়িতে এতো সোরগোল কেন? কোন পার্টি হচ্ছে নাকি এই চৌধুরী বাড়িতে?'(আমি)
‘ তওবা তওবা! এইসব কি উল্টাপাল্টা কথা কইয়া যাইতাছেন আম্মাজান?স্যার ম’র’তা’ছে আর আপনি পার্টি লইয়া পড়ছেন, আপনার জামাইয়ের ফিল আপনার একটুও দয়া নাই কি আম্মাজান।স্যার সত্যই আপনার লাইগা বিষ খাইছে , বিশ্বাস না করলে বাড়িতে যাইয়া দেখেন।আর এই সোরগোল বাড়িত ডাক্তার আইছেন হের লাইগাই।যাই আমি আমার কামে যাই, আপনার লগে ফাও প্যাচাল পাইড়া লাভ নাই আমার।’

চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে খালেক চাচা গেটের কাছে চলে গেল। আমি আমার কান কে এখনও পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছি না। না পূর্ব এটা কি করে? তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম।বসার রুমে সোফায় একজন মাঝ বয়সী লোক বসে আছে। পোশাক দেখে মনে হচ্ছে এই হয়তো বা ডাক্তার হবে। ভদ্রলোক বসে বসে ফোন স্ক্রল করছেন দেখে উনাকে আর কিছু বললাম না। একটু দূরে সাউন্ড বক্স রাখা, ওখান থেকেই পার্টি চলার মতো কোলাহল আর মানুষজনের আওয়াজ আসছে।পাশ কাটিয়ে রুমে চলে এলাম।

দরজা টা আলতো করে লাগানো ছিল, খুলে ভিতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম আমি। অবাক মানে মাত্রারিক্ত পরিমাণে অবাক হয়েছি। পূর্ব একা চুপচাপ বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন ও আমার অপেক্ষাই করছিল। রুমে আর কেউ নেই, আসার সময় ও গেটে খালেক চাচা আর বসার রুমে ওই ভদ্রলোক ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ে নি। তাহলে বাড়ির লোকজন,মা বাবা দাদী এরা সব গেল কোথায়? পূর্ব বহাল তবিয়তে বসে আছে তবে খালেক চাচা মে বললো উনি আমার জন্য বিষ খেয়েছেন? তবে কি খালেক চাচা আমাকে মিথ্যা কথা বললেন, উনি ও কি পূর্বের সাথে হাত মিলিয়েছেন??নাহ আর কিছু ভাবতে পারলাম না আমি। বিস্ফোরিত চোখে পূর্বের দিকে তাকালাম।

‘ স্নিগ্ধ! এভাবে তাকিয়ে কি দেখছো আমাকে?এসো পাশে এসে বসো না। বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলে ভালো কথা, তাই বলে এতো রাত করে বাসায় ফিরে কেউই?’
বেশ স্বাভাবিক গলায় বললেন পূর্ব। উনার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে উনি সম্পূর্ণ নির্দোষ ভালো একজন মানুষ।কি সহজ ভাবে‌ কথা বলছেন আমার সাথে। আমি কথা না বাড়িয়ে বেডের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম কিন্তু পর মূহুর্তের মধ্যেই পা দুটো থমকে গেল আমার।

আমার পায়ের দিকে তাকালাম,ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম একরকম।সোফা থেকে বেড বরাবর একটা চিকন ধারালো অস্ত্রের তার টানা হয়েছে।মাটি থেকে দুই ইঞ্চি উপরে রাখা আছে, সহজেই যে কারোর চোখে পড়বে না এই তার। কিন্তু অসাবধানতা বশত গায়ের কোথাও লাগলে মাংস চিরে ভিতরে হাড়ে গিয়ে ঠেকবে এই তার টা। ঠোঁট কামড়ে ধরলাম ব্যথায়, পায়ের অনেকটাই কেটে গেছে তারে লেগে। রক্তে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে ফ্লোর টা। দুই পা পিছিয়ে এলাম,সপাং করে তার টা পা থেকে বেরিয়ে এলো।

দুই পায়ে ই তার ঢুকেছিল, প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমার অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ফোবিয়া আছে, সহ্য করতে পারিনা এটা।আর এই বিষয়টি পূর্ব জানে,তামুর এক্সি’ডে’ন্ট এর পর ওকে হসপিটালে দেখে এই ফোবিয়া র জন্যই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। টলমল চোখে পূর্বের দিকে তাকালাম আমি,ও নির্লিপ্ত ভাবে এখনও ওভাবেই বসে আছে। ঠোঁটের কোণে একটা চাপা হাসি,কি মোহনীয় সেই হাসি। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে।

কষ্ট হচ্ছে খুব। ভাবতে পারছি না উনি আমাকে মা’রা’র জন্য এভাবে কষ্ট দিবেন আমাকে, আমার দুর্বলতা জেনে সেটা দিয়েই শেষ করে ফেলবেন আমাকে এতো তাড়াতাড়ি এটা আমার ভাবনায় আসেনি। ভালোবেসে কি ভুল করলাম উনাকে? চোখ বন্ধ করে ভরসা করে কি নিজের মৃ’ত্যু’কে ডেকে আনলাম আমি, আমি শেষ হয়ে গেলে শাওন স্যার একা কি করবেন,কি করে শেষ করবেন এই সবকিছু? আমার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মানুষটাই কিনা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে , কিছু বলতে চাইলাম উনাকে মুখ ফুটে। কিন্তু পারলাম না! পায়ের দিকে চোখ গেল আবার,আর সহ্য করতে পারলাম না।জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম ফ্লোরে,জ্ঞান হারানোর ঠিক আগ মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠলো পূর্বের ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা সেই চাপা হাসি!!!!

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২০+২১

সমাপ্ত

আসসালামুয়ালাইকুম। প্রথম খণ্ডের এখানেই সমাপ্তি হলো। কয়েকদিন পর দ্বিতীয় খণ্ড আসবে।

প্রণয়ের বিরহ  পর্ব ২৩