প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৬

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৬
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

তাসনিয়া দের বাড়ির ঠিক সামনে এসে পূর্বের গাড়ি থামলো।তার স্নিগ্ধর বিয়ে আজ এটা মনে হতেই বুকের বাম সাইডে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে পূর্বের, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলো। তূর্য ও নামলো। বাড়িটা ঝকমক করছে লাল নীল আলোতে, তূর্য বেশ অবাক হয়েই বললো,,

‘ আরে বাপস্,কয়েক ঘন্টার বিয়ের আয়োজনে এতো সাজগোজ কি করে ইয়ার?'(তূর্য )
পূর্ব মুখে কিছুই বললো না। চারপাশে তাকিয়ে পরিবেশ টা বুঝার চেষ্টা করলো শুধু মাত্র। তূর্য তাহমিমা কে এসএমএস করে জানিয়ে দিল ওরা এসে গেছে, এবার বাকি যা করার ওকেই করতে হবে।এটাও বলে দিল কবুল বলার ঠিক আগ মুহূর্তে ওরা এন্ট্রি করবে যেন তাসনিয়ার বিয়ে টাও আটকানো যায় আবার বড় কোনো সমস্যা ও যেন না হয়। ততক্ষণ ও যেন হ্যান্ডেল করে সবকিছু।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ দোস্ত, বাড়ির ভিতরে চল,দেখি ভিতরের পরিবেশ গরম নাকি ঠান্ডা ঠান্ডা!'(তূর্য)
পূর্ব মাথা দুলিয়ে সায় দেয়।ধীর শান্ত পায়ে হেঁটে গেটের ভিতরে ঢুকছে পূর্ব আর তার প্রতিটা পদক্ষেপে বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। একটু ভিতরে এসে দাড়িয়ে পড়লো পূর্ব,হ্যা মনে পড়েছে ওর। ঠিক এখানেই তার স্নিগ্ধার সাথে ধাক্কা টা লেগেছিল,প্রথম প্রেমের মাতাল হাওয়া তার গায়ে এখানেই লেগেছে।এক ক্ষণের দেখায় কি করে এতোটা মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে স্নিগ্ধা, এই মেয়েটা এতো মায়াবিনি কেন? পূর্ব কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তূর্য তাড়া দিল,,,

‘ কি ইয়ার, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবতে শুরু করলি তুই, তাড়াতাড়ি চ নাহলে বিয়েটা তো,,,,,'(তূর্য )
‘ না। আমি থাকতে বিয়েটা ওর অন্য কারো সাথে হবে না,চল।(পূর্ব)
তূর্য কে মাঝপথে থামিয়ে দিল পূর্ব,কন্ঠে ওর কোন এক অজানা আশঙ্কা কাজ করছে যেন। তূর্য খানিকটা অবাক হলেও মুখে কিছু বলল না, আপাতত এই বিষয় নিয়ে কথা বলার উপযুক্ত সময় নয় এটা। আগে বিয়েটা বন্ধ করতে হবে তারপর সমস্ত কৌতূহল মেটানো যাবে।

‘ বলো মা কবুল?’
কাজী সাহেব চাপ দিলেন কবুল বলার জন্য। কিছুক্ষণ আগেই মহিলা গুলো হইহুল্লোড় করে আমাকে রুম থেকে বের করে নিয়ে এসে বিয়ের আসরে এনে বসিয়েছে। পাশেই বর রূপী লোকটি মুখে রুমাল চেপে ধরে বসে আছে আর বর পক্ষের লোকজন সবাই হাসি তামাশা করছে আমাকে আর লোকটাকে নিয়ে। তাহমিমা আমার পাশেই ছিল,ও দাঁত কিড়মিড় করতে করতে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,,

‘ আই সয়ার, আপু তুই যদি একটা টু শব্দটি পর্যন্ত করেছিস তো?আর মাত্র কয়েক মিনিট অপেক্ষা কর আপু, তূর্য আর পূর্ব ভাইয়া চলে এসেছে আমাদের বাসায়। মুখে সুপার গ্লূ লাগিয়ে চুপ করে বসে থাক।'(তাহমিমা )
বিয়ের কনে কবুল বলছে না দেখে প্রায় সবাই আমাকে বলতে লাগলো, ‘ কবুল টা বলে ফেলো তাসনিয়া। আজ না হোক কাল তো বিয়ে করতেই হবে তাই এখন করলেই ক্ষতি কি?

বাবা মায়ের জন্য মন খারাপ করছে বুঝি, এতো চিন্তা করোনা দু’দিন পর পর এসে দেখে যাবে ওদের।’ আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম, কোনো আওয়াজ করলাম না মুখ দিয়ে। কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছে আমার,কি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমি।বাবাই নাকি বটগাছের ছায়া মেয়েদের জীবনে, কিন্তু আমার বটগাছের ছায়া তো আমার জীবনে গোখরো সাপের নিঃশ্বাস ফেলল। নিচের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম আমি। সহসা মা আমার সামনে এসে দাড়ালো। আমার মুখ টা একটান দিয়ে উপরের দিকে তুলে নিয়ে বললো,,,

‘ এতো নাটক করে কোন কাজ নেই তাসনিয়া, বিয়েটা তোকে করতেই হবে। এতোক্ষণ ধরে অনেক সহ্য করেছি তোর জ্বালা যন্ত্রণা আর না। চুপচাপ কবুল বল, নাহলে তোর কপালে অনেক খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে।’ (মা)
‘ মা,ক কি করছো তুমি?’

তাসনিয়া মা’কে বাধা দিতে গেলে মা হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিল ওকে। মায়ের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি খুব রেগে আছেন আমার মুখ খোলা নিয়ে। তাহমিমা ভয়ে বারবার ঢোক গিলতে লাগলো, তবে কি আপুর বিয়েটা হয়েই যাবে? তূর্য কি ঢপ দিলো তাকে, তবে যে বললো ও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর এখনই আসছে ভিতরে।আর কিছু ভাবতে পারলো না তাহমিমা,আপু কে দেওয়া কথাটা রাখতে পারলো না ও। নিজের ভুলের জন্য দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো ওখানে বসেই।

‘ কাজী সাহেব, আবার বিয়ে পড়ান।’
মা আমার মুখটা ছেড়ে দিয়ে কাজীকে হুকুম দিলো। কাজী সাহেব আবার বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন,সাক্ষী সহ বিয়ে পড়ানোর সবকটি বাক্য বলার পর আমাকে আবার কবুল বলতে বললেন। আমি মায়ের দিকে তাকালাম একবার, আমার দিকে মা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে আমি নিজের ভাগ্যের কাছে হার মেনে নিলাম,উপায় নেই আর।

‘ বলো মা কবুল, বেশি দেরি করো না মা।'(কাজী সাহেব)
কাঁপা কাঁপা গলায় কবুল বলবো এমন সময় একটা পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে এলো ভিড়ের মধ্য থেকে।
‘ স্নিগ্ধা কবুল বলবে না।’

উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেল এমন আকস্মিক ঘটনায়। ততক্ষণে পূর্ব আর তূর্য তাসনিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রাগে শরীর কাঁপছে পূর্বের, কোনো রকমে নিজের রাগ সামলে নিলো।মা খুব রেগে গিয়ে মুখ থেকে জাতীয় ভাষা বের করতে যাচ্ছিল সেই আগন্তুকের উদ্দেশ্যে কিন্তু পূর্ব আর তূর্য কে দেখে একেবারে চুপ হয়ে গেল। তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি যে ওরা এখানে আসতে পারে।

তাহমিমা ও অবাক হলো সাথে খুশি ও হলো খুব, তূর্য কথা রেখেছে তার আপুর বিয়েটা আটকাতে পারবে তাহলে ও।বড় মেয়ের বিয়ে হচ্ছিল এখানে সেটা ভুলে গিয়ে মা উনাদের সাথে ফর্মালিটিজ দেখাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন।কোথা থেকে দৌড়াদৌড়ি করে দুটো চেয়ার নিয়ে এলেন নিজেই ,,

‘ আরে জামাই বাবা যে,বসো বসো বাবা।তা বাবা তোমাদের বাড়ির সব খবর ভালো তো?’ (মা)
‘ আমরা এখানে বসতে আসিনি আন্টি। এসব কি হচ্ছে এখানে?'(বেশ রাগী গলায় বলল পূর্ব)
‘ ক কই কি হচ্ছে বাবা?'(মা)
‘ কার বিয়ে হচ্ছে এখানে শুনি? আমি তো কিছুই জানলাম না। যেখানে আমার বন্ধুর আর আপনার ছোট মেয়ে তাহমিমার বিয়ে হবে আর কিছুদিন পর সেখানে আবার বিয়ে হচ্ছে কার?’ (পূর্ব)
মা তাড়াতাড়ি করে বলে উঠলো,,

‘ আরে ওতো আমার বড় মেয়ে তাসনিয়ার বিয়ে হচ্ছিল বাবা।কি করবো বলো তোমরাই, মেয়েটা যেভাবে উড়ছে খোলা বাতাসে, আর বেশিদিন এভাবে রাখলে যদি মুখ পুড়িয়ে দেয় আমাদের তাহলে কি হবে তখন?তাই মান সম্মান রক্ষা করতে আগেই আপদ পার করছিলাম।'(মা)
মায়ের কথা শেষ হওয়া মাত্রই পূর্ব মায়ের দিকে রোষারক্ত নয়নে তাকালো।দু চোখ দিয়ে যেন আ’গু’ন ঝরছে তার। হাতের মুঠো শক্ত করে ধরলো,,,,

‘ শাট আপ।’
এর মধ্যেই উপস্থিত বর পক্ষের লোকজন বাবার সাথে ঝামেলা শুরু করলো। এখানে একটা বিয়ে হচ্ছে আর সেটা বাদ দিয়ে সার্কাস চলছে এখানে?খালা নানী ওরা পড়লো চাপের মুখে,মামা ওদের কে কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারছে না। একদিকে বড়লোক নাতজামাই আরেক দিকে এই আপদ বিদায় করার চেষ্টা,কি করবে বুঝতে না পেরে নানী মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল মাটিতে। পূর্বের ওদিকে খেয়াল নেই,রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে ও। কাজীর কাছে গিয়ে সোজা কাজীর পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে টেনে উঠালো বসা থেকে। বুড়ো কাজী সাহেব হঠাৎ এমন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না মোটেই, ভয়ে ভয়ে বললেন,,,

‘ আমি আমি কি করেছি, আপনি আমাকে মা’র’ছে’ন কেন?’
‘ চুপ, একদম চুপ। কি করেছেন হ্যা? একটা বিবাহিতা মেয়েকে আবার বিয়ে পড়াচ্ছিলেন আর বলছেন কি করেছেন?'(পূর্ব)
পূর্বের বলা এই কয়েকটি শব্দ শুনে আশপাশের পরিবেশ যেন থমকে দাঁড়াল। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে পূর্বের দিকে আর আমার দিকে।

আমি নিজেও কি শুনলাম জানি না, চমকে উঠে উনার দিকে তাকালাম, আমি বিবাহিতা মেয়ে? এসব কি বলছেন উনি। আমার যার সাথে বিয়ে হচ্ছিল সে এতক্ষন ধরে সবার কান্ড কারখানা দেখছিল কিন্তু পূর্বের কথা শুনে উঠে এলো ওর সামনে। দু’হাত বুকে ভাঁজ করে রেখে বলল,

‘ এই মাত্র কি বললেন আপনি? তাসনিয়া বিবাহিতা মেয়ে?তো ওকে বিয়ে করেছে টা কে শুনি,কে ওর স্বামী তাকে আমি ও একটু দেখি? যেহেতু ওর সাথে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছিল। বলুন কার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে?’

‘ আমার সাথে।এক মাস আগে ওর কোর্ট ম্যারেজ হয়েছে, বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করে দেখুন ওকে?'(পূর্ব)
তূর্যের হেঁচকি উঠতে শুরু করেছে পূর্বের কথা শুনে। পূর্ব যেকোনো মূল্যে বিয়েটা আটকাবে সেটা তূর্য জানতো কিন্তু এমন ডাহা মিথ্যা কথা ও বলতে পারে এটা ভাবেনি ও।

তাহমিমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো তূর্য, তাহমিমা ও রসগোল্লার মত চোখ করে তার না হওয়া দুলাভাই কে দেখছে। মনে মনে বললো,
‘জিও না হওয়া বর্তমান দুলাভাই, আপনার শালি হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি আমি।’ (তাহমিমা)

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৫

[ এখন থেকে একদিন পর পর গল্প পাবেন ইনশাআল্লাহ। আর হ্যা বড় পর্ব দিছি ?]

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ৭